সুলতান দারিয়া খাঁন লোহানীর পুত্র বাহার খাঁর অধীনে চাকরি নেন। এ সময়ে একবার সুলতান বাহার খাঁর
সঙ্গে শিকারে গিয়ে ফরিদ কারো সাহায্য ছাড়া একাই একটি বাঘ মেরেছিলেন বলে তাঁর সাহসিকতার জন্যে
সুলতান কর্তৃক ‘শের খাঁ' উপাধিতে ভ‚ষিত হন।
কিন্তু ভাগ্য বেশিদিন তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন রইল না। শত্রুদের প্ররোচনায় তিনি পুনরায় তাঁর পিতার জায়গীর
থেকে বিতাড়িত হন। এই সময় বাবুর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রি.) ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত
করলে শের খাঁ মুঘলদের শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে বাবুরের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। বাবুরের সহায়তায় তিনি
সাসারামের জায়গীর ফিরে পান (১৫২৮ খ্রি.)। এর কিছুদিন পর বিহারের সুলতান বাহার খাঁর মৃত্যু হলে
শের খাঁ বিহারের নাবালক শাসনকর্তা জালাল খাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন।
ধীরে ধীরে সৈন্যবাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিহারের প্রকৃত শাসনকর্তায় পরিণত হন। এই
সময় চুনার দুর্গের অধিপতি তাজ খাঁর মৃত্যু হলে তিনি তাঁর বিধবা পতœীকে বিবাহ করে চুনার দুর্গের
অধিপতি হন (১৫৩০ খ্রি.)। শের খাঁর এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাবৃদ্ধিতে আফগানগণ ঈর্ষানি¦ত হয়। সুলতান
জালাল খাঁ শের খাঁর অভিভাবকত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহের সাহায্যে
শের খাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করলে শের খাঁ ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরুজগড়ের যুদ্ধে বাংলা ও বিহারের সম্মিলিত
বাহিনীকে পরাজিত করে বিহারের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে কার্যত তিনি
বিহারের সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এই সময়ে তাঁর ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে আফগান অভিজাতবর্গ তাঁর
নেতৃত্বাধীনে সমবেত হন।
পাঠান-মুঘল সংঘর্ষ
সুরুজগড়ের যুদ্ধে জয়ী হয়ে শের খাঁ বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের
গুজরাট অভিযানের সুযোগে শের খাঁ গৌড়ের নিকট উপস্থিত হলে দুর্বল মাহমুদ শাহ তাঁর সঙ্গে সন্ধি
করেন। সন্ধির শর্তানুযায়ী তের লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ও শিউল হতে সক্রিগলী পর্যন্ত শের খাঁকে দিতে বাধ্য হলেন।
কিন্তু এতেও বাংলা আফগান আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল না। ১৫৩৭ খ্রি. বাংলা অধিকার করার জন্যে শের
খাঁ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অবরোধ করেন। এই সময় হুমায়ুন গুজরাট অধিকার সমাপ্ত করে
আগ্রায় সুখে কালাতিপাত করছিলেন। শের খাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে হুমায়ুন অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে
অগ্রসর হন। কিন্তু হুমায়ুন বাংলায় না গিয়ে শের খাঁর চুনার দুর্গ অবরোধ করেন (১৫৩৭ খ্রি.)। এই সুযোগে
শের খাঁ গৌড় এবং রোটাস দুর্গেও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুন বাংলায় গেলে শের খাঁ তাঁর সঙ্গে
প্রত্যক্ষ যুদ্ধে না গিয়ে বিহার, জৌনপুর, কনৌজ পুনরুদ্ধার করেন। শের খাঁর এরূপ কার্যকলাপে হুমায়ুন
চিন্তিত হন এবং তিনি আগ্রায় প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। ফেরার পথে বক্সারের নিকট চৌসায় ১৫৩৯ খ্রি.
হুমায়ুনের সঙ্গে শের খাঁর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হুমায়ুন সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে কোন রকমে প্রাণ নিয়ে
আগ্রায় প্রত্যাবর্তন করেন। শের খাঁর রাজ্য লাভের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হলো চৌসার যুদ্ধে
জয়লাভ। এই বিজয় দ্বারা শের খাঁ বাংলা, বিহার ও আসামের এক বিস্তৃত অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বিস্তার
করেন এবং ‘শেরশাহ' উপাধি গ্রহণ করে নিজনামে মুদ্রা অঙ্কিত করেন। পরের বৎসর ১৫৪০ খ্রি. হুমায়ুন
পুনরায় শেরশাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে পুনরায় চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। এই
যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে হুমায়ুন সিংহাসনচ্যুত হয়ে ১৫৪০Ñ১৫৫৫ খ্রি. পর্যন্ত পনর বৎসর দেশ থেকে
দেশান্তরে আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। অন্যদিকে শেরশাহ উত্তর ভারতের অবিসংবাদী
শাসকরূপে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
শেরশাহের রাজ্য বিস্তার
দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে শেরশাহ পাঞ্জাব অধিকার করেন। এই সময়ে (১৫৪১ খ্রি.) বাংলার শাসক
খিজির খাঁ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি পাঞ্জাব থেকে বাংলায় এসে খিজির খাঁকে বন্দি করেন। অতপর
তিনি বাংলায় নতুন এক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তে বেসামরিক শাসন কায়েম
করেন। শেরশাহ বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি সরকারের শাসনভার একজন আমীনের
ওপর অর্পণ করেন। বাংলার শাসকরূপে তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচরকে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি বাংলার
শাসনকর্তাকে ‘আমীন-ই-বাংলা' উপাধিতে ভ‚ষিত করেন।
অতপর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে রাজপুতনার দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৫৪২ খ্রি. তিনি মালব অধিকার
করেন। মালব থেকে আগ্রা প্রত্যাবর্তনের পথে রণথম্ভোর দুর্গ অধিকার করেন। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা হায়াৎ
খাঁ নিজামী পাঞ্জাবের মন্টোগোমারী জেলার বিদ্রোহী ফথ খান জাঠকে দমন করে পরে মুলতান অধিকার
করেন। ১৫৪৩ খ্রি. শেরশাহ সিন্ধুর ভাক্কার ও সেহওয়ান দুর্গ দু'টি অধিকার করেন। একই বৎসর চান্দেরী
ও রাইসিন দুর্গ অধিকার করেন। অতপর তিনি মাড়ওয়ারের মালদেবের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কূটকৌশলের
আশ্রয় গ্রহণ করে তিনি রাজপুত সেনাপতিদের পরাজিত করেন। ঐ বছরই তিনি যোধপুর অধিকার করেন।
১৫৪৪ খ্রি. মেবারের রাজধানী চিতোরের পতন ঘটে।
শেরশাহের সর্বশেষ অভিযান ছিল বুন্দেলখন্ডের কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ। আহমদ ইয়াদগারের বিবরণ থেকে
জানা যায়, সাম্রাজ্যহারা হুমায়ুনের সঙ্গে কালিঞ্জরের রাজা বন্ধুত্ব রেখেছিলেন। এই কারণে শেরশাহ ১৫৪৪
খ্রি. কালিঞ্জর দুর্গ অধিকারের জন্যে অভিযান করেন। দুর্গ অবরোধকালে একটি গোলা দুর্গের দরজায়
আঘাত পেয়ে প্রতিহত হয়ে শেরশাহকে আঘাত করে। এই গোলার আঘাতে শেরশাহ ১৫৪৫ খ্রি: ২২ মে
মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর সময় কাশ্মির, গুজরাট, আসাম ছাড়া সমগ্র উত্তর ভারত তাঁর সাম্রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর সাম্রাজ্য পশ্চিমে সিন্ধু থেকে উত্তর-পশ্চিমে গোক্কর দেশ, উত্তরে হিমালয় থেকে পূর্বে
আসাম এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
শেরশাহের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা
শেরশাহ মাত্র পাঁচ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যে সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার
সমন¦য়ে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও নব-প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের শান্তি রক্ষা ও সুশাসনের উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা
প্রবর্তন করে ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। শেরশাহ
আলাউদ্দিন খলজীর শাসনপদ্ধতির কিছু মূলনীতি অনুসরণ করেছিলেন। তবে অধিকাংশ ছিল তাঁর নিজস্ব
উদ্ভাবন।তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের হিন্দু-মুসলিম শাসন পদ্ধতির কিছু কিছু মৌলিক নীতি
গ্রহণপূর্বক স্বীয় প্রতিভার দ্বারা সেগুলোকে আধুনিক রূপদান করেছিলেন। বৃটিশ ঐতিহাসিক কিনি
শেরশাহের শাসন পদ্ধতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, কোন শাসকই এমনকি বৃটিশ সরকারও
শাসনকার্যে শেরশাহের ন্যায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করেননি।
মধ্যযুগে সর্বত্র শাসকের ক্ষমতা ছিল অবাধ। সে হিসেবে শেরশাহও অবশ্যই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী
ছিলেন। তবে তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন না। নিজ হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভ‚ত রেখেও প্রদেশে কর্মচারীদের
তত্ত¡াবধান করতেন। জনকল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে যে
কয়জন রাজা অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে প্রজার কল্যাণে কাজ করেছেন তাঁদের সাথে ষোড়শ শতকে
ভারতের শাসক শেরশাহের তুলনা করা চলে।
বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা
শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে বা অঞ্চলে ভাগ
করেছিলেন। আবার প্রত্যেক সরকারকে কয়েকটি পরগণায় ভাগ করেন। প্রত্যেকটি পরগণায় একজন করে
শিকদার, আমীন, মুনসীফ, খাজাঞ্চী বা কোষাধ্যক্ষ, দু'জন ‘কারকুন' (হিসাব লেখক, একজন হিন্দু ও
একজন মুসলিম) থাকতেন। পরগণার সামরিক অধিকর্তা হলেন শিকদার।কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশনির্দেশ কার্যকরী করা, প্রয়োজনের সময় আমীনকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা ছিল তাঁর কর্তব্য। আমীন
ছিলেন সর্বোচ্চ বেসামরিক কর্মকর্তা। পরগণার রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় করাই ছিল তাঁর কর্তব্য।
প্রত্যেকটি সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন শিকদার-ই-শিকদারান এবং মুন্সীফ-ই-মুনসীফান।
মুনসীফ-ই-মুনসীফান সাধারণত দিওয়ানী মামলার বিচার করতেন এবং শিকদার-ই-শিকদারান সরকারের
অভ্যন্তরে শান্তি-শৃ´খলা রক্ষা ও বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত থাকতেন। শেরশাহ ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত শাসন
ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং যাতে কোন রাজকর্মচারী স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পারে
সেজন্য প্রতি তিন বৎসর পর পর নিয়মিতভাবে তাদের বদলির ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজস্ব ব্যবস্থা
শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার অন্যতম উজ্জ্বল দিক ছিল তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার মূল
লক্ষ্য ছিল যাতে রাজকোষ বঞ্চিত না হয় এবং প্রজারাও অযথা উৎপীড়িত না হয়। পূর্বে রাজস্বের পরিমাণ
নির্ধারণের জন্যে জমি জরিপের কোন ব্যবস্থা ছিল না। শেরশাহ রাজস্বের হার নির্ধারণের জন্যে সাম্রাজ্যের
সমগ্র জমির নির্ভুল জরিপের ব্যবস্থা করেন। উর্বরতা অনুসারে জমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। গড়
উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ দেয় রাজস্বরূপে নির্ধারিত হয়েছিল। কর নির্ধারণের জন্যে তিন রকম ব্যবস্থা
প্রচলিত ছিল: (১) গাল্লা-বক্স বা বাতাই, (২) নস্ক বা মুকতাই বা কানকুট, (৩) নক্দি বা জাব্তি
জমাই। উৎপন্ন শস্যে অথবা নগদ অর্থে কর দেওয়া যেত। তিনি কর নির্ধারণে উদার নীতি গ্রহণ করলেও
আদায়ের ক্ষেত্রে কোন ঔদার্যের পক্ষপাতি ছিলেন না। রাজস্ব আদায়ের জন্যে মুকাদ্দম, চৌধুরী, পাটোয়ারী
প্রভৃতি কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজস্ব আদায়কালে যেন অহেতুক অত্যাচার, উৎপীড়ন করা না হয়
সে ব্যাপারে উক্ত রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের সতর্ক করে দেয়া হতো। শেরশাহ জমির ওপর প্রজাদের
অধিকার নির্ধারণের জন্যে ‘কবুলিয়ত' এবং ‘পাট্টা' প্রথার প্রবর্তন করেন। সম্রাটের কি প্রাপ্য তা স্বীকার করে
প্রজাকে দিতে হতো লিখিত ‘কবুলিয়ত'। আর জমিতে প্রজার অধিকার স্বীকার করে প্রজাকে সম্রাট দিতেন
‘পাট্টা'। সম্রাট ও প্রজার পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সুরক্ষার জন্যে ‘কবুলিয়ত' ও ‘পাট্টা' নামক দু'টি
দলিল আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করে শেরশাহ প্রকৃতই আধুনিক রাজস্ব ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন।
শুল্ক ও মুদ্রানীতি
ভ‚মি রাজস্ব সংস্কারের পরই মুদ্রা ও শুল্ক সংস্কার শেরশাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতির জন্যে তিনি আন্ত:প্রাদেশিক শুল্ক আদায়ের রীতি তুলে দিয়ে কেবলমাত্র সীমান্তে অথবা
বিক্রয়ের স্থলে উক্ত শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের যথেষ্ট সুবিধা হয়। এরফলে
যেখানে সেখানে সমগ্র দেশব্যাপী ব্যবসায়ীদের ওপর শুল্ক আদায়ের জুলুম বন্ধ হয়ে যায়।
শেরশাহ মুদ্রা ব্যবস্থারও সংস্কার সাধন করেন। তিনি তাঁর মুদ্রার উপাদানে নির্ভেজাল, ওজনে সঠিক ও
গঠনরীতিতে মনোরম ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রভুত গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি চতুষ্কোণ ও গোলাকার
দু'ধরনের মুদ্রা চালু করেন। তিনি সোনা, রূপা ও তামার পৃথক মুদ্রা চালু করেন। তামার মুদ্রাকে বলা হতো
দাম। এছাড়া আনি, দু'আনি, সিকি, আধুলি স্তরের মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন। এসঙ্গে মুদ্রার নকসার উন্নতি
সাধন করেন। তাঁর এই মুদ্রানীতির সংস্কারের ফলে সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে লেনদেনের
অসুবিধা দূর হয়। তাঁর মুদ্রা পদ্ধতি মুঘল ও কোম্পানি আমলেও বজায় ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল ব্রিটিশ
মুদ্রার ভিত্তি।
শেরশাহের বিচার ব্যবস্থা
শেরশাহের বিচার ব্যবস্থা তাঁর উন্নত শাসন পদ্ধতির আর একটি উজ্জ্বল দিক। তিনি বিচার ব্যবস্থায়
নিরপেক্ষতার নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। বংশ কৌলিন্য ও সামাজিক মর্যাদার কোন গুরুত্বই বিচার ব্যবস্থায়
দেয়া হতো না। অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হতো। এক্ষেত্রে শেরশাহের নিকটাত্মীয় হলেও
রেহাই পেতেন না। প্রতি পরগণার দিওয়ানি বিচার কার্য পরিচালনা করতেন একজন আমিন। ফৌজদারী
বিচারের ভার ছিল কাজী ও মীর আদলের ওপর। কয়েকটি পরগণার ওপর একজন করে মুনসীফ-ইমুনসীফান দেওয়ানি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন এবং কাজী-উল-কুজ্জাত বা প্রধান কাজী ছিলেন ফৌজদারী
বিচারের ভারপ্রাপ্ত। বিচার ব্যবস্থায় স্বয়ং সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। শেরশাহের দন্ডবিধি ছিল
অত্যন্ত কঠোর। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে কঠোর দন্ড ভোগ করতে হতো। এমনকি চুরি ডাকাতির
অপরাধে প্রাণদন্ড দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এরূপ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যাতে অপরাধ
প্রবণতা কমে যায়। বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর সম্রাট সদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। কর্তব্যে
অবহেলার জন্যে তাদের শাস্তি ভোগ করতে হতো।
সামরিক ব্যবস্থা
শেরশাহের সামরিক পদ্ধতি আলাউদ্দিন খলজীর সামরিক সংগঠনের অনুকরণে গঠিত ছিল। সাম্রাজ্যের
বিভিন্ন স্থানে সেনানিবাস স্থাপন করে সৈন্য মোতায়েন রাখার রীতি শেরশাহ গ্রহণ করেছিলেন। দিল্লি ও
রোটাসের সেনানিবাস ছিল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সেনানিবাস। সেনানিবাসে সামরিক
ফৌজদারের অধীন ‘ফৌজ' অবস্থান করতো। সৈন্যবাহিনী প্রধানত তাঁর অধীনেই থাকতো। তাঁর নিজস্ব
সৈন্যের মধ্যে দেড় লক্ষ অশ্বারোহী, পঁচিশ হাজার পদাতিক এবং পাঁচ হাজার হাতি ও গোলন্দাজ ছিল। তাঁর
সেনাবাহিনীর বেতন কোন সামরিক অফিসারের মাধ্যমে না দিয়ে প্রতিটি সৈনিককে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত
হয়ে নিতে হতো। সিপাহিদের বেতন নির্দিষ্ট ছিল। শেরশাহ তাঁর সেনাবাহিনীতে দু'টি বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তন
করেছিলেনÑ (১) দাগ বা অশ্ব চিহ্নিতকরণ, (২) চেরা বা সৈন্যদের বিবরণমূলক তালিকা রাখা। সামরিক
বিভাগে কঠোর শৃ´খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হতো। যুদ্ধের সময় অথবা
সেনাবাহিনীর যাতায়তের ফলে কৃষকদের ফসলের কোন ক্ষতি সাধিত হলে শেরশাহ সেই ক্ষতি পূরণ করে
দিতেন।
পুলিশী ব্যবস্থা ও গুপ্তচর প্রথা
অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃ´খলা রক্ষার জন্যে শেরশাহ পুলিশী ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি সাধন করেন। দেশের
নিরাপত্তার জন্যে তিনি আঞ্চলিক শাসকদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। গ্রামের প্রধান নিজ এলাকার
অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে বাধ্য ছিলেন। শেরশাহের পুলিশী ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন,
“শেরশাহের পুলিশী ব্যবস্থা সনাতনী হলেও উন্নত ধরনের ও শক্তিশালী ছিল।” সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের
সংবাদ সংগ্রহের জন্যে শেরশাহ গুপ্তচর প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানতে পারতেন। এসব ব্যবস্থার ফলে সাম্রাজ্যে
শান্তি অক্ষুন্ন ছিল এবং অপরাধ কমে গিয়েছিল।সমসাময়িক ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন মন্তব্য করেন,
“রাস্তাঘাটে কেউ যদি সোনার থলি নিয়েও ঘুমিয়ে পড়ত, তাতে চুরি যাওয়ার কোন ভয় ছিল না।”
জনহিতকর কার্যাবলি
সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্যে শেরশাহ বহু সুন্দর ও সুদীর্ঘ রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন।
এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সোনারগাঁ থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লি এবং পাঞ্জাব হয়ে সিন্ধু পর্যন্ত রাজপথটি। এটি
গ্র্যান্ড রোড নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টি ছিল আগ্রা, যোধপুর এবং চিতোর পর্যন্ত। তৃতীয়টি ছিল আগ্রা থেকে
বরহানপুর এবং চতুর্থটি ছিল লাহোর থেকে মুলতান পর্যন্ত। প্রাচীন ভারতবর্ষের আদর্শ অনুযায়ী পথের
দুধারে তিনি বৃক্ষ রোপন ও সরাইখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রায় ১৭০০টি সরাইখানা নির্মাণ
করেছিলেন। এই সরাইখানাগুলো ডাক-চৌকির কাজ করতো। অর্থাৎ এগুলো চিঠিপত্র আদান প্রদানের
কেন্দ্র ছিল এবং আঞ্চলিক থানার কাজ করতো। এই দপ্তরগুলো যাদের হাতে ছিল তাদের দারোগা-ইডাকচৌকি বলা হতো। সরাইখানাগুলো পথিকের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সরাইখানাগুলোতে
হিন্দু-মুসলমানদের থাকার পৃথক বন্দোবস্ত ছিল। এসব সরাইখানার ব্যয় সরকার প্রদত্ত জমির আয় থেকে
নির্বাহ করা হতো।
ধর্মীয় নীতি
ধর্মের ব্যাপারে শেরশাহ যুগধর্মকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজে নিষ্ঠাবান মুসলমান হলেও
প্রজাদের ধর্মের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সহিষ্ণু। নিজের ব্যক্তিগত ধর্মকে কখনও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রয়োগ
করার চেষ্টা করেননি। জৌনপুরে শিক্ষা গ্রহণ এবং হানাফী মতবাদে বিশ্বাসী শেরশাহ ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদার
মানসিকতার পরিচয় দেন। দূরদর্শী রাজনীতিকের মতো সমস্ত প্রজাকে তিনি সমান দৃষ্টিতে দেখতেন।
রাষ্ট্রীয় কার্যে হিন্দু ও মুসলমানকে তিনি কখনও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেননি। প্রজাদের ভাগ করেছিলেন
যোগ্যতা ও অযোগ্যতার ভিত্তিতে। তিনি প্রজাদের যোগ্যতার মানদন্ডে বিচার করে রাষ্ট্রীয় কার্যে নিয়োগ
দিতেন। ব্রহ্মজিৎ গৌড় নামক জনৈক হিন্দুকে তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান
করেছিলেন। অবশ্য হিন্দুদের ‘জিজিয়া কর' তিনি রহিত করেননি। তবে ‘জিজিয়া কর' ধর্মীয় কর হিসেবে
আদায় করতেন না। আকবরের মতো মনের বিশালতা সম্ভবত তাঁর ছিল না, অথবা হয়তো জীবনের
অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে বৈশিষ্ট্য অর্জনের সময় ও সুযোগ তিনি পাননি।
শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব
শেরশাহের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, অসামান্য সমরকুশলী, সুদক্ষ এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন
শাসক ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে খুবই বিরল। সাসারামের এক জায়গীরদারের অবহেলিত পুত্র হিসেবে
জীবন আরম্ভ করেন এবং মুঘলদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
নেপোলিয়নের মতো সামান্য সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত হন এবং
এক নতুন সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেন। নেপোলিয়নের মতোই সেই সাম্রাজ্যের সংস্কার সাধন করে জনসাধারণের
কৃতজ্ঞভাজন হয়েছিলেন। ‘জিজিয়া কর' প্রত্যাহার না করা, রাইসিন দুর্গ দখলের সময় ও রাজপুতদের
বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় জেহাদ ঘোষণা করাকে অনেকে তাঁর ধর্মান্ধতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে
চেয়েছেন। কিন্তু মধ্যযুগের বাতাবরণে বিচার করলে এমন বুদ্ধিমান, তেজস্বী, পরিশ্রমী এবং দূরদৃষ্টি ও
শাসন সংস্কার করার প্রতিভাসম্পন্ন এই নৃপতির গুণাবলি এতো মহান যে, সামান্য দোষও তাতে চাপা পড়ে
যায়। মুসলিম রাজত্বকালে আলাউদ্দিন খলজী, মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং আকবরের মধ্যবর্তী সময়ে
ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে একমাত্র শেরশাহই ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল তারকা।
শেরশাহ ছিলেন মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে অন্যতম একজন সুদক্ষ প্রশাসক। নরপতির কর্তব্য সম্পর্কে
তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন। রাষ্ট্র ও প্রজার কল্যাণই শাসকদের কর্তব্য, তা তিনি বিস্মৃত হননি। শেরশাহের
সাম্রাজ্য ছিল জনসাধারণের কল্যাণ করার ইচ্ছার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই আরস্কিন শেরশাহকে
‘জনসাধারণের অভিভাবক' হিসেবে দেখেছেন। শেরশাহ আলাউদ্দিন খলজী ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মতো
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসনের পক্ষপাতী ছিলেন। শাসনকার্যে দুর্নীতি ও অবিচার তিনি মোটেই সহ্য করতে
পারতেন না। অপরাধী কর্মচারীকে তিনি কঠোর শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। কৃষকের স্বার্থ রক্ষায়
তিনি বিশেষ যতœবান ছিলেন। কেউ শস্যহানি করলে তিনি কঠোর শাস্তি দিতেন। দরিদ্র ও অনাথদের জন্যে
তাঁর সহানুভ‚তির অন্ত ছিল না। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে তিনি রাইসিন ও রোটাস দুর্গ অধিকারের সময়
ক‚টকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি স্বভাবনিষ্ঠুর ছিলেন না। দয়া ও কোমলতা ছিল তাঁর
চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
সৈনিক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি শুধু একজন যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন
একজন সুচতুর সামরিক পরিকল্পনাকারী। যেরূপ চাতুর্যের সঙ্গে হুমায়ুনকে মোকাবিলা করেছিলেন, তা তাঁর
উচ্চস্তরের কূটনীতি হিসেবে বিবেচিত। হুমায়ুনের ভুলগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি চূড়ান্তভাবে সফল হন।
আফগান জাতি যখন ছত্রভঙ্গ তখন তিনি তাদের সমবেত করে এক রাষ্ট্রীয় ঐক্যের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম
হয়েছিলেন। আফগান জাতীয়তাবোধের তিনিই স্রষ্টা।
শেরশাহ জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্যে শিল্প-বাণিজ্যে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। এজন্যে
তিনি আন্ত:প্রাদেশিক শুল্ক বাতিল করে এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ করে আধুনিক অর্থনৈতিক জ্ঞানের পরিচয়
দেন। ঘোড়ার পিঠে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা, পুলিশী ব্যবস্থার সংগঠন, সামরিক বাহিনীর উন্নতি বিধান,
বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করে শেরশাহ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
যদিও তিনি সুশিক্ষিত এবং আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, তথাপি তিনি নিজেকে
একজন বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
কিন্তু তাঁর রাজদরবারে দিল্লির সুলতানি আমলের রাজদরবারের মতো কোন পন্ডিতই কোন বিষয়ে তেমন
গুরুত্বপূর্ণ রচনার স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেননি। অবশ্য এই দৈন্যতা তিনি পূরণ করেছিলেন তাঁর অনবদ্য
স্থাপত্য শিল্পের মাধ্যমে। শেরশাহ তাঁর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ স্বল্প সময়ের শাসনকালেও স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ
নিদর্শন রেখে গেছেন। দিল্লিতে নির্মিত তাঁর ‘পুরান-কিল্লা' ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন¦য়ের এক
অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন। এছাড়া তাঁর স্থাপত্য শিল্পের অন্য একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সাসারামে তাঁর নিজের
জন্য তৈরি সমাধিভবন। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন¦য়ের এই নিদর্শনটিকে কানিংহাম শিল্প-সুষমার ক্ষেত্রে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। পার্শী ব্রাউনও শেরশাহের স্থাপত্য শিল্পের উচ্ছ¦সিত প্রশংসা করেছেন।
শেরশাহ ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসক। স্বয়ং ধর্মপরায়ণ মুসলমান হয়েও তিনি শাসনকার্যে কোনরূপ
ধর্মান্ধতা প্রদর্শন করেননি। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সৌহার্দ ও সম্প্রীতিই ছিল তাঁর ধর্মনীতির অন্যতম
বৈশিষ্ট্য।
এভাবে সমস্ত দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রজাদের প্রতি দাক্ষিণ্য, কৃষকদের প্রতি যতœ, উদার
দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যায়বিচার, কঠোর পরিশ্রম, নিজের সুখ ও বিশ্রাম বিসর্জন দিয়ে কর্তব্য পরায়ণতা এবং সর্বোপরি
রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিভা প্রভৃতি গুণাবলির জন্যে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে মহান আকবরের পরই
শেরশাহ এক গৌরবময় আসন অধিকার করে আছেন। এজন্য আধুনিক ঐতিহাসিকগণ আফগান জাতির
শ্রেষ্ঠ প্রতিভা শেরশাহের সঙ্গে মুঘল সম্রাট আকবরের সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাই ঐতিহাসিক
ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “ইতিহাসে শেরশাহ একটি উচ্চ স্থান লাভের যোগ্য। রাজনৈতিক সংস্কার এবং ধর্মীয়
সহিষ্ণুতা নীতির প্রবর্তন দ্বারা তিনি অজ্ঞাতসারে আকবরের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন”
সারসংক্ষেপ
সাসারামের একজন্য সামান্য জায়গীরদার থেকে শেরশাহ দিল্লির বাদশাহ হন। তিনি তাঁর সামরিক
দক্ষতা ও রণকৌশলের মাধ্যমে প্রথমে বিহার পরে বাংলা অধিকার করেন। পরবর্তীকালে কনৌজ বা
বিলগ্রামের যুদ্ধে (১৫৪০ খ্রি.) হুমায়ুনকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
করেন। দিল্লির সিংহাসনে শূর-আফগান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। অতপর তিনি রনথম্ভোর, মালব, কালিঞ্জর
প্রভৃতি অধিকার করে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। এবং শাসনকার্যে মনোনিবেশ করে সাম্রাজ্যের প্রভুত
উন্নতি সাধন করেন। তাঁর শাসনকালের অন্যতম অবদান ছিল সাম্রাজ্যকে শাসনের সুবিধার জন্যে
সরকার ও পরগনায় বিভক্তি, রাজস্ব সংস্কার, শুল্ক ও মুদ্রানীতির সংস্কার, সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন,
সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন ইত্যাদি।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। শেরশাহের বাল্যনাম কি ছিল?
(ক) সেলিম (খ) ফরিদ
(গ) হাসান (ঘ) ফরিদুল।
২। শেরশাহ বিহারের কোন নাবালক শাসকের অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন?
(ক) জালাল খাঁর (খ) জামাল খাঁর
(গ) দারিয়া খাঁর (ঘ) বাহার খাঁর।
৩। বাংলার শাসক মাহমুদ শাহ শের খাঁকে সন্ধির শর্তানুসারে কত স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলেন?
(ক) পাঁচ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (খ) বার লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা
(গ) তের লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (ঘ) পনর লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা।
৪। কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথার প্রবর্তন কে করেছিলেন?
(ক) বাবুর (খ) হুমায়ুন
(গ) শেরশাহ (ঘ) আকবর।
৫। শেরশাহ তাঁর সমগ্র সাম্রাজ্যকে কয়টি সরকারে বিভক্ত করেছিলেন?
(ক) ৫৭টি (খ) ৪৭টি
(গ) ৬৭টি (ঘ) ২৭টি।
৬। পরগণার দিওয়ানি বিচার কে পরিচালনা করতেন?
(ক) আমীন (খ) মীর আদল
(গ) মুনসীফ-ই-মুনসীফান (ঘ) কাজী-উল-কুজ্জাত।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। শেরশাহ বাংলা অধিকারের পর যে নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন তার একটি বিবরণ দিন।
২। শেরশাহের বেসামরিক শাসনব্যবস্থার বিবরণ দিন।
৩। শেরশাহের জনহিতকর কার্যাবলী ও ধর্মনীতি বর্ণনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। সাসারামের জায়গীরদার থেকে কিভাবে শেরশাহ দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তার একটি বিবরণ
লিপিবদ্ধ করুন।
২। শেরশাহের শাসন সংস্কারের বর্ণনা দিন।
৩। শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত