সিরিয়া ও লেবানন ( Syria and Lebanon ) ফরাসি ম্যান্ডেট শাসনাধীনে সিরিয়া ও লেবানন

সিরিয়া ও লেবানন মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। দুটি দেশের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিম্নে দেশ দুটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হল :
সিরিয়া : সিরিয়া দেশটি আরব প্রজাতন্ত্র নামে বর্তমানে পরিচিত। মানব জাতির নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অগ্রগতি এবং বিশ্ব সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের মত দুটি একেশ্বরবাদী ধর্মের উৎপত্তি এ অঞ্চলে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থানগুলির অবস্থানের কারণে ধর্মবিশ্বাসীদের কাছেও এ অঞ্চলের একটি আলাদা মূল্য রয়েছে। উমাইয়া আমলে ইসলামি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, ঐতিহ্যবাহী ফনেশিয় জাতির বসবাস ছিল এ সিরিয়াতেই। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, প্রাচীন মানব সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল সিরিয়া। সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে। সে বিবেচনায় সিরিয়াকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার মর্যাদা দেয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দ পর্যন্ত সুমেরিয়, আক্কাদিয়, আমোরাইট, মিশরিয়, হিটাইট, আশিরিয় ও ব্যাবিলনিয়দের শাসনাধীনে ছিল সিরিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস সিরিয়াকে আকামিনিয়ান সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে সম্রাট আলেকজান্ডার সিরিয়া দখল করেন। এবং তার উত্তরসূরি খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৪ অব্দ পর্যন্ত সিরিয়া শাসন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দ পর্যন্ত সিরিয়া রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ এবং ৩০০-৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিরিয়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে শাসিত হয়। ৬৩৪ সালে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে আরবরা সিরিয়া দখল করে নেয়। ১৫১৬ সালে তুর্কি শাসনে আসার পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া আরব মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলি লিভান্ট নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও জর্দান বৃহত্তর সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল । এছাড়াও বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত এন্টিওক এবং আলেকজান্দ্রেত্তা বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ ছিল। তাই ১৯১৮ সালের পূর্বেকার সিরিয়া বলতে আমরা বৃহত্তর সিরিয়াকেই বুঝব যা ওসমানিয় শাসনামলে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিরিয়ায় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধের পর এখানে ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন চালু হয়। উল্লেখ্য যে, সিরিয়া ১৭ এপ্রিল ১৯৪৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ২১ জানুয়ারি সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র নামকরণ করে। ১৩ অক্টোবর · ১৯৬১ সালে সিরিয়া আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৭ সালে ৬ দিন ব্যাপী ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করে বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে সিরিয়া। সিরিয়া “সভ্যতার সূতিকাগার” ভৌগলিক উপাধিতে পরিচিত ।
লেবানন পরিচিতি
বিশ্ব ইতিহাসে লেবানন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। ২২ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে লেবানন ফ্রান্সের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সংবিধান অনুযায়ী দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন একজন ম্যারোনাইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন সুন্নী মুসলিম এবং আইন সভার স্পিকার হবেন একজন শিয়া মুসলিম । ইসরাইল লেবাননে বহুবার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। যেমন- অপারেশন লিথানি, অপারেশন পিস ফর গ্যালিলি, অপারেশন অ্যাকাউন্টেবিলিটি, অপারেশন গ্রাস অব র‍্যাথ ও অপারেশন জাস্ট রিওয়ার্ড ইত্যাদি ।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, লেবানন তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির পর সিরিয়ার মান আসাফ এবং বানু সাইফা অঞ্চলসমূহ সামন্তপ্রভুদের দ্বারা শাসিত হত। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে লেবাননে ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান হিসেবে অঞ্চলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। দ্রুজ, খ্রিস্টান, ম্যারিয়নাইট ছাড়াও মুসলিম অধ্যুষিত লেবানন তুর্কি আমলে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ছিল। দামেস্কের তুর্কি গভর্ণর লেবাননের সামন্ত প্রভু এবং তুর্কি সুলতানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। মানি সম্প্রদায়ের নেতা ফখরুদ্দিন লেবাননে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তুর্কিেেদর সাথে লেবাননিদের প্রায়ই সংঘর্ষ বাধত। ১৮৫৬ সালে দ্বিতীয় ফখরুদ্দিন ক্ষমতা লাভ করে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসনের প্রয়াস পান। তিনি ত্রিপলি, বালাবেক, বৈরুত ও সিডন দখল করেন। তিনি একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠন করেন। তিনি ইউরোপীয় শক্তি বর্গের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে তুর্কি সরকার তাকে বিতাড়িত করে। এবং দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসনে থাকার পর তিনি লেবাননে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বীয় ক্ষমতা ও দক্ষতার বলে তিনি আলেপ্পো থেকে মিশরিয় সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চলে একজন আরব শাসকের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। কিন্তু ১৫৩৬ সালে তুর্কি সুলতানের নির্দেশে দামেস্ক থেকে তুর্কি বাহিনী লেবাননে প্রবেশ করে দ্বিতীয় ফখরুদ্দিনকে আটক করে কন্সটান্টিনোপালে প্রেরণ করেন। সেখানে ফখরুদ্দিন ও তার পুত্র সন্তানের শিরঃশ্চেদ করে হত্যা করা হয়। ফখরুদ্দিনের মৃত্যুর পর মান পরিবার ক্ষমতাচ্যুত হয়।
মান বংশের অধঃপতনে লেবাননে শিহাবি খ্রিস্টানের আবির্ভাব ঘটে। তারা কুরাইশি বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। ১৬৩৫ সালে দ্বিতীয় ফখরুদ্দিনের মৃত্যু হলে লেবাননে রাজনৈতিক অরাজকতা শুরু হয় এবং তা ১৫০ বছর স্থায়ী হয়। ১৭৭৮ সালে দ্বিতীয় বশির আল শিহাবি লেবাননের গভর্ণর হিসেবে নির্বাচিত হন। তার পূর্বে লেবাননের গভর্নর ছিলেন ইউসুফ । প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার অধিপতি আহমদ আল জাজ্জাবের নির্দেশে ইউসুফকে একরে শহরে হত্যা করা হয়। কিন্তু ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন যখন মিশর আক্রমণ করেন তখন আমির বশির আহমদ আল জাজ্জারের সাহায্যে সৈন্য পাঠান নি। এ কারণে আহম্মদ আল-জাজ্জারের সাথে আমির বশিরের বিরোধ বাধে। উপরন্তু ইউসুফের সন্তানেরা আমির বশিরের বিরোধীতা করে। এজন্য লেবানন থেকে আমির বশির মিশরে পালিয়ে যান এবং ব্রিটিশদের সাহায্য প্রার্থনা করেন । ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ার অধিপতি আল জাজ্জারের মৃত্যুর পর আমির বশির লেবাননে ফিরে আসেন। এবং ইউসুফের সন্তানদের ক্ষমতানির্মূল করেন। তিনি তুর্কি সুলতানের বন্ধুত্ব কামনা করে ১৫,০০০ লেবাননি সৈন্য তার সাহায্যে পাঠান। এসব সৈন্যরা ওহাবি যোদ্ধাদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় । আমির বশির সিরিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন । তিনি দামেস্ক ও ত্রিপলীর গভর্ণরদের (ওয়ালি) মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ মেটানো, সিরিয়ার আল- সিরিয়া অঞ্চল লেবাননের অন্তর্ভুক্তি এবং সিরিয় রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের ফলে তুর্কি সুলতান আমির বশিরের ওপর অসন্তুষ্ট হন। এর ফলে ১৮২১ সালে বশির দ্বিতীয়বারের মতো মিশরে আত্মগোপন করেন। মিশরের শাসক (খেদিভ) মুহম্মদ আলী পাশার সাহচর্য লাভ করেন ।
মুহম্মদ আলী পাশার মৃত্যু হলে তার পুত্র ইব্রাহিম পাশা মিশরের খেদিভ হলে আমির বশির পুনরায় লেবাননে ফিরে যান। তিনি ১৮৩১ সালে ইব্রাহিমের সিরিয়া অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন এবং একরে দখলের সময় লেবাননি সৈন্য দল দিয়ে সাহায্য করেন। ইব্রাহিম পাশা দামেস্ক এবং হিমস দখল করে তুরুস্ক পর্বতমালার কাছে সেনাবাহিনী নিয়ে শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সমর্থন লাভ করে তুর্কি সুলতান তার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ইব্রাহিম পাশা তার বাহিনী নিয়ে মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন। ইব্রাহিম পাশার শাসনামলে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বৈষম্য দূর হয়। সিরিয়ার গভর্নরগণ পক্ষপাতিত্বের নীতি অবলম্বন করেন। লেবানন ও ফিলিস্তিন কৃষকদের ওপর ৩ গুণ কর বৃদ্ধি করা হলে তারা ১৮৬৪ সালে বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহ সারা সিরিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ১৯৪০ সালে কৃষক বিদ্রোহ লেবাননে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে তুরস্কের সুলতান মাহমুদ সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু নিছির নামক এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে মিশরিয় বাহিনীর নিকট তুর্কি বাহিনী পরাজিত হয়। এর ফলে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ বিশেষ করে তুরস্কের মিত্র ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় শান্তিপূর্ণভাবে ইব্রাহিম পাশা সিরিয়া ত্যাগ করে মিশরে চলে যান। ১৯৪০ সালের নভেম্বরে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ইব্রাহিম পাশা মিশরে প্রত্যাবর্তন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। তিনি ৯ বছর সিরিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করলেও সেখানে আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন। এর ফলে সিরিয়ায় তুর্কি রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে এবং লেবাননকে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। ১৮৪২ সালে এ প্রশাসনিক সংস্কার করে এক অংশ ড্রজদের অধীন এবং অপর অংশ ম্যারোনাইট গভর্নরের অধীনে দেওয়া হয় । এর ফলে লেবাননে তীব্র রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইংরেজ প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
ইব্রাহিম পাশা সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী মিশরে প্রত্যাহার করলে লেবাননের গভর্ণর দ্বিতীয় আমির বশিরকে ১৯৪০ সালে মাল্টায় নির্বাসতি করা হয়। সেখান থেকে তাকে তুর্কি রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয় বশির ১৮৫০ সালে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় বশির লেবাননে কৃতিত্বের সাথে শাসন করেন। তার সময় লেবানন একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয় । অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পূর্ণ মর্যাদা এবং রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়। তার সময়ে লেবাননে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। শিহাবী শাসকদের আমলে ডুজদের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় এবং ম্যারোনাইট কৃষকরা দক্ষিণ থেকে উত্তরে যেতে শুরু করে। এরপর ১৮৬১ সালে ওসমানিয় সুলতান মাউন্ট লেবাননকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৫) লেবাননের এ স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে সরাসরি তুর্কি শাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৯২০ সালের ৩০ আগস্ট সিরিয়া লেবাননের হাইকমিশনার জেনারেল গুরোর এক আদেশ বলে বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠন করে ফরাসি কর্তৃপক্ষ । বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত অঞ্চলসমূহ নিয়েই গঠিত হয় বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র ।
ফরাসি ম্যান্ডেট শাসনাধীনে সিরিয়া ও লেবানন
সিরিয়া ও লেবাননে ম্যান্ডেটরি শাসন মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিরিয়া ও লেবাননের ম্যান্ডেটরি শাসন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
সিরিয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটারি শাসন : প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সিরিয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন কায়েম হয়। উল্লেখ্য যে, সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ফরাসি ম্যাটেরি শাসনকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে সম্পাদিত সাইকস-পিকো চুক্তির সফল বাস্তবায়ন বলা যায়। অন্য কোন বৃহৎশক্তির পরিবর্তে ফ্রান্সকে এ অঞ্চলের ম্যান্ডেটরি শাসন ক্ষমতা প্রদান করার পিছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান ছিল। রোমান শাসনামল থেকেই দক্ষিণ ফ্রান্সের সাথে সিরিয়ার যোগাযোগ ছিল । ক্রসেডে নেতৃত্ব দানকারী দেশগুলির মধ্যেও ফ্রান্স ছিল অন্যতম। ১৫৩৫ সালে ফরাসি সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস তুরস্কের সুলতান প্রথম সুলায়মানের নিকট হতে Capitulation লাভ করেন। পরবর্তীকালে ৪র্থ হেনরী, রিশেলু, এবং চতুর্থশ লুই এর সময়ও এ সুযোগ সুধিবা বহাল থাকে। মার্কেন্টাইলিজমের যুগে চতুর্থশ লুই এর অর্থমন্ত্রী কোলবার্ট তুরস্কে ফরাসি বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেন। ১৭৪০ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্সের পূর্বতন Capitulation নবায়ন লাভ করে। চুক্তিতে পূর্বতন বিশেষ সুযোগ - সুবিধাগুলি ছাড়াও ফ্রান্স সিরিয়ায় খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থানগুলির উপর বিশেষ অধিকার লাভ করে এবং ল্যাটিন খ্রিস্টানদের রক্ষাকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবেই সিরিয়ায় ফরাসি আধিপত্যের সূচনা হয়। ১৮০২ সালে নেপোলিয়ন কর্তৃক তুরস্কের সুলতানের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতেও Capitulation সুবিধাগুলি বজায় রাখা হয়। এ সময়ে সিরিয়ায় ফরাসি প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মত। মিশরের শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা, যিনি ১৮৩০ এর দশকে সিরিয়া দখল করে নিয়েছিলেন। তার প্রতি ফ্রান্সের সহানুভূতি ছিল । সিরিয়ায় খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিশেষত লেনাবনের ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের সাথে ফ্রান্সের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বৃহত্তর সিরিয়ার বৈরুতে স্থাপিত জেসুইট ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে ফরাসি সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে বৃহত্তর সিরিয়ায় ৮০টি ফরাসি স্কুলে প্রায় ৪০,০০০ ছাত্র অধ্যয়নরত ছিল। এবং এ বাবদ ফরাসি সরকারের বার্ষিক ব্যয় ছিল প্রায় এক মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক। ফরাসি ভাষা শিক্ষিত শ্রেণীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ভাষায় পরিণত হয় এবং অনেক সিরিয় লেবানিজ খ্রিস্টান আরবির বদলে ফ্রেঞ্চকে কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন। উচ্চ শিক্ষার্থে সিরিয়ার শিক্ষার্থীদের নিকট কায়রোর পরেই পছন্দনীয় স্থান ছিল ফ্রান্স। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও সিরিয়ায় ফ্রান্সের বিশেষ স্বার্থ জড়িত ছিল। ওসমানিয় সাম্রাজ্যে ফরাসি ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের মোটা অংকের বিনিয়োগ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ওসমানিয় পাবলিক ঋণের ৬৩% ছিল ফরাসিদের দেয়া । সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের রেলওয়ে ব্যবস্থার উপরও ফরাসি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল। এছাড়া এখানকার বন্দর, গ্যাস ও বৈদ্যুতিক কোম্পানী, ক্যামিকেল প্লান্ট ও রেশম উৎপাদন সহ-অন্যান্য ক্ষেত্রেও ফ্রান্সের স্বার্থ জড়িত ছিল। এসব স্বার্থ রক্ষায় এ অঞ্চলে ফরাসি প্রভাব বজায় রাখা ছিল জরুরী। তুর্কি শাসন বিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্ন সিরিয়ার খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৩ সালে তাদের কংগ্রেস অধিবেশনের স্থান হিসেবে প্যারিসকে বেছে নিয়েছিল। যা ফ্রান্সের সাথে এ অঞ্চলের নিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে। এসব কারণে যখন ওসমানিয় সাম্রাজ্যের বিজিত অঞ্চলগুলির বিলি বন্টনের বিষয়টি উপস্থিত হল তখন ফ্রান্স নিজেকে বৃহত্তর সিরিয়ার ন্যায় সঙ্গত ট্রাস্টি হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী আরব জাতীয়তাবাদের মনোভাব ফ্রান্সকে হতাশ করেছিল। সিরিয়াবাসী কিং-ক্রেন কমিশনকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় কোন বিদেশি শক্তির অভিভাবকত্ব তাদের নিকট কাম্য ছিল না ।
আমীর ফয়সালের নেতৃত্বে সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী সরকারও ফ্রান্সের পরিবর্তে কিছুটা ব্রিটিশ প্রীতি লক্ষনীয় ছিল। যাহোক, ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে স্যান-রেমো সম্মেলনে বৃহত্তর সিরিয়ার শাসনভার ফ্রান্সের উপর ন্যাস্ত করা হয়। জুলাই মাসে ফ্রান্স সিরিয়া দখল করে নেয় এবং ফয়সাল ইউরোপে পালিয়ে যান। ফিলিস্তিনকে অবিভক্ত সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনাধীনে অর্পণ করা হয়। ফলে সিরিয়ার সাথে ফিলিস্তিনের সীমানা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের সীমানা চিহ্নিত করে ফ্রান্স ও ব্রিটেন একটি কনভেনশন স্বাক্ষর করে। একইভাবে ১৯২১ সালের ২০ অক্টোবর এক চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স উত্তর সিরিয়ার সাথে তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করে। ১৯২২ সালের ২০ জুলাই সিরিয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন ব্যবস্থা লীগ অব নেশনস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। সিরিয়ার উপর পূর্ণ সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্স এ অঞ্চলে তার শাসন ক্ষমতা স্থায়ী করার উপায় খুঁজতে থাকে। এ লক্ষ্যে ফ্রান্স গতানুগতিক ও চিরাচরিত বিভাজন ও শাসননীতি অনুসরণ করে। ফয়সালের সিরিয়া ত্যাগের পর পরই জেনারেল গুরো বৃহত্তর সিরিয়াকে ৪টি ভাগে ভাগ করেন। (এ) বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র, (বি) জাবাল আদ দ্রুজসহ দামেস্ক রাজ্য; (সি) আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাসহ আলেপ্পো রাষ্ট্র এবং (ডি) লাতাকিয়া বা আলাবিরাজ্য। পরবর্তীতে দামেস্ক রাজ্য হতে জাবাল দ্রুজকে পৃথক করে একটি আলাদা রজ্যের মর্যাদা দেয়া হয় । এবং আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাকে আলেপ্পো থেকে পৃথক করে একটি স্বায়ত্তশাসিত জেলার মর্যাদা দেয়া হয় ।
সুতরাং, উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯২২ সালের ২০ জুলাই সিরিয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন ব্যবস্থা লীগ অব নেশনস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে সিরিয়ার উপর পূর্ণ সামরিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্স এ অঞ্চলে তার শাসন ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যমে ১৯৪৬ সালের ১৭ এপ্রিল সিরিয়ার স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে চিরতরে ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ঘটে ।
ফরাসি ম্যান্ডেট শাসনাধীনে লেবানন
লেবাননে ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ম্যান্ডেটরি শাসনামলে লেবাননের ইতিহাস নিম্নে তুলে ধরা হল :
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতেই লেবাননের স্বায়ত্ত্বশাসন খর্ব করা হয় এবং ১৯১৫ সালের অক্টোবরে প্রত্যক্ষ ওসমানিয় শাসন পুনরায় প্রবর্তিত হয়। সেনাবাহিনীর জন্য সরকার খাদ্যশস্য ক্রয় ও মজুদ করায় দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিদেশ থেকে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী লেবাননিরা টাকা পাঠাতে না পারায় দেশের অভ্যন্তরে বহু লোক সীমাহীন দুর্দশায় পতিত হয়। তদুপরি রাজনৈতিক ভবিষ্যত লেবাননিদেরকে শঙ্কিত করে তোলে। ব্রিটেনের সহায়তায় ও শরীফ হুসাইনের নেতৃত্বে যে আরব বিদ্রোহ শুরু হয় তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বহু লেবাননী খ্রিস্টানদের মনে শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। প্রথম হতেই তারা ফ্রান্সের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত সাইকস-পিকো নামক গোপন চুক্তিতে ফ্রান্স এ এলাকার উপর তার বিশেষ প্রভাব ও দাবির কথা স্বীকার করে নিতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন ইউরোপিয় দেশে ফরাসি লেবাননি খ্রিস্টানরা লেবাননের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য জনমত গঠন করে এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ফরাসি সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। ফ্রান্সও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তার অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য এ সুযোগ সহজে ছাড়তে রাজি ছিল না। যুদ্ধের শেষ দিকে ফ্রান্স লেবাননের উপকূলে অবস্থিত আরওয়াদ দ্বীপে তার নৌঘাটি স্থাপন করে এবং সেখান থেকে সিরিয়া লেবাননের ঘটনার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে।
ফয়সালের নেতৃত্বে আরব বাহিনী দামেস্ক প্রবেশ করার পর এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মুসলিম আরব জাতীয়তাবাদীরা দামেস্কে প্রতিষ্ঠিত ফয়সালের সরকারকে এক অখণ্ড আরব সামাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করতে থাকে। উপরন্তু লেবাননকে তারা সিরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করত। ফয়সালের অনুচর শুকরী পাশা আল-আইয়ুবী কর্তৃক বৈরুত ও বাআবদায় আরব সরকারের পতাকা উত্তোলন এ মনোভাবেরই প্রকাশ করে ।
ফ্রান্স অবশ্য এ ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি ছিল না। ১৯১৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল এ্যালেনবীর অনুমতিক্রমে একটি ফরাসি সেনাদল সহ মিত্র বাহিনী নিয়ে বৈরুতে প্রবেশ করেন। শুকরী পাশা বৈরুত হতে বহিষ্কৃত হন। সরকারি ভবনগুলি হতে আরব সরকারের পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়। একজন ফরাসি সামরিক কর্মচারীকে সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়।
১৯২০ সালের এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখে মিত্র শক্তির সর্বোচ্চ পরিষদ স্যান- রেমোর সম্মেলনে মিলিত হয়ে লেবাননের ম্যান্ডেটরি শাসনভার ফ্রান্সের উপর অর্পণ করা হয়। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বিক্ষোভ দেখা দিলেও লেবাননের খ্রিস্টান জনসাধারণ একে স্বাগত জানায়। এর পূর্বে ১৯১৯ সালের নভেম্বরে স্বনামধন্য সেনানায়ক জেনারেল হেনরী গুরোর নিকট প্রাচ্যে ফরাসি বাহিনীর প্রধান সিরিয়া ও লেবাননে ফরাসি হাইকমিশনার হিসেবে আগমন করেন ।
ম্যান্ডেটারি শাসনের শুরুতেই ফরাসি কর্তৃপক্ষ তাদের বিশেষ আস্থাভাজন ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে মাউন্ট লেবাননের এলাকা সম্প্রসারিত করে। পূর্বে বিকা উপত্যকা ও বালাবাক অঞ্চল, দক্ষিণে হাবায়া ও রাশায়া জেলা এবং পশ্চিমে ত্রিপলী, বৈরুত, সাইদন ও সূর ইত্যাদি সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর মাউন্ট লেবাননের সাথে যুক্ত করে হাইকমিশনার ১৯২০ সালের ১ সেপ্টেম্বরে বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এক ফরমান জারি করেন। এ ঘটনা লেবাননের পরবর্তী ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এসব এলাকার সুন্নী ও শিয়া মুসলমান দ্রুজ ও গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টান বিশেষ করে প্রথমোক্ত সম্প্রদায় অপরাপর আরব রাষ্ট্র হতে এভাবে বিচ্ছিন্ন হতে এবং ফরাসি কর্তৃত্ব মেনে নিতে রাজি ছিল না ।
পুরো ম্যান্ডেট আমলে বিশেষ করে প্রথমদিকে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ফলে অন্যান্য সম্প্রদায় ফরাসিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে ৷
সুন্নী মুসলমানরা পাশ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ঐক্য স্থাপনের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তাদের অনেকেই একটি পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে লেবাননের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি ছিল না। ১৯২২ সালে লেবাননের প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ঐক্যপন্থী সুন্নী মুসলমানরা নির্বাচনের বিরোধীতা করে এবং ফরাসি ঘেষা ঐক্য বিরোধী স্বরাষ্ট্র সচিব আসআদ বে খুরশিদকে হত্যা করে। তবে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করতে প্রয়াসী হয়। এ প্রয়াস অনেকাংশে সফলও হয় ৷
১৯২৫ সালে সিরিয়ায় দ্রুজদের যে বিদ্রোহ হয় তা ক্রমে দক্ষিণ লেবাননে ছড়িয়ে পড়ে এবং লেবাননি দ্রুজ ও জাবাল আনিল এলাকায় শিয়া মুসলমানদের উচ্চকিত করে তোলে। তবে ম্যারোনাট খ্রিস্টানদের আনুগত্য অটুট ছিল। এ বিদ্রোহের বিফলতার পরেই দ্রুজ ও শিয়া মুসলমানরা মোটামুটিভাবে লেবাননি রাষ্ট্র ও ফরাসি ম্যান্ডেট ব্যবস্থা মেনে নেয় ।
লেবাননের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পূর্ণ করার জন্য একটি সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতিনিধি পরিষদ বিধান পরিষদ হিসেবে মিলিত হয়। সংবিধান রচনা করার জন্য একটি ফরাসি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রণীত খসড়া বিধান পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯২৬ সালের ২৪ মে লেবাননকে একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্নী মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। খ্রিস্টান নিয়ন্ত্রিত লেবানন রাষ্ট্রে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে তীব্র আপত্তি জানায়। লেবাননের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলি সিরিয়ার সাথে যুক্ত করার দাবিতে সভা অনুষ্ঠান ও স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ১৯২৮ সালে দামেস্কে সিরিয়ার বিধান পরিষদে সে দেশের সংবিধান নিয়ে আলোচনার সময় লেবাননের সূন্নি মুসলমানদের
কয়েকজন প্রতিনিধি গমন করে সিরিয়া লেবাননের ঐক্য সম্পর্কিত ধারা সংবিধানে সংযোজনের জন্য আলাপ-আলোচনা করে। অতি সাধারণভাবে এক একটি ধারা সংবিধানে যুক্ত করা হয়। যার বাস্তবে কোন গুরুত্ব ছিল না।
ম্যারোনাইট খ্রিস্টান ছাড়া যে সম্প্রদায়গুলি ম্যান্ডেট ব্যবস্থার প্রতি অনুরক্ত ছিল না ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ ক্রমে ক্রমে তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে। শিয়া মুসলমানদের জন্য পৃথক ধর্মীয় বিচারালয় স্থাপন করা হয়। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন ম্যারোনাইট খ্রিস্টানকে নিয়োগ না করে একজন গ্রীক অর্থোডক্স চার্লস দাব্বাসকে নিয়োগ করা হয়। সুন্নি মুসলমান নেতৃবৃন্দের সমর্থন লাভেরও চেষ্টা করা হয়। ত্রিপলির রাজনীতিবিদ শেখ মুহাম্মদযিশকে সংসদের স্পিকার নির্বাচিত করা হয় ।
সিরিয়ার ন্যায় লেবাননেও ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ফরাসি উপেদেষ্টা নিয়োগ করে শাসন ব্যবস্থার উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পায়। বিশেষত বিচার বিভাগে এ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। এর ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা যে বৃদ্ধি পেয়েছিল সে কথা অস্বীকার করা যায় না । কিন্তু এ ধরনের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ কিছু ম্যারোনাইট খ্রিস্টানকেও ম্যান্ডেটরি বিরোধী করে তুলেছিল। দ্বিতীয় সংসদের কার্যকলাপকে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ম্যান্ডেট বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে ১৯২৬-১৯৪৩ সালের মধ্যে দুবার সংসদ বাতিল করা হয়। ফরাসি সমর্থকদের মধ্যে অনেকে এতে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তৃতীয় শতকের মধ্যভাগ হতে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের মধ্য হতেও অনেকে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করতে থাকে। তা সত্ত্বেও ম্যারোনাইট নেতৃবৃন্দের অনেকেই মুসলিম আরব জাতীয়তাবাদকে বিপদস্বরূপ মনে করে ফান্সের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকাকেই লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ বলে মনে করেছে। অবশ্য কিছু কিছু ম্যারোনাইট নেতা লেবাননি মুসলমানদের ও আরব জাতীয়তাবাদের সাথে সাধারণভাবে সমঝোতা স্থাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এমিল ইদ্দাদকে প্রথমোক্ত দলের এবং বিশারা আল খুরীকে দ্বিতীয় দলের প্রতিভু বলে গণ্য করা যায় । এরা উভয়ই বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করে।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে লেবানন বিভিন্ন সময়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সংবিধানের কতগুলি মৌলিক ত্রুটি। এগুলির মধ্যে রাষ্ট্রপ্রধান ও সংসদের পারস্পরিক ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব উল্লেখযোগ্য। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে সংসদই রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি প্রদানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভা গঠন ও বাতিল করতে পারতেন। এটি সংবিধানের ৫৫ ধারায় উল্লেখ আছে। মন্ত্রীসভা সংসদের নিকট দায়ী থাকলেও প্রেসিডেন্ট কারো নিকট দায়ী থাকবেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সংসদের তোয়াক্কা না করে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। তাছাড়া রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রেসিডেন্ট সরকারি অনুমোদন বা সংসদের মতামত ছাড়াই যেকোন দেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে পারতেন। সংসদ বাতিল ঘোষণা করার ক্ষমতাও প্রেসিডেন্টের ছিল ।
সংসদকে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত দুর্বল করে রাখা হয়। শক্তিশালী সংসদ এবং ফরাসি স্বার্থ পরস্পর বিরোধী মনে করে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ সংসদকে একটি বিতর্ক সভায় পরিণত করতে চেয়েছিল। বিভিন্ন দিক দিয়ে সংসদকে দুর্বল করে রাখা হয়। প্রথম ফরাসি হাইকমিশনার (পরে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টকে) অত্যন্ত বেশি ক্ষমতা দেয়ার ফলে সংসদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত সংসদের সদস্যপদ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে তার ফলে সংসদ কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী নেতার ক্রীড়নকে পরিণত হয়। তৃতীয়ত, ম্যান্ডেট আমলে সংসদের এক তৃতীয়াংশ সদস্য ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ দ্বারা মনোনীত হতেন। এসব কারণে একটি স্বাধীন দেশের সংসদকে যে ধরনের কাজ করতে হয়, লেবাননের সংসদ তা করার কোন সুযোগ পায় নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশেষ করে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয়ের সময় হতে ম্যারোনাইট খ্রিস্টান ও ফ্রান্সের সাথে যুক্ত থাকা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করতে থাকে । এ সময় হতে লেবানন সিরিয়ার সাথে একযোগে ফরাসি বিরোধী আন্দোলন চালায়। একই সাথে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৩ সালের ২২ নভেম্বরে লেবানন স্বাধীনতা লাভ করায় ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ঘটে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]