সিরিয়া ও লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলন মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীনতা আন্দোলন
সিরিয়া ও লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলন মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিরিয়া ও লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯২০ সালে বাদশাহ ফয়সালকে সিরিয়া হতে বহিস্কারের পর হতে ১৯৪৬ সালে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সিরয়া ও লেবাননের ইতিহাস হল ভয়াবহ দাঙ্গা আর বিদ্রোহের ইতিহাস, ম্যান্ডেটরি শাসনামলে সিরিয়া ও লেবাননের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যকার বিরোধের কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল :
ম্যান্ডেটরি শাসনের পূর্বে ও পরে মধ্যপ্রাচ্যের আরব অধ্যুষিত যেকোন অঞ্চলের তুলনায় সিরিয়া ও লেবাননের জাতীয়তাবাদ ছিল প্রবল শক্তিশালী। সিরিয়া লেবাননী জাতীয়তাবাদী গোপন সংস্থাগুলির নেতৃবৃন্দই ফয়সালের মাধ্যমে শরীফ- ম্যাকমেহন পত্রালাপের শর্তগুলি স্থির করে দেয়। বৃহত্তর সিরিয়ার গুপ্ত সমিতি ফাতাতই সর্বপ্রথম সম্মিলিত আরব রাজত্বের প্রস্তাব করে। এছাড়া উমাইয়াদের
শাসনামলে দামেস্ক ছিল সম্মিলিত আরব সাম্রজ্যের রাজধানী। এ ঐতিহাসিক চেতনা থেকেও সিরিয়রা ঐক্যবদ্ধ আরব রাজ্য গঠনের ব্যাপারে একটি বিশেষ দায়িত্ব অনুভব করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরবদের সকল দাবি উপেক্ষা করে যখন সিরিয়ার উপর ম্যান্ডেটরি শাসন চাপিয়ে দেয়া হল তখন সঙ্গত কারণেই সিরিয়ার জাতীয়তাবাদীরা তা সহজে মেনে নিতে পারে নি ।
উপরন্তু ফ্রান্সের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে ম্যান্ডেটরি শাসক হিসেবে নিযুক্ত করার সিরিয় দাবিটিও যখন প্রত্যাখাত হল তখন সিরিয়াবাসীর অসন্তোষের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেল। ফলে ম্যান্ডেটরি শাসনামলের সূচনালগ্ন থেকেই ফরাসি কর্তপক্ষের সাথে অবিভক্ত সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের সম্পর্ক ছিল .বৈরিতাপূর্ণ । যা পরবর্তীতে প্রশমিত না হয়ে আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায় ।
তুর্কিদের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য নিয়েই আরব জাতীয়তাবাদীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু তুর্কিদের কবল থেকে সিরিয়াবাসীকে মুক্ত করার এ প্রচেষ্টায় ফ্রান্সের অবদান ছিল একেবারেই নগণ্য। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ও আরব বাহিনী যখন তুর্কি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে দামেস্কে প্রবেশ করে তখন ব্রিটিশ বাহিনীর অংশ হিসেবে একটি ক্ষুদ্র ফরাসি সেনাদল এতে যোগ দিয়েছিল । সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের মতে এ নগণ্য অবদানের জন্য সিরিয়ার ম্যান্ডেটরি শাসক হিসেবে নিযুক্ত হবার কোন অধিকার ফ্রান্সের নেই। জাতীয়তাবাদীদের এ মনোভাব ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের সাথে বিরোধীতার অন্যতম কারণ ছিল। তুর্কি বাহিনীর নিকট হতে সিরিয়াকে মুক্ত করার পর আরব জাতীয়তাবাদের মুখপাত্র ফয়সাল সিরিয়ার অভ্যন্তরভাগে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। সিরিয়ায় ফয়সালের সরকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আগের চেয়ে জোরদার হয়ে উঠে। পুরনো গোপন জাতীয়তাবাদী সংস্থাগুলো প্রকাশ্যে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু অনতিকাল পরেই ফরাসি সেনারা অপমানজনকভাবে ফয়সালকে অপসারিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। কোন দেশপ্রেমিক সিরিয়াবাসীর পক্ষ ফরাসি কর্তৃপক্ষের এ আচরণ সহজভাবে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল
সিরিয়া-লেবাননী জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, লীগ অব নেশনস কর্তৃক জার্মানি ও তার মিত্রদের কাছ থেকে বিজত অঞ্চলগুলিতে যে ম্যান্ডেটরি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় তা ঐ অঞ্চলের জনগণের অগ্রগতির স্তর। ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ আরো কিছু কারণে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন—পূর্বতন তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ফিলিস্তিন ও ট্রান্স জর্ডান ছিল “এ” ক্যাটাগরির ম্যান্ডেটরি অঞ্চল। লীগ সনদের ২২ নং ধারানুযায়ী যেহেতু এ অঞ্চল “বি” ক্যাটাগরি (মধ্য আফ্রিকার বিজিত অঞ্চলসমূহ) এবং “সি” ক্যাটাগরিভুক্ত (দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জসমূহ) অঞ্চলগুলির তুলনায় অধিকতর অগ্রসর ছিল, সেহেতু এ অঞ্চলে ম্যান্ডেটরি শক্তির নিয়ন্ত্রণের মাত্রা হবে সীমিত । কেননা একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে তাদের অগ্রগতি ছিল সন্তোষজনক। ম্যান্ডেটের শর্তানুযায়ী সিরিয়াবাসীকে উপদেশ ও সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের উপযোগী করে তোলাই ছিল ফ্রান্সের দায়িত্ব। কিন্তু ফ্রান্স এ এলাকায় যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছিল তার সাথে ফরাসি উপনিবেশগুলিতে স্থাপিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার পরিবর্তে সিরিয়াকে একটি ফরাসি উপনিবেশে পরিণত করার এ প্রচেষ্টা সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল। ফরাসিদের ধর্ম বিষয়ক নীতিও সিরিয়াবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারা রোমান ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের সহায়তার জন্য ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বাকী ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে অধিক সুবিধা প্রদান করত। এছাড়া লেবাননে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের রক্ষাকর্তা হিসেবে ফ্রান্সের ভূমিকা সিরিয়াবাসীর মনে ফরাসি মনোভাব গড়ে তুলেছিল। আর আরব জাতীয়তাবাদীর উদ্দেশ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু ম্যান্ডেটরি শাসনের শুরুতেই ফ্রান্স “বিভাজন ও শাসন” নীতি অনুসরণ করে বৃহত্তর সিরিয়াকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে ফেলে। সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করাই যে এর উদ্দেশ্য তা বুঝতে সিরিয়াবাসীর কষ্ট হয় নি। এছাড়া বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র সৃষ্টির ফলে সংযুক্ত নতুন এলাকায় সুন্নী ও শিয়া মুসলমানরা ফরাসিদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। কেননা এর ফলে সংযুক্ত এলাকার মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টানদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে ভীত ছিল। পূর্বতন তুর্কি সাম্রাজ্যের এ মুসলমানরা ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী। এই প্রথম তারা একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্রের অধীনে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় ।
১৯২১-১৯২২ সালের লোক গণনা অনুযায়ী লেবাননে খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ । অবশ্য এ লোক গণনায় মুসলমানদের পক্ষ থেকে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। লেবাননের সরকার ব্যবস্থায় লোকসংখ্যার ধর্মীয় অনুপাত অনুযায়ী আসন বণ্টিত হওয়ায় মুসলমানরা নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে। খ্রিস্টানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য ফরাসি কর্তৃপক্ষ লেবাননে খ্রিস্টানদের বিদেশ গমনের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে এবং বিদেশি খ্রিস্টানদের লেবাননে বসবাসে উৎসাহিত করে। এ অবস্থায় সংযুক্ত এলাকার মুসলমানরা নিজেদেরকে সিরিয়ার অধিবাসী হিসেবেই মনে করতে থাকে এবং বিভিন্ন সময় সিরিয়ার সাথে সংযুক্তির দাবী জোরালোভাবে উপস্থাপন করে। এ নিয়ে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের সাথে সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের বিরোধ দেখা দেয় ।
সিরিয়া-লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দেখা যায় যে, সিরিয়া লেবাননে ফরাসি ম্যান্ডটারি শাসনের প্রথম
দিকে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফরাসি সেনাবাহিনীর ৩ জন জেনারেল এ সময় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। এরা হলেন জেনারেল হেনরী গুরো নভেম্বর ১৯১৯ হতে নভেম্বর ১৯২২, জেনারেল মেক্সিম ভেগা মে ১৯২৩ হতে নভেম্বর ১৯২৪, জেনারেল সায়েরা জানুয়ারি ১৯২৫ হতে নভেম্বর ১৯২৫। সিরিয়া লেবাননের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি তাদের কোন সহানুভূতি ছিল না। ১৯২৫ সালের গোড়ার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসনের অবসান ঘোষণা করা হলেও হাইকমিশনারের ক্ষমতার কোন হেরফের হয় নি । পদাধিকার বলে তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান । আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় তার ক্ষমতা ছিল অপ্রতিরোধ্য। উল্লেখ্য যে, সনাতন ওসমানিয় সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলোকে রজ্যের পর্যায়ে উন্নীত করা হলেও ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যগুলি পরিচালনার জন্য কোন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় নি। অথচ সিরিয় জাতীয়তাবাদীরা লক্ষ্য করল শিক্ষা দীক্ষা ও জীবন-যাত্রার মানের দিক থেকে তাদের চেয়ে পশ্চাদপদ ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটাধীনে একটি চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ওসমানিয় শাসনামলে প্রদেশগুলিতে অধিকতর স্বাধীনতাভোগকারী উপদেষ্টা পরিষদের বদলে ফরাসি কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ গঠন করে। এ প্রতিনিধি পরিষদগুলি অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার অধিকারী ছিল এবং হাইকমিশনারের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে ইরাকে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংসদ গঠিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী এ সংসদের বেশ কিছু দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পলন করতে থাকে। জাতীয়তাবাদীদের মতে সিরিয়ায় ম্যান্ডেটরি শাসন ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের চেয়েও ভয়ংকর । কেননা উপনিবেশের শাসন ব্যবস্থা যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয় সেহেতু এ শাসন ব্যবস্থার সফলতা অথবা ব্যর্থতার দায়ভার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে ম্যান্ডেটরি এলাকার শাসনভার স্থানীয়দের উপর ন্যস্ত হলেও মূল ক্ষমতা ছিল ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের অধীনে। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণ হলেও এ ব্যর্থতার দায়ভার তাদের উপর বর্তায় না। কিন্তু সফলতার জন্য প্রশংসাটুকু তাদের ভাগেই পড়ে। এ কারণে বৃহত্তর সিরিয়া-লেবানন-বাসীর মনে তীব্র ফরাসি বিরোধীতা লক্ষ্য করা গেলেও শুরুতে তারা কোন ফরাসি বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। ফয়সালের অনুপস্থিতি এবং সংগঠিত রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিই ছিল এর প্রধান কারণ। তবে সিরিয়া লেবাননের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ফরাসী শাসন বিরোধী তৎপরতা চলতে থাকে। সিরিয়া লেবাননের বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক আন্দোলনের বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে শীর্ষ রাজ্যের নাম 'জাবাল আল দ্রুজ'। এ রাজ্যে ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠার ৫ বছরের মধ্যেই বিক্ষোভ দানা বেধে উঠে এবং তা ভয়াবহ বিদ্রোহের রূপ নেয়। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে এ রাজ্যে বিদ্রোহের
সূত্রপাত ঘটে এবং পরে তা দামেস্ক সহ অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ রাজ্যের গভর্নর ক্যাপ্টেন গেব্রেয়েল কারবিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা ও জবরদস্তিমূলক শাসন এ বিদ্রোহের সূচনা করে। এ বিদ্রোহ অবসানে হাইকমিশনার সারেয়ার দমনমূলক ও ভ্রান্ত নীতি সমস্যাটিকে আরো প্রকট করে তোলে। ম্যান্ডেটরি শাসক হিসেবে আগমন করেই ফ্রান্স সিরিয়ার এ যুদ্ধংদেহি দ্রুজ সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করার নীতি অবলম্বন করেছিল। ১৯২১ সালে দামেস্ক রাজ্য হতে জাবাল আল-দ্রুজকে আলাদা করে পৃথক রাজ্য সৃষ্টির সময় স্থির হয়েছিল যে, দ্রুজদের দ্বারা নির্বাচিত একজন গভর্নর পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন। একজন উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবেন। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্রুজ গভর্নর সেলিম আল আতরাশের মৃত্যু হলে পরবর্তী গভর্নর নির্বাচন নিয়ে দ্রুজ নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় । একজন স্থানীয় অধিবাসীকে গভর্নর নিযুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে জাবাল-আল-দ্রুজের সংসদ ফরাসি উপদেষ্টাকেই সাময়িকভাবে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করে। ফলে গভর্নর ও উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন একজন ফরাসি ব্যক্তি। ১৯২৪ সালে ক্যাপ্টেন কারবিয়া জাবাল আল- দ্রুজে আসেন এবং তার পূর্বসূরীর মত তিনিও উভয় পদে সমাসীন হন। সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি জাবাল আল দ্রুজে জবরদস্তিমূলক শাসন কায়েম করেন। তুচ্ছ কারণে দ্রুজ নেতৃবৃন্দ ও সম্মানিত শেখদের সাথে তিনি অপমানজনক ব্যবহার করতে থাকেন। বাধ্যতামূলক শ্রম, নিষ্ঠুর শাস্তি দান প্রথা এবং স্থানীয় স্কুল শিক্ষকদের গুপ্তচর বৃত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত করা ছিল তার ২০ মাসের শাসনামলের বৈশিষ্ট্য। ১৯২৫ সালের প্রথম দিকে একদল দ্রুজ প্রতিনিধি হাই কমিশনার সারেয়ার নিকট জেনারেল কারবিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে বৈরুতে গমন করেন। তারা ১৯২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী, কারবিয়ার বদলে একজন স্থানীয় গভর্নর নিয়োগের দাবিতে একজন হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। মারেয়া দ্রুজ নেতৃবৃন্দর সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানান। উপরন্তু তিনি ঘোষণা করেন যে, এ ধরনের কোন চুক্তির কোন রেকর্ড হাই কমিশনে নেই। দ্রুজরা তার অবগতির জন্য চুক্তির একটি কপি প্রেরণ করলে তিনি মন্তব্য করেন যে, চুক্তিটির ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও বাস্তব বিবেচনায় এটি মূল্যহীন। দ্রুজ নেতৃবৃন্দ আরো একবার তার সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে প্রত্যাখাত হয়। অতঃপর তারা গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু আশানুরূপ কোন ফল না পেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দামেস্কের ফরাসি কর্তৃপক্ষ হাইকমিশনারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রয়ণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অবহিত করেন। তারপরও জেনারেল সারেয়া বিদ্রোহীদের সাথে কোন প্রকার আলোচনায় না বসে চলচাতুরির আশ্রয় নেন । তিনি ভেবেছিলেন বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারীদের জোরপূর্বক কিছুদিনের জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলে আন্দোলনটি স্তিমিত হয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে দ্রুজ নেতৃবৃেন্দের সাথে আলোচনার জন্য তিনি তাদের দামেস্কে আমন্ত্রণ জানান ।
আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে যারা দামেস্কে গেলেন তাদেরকে হোটেল কক্ষ থেকেই গ্রেফতার করা হল এবং কড়া প্রহরায় পালমিরায় নির্বাসন দেয়া হয় । দ্রুজ নেতা সুলতান আল আতরাশ নিমন্ত্রিত হলেও হাইকমিশনারের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে আত্মগোপন করেন। সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল । কিছুটা শক্তি সঞ্চয়ের পর ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এবং জামাল আল-দ্রুজের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মালখাদ দখল করে নেন। তখনো পর্যন্ত বিদ্রোহটি স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত ছিল। এবং খুব অল্প সংখ্যক দ্রুজ আতরাশের সাথে যোগ দিয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, ১৯২৫ সালে অতর্কিতে আক্রমণ করে বিদ্রোহীরা ফরাসি বাহিনীর একটি অংশকে ধ্বংস করে দেয়। এ সাফল্যের ফলে দ্রুজরা দলে দলে বিদ্রোহ বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। জাবাল আলদ্রুজের রাজধানী সুয়াইদায় অবস্থিত ফরাসি বাহিনীকে বিদ্রোহীরা অবরুদ্ধ করে রাখে। ফরাসি বাহিনীকে অবরোধ মুক্ত করার জন্য ১৯২৫ সালের ৩১ জুলাই জেনারেল মিশরের নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। বিদ্রোহীদের আক্রমণে এ সেনাদলও বিপর্যস্থ হয়। আগস্ট মাস নাগাদ ফ্রান্স হতে সৈন্যদল আগমন করায় ফরাসি বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। ২৪ সেপ্টেম্বর ফরাসী বাহিনী সয়াইদা দখল করে অবরুদ্ধ সেনাবাহিনীকে মুক্ত করে। ক্রমে অন্যান্য শহরগুলিও বিদ্রোহীদের কবল হতে মুক্ত করা হয়। অক্টোবর মাসে ফরাসি সরকার ক্যাপ্টেন কারবিয়াকে জাবাল আল-দ্রুজ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এবং একজন নতুন গভর্ণর প্রেরণ করেন । ১৯২৭ সাল নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। বিদ্রোহীরা সিরিয়া ত্যাগ করে সউদি আরব ও মিশরে আশ্রয় গ্রহণ করে ।
সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতাকামীরা দামেস্ক ও আলেপ্পো রাজ্যেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। উল্লেখ্য যে, জাবাল আল-দ্রুজের বিদ্রোহ এবং প্রথম দিকে বিদ্রোহীদের সফলতা দামেস্ক ও আলেপ্পোসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। দ্রুজদের বিদ্রোহ ও ক্রমাগত সাফল্যের খবর দামেস্কে পৌছলে সেখানে দারুন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দামেস্কের জাতীয়তাবাদীরা দ্রুজদের আন্দোলনকে ম্যান্ডেটারি শাসনের অবসান অথবা আরব জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতি আদায়ের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা জাবাল আলদ্রজে গমন করে বিদ্রোহের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। এবং সুলতান আল আতরাশকে প্রেসিডেন্ট করে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন করে। আল আতরাশ সিরিয়া থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার এবং ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। দক্ষিণ লেবানন আক্রমন ও দখল করে তারা লেবাননের খ্রিস্টানদের বুঝিয়ে দেয় যে ফ্রান্স তাদের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম । বিদ্রোহীরা ভেবেছিল এর ফলে খ্রিস্টানরা তাদের সাথে সমঝোতায় উপনীত হতে বাধ্য হবে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদীদের দল গণদলের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়। এবং নেতৃবৃন্দকে জেলে আটক করে। জাবাল আল দ্রুজে বিদ্রোহের শুরু
থেকেই হাইকমিশনার জেনারেল মরিস সারেয়া এ আন্দোলন দমনে যে কর্মপন্থা অবলম্বন করেন তা বৃহত্তর সিরিয়া ও সিরিয়ার বাইরে বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে। ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে ফ্রান্সে হেরিয়ে সরকারের পতন ঘটলে তার অবস্থান দুর্বল হয়ে যায় এবং সিরিয়া লেবানন থেকে তার প্রত্যাহারের বিষয়টি অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফরাসি নতুন প্রধানমন্ত্রী Aristide Briand ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর তাকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । আরী দ্য জুভেকে নতুন হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সিনেটর, সাংবাদিক এবং জেনেভায় লীগ অব নেশনসের সদর দফতরে একজন ফরাসি প্রতিনিধি। হাই কমিশনার হিসেবে তার নিয়োগ জাতীয়তাবাদীদের আশান্বিত করে। কেননা তিনি ছিলেন সিরিয়া-লেবাননে নিযুক্ত প্রথম বেসামরিক হাইকমিশনার। ইতোপূর্বে এ পদে দায়িত্ব পালনকারীদের সকলেই ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। সে কারণে সিরিয়া-লেবনানে ম্যান্ডেটরি শাসন ব্যবস্থায় সামরিক ছাপ ছিল স্পষ্ট। শাসক শ্রেণীর এ সামরিক চরিত্র উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়। নব নিযুক্ত বেসামরিক হাই কমিশনার প্রথমেই শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৬ সালের জানুয়ারী মাসে সিরিয়ায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট সুবহী বে বারাকাতের পরিবর্তে সিরিয়াবাসীর নিকট গ্রহণযোগ্য আহমেদ নামি বে-কে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। তিনি ফ্রান্স ও সিরিয়া সম্পর্কে ১৯২২ সালে সম্পাদিত ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তির অনুরূপ একটি চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু অল্প কিছুকাল পরেই তিনি ফরাসি পররাষ্ট্র দফতরে নিকট প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ আরি পাসোঁ এর অনুকূলে পদত্যাগ করেন। নতুন হাইকমিশনার সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। নির্বাচনে জাতীয়তাবাদীগণ সংসদের এক তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সংসদে জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। কেননা আলেপ্পোর ইব্রাহীম হানানু দামেস্কের জামিল মারদাম মে, ফারিস আল খুরী এবং হামার হাশিম আল আতাশীর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে, ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা সিরিয়ার রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিও ছিল তাদের দখলে। যেমন হাশিম আল আতাশি সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। এবং ইব্রাহিম হানানু হন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান। ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে সংবিধানের একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়। সংসদে গৃহীত হওয়ার পর খসড়াটি অনুমোদনের জন্য হাইকমিশনারের নিকট প্রেরণ করা হয়। সার্বজনীয় ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত এক কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা এবংএর উপর আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত ক্ষমতা অর্পণ, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও দায়িত্বশীল মন্ত্রী সভার উপর প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ ইত্যাদি বিষয় হাই কমিশনারের নিকট গ্রহণযোগ্য মনে হলেও সংবিধানের কয়েকটি ধারার
ব্যাপারে তিনি আপত্তি উত্থাপন করেন। যেমন সংবিধানে ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার কথা বলা হয়েছে যা লেবানন, আল-দ্রুজ, আলাবি রাজ্য, ট্রান্স জর্ডান ও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক স্বতন্ত্রকে অস্বীকার করে। এছাড়াও সংবিধানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের ক্ষমা প্রদর্শন, চুক্তি সম্পাদন, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ এমনকি প্রয়োজনে সামরিক আইন জারি করার ক্ষমতার কথাও উল্লেখ ছিল। কিন্তু কোথায়ও সিরিয়ায় ম্যান্ডেটরি শাসনের কথা উল্লেখ ছিল না। হাইকমিশনার সংবিধান থেকে এসব বিষয় বাদ দেয়ার জন্য সংসদকে অনুরোধ করেন। কিন্তু সংসদ তা প্রত্যাখ্যান করায় তিনি ১৯৩০ সালের মে মাসে সংসদ বিলুপ্ত করে দেন এবং নিজে একটি সংবিধান জারি করেন। সংবিধানের যে ধারাগুলি সম্পর্কে হাইকমিশনারের আপত্তি ছিল সেগুলি ছাড়া জারিকৃত নতুন সংবিধানটিতে পূর্বতন সংবিধানের সকল ধারাই বহাল ছিল । ১৯৩২ সালের নতুন সংবিধানের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং মধ্যপন্থিরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তারা ফ্রান্সের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষপাতী ছিলেন। আলেপ্পোর আলী আল-আবিদ সংসদ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি একজন মধ্যপন্থি হাক্কি আল আজমকে মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব দেন। এ মন্ত্রী সভার প্রথম দিকে কয়েকজন জাতীয়তাবাদী নেতা যোগ দিলেও পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে কিছু বিষয়ে মৌলিক মতপার্থক্যের কারণে তারা পদত্যাগ করেন ।
সিরিয়া লেবাননে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বৃহত্তর লেবানন, লাতাকিয়া বা আলাবি রাজ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। উল্লেখ্য যে, ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসনামলের প্রথম দিকে সিরিয়ার অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র ও লাতাকিয়া ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। তবে ১৯২৫ সালের দ্রুজ বিদ্রোহ এ অঞ্চলকেও স্পর্শ করেছিল। ১৯২৫ সালে আল-আতরাশে ভ্রাতা জায়েদ আল আতরাশের নেতৃত্বে একটি দ্রুজ বাহিনী দক্ষিণ লেবানন আক্রমণ করে। লেবাননের দ্রুজগণ জাবাল আল দ্রুজের স্বধর্মীদের সাথে মিলিত হয়ে বিদ্রোহী সেনাদলকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। তারা কয়েকটি খ্রিস্টান শহরও দখল করে নেয়। স্থানীয় খ্রিস্টানরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠে । ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ খ্রিস্টানদের রক্ষায় একটি ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণ করে। এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে। ফলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় ৷ খ্রিস্টান ও দ্রুজদের মধ্যকার ঐ বৈরিতা যাতে দাঙ্গায় রূপ নেয় সেজন্য জায়েদ আল আতরাশ দক্ষিণ লেবাননে প্রবেশ করেই খ্রিস্টানদের আশ্বস্থ করে একটি ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, তার সেনাবাহিনী কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেশবশত লেবানন আক্রমণ করে নি। তাদের এ আক্রমণ ফরাসি সরকার ও এর সমর্থকদের বিরুদ্ধে এবং এ বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে উৎসারিত। তিনি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে খ্রিস্টানদেরকে বিদ্রোহী সেনাদলের সাথে যোগদানের আহবান জানান। কিন্তু স্থানীয় খ্রিস্টান ও দ্রুজদের মধ্যে পূর্ব থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করায়

তার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নি। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই অতিরিক্ত ফরাসি সেনা আগমণের ফলে দ্রুজ সেনাদল লেবানন ছাড়তে বাধ্য হয়। এর অল্প কিছুদিন পরই লেবাননের দ্রুজদের একটি প্রতিনিধিদল বৈরুতে গিয়ে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। এ বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর লেবাননের সাথে সংযুক্তকৃত অঞ্চলের মুসলমানরা মোটামুটিভাবে বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র ও ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন মেনে নেয়। অবশ্য ১৯২৮ সালের গ্রীষ্মকালে সিরিয়ার বিধান পরিষদের সংবিধান প্রণয়নের প্রাককালে লেবানন হতে কিছু মুসলিম প্রতিনিধি সিরিয়ায় গমন করে লেবাননের মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলি সিরিয়ার সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এ ব্যাপারে সিরিয়ার পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি। যা হোক ১৯২৫ সালের এ বিদ্রোহের প্রতি লেবাননের খ্রিস্টানদের কোন সমর্থন ছিল না। তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিস্টানরা বরং এ ভেবে খুশি হয়েছিল যে এর ফলে হাইকমিশনার সারেয়ার সাথে মুসলিমদের সমঝোতায় উপনীত হওয়ার শেষ সম্ভাবনাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকল না। পাশাপাশি এটাও প্রমাণিত হল যে, লেবাননের খ্রিস্টানরাই সিরিয়া লেবাননে ফরাসি শাসনের একমাত্র সমর্থক, যাদের উপর ফ্রান্স নির্ভর করতে পারে। তবে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ও লেবনানের খ্রিস্টানদের মধ্যেও কিছু বিষয় নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালে প্রশ্ন দেখা দেয় যে লেবাননের গভর্ণর কি একজন স্থায়ী ব্যক্তি হবেন। নাকি একজন ফরাসি হবেন । দীর্ঘ বিতর্কের পর (সেপ্টেম্বর ১৯২০ থেকে মে ১৯১৪) Trabaud- কে গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। লেবাননের খ্রিস্টানদের বিশেষ করে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের প্রত্যাশা ছিল যে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে এ পদে নিযুক্ত করা হবে। পরবর্তী ৬ বছর দাবিটি ক্রমশঃ জোরালো হয়ে উঠে। লেবাননের খ্রিস্টানরা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করল যে, দামেস্ক ও আলেপ্পোকে ফ্রান্স স্থানীয় গভর্ণরের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। অথচ তুলনামূলকভাবে লেবানন একটি অগ্রসর অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত পশ্চাদপদ ও অনুন্নত আলাবিদের মত লেবাননে প্রত্যক্ষ ফরাসি শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯২৬ সাল নাগাদ আরো ৩ জন ফরাসি গভর্ণর লেবাননে দায়িত্ব পালন করেন। তারা হলেন M. Pribat Aubouard মে ১৯২৩ হতে জুন ১৯২৪ পর্যন্ত; Leon Cayla জানুয়ারী ১৯২৫ হতে মে ১৯২৬। অবশ্য এক্ষেত্রে ফরাসি কর্তৃপক্ষ লেবাননের মুসলিম ও অন্যান্য খ্রিস্টানদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এ সকল সম্প্রদায় প্রভাবশালী ম্যারোনাইট খ্রিস্টান গভর্ণরের চেয়ে একজন ফরাসি গভর্ণরকে তাদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছিল। যা হোক, ১৯২৬ সালের মে মাসে লেবাননের জন্য একটি সংবিধান ঘোষণা করা হয়। বৃহত্তর লেবানন রাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। সংবিধান পাশ্চাত্য ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। এবং এ সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনি৷ধত্ব নিশ্চিত করা হয়। লেবাননে ফরাসি গভর্ণরের বদলে
একজন গ্রীক গোঁড়া খ্রিস্টান চালর্স দাব্বাসকে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয় । এ থেকে সিরিয় জাতীয়তাবাদীদের অনেকেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন যে যদি লেবাননের সাথে সংযুক্তকৃত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি বিযুক্ত করা হয় তাহলে অবশিষ্ট ক্ষুদ্র এবং খ্রিস্টান রাষ্ট্রটি খুব সহজেই পাশ্চাত্য ঘেষা হয়ে পড়বে এবং চূড়ান্তভাবে আরব বিশ্ব থেকে পৃথক হয়ে পড়বে। এছাড়া সিরিয় জাতিয়তাবাদীরা খ্রিস্টানদেরকে চাপের মুখে রাখার জন্য ভূ-খণ্ডগত ইস্যুটিকে প্রায়ই ব্যবহার করত। তাই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে লেবাননের অভ্যুদ্বয় না হওয়া পর্যন্ত সিরিয়া তার ভূ-খণ্ডগত দাবিটি পরিত্যাগ করে নি। এ পর্যায়ে লাতাকিয়া বা আলাবি রাজ্যে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে নি
এবার স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় আলোচনা করা প্রয়োজন। এ পর্যায়ে সিরিয়া লেবানন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। উল্লেখ্য যে, ১৯৩০ সালে সম্পাদিত ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩২ সালের ইরাকের লীগ অব নেশনসের সদস্যপদ লাভ সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী মহলকে আরো গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তারা সিরিয়ার জন্যও অনুরূপ একটি চুক্তি দাবি করতে থাকে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৩৬ সালে ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবনাননের সাথে পৃথক পৃথক ভাবে দুটি চুক্তি সম্পাদন করে। সিরিয়া ও লেবাননে চুক্তিটি ব্যাপক সাড়া জাগায়। সিরিয়ার সর্বত্র চুক্তিটি অভিনন্দিত হয়। এ সময় লাতাকিয়া এবং জাবাল আল দ্রুজ রাজ্য সিরিয়া রাজ্যের সাথে যোগ দেয় । আলেপ্পো পূর্বেই এ রাজ্যে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু চুক্তিটি ফরাসি পার্লামেন্টে অনুমোদন লাভ করে নি। ফলে সিরিয়া লেবাননের জনসাধারণ ফরাসি শাসনের প্রতি আরো বেশী বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ফ্রান্স পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য সিরিয়া ও লেবাননের প্রত্যক্ষ শাসন চালু করে। সংবিধান মূলতবী ঘোষণা করা হয় এবং মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। যদিও প্রেসিডেন্ট তার পদে বহাল ছিলেন। কিন্তু তার কোন ক্ষমতা ছিল না। যুদ্ধের প্রথম মাসেই জেনারেল ভেগার নেতৃত্বে ফ্রান্স সিরিয়ায় ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। উদ্দেশ্য ছিল যদি যুদ্ধ পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে । কিন্তু ১৯৪০ সালের জুন মাসে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেয়ায় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সিরিয়া -লেবানন ফ্রান্সের জার্মান প্রভাবিত মার্শাল পেতার নেতৃত্বে গঠিত ভিসি সরকারের অধীনে চলে যায়। জেনারেল ভেগার বদলে জেনারেল মিথেল হাওজার নিকট প্রাচ্যে ফরাসী বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন। অন্যদিকে যারা পেঁতা সরকারের জার্মানীর নিকট আত্মসমর্পণমূলক নীতির সাথে একমত হতে পারে নি তারা দ্য গলের নেতৃত্বে ব্রিটেনে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করে ব্রিটিশ সরকার সিরিয়া লেবাননে জার্মানির প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়ে। জার্মানির নিকট প্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান Herr Van Henting নাৎসি প্রচারণার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় আসেন। ১৯৪১ সালের মে মাসে ইরাকে রশীদ আলী আল গিলানীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জার্মানি সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। সিরিয়ার লেবাননের জার্মান প্রভাবিত হাইকমিশনার জেনারেল ডেনজ এ কাজে জার্মানিকে সিরিয়া লেবাননের বিমান বন্দরগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়া লেবাননের ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের কাছে নিরপেক্ষতার আশ্বাস চেয়েও কোন সাড়া না পেয়ে অবশেষে সিরিয়া লেবাননে আক্রমণ করে। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীও যোগ দেয়। আক্রমণের প্রাক্কালে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল কাত্রো সিরিয়া লেবাননে ম্যান্ডেটারি শাসনের অবসান এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণার প্রতি ব্রিটিশ সরকার সমর্থন করে।
জার্মান প্রভাবিত ম্যান্ডেটরি শাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়া লেবাননবাসীর সমর্থন আদায় করাই ছিল এ ঘোষণার উদ্দেশ্য। ১৯৪১ সালের জুন মাসে মিত্রবাহিনী ইরাক, ট্রান্স, জর্ডান ও ফিলিস্তিন হতে সিরিয়া লেবাননে প্রবেশ করে তা দখল করে নেয়। ২৪ জুন জেনারেল গণ কাত্রো সিরিয়া লেবাননে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। হাই কমিশনারের বদলে তার পদবি হয় 'Delegate General plenipotentiary of Free France in the Levant, ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে জেনারেল কাত্রো শেখ তাজউদ্দিন আল- হাসানীকে প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত করেন এবং আবারো সিরিয়াবাসীর স্বাধীনতা স্বীকার করে একটি ঘোষণা প্রদান করেন। এ ঘোষণার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়া যেসব অধিকার ভোগ করবে সেগুলি উল্লেখ করেন। যেমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়া বিশ্বের যে কোন দেশে তার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে পারবে। যেসব দেশে সিরিয়া তার প্রতিনিধি প্রেরণ করবে না সেসব দেশে ফ্রান্সই সিরিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবে। একটি সিরিয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপরে ফ্রান্স সর্ব প্রকার সহযোগিতা করবে। এ বাহিনী গঠিত না হওয়া পর্যন্ত মিত্রবাহিনী সিরিয়ার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। এ দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সিরিয়া সরকার মিত্র শক্তিকে সিরিয়া ভূ-খণ্ড ও যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করবে। জেনারেল কাত্রোর এ ঘোষণায় সিরিয় জাতীতাবাদীরা আশ্বস্থ হয় । ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লেবাননে জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করে এবং রিয়াদ আল মূলহের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এ সরকার লেবনানের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী জানায়। ফরাসি সরকার মৌখিকভাবে সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও কার্যত সিরিয়া লেবানন তখনও পূর্ণস্বাধীনতা পায় নি । যেমন স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ছিল না। ফরাসি প্রতিনিধি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন পরিবর্তন বা বিলুপ্ত করে দিতে পারতেন। শুল্ক বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, বিভাগ, বেদুঈন নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব তখনও ফরাসী প্রতিনিধির নিয়ন্ত্রণে ছিল ।
১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে নতুন ফরাসি প্রতিনিধি জ্যা হেলুর নিকট সিরিয়া ও লেবাননের সরকার একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এ স্মারকলিপিতে উভয় সরকার সিরিয়া লেবাননের সংবিধান পরিবর্তন করে ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান এবং পূর্ণ প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণের দাবি জানান। কিন্তু ফরাসি প্রতিনিধি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সার্বিক ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয় বলে জানান । তিনি আরো বলেন যে ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবাননে ম্যান্ডেটরি শাসক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছে লীগ অব নেশনস থেকে। তাই আইনগতভাবে লীগ অব নেশনস বা তার উত্তরসূরী কোন সংস্থার অনুমোদন ছাড়া সে এ দায়িত্ব অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করতে পারে না। যদি তা করতেই হয় তাহলে একটি চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননকে ফ্রান্সের স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। ১৯৩৬ সালের চুক্তিটি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু হেলুর এ প্রস্তাব সিরিয়া লেবাননের জাতীয়তাবাদীরা প্রত্যাখ্যান করে। ফ্রান্সের এককালের একান্ত অনুগত লেবাননই প্রথম জবাবটি দেয়। নভেম্বর মাসের ৮ তারিখে লেবাননের সংসদ একটি বিশেষ অধিবেশন আহবান করে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান হতে ম্যান্ডেট সম্পাদিত ধারাটি বাদ দিয়ে দেয় এবং লেবাননের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা সন্নিবেশ করে। ফরাসি ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দান বিষয়ক ধারাটি সংবিধান হতে বাদ দেয়া হয়। সিরিয়ার সংসদও ১৯৪৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ম্যান্ডেট সম্পর্কিত সংবিধানরে ১১৬ নং ধারাটি বাতিল করে দেয়। উভয় দেশের সংসদ কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের ফরাসি বিরোধী পদক্ষেপ ফরাসি প্রতিনিধি হেলুকে যারপর নাই ক্ষুব্ধ করে। তিনি লেবাননের সংবিধান বাতিল ও সংসদ স্থগিত করে দেন। প্রেসিডেন্ট বিশারা আল খুরীসহ মন্ত্রীসভার অধিকাংশ সদস্যকে গ্রেফতার করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বৈরুতসহ লেবাননের অন্যান্য শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। এবং ফরাসি সেনাদের সাথে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। লেবাননের সর্বত্র জেনারেল গ্যালোর প্রতিকৃতিতে অগ্নিসংযোগ করা হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফরাসি কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করে। শুধু সিরিয়া লেবাননেই নয়, ইরাক, মিশর ও ফিলিস্তিনেও এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ব্রিটিশ সরকারও এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। কেন না যুদ্ধের প্রয়োজনে এ অঞ্চলে স্বাধীনতা বজায় রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরী। ব্রিটিশ সরকার অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট বিশারা আল খুরী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং সিরিয়া লেবাননে ফরাসি প্রতিনিধি জাঁ হেলুকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সুপারিশ করে। অন্যথায় ব্রিটিশ সামরিক হস্তক্ষেপেরও ইঙ্গিত দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে ফরাসী সরকার হেলুর বদলে জেনারেল কাত্রোকে আবারো ফরাসি প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়। এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে । ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাস হতেই শুল্ক বিভাগসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলি সিরিয়া ও লেবানন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। তবে ফরাসি সরকার পুরোপুরিভাবে সিরিয়া লেবনাননের উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজী ছিল না। সিরিয়া লেবাননের সাথে ফ্রান্স ১৯৩৬ সালের চুক্তির অনুরূপ একটি চুক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করেছিল যার মাধ্যমে দেশ দুটিতে স্বাধীনতার পরও ফরাসি প্রভাব বজায় রাখা হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে সিরিয়া ও লেবাননবাসীর মধ্যে যে মানসিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তাকে একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুতেই পরিতৃপ্ত করা সম্ভব ছিল না। এ বাস্তবতাটি ফরাসি কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পারে নি। তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননকে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর নীতি গ্রহণ করে। বৈরুতে ফরাসি সেনা অবতরণ শুরু হয় । জেনারেল বিয়া প্যারিস হতে চুক্তির একটি খসড়া নিয়ে আসেন। কিন্তু সিরিয়া ও লেবাননের সরকার এ চুক্তি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আবারো দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ফরাসি সরকার। কিন্তু এতে আন্দোলন স্তিমিত না হয়ে আরো বেগবান হয়ে উঠে। এ পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সিরিয়া লেবাননের সরকার প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ অবশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়া ও লেবাননকে স্বীকৃতি প্রদান করে । ১৯৪৫ সালের ২২ মার্চ উভয় দেশই আরব লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আরব লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই মাসে রাষ্ট্র দুটি মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে যোগদানের যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু তারপরও উভয় দেশকেই একটি সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও ইঙ্গ-ফরাসি সেনাবাহিনী তখনো সিরিয়া লেবাননে অবস্থান করছিল। যে কোন স্বাধীন দেশের জন্য তা ছিল অস্বস্তিকর। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্রমে ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহারের ইঙ্গ-ফরাসি ঘোষণা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তোলে। সিরিয়া লেবানন-বাসী ক্রমে ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহারের এ ঘোষণার দীর্ঘ সূত্রিতার আভাস পায়। ১৯৪৬ সালের মে মাসে উভয় দেশের সরকার বিষয়টি জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে। নিরাপত্তা পরিষদ যত দ্রুত সম্ভব সিরিয়া লেবানন হতে সকল বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হল। কিন্তু প্রস্তাবটিতে কোন সময় সীমা উল্লেখ না থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। এবং তা বাতিল হয়ে যায়। যা হোক প্রস্তাবটি পাস না হলেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স এ প্রস্তাব অনুযায়ী সিরিয়া লেবানন হতে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। ১৯৪৬ সালের ১৭ এপ্রিল সিরিয়া থেকে এবং ৩১ ডিসেম্বর লেবানন হতে শেষ বিদেশি সৈন্য অপসারিত হয়। এবং তারা বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৭ এপ্রিল সিরিয়ার এবং ৩১ ডিসেম্বর লেবাননের জাতীয় দিবস।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]