ফ্রান্সের সাথে চুক্তি, ১৯৩৬
ফ্রান্সের সাথে সিরিয়ার চুক্তি ১৯৩৬ পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৃহত্তর সিরিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এ চুক্তি একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এ চুক্তির ঐতিহাসিক পটভূমি নিম্নে তুলে ধরা হল :
ম্যান্ডেটরি শাসক হিসেবে সিরিয়ায় ফরাসিদের আগমন এ অঞ্চলের জনগণের মনঃপুত না হলেও প্রথমদিকে তারা ম্যান্ডেটরি বিরোধী কোন প্রকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। ফয়সালের মত যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং সংগঠিত রাজনৈতিক দলের 'অনুপস্থিতিই ছিল এর মূল কারণ। ম্যান্ডেটরি শাসনের সূচনালগ্নে সিরিয়ায় স্বশাসনের উপযুক্ত কোন উন্নত সংস্থা ছিল না। জনগণের গণতন্ত্র ও সংসদীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। ধীরে ধীরে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ সংসদীয় ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রশাসনকি ব্যবস্থা গড়ে তুললেও সংসদের ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। এছাড়া প্রশাসনে স্থানীয়দের অংশ গ্রহণের সুযোগ ছিল না বললেই চলে । জাতীয়তাবাদীরা ম্যান্ডেটরি শাসনের প্রতি বিরূপ হওয়ায় সাধারণত ভাবমূৰ্তিহীন শ্রেণীর নেতৃবৃন্দই এ শাসনের সাথে সহযোগিতা করে। ফলে তাদের নেতৃত্বে সিরিয়ার জনগণের আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয় নি। অন্যদিকে প্রশাসনের উচ্চ পদগুলি ছিল ফরাসিদের দখলে। হাইকমিশনারের কর্তৃত্ব ছিল সীমাহীন । হাইকমিশনারের জারিকৃত যে কোন আদেশ ম্যান্ডেটাধীন এলাকায় আইন বলে গণ্য হত। সিরিয়া লেবাননে নিযুক্ত প্রথম ৩ জন হাইকমিশনার সেনাবাহিনীর লোক হওয়ায় তাদের কর্তৃত্বের মাত্রা ছিল আরো বেশি। ১৯২৫ সালে সংগটিত জাবাল আল দ্রুজের বিদ্রোহ দমনে জেনারেল মরিস সারেয়ার আপোষহীন মনোভাব বিদ্রোহটিকে আরো বেশি উসকে দেয় এবং তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ দমনের জন্য জেনারেল মরিস সারেয়াকে প্রত্যাহার করে নিয়ে প্রথমবারের মত ১৯২৬ সালের জুন মাসে সিরিয়া লেবাননে একজন বেসামরিক হাইকমিশনার নিযুক্ত করা হয়। নতুন হাই কমিশনার আরী দ্য জুভে আপোষ- মিমাংসার পথ অনুসরণ করে। তিনিই প্রথম লীগ অব নেশনসের স্থায়ী ম্যান্ডেট কমিশনের সাথে মন্তব্য করেন যে, ১৯২২ সালের ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তির অনুরূপ একটি চুক্তি ফ্রান্স ও সিরিয়ার মধ্যে ও সম্পাদিত হওয়া উচিত। কিন্তু হাইকমিশনার হিসেবে সিরিয়া-লেবাননে তার কার্যকালের মেয়াদ ছিল মাত্র কয়েকমাস। তার সিরিয়া ত্যাগের পর বেশ কিছুকাল এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি সাধিত হয় নি। উপরন্তু ১৯৩০ সালের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে সিরিয়ার সংসদ ও ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের মধ্যে নতুন করে মতানৈক্য দেখা দেয়ায় হাইকমিশনার এক আদেশ বলে সংসদ বিলুপ্ত করে দেন। এবং নিজে নতুন একটি সংবধিান জারি করেন। জারিকৃত সংবিধানের অধীনে ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ১৯৩২ সালের ৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও জাতীয়তাবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে নি। নির্বাচিতদের অধিকাংশই
ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার পক্ষপাতি ছিলেন। তারা মুহাম্মদ আলী বে আল-আবিদকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। তিনি একজন অভিজাত ব্যক্তি হাক্কী আল আজমের উপর মন্ত্রীসভা গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। মন্ত্রীসভায় কয়েকজন জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্ন নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করে আযম বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। ১৯৩০ সালে সম্পাদিত ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি এবং এরই ধারাবাহিকতায় লীগ অব নেশনসের সদস্যপদ লাভ সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী মহলকে প্রভাবিত করে। তারা সিরিয়ার জন্যও অনুরূপ একটি চুক্তি দাবী করতে থাকে। মন্ত্রিসভা ও হাইকমিশনারের মধ্যে ফরাসি সিরিয়া চুক্তির সম্ভাব্য ধারাগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ ও সিরিয়া পার্লামেন্টের মধ্যপন্থিদের সাথে কিছু মৌলিক বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়ায় ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে মন্ত্রীসভার জাতীয়তাবাদী সদস্যরা পদত্যাগ করেন । ফ্রান্সের সাথে সহযোগিতার মনোভাবাপন্ন এমন সদস্যদের দিয়ে শূন্য পদগুলি পূরণ করা হয়। নভেম্বর মাসে পুনর্গঠিত মন্ত্রীসভা ও নবনিযুক্ত হাইকমিশনার কোঁদ দ্য মারতেল চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৩০ সালের ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তির সাথে অনেক পার্থক্য ছিল। বলা হয় এ চুক্তির মেয়াদ হবে সিরিয়ার লীগ ভুক্তির দিন হতে পরবর্তী ২৫ বছর। পর্যায়ক্রমে সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আরো কিছু চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া কর্তৃপক্ষের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সিরিয়া কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং এসব বিষয়ে সন্তোষজনক অগ্রগতির পর ফ্রান্স সিরিয়ার লীগভুক্তির বিষয়ে সুপারিশ করবে। সিরিয়ার সেনাবাহিনীও পুলিশ বাহিনী গঠনে ফ্রান্স সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তবে পাশাপাশি ফরাসি সেনাবাহিনী সিরিয়ায় অবস্থান করবে। কর ও রাজস্ব বিষয়ক ক্ষমতাসহ যৌথ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি ফরাসি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। চুক্তিটির সর্বত্র ফরাসি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং জাবাল আল দ্রুজ ও আলাবি রাজ্যকে সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত না করায় জাতীয়তাবাদীরা এর বিরোধীতা করে। সিরিয়ার সর্বত্র চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। সিরিয়ার প্রবীণ জাতীয়তাবাদী নেতা হাশিম আল আতাশী সারা সিরিয়ায় ৬০ দিনের ধর্মঘটের ডাক দেন। জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ফরাসি কর্তৃপক্ষকে বুঝাতে সক্ষম হন যে তারাই সিরিয়াবাসীর পক্ষে চুক্তি করার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। ইতোমধ্যে সিরিয়ার জাতীয়তাবাদীদের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য আতা আইয়ুবীর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ফরাসি সরকার হাশিম আল আতাশিকে চুক্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য প্যারিসে আমন্ত্রণ জানান । আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৯৩৬ সালের ২১ মার্চ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনাসহ সিরিয় প্রতিনিধি দল প্যারিস গমন করে। হাশিম আল আতাশীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ছিলেন জামিল মারদাম বে, সা'দুল্লা আল-জাবেরি, ফরাসি আল খুরী, এডমন্ড হোমসি এবং মুস্তফা আল- শিহাবি। আলবার্ট সারেয়া সরকারের বিদেশমন্ত্রী এম. ফ্লানদিন সিরিয় প্রতিনিধি দলকে ২ এপ্রিল প্যারিসে স্বাগত জানান। কিন্তু ফ্রান্সে পৌছেই সিরিয়ার স্বার্থের
অনুকূলে কোন চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে ফরাসি সরকারের আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। চুক্তি সম্পাদনের নামে সিরিয় প্রতিনিধি দলকে প্যারিসে আমন্ত্রণের মাধ্যমে ফরাসি সরকার আসলে সিরিয়ার মান্ডেট বিরোধী আন্দোলনকে প্রশমিত করতে চেয়েছিল। প্যারিসে সিরিয় দাবিগুলি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে ফরাসি সরকারের অনীহা থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ফলে শুরুতেই আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে হাশিম আল আতাশীকে সম্ভাব্য চুক্তির একটি খসড়া প্রদান করা হয়, যার শর্তাবলি ছিল সিরিয়াবাসীর স্বার্থ পরিপন্থি। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিবর্তন সিরিয়াবাসীর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। সারেয়ার বদলে বামপন্থীদের যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন লিও ব্লুম। বিদেশমন্ত্রী হন দেলবস। ফরাসি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন না হলে আদৌ কোন চুক্তি স্বাক্ষরিত হত কিনা এ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কেননা বামপন্থীদের এ মন্ত্রীসভা ছিল উপরের প্রকৃতির এবং সিরিয়াবাসীর প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল। যে কারণে সিরিয়ার স্বার্থের অনুকূলে একটি চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। চুক্তিটি সম্পাদনে প্রধানমন্ত্রী ব্লুম ছাড়াও উদারপন্থী আন্ডার সেক্রেটারি পিয়েরে ভিনু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চুক্তির খসড়া উভয় পক্ষের সম্মতি লক্ষ করে । ফ্রান্সের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ফরাসি বিদেশ দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি পিয়েরে ভিনু এবং সিরিয়ার পক্ষে প্রতিনিধি দলের প্রধান হাশিম বে-আল আতাশী ।
ফরাসি-সিরিয় চুক্তি ১৯৩৫ এর ধারা :
ফরাসি-সিরিয় চুক্তি ১৯৩৬ এর কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ধারা রয়েছে। উল্লেখ্য যে চুক্তির শুরুতেই স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে সিরিয়ার অগ্রগতি সন্তোষজনক বলে মন্তব্য করা হয়। বলা হল ফ্রান্স ও সিরিয়ার মধ্যকার এ মৈত্রী ও বন্ধুত্বমূলক চুক্তিটির মেয়াদ হবে সিরিয়ার লীগ ভুক্তির দিন হতে পরবর্তী ২৫ বছর। মূল চুক্তির সাথে একটি মিলিটারি কনভেনশন এবং আরো কিছু উপচুক্তি সংযুক্ত হয়েছিল । চুক্তির মূল ধারাগুলি নিম্নে তুলে ধরা হল :
(এ) এ বছরের মধ্যে সিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করবে এবং স্বাধীন সিরিয়াকে লীগ অব নেশনসের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ফ্রান্স সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। (বি) দুটি দেশ পরস্পরের সাথে আলোচনা করে তাদের বিদেশ নীতি নির্ধারণ করবে বলে স্থির হয়। কোন পক্ষই তৃতীয় কোন শক্তির সাথে এমন কোন সম্পর্ক স্থাপন করবে না যা ফরাসি সিরিয় চুক্তির শর্তাবলীর সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। দুই পক্ষের কোন পক্ষ যদি তৃতীয় কোন পক্ষের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে উভয় পক্ষ একযোগে কাজ করবে। (সি) চুক্তির সাথে সংযুক্ত সামরিক কনভেনশনটিতে বলা হয় যে উভয় পক্ষের মধ্যে সামরিক মৈত্রীও স্থাপিত হবে। ফ্রান্স সিরিয়ায় দুটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অধিকার লাভ করবে এবং তা চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্রান্স ব্যবহার করবে। ঘাটি দুটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত
না হওয়া পর্যন্ত সিরিয়া ফ্রান্সকে দামেস্ক ও আলেপ্পোর নিকটস্থ দুটি ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিবে। ফরাসি সামরিক উপদেষ্টাদের পরামর্শক্রমে সিরিয়া সেনাবাহিনী গঠিত হবে এবং ফ্রান্স সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করবে। যুদ্ধের সময় সিরিয়া ফ্রান্সকে তার স্থল পথ, জলপথ ও আকাশপথ ব্যবহারের সুবিধাসহ যাতায়াতের ক্ষেত্রে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে।
(ডি) প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সিরিয়া ফরাসি উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিতে সম্মত হয়। ওসমানিয় শাসনামল থেকেই ফ্রান্স সিরিয়ার Capitulation সুবিধা ভোগ করে আসছিল। কয়েক শতাব্দি ধরে ভোগ করে আসা এ বিশেষ সুবিধাটি ফ্রান্স পরিত্যাগ করার সদিচ্ছা প্রকাশ করল। তবে সিরিয়ায় বসবাসকারী বিদেশিদের নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিরিয়ায় ফ্রান্সের একজন রাষ্ট্রদূত থাকবেন এবং তিনি সিরিয়ায় নিযুক্ত সকল বিদেশী কুটনীতিকের চেয়ে অধিক মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হবেন। সিরিয় সরকার অন্যান্য দেশে তার প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারবে। যেসব দেশে সিরয় সরকারের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না সেসব দেশে ফ্রান্সই সিরিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবে। আর সিরিয় সরকার সিরিয়ায় যেকোন ফরাসি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করবে। সিরিয় সরকার সে দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে সংবিধানে বর্ণিত সুযোগ-সুবিধাগুলি প্রদানের নিশ্চয়তা দেয় ।
সংযুক্ত ধারা :
ফরাসি সিরিয় মূল চুক্তির সাথে সংযোজিত উপচুক্তিতে সিরিয়ার সাথে জাবাল আল দ্রুজ ও আলাবি রজ্যের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। বলা হয় অঞ্চল দুটি সিরয়ার সাথে সংযুক্ত হবে। তবে সেখানে ৫ বছরের জন্য ফরাসি সেনাবাহিনী অবস্থান করবে। কিন্তু আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাটিকে সিরিয়ার সাথে সংযুক্ত না করে পূর্বের মত একটি স্বায়ত্তশাসিত জেলা হিসেবেই সিরিয়া থেকে পৃথক রাখা হল ।
সিরিয়া লীগ অব নেশনস এর সদস্য হওয়ার পর চুক্তিটি কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর জন্য কয়েকটি শর্তও ছিল। (১) নির্বাচনের পর নবগঠিত সরকার কর্তৃক চুক্তিটি অবশ্যই স্বাক্ষরিত হতে হবে। (২) এটি ফরাসি ও সিরিয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। (৩) চুক্তিটি অনুমোদনের পর প্রশাসন কাঠামো যথারীতি গড়ে তোলার জন্য ৩ বৎসর সময় দিতে হবে। এ সময়ের পরেই মাত্র সিরিয়া লীগ অব নেশনসের সদস্য হবার জন্য আবেদন করতে পারবে ।
ফ্রান্সের সচেতন নাগরিকরা চুক্তিটি সমর্থন করে। বামপন্থি যুক্তফ্রন্টের অন্যতম সদস্য পিয়েরে ভিনু মন্তব্য করেন যে প্রস্তাবিত চুক্তিটি ফরাসি-সিরিয়ার পুরাতন সম্পর্কের স্থলে যুগোপযোগী নতুন সম্পর্কের সূচনা করবে। ১৯৩০ সালের ইঙ্গ- ইরাকি চুক্তির সাথে অনেক দিক দিয়ে সাদৃশ্য থাকলেও ফরসি-সিরিয়া চুক্তি কোন
কোন দিক দিয়ে আরো উন্নততর বলে তিনি মন্তব্য করেন। দক্ষিণপন্থীদের কোন কোন মহলও একে স্বাগত জানায়। স্বানমধন্য 'লুতাম' পত্রিকা এক সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করে যে চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স সিরিয়ায় তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পথে একটি দীর্ঘ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য অনেকে চুক্তিটির বিরুদ্ধে ছিল ।
সিরিয়াতেও চুক্তিটি অভিনন্দিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রতিনিধি দল সিরিয়া প্রত্যাবর্তন করলে প্রতিনিধি দলকে ব্যাপক সম্বর্ধনা দেয়া হয়। জাতীয় ব্লকের নেতৃবৃন্দ চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে বলে দলের সমর্থকরা চুক্তিটি সমর্থকে পরিণত হয়। চরমপন্থী বলে পরিচিত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দও চুক্তিটি সমর্থন করেন। ম্যান্ডেট ব্যবস্থার তীব্র বিরোধী সিরিয়া ফিলিস্তিন কমিটির সদস্য শাকিব আরসালার মন্তব্য করেন যে, এ চুক্তি ফ্রান্স ও সিরিয়ার মধ্যে যুগ সঞ্চিত সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্বের শুভ সূচনা করেছে। কমিটির অন্য একজন সদস্য আলেপ্পোর ইহসান আল-জাবেরী চুক্তিটি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, “এ চুক্তি সিরিয়ার প্রকৃত স্বাধীনতার পথ সুগম করেছে।”
ফরাসি-সিরিয় চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সিরিয়ায় ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় ব্লক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফারিম আল-খুরী সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। মুহাম্মদ আলী আল আবিদের স্থলে আতাশী রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন। তার নির্দেশে জামিল মারদাম শুধু জাতীয় ব্লক হতে সদস্য নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভা ফরাসি সিরিয় চুক্তিটি সংসদে পেশ করলে সংসদ সানন্দে ইহা অনুমোদন করে। কিছু পরিমাণে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে জাবাল আদ দুরুজ ও আলাবি এলাকাকে সিরিয়ার সাথে একত্রিত করা হয়। মাযহার রাসমানকে আলাবি এলাকার এবং নাসিব আল-বাকারীকে জাবাল আদ দুরুজের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৭ সালের প্রথম দিক হতেই সিরিয় সরকার অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী হয়। বার্ষিক বাজেট সম্পর্কে সরকার বিনা বাধায় কাজ করার অধিকার লাভ করে । সরকার পুলিশ বাহিনীর সীমিত পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে ।
কিন্তু শীঘ্রই অবস্থা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। আলেকজান্দ্রেত্তা জেলার আরব অধিবাসীবৃন্দ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ফ্রান্স তুরস্ককে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যার ফলে ক্রমে ক্রমে জেলাটি তুরস্কের কুক্ষিগত হয়। এ ঘটনায় একদিকে যেমন সিরিয়াবাসীর মনে ফরাসি বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে, অন্যদিকে সিরিয়ার প্রতি ফ্রান্সের সহানুভূতিহীনতা প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় জাজিরা এলাকায় যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলতেছিল তাতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলাবি এলাকায়ও অনুরূপ ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। এসব ধর্মপ্রচারকদের প্রতি ম্যান্ডেটরি প্রশাসন কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি বা সমর্থন আছে মনে করে ফ্রান্সের প্রতি অনেকেই আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ।
ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণেও চুক্তিটি কার্যকরী হতে পারে নি। রাজনৈতিক স্থায়িত্বের অভাব ফরাসি তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রায় এক বৎসরকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পর ফরাসি সিরিয়া খসড়া চুক্তি প্রণয়নকারী লিও ব্লুম সরকারের পতন ঘটে। এরপর ক্ষমতায় আসীন দক্ষিণপন্থী দলগুলি ও সরকার সিরিয়াতে ফরাসি প্রভাব হ্রাসের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। স্বাভাবিকভাবেই এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে তারা সম্মত হয় নি। দ্বিতীয়ত জার্মানীতে নাৎসী দল এবং ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের কার্যকলাপের ফলে আরেকটি ইউরোপীয় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। আসন্ন যুদ্ধের প্রাককালে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শক্তি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল দুর্বল করতে কোন ফরাসি সরকারই রাজী ছিল না। প্রধানমন্ত্রী জামিল মারদম প্যারিসে গিয়ে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বনে'র সাথে আলাপ-আলোচনা করলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নি। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ বনে (বিদেশমন্ত্রী) সংসদে ঘোষণা করেন যে সরকার ফরাসি সিরিয় চুক্তি অনুমোদন করবে না এবং এমনকি সংসদেও পেশ করবে না। পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে ফরাসি শক্তি ও প্রভাব ক্ষুন্ন করতে পারে এমন কোন পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করবে না বলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন।
ফরাসি সংসদে চুক্তিটি অনুমোদন হবে না এমন সংবাদে সিরিয় জনসাধারণ হতাশ হয়ে পড়ে। ৩১ ডিসেম্বর সংসদের এক অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে ১৯৩৬ সালে চুক্তি অটো অনুমোদিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। সিরিয়ার অধিকার, অখণ্ডতা ও স্বধীনতা রক্ষার প্রশ্নে সরকারকে সজাগ হতে অনুরোধ করা হয়। ফ্রান্স প্রেরিত যেকোন কমিশনের সাথে সহযোগিতা করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ফরাসি কর্মচারীদের সহায়তায় জাবাল-আল-দ্রুজ, আলাবি ও জাজিরা এলাকায় যে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন চলছে তা কঠোর হস্তে দমন করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয় ।
ফ্রান্সের বিরোধ মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। আলেকজান্দ্রেত্তা জেলার ব্যাপারে ফরাসি সরকারের ভূমিকা এবং ফিলিস্তিনে আরব বিদ্রোহ জনসাধারণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জাতীয় ব্লক দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং ফরাসি বিদ্বেষী শাহবন্দর চুক্তির পক্ষেও বিভিন্ন ফরাসি নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস পান ।
১৯৩৮ সালের শেষ দিকে নতুন হাইকমিশনার গেব্রিয়েল পিউ সিরিয়ায় আগমন করলে জাতীয়তাবাদীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । নভেম্বরে তিনি এমন একটি অধ্যাদেশ জারি করেন যা সিরিয়ার মুসলমানদের কাছে অপমানজনক মনে হয় । ইতোপূর্বে তদানীন্তন হাইকমিশনার কোৎ দ্য মারতেল প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব অধিকারের প্রশ্নে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা নির্ণয় করে আইন রচনায় উদ্যোগী হলে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। নতুন হাইকমিশনার পিউ এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ
নিয়ম পরিবর্তন করলে ব্যাপক গোলযোগ দেখা দেয়। এ আদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরও কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বলে গণ্য করায় মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ব্যাপক জনমতের চাপে মারদাম মন্ত্রীসভা হাইকমিশনারের নিকট এ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৩৬ সালের চুক্তির পরও এ ধরনের অধ্যাদেশ জারীর অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে ফরাসি মন্ত্রিসভা ফরাসি কর্মচারীদের বিভিন্ন এলাকায় যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উসকানি দিচ্ছে এরও ব্যাপক সমালোচনা করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ফরাসি-সিরিয়া চুক্তিটি সম্পাদনের অল্প কিছুকাল পরেই ১৯৩৬ সালের ১৩ নভেম্বর ফ্রান্স লেবাননের সাথে ও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফ্রান্সের পক্ষে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন লেবাননে নিযুক্ত ফরাসি হাইকমিশনার কোৎ দ্য মারতেল এবং লেবাননের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ইসমাইল এদ্দি। চুক্তিটিকে ফরাসি সিরিয় চুক্তির অবিকল নকল বলা যায় । তবে আঞ্চলিক ও সংখ্যালঘু প্রশ্নে লেবাননে সিরিয়ার তুলনায় কিছুটা বৈচিত্র থাকায় ফরাসি লেবাননি চুক্তিতে এসব বিষয়ের কিছু বিশেষ ধারা সংযোজিত হয়েছিল যা ফরাসি-সিরিয় চুক্তির তুলনায় কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল। যেমন লেবাননে ফরাসি সেনার সংখ্যা ও অবস্থানের সময় সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় নি। আবার লেবাননে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস থাকায় এখানকার পরিস্থিতি ছিল সিরিয়ার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ফরাসি- লেবাননি চুক্তিতে তাই লেবাননি সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পদগুলিতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। যাহোক, পরবর্তীকালে এ চুক্তিটিও ফরাসি পার্লামেন্টে অনুমোদিত না হওয়ায় তা কার্যকর হতে পারে নি।
সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, ফরাসি-সিরিয় লেবাননী চুক্তি-১৯৩৬, ফরাসি সংসদ অনুমোদন না করায় চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। এতে সিরিয়া-লেবাননের জনসাধারণ চরম হতাশ হয়ে পড়ে। তারা ফরাসি সরকার ও ম্যান্ডেটরি শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে । সিরিয়া-লেবাননের জাতীয়তাবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার নতি স্বীকার করে। এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় দেশই সিরিয়া-লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। ফলে ১৯৪৬ সালে সিরিয়া ও লেবানন একযোগে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ।
লিভান্টে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ
লিভান্টে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। নিম্নে লিভান্টে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ সম্পর্কে
আলোচনা করা হল :
লিভান্ট সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে লিভান্ট এর অবস্থান কোথায় তা জানা বিশেষভাবে প্রয়োজন। এখানে লিভান্ট এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
ইংরেজি Levant এর অর্থ পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল বা দেশসমূহ। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে ১৫১৬ সালে তুর্কি শাসনে আসার পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া আরব মুসলমানদের শাসনাধীনে ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৃহত্তর সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলসমূহ লিভান্ট নামে পরিচিত ছিল। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি বৃহত্তর সিরিয়া নামেও পরিচিত ছিল। বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও জর্ডান বৃহত্তর সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও বর্তমান তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত এন্টিওক এবং আলেকজান্দ্রেত্তা বৃহত্তর সিরিয়ায় অংশ ছিল । তাই ১৯১৮ সালের পূর্বেকার লিভান্ট বা সিরিয়া বলতে আমরা বৃহত্তর সিরিয়াকেই বুঝব যা ওসমানিয় শাসনামলে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিরিয়ায় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধের পর এখানে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন চালু করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ লিভান্ট অঞ্চল চাঞ্চল্যকর বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণে বৃহৎ শক্তিবর্গের দৃষ্টি এ অঞ্চলের উপর পড়ে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন লিভান্টে হস্তক্ষেপ করে। এদিকে ফরাসী সরকার এ অঞ্চলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৩৬ সালের ফরাসি সিরিয় চুক্তিটি সংসদে অনুমোদন না করায় বাতিল তা হয়ে যায়। ফলে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে 1
নাৎসী জার্মানি ও ফ্যাসিস্ট ইতালির জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শুরুতেই ফ্রান্স পূব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য সিরিয়া লেবাননে প্রত্যক্ষ শাসন চালু করে। সংবিধান মূলতবী ঘোষণা করা হয় এবং মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। যদিও প্রেসিডেন্ট তার পদে বহাল ছিলেন। কিন্তু তার কোন ক্ষমতা ছিল না। যুদ্ধের প্রথম মাসেই জেনারেল ভেগার নেতৃত্বে ফ্রান্স সিরিয়ায় ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। উদ্দেশ্য ছিল যদি যুদ্ধ পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্ত ১৯৪০ সালের জুন মাসে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেয়ায় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সিরিয়া লেবানন ফ্রান্সের জার্মান প্রভাবিত মার্শাল পেতার নেতৃত্বে গঠিত ‘Vichy Government' বা ভিসি সরকারের অধীনে চলে যায়। জেনারেল ভেগার বদলে জেনারেল মিথেল হাওজার নিকট প্রাচ্যে ফরাসি বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন। অন্যদিকে যারা পেঁতা সরকারের জার্মানির নিকট আত্মসমর্পণমূলক নীতির সাথে একমত হতে পারে নি তারা দ্যা গলের নেতৃত্বে ব্রিটেনে একটি প্রবাসি সরকার গঠন করে। বিট্রিশ সরকার লিভান্টে অর্থাৎ বৃহত্তর সিরিয়া লেবাননে জার্মানির প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়ে। জার্মানির নিকট প্রাচ্য বিষয়ক বিদেশ দপ্তরের প্রধান Herr Von Henting নাৎসি প্রচারণার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় আসেন। ১৯৪১ সালের মে মাসে ইরাকে রশীদ আলী আল গিলানীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জার্মানি সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে । সিরিয়া-লেবাননের জার্মান প্রভাবিত হাইকমিশনার জেনারেল ডেনজ এ কাজে
জার্মানিকে সিরিয়া লেবাননের বিমান বন্দরগুলি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়া লেবাননের ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের কাছে নিরেপেক্ষতার আশ্বাস চেয়েও কোন সাড়া না পেয়ে অবশেষে সিরিয়া লেবানন আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীও যোগ দেয়। আক্রমণের প্রাককালে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল কাত্রো লিভান্টে অর্থাৎ সিরিয়া লেবাননে ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণার প্রতি ব্রিটিশ সরকার সমর্থন জ্ঞাপন করে । জার্মান প্রভাবিত ম্যান্ডেটরি প্রশাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়া লেবাননবাসীর সমর্থন আদায়ই ছিল এ ঘোষণার মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য। ১৯৪১ সালের জুন মাসে মিত্রবাহিনী ইরাক, ট্রান্স জর্ডান ও ফিলিস্তিন হতে সিরিয়া লেবাননে প্রবেশ করে তা দখল করে নেয়। ২৪ জুন জেনারেল গল কাত্রোকে লিভান্ট বা সিরিয়া লেবাননে স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। হাইকমিশারের বদলে তার পদবি হয় Delegate General Plenipotentiary of Free France in the
Levant.
সিরিয়া ও লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব (১৯৪১-১৯৪৬)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সিরিয়া ও লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘটনাসমূহ মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা আন্দোলন ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত নিম্নে তুলে ধরা হল :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সিরিয়ায় সর্বপ্রকার সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। জাতীয় ব্লকের নেতৃবৃন্দের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। এবং কয়েকজনকে কারাদণ্ড ও নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৪০ সালের মে মাস পর্যন্ত জেনারেল ভেগা নিকটপ্রাচ্যে ফরাসি বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। এরপর জেনারেল মিথেল হাওজার তার স্থলাভিষিক্ত হন। এদিকে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ উদ্বেগের সাথে ইউরোপে যুদ্ধের অগ্রগতি লক্ষ্য করছিল। জার্মান বাহিনী কর্তৃক প্যারিসসহ প্রায় সমগ্র উত্তর ফ্রান্স দখল এবং মার্শাল পেঁতা কর্তৃক আত্মসমর্পণ সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জেনারেল মিথেল হাওজার এক ঘোষণার বলেন যে ফ্রান্সে স্বাক্ষরিত যুদ্ধ বিরতি সিরিয়াও মেনে চলবে। ম্যান্ডেটরি শাসনাধীন এলাকার কোন পরিবর্তন হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বৃহত্তর সিরিয়া ও লেবাননে জার্মান ও ইতালিয় প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনায় বৃটিশ সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর এক ঘোষণায় সিরিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ব্রিটিশ মনোভাব ব্যাখ্যা করে। জেনারেল মিথেল হাওজারের অস্ত্র সংবরণ সম্পর্কিত ঘোষণার উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয়। সে জার্মানি বা ইতালি কর্তৃক আক্রান্ত হলে ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ সিরিয়া
লেবানন রক্ষা করার জন্য অস্ত্র ধারণ করবেন কিনা সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখা হয় নি। ব্রিটিশ ঘোষণায় স্পষ্ট করে বলা হয় যে অবন্ধুসূলভ মনোভাবাপন্ন কোন দেশ সিরিয়া লেবনানন দখল করতে চেষ্টা করলে ব্রিটিশ সরকার নিষ্ক্রিয় থাকবে না। এবং যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার স্বাধীনতা ব্রিটিশ সরকারের অবশ্যই থাকবে ।
পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে বৃটিশ সরকারের উদ্বেগ আরো বৃদ্ধি পায়। আগস্ট মাসে একটি ইতালিয় যুদ্ধ বিরতি কমিশন বৈরুতে আগমন করে। সিরিয়া লেবানকে অক্ষ শক্তির দিকে নিয়ে যাওয়াই সে কমিশনের মূখ্য উদ্দেশ্য এ ব্যাপারে কারো মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। জার্মানিও ক্রমে ক্রমে সিরিয়া লেবাননে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। পিউ এর স্থলে জার্মান ঘেষা চিয়াপকে হাইকমিশনারের নিযুক্ত করা হয। সিরিয়া আগমনের পথে বিমান আক্রমণে তার মৃত্যু হলে অন্য একজন জার্মান ঘেষা জেনারেল ডেনজ এর স্থলাভিষিক্ত হয়। মিত্র শক্তির প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন কিছু সংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক লোককে বন্দী করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সিরিয়া লেনাননের সাথে ট্রান্সজর্ডান ও ফিলিস্তিনের যাতায়াত ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ।
পেঁতা সরকারের আত্মসম্পূর্ণমূলক নীতির সাথে যারা একমত হতে পারে নি তাদের অনেকেই জার্মান বিরোধী কর্মপন্থা গ্রহণ করার জন্য ব্রিটেনে উপস্থিত হন এবং দ্যা গলের নেতৃত্বে একটি পাল্টা নির্বাসিত সরকার গঠন করে। ইন্দোচীনে ফরাসি গভর্ণর জর্জ কাত্রো পদত্যাগ করে দ্যা গলের সাথে যোগ দিলে স্বাধীন ফ্রান্স আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে ।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও দ্রব্য সামগ্রীর চড়া মূল্যের ফলে যে গণ অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল তা ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। মার্চ মাসে জাতীয়তাবাদী নেতা শুকরী আল-কুয়াতলী আন্দোলনের লক্ষ ব্যাখ্যা করে একটি ইস্তেহার প্রচার করেন। আমলা শাসনের সমালোচনা করে তিনি একে গণবিরোধী বলে অভিহিত করেন এবং প্রতিনিধিত্বমূল সরকারের দাবি জানান। বাহিজ আল-খাতিবের নেতৃত্বে ‘পরিচালক' পরিষদ পদত্যাগ করে। হাইকমিশনার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা চালান এবং দামেস্কের অন্যতম অভিজাত বংশের খালিদ আল আযমের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করতে সক্ষম হয়।
ইরাকে রশীদ আলী আল-গায়লানীর নেতৃত্বে সংঘটিত ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্ৰোহ সিরিয়ার রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণে সাহায্য করে। ইরাক হতে ব্রিটিশ প্রভাব বিলুপ্তির আশায় জার্মানি রশিদ আলীকে সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে প্রয়াস পায় । এবং পেঁতা সরকার জার্মানীকে সিরিয়া লেবাননের বিমান বন্দর গুলি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। বেশ কিছু জার্মান বিমান বৈরুত হয়ে ইরাকে যায়। ব্রিটিশ সরকার এ অবস্থা চলতে দিতে রাজী ছিল না। কায়রোয় অবস্থিত ব্রিটিশ প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন
আলিভার লিলটন মধ্যপ্রাচ্য মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওয়াভেল এবং ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হেরল্ড ম্যাকমাইকেল সিরিয়া লেবাননের ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে আশ্বাস কামনা করেও কোন সাড়া পান নি। War Council বা সমর পরিষদের নির্দেশে মধ্যপ্রাচ্য অবস্থিত ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষ সিরিয়া লেবানন আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একক ব্রিটিশ অভিযানের বিরুদ্ধে দ্যা গলের স্বাধীন ফ্রান্স সরকার মত প্রকাশ করায় একটি ক্ষুদ্র ফরাসি বাহিনী অভিযানের সাথে যুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
সিরিয়া লেবাননে অভিযান প্রেরণ করতে যে পরিমাণ সেনা প্রয়োজন তা দেওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পেরে জেনারেল ওয়াভেল দ্বিধাবোধ করছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চার্চিল প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক সৈন্য নিয়েও আক্রমণ করার উপর জোর দেন। শেষ পর্যন্ত স্যার হেনরী মেইটল্যান্ড উইলসনের অধীনে তোব্রুক হতে আনীত সপ্তম অস্ট্রেলিয় ডিভিশনের দুটি বিগ্রেড, প্রথম অশ্বারোহী ডিভিশনের একাংশ, ইরিত্রিয়া হতে আনীত পঞ্চম ভারতীয় ব্রিগেড এক স্কোয়াড্রন সাজুয়া গাড়ী একটি কমান্ডো বাহিনী প্রস্তুত হয়। স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের মাত্র ৬ ব্যাটালিয়ান সৈন্য এ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। ১৯৪১ সালের জুন মাসের ৮ তারিখে আক্রমণ শুরু হয় মিত্র বাহিনী ইরাক, ট্রান্সজর্ডান ও পালেস্টাইন হতে সিরিয়া লেবাননে প্রবেশ করে। ম্যান্ডেটরি সেনা বাহিনী দৃঢ়তার সাথে আক্রমণকারী বাহিনীর মোকাবেলা করে এবং যত সহজে সিরিয়া লেবানন দখল করা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল তা সম্ভব হয় নি। তুমুল যুদ্ধের পর জুন মাসের ২১ তারিখে দামেস্ক মিত্রবাহিনীর দখলে আসে। ক্রমে অন্যান্য শহরও ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের শাসন মুক্ত হয়। জুলাই মাসের ৮ তারিখে জেনারেল ডেনজ যুদ্ধ বিরতির আবেদন জানান। অস্ত্র সংবরণের খসড়া ১২ তারিখে প্রস্তুত হয় এবং ১৪ তারিখ এতে স্বাক্ষরদান করা হয়। এ চুক্তির শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ :
(এ) সিরিয়া লেবানন মিত্রবাহিনীর দখলে থাকবে। (বি) ম্যান্ডেটরি সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধরত সৈন্যকদের মর্যাদা দান করতে হবে ।
(সি) যুদ্ধের সময় সরঞ্জাম হয় ব্রিটিশ বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করতে হবে অথবা তাদের নির্দেশ অনুযায়ী নষ্ট করে দিতে হবে।
(ডি) সিরিয়া লেবাননে ফরাসি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালন ব্যবস্থা ও মর্যাদা অপরিবর্তিত থাকবে ।
(ই) সকল পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা, বন্দরের সুযোগ-সুবিধা, নৌ-বহর, বিমান বন্দর ও সমস্ত জ্বালানী অপরিবর্তিত অবস্থায় মিত্র বাহিনীর নিকট হস্তান্তর হবে। সিরিয়া লেবাননের যেসব লোক ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না ।
মিত্রবাহিনী সিরিয়া লেবানন আক্রমণের প্রাককালে 'স্বাধীন ফ্রান্স' সরকারের প্রধান দ্যা গলের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল কাত্রো সিরিয়া লেবাননের জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা জারি করেন। ‘স্বাধীন ফ্রান্স' সরকারকে ফ্রান্সের প্রকৃত সরকার বলে ঘোষণার পর বলা হয় যে, সেই সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সিরিয়া লেবাননের ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ও এদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । এক বা একাধিক রাষ্ট্র হিসেবে থাকার পূর্ণ অধিকার সিরিয়া লেবাননের আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিরিয়া লেবাননের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক একটি চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। এদিকে প্রায় একই সাথে কায়রোয় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার মাইলস ল্যাম্পেসন এক ঘোষণায় ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব ব্যাখ্যা করেন। ‘স্বাধীন ফ্রান্স' সরকারের পক্ষ হতে সিরিয়া লেবাননকে যে স্বাধীনতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে, ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণভাবে নিজেকে তার সাথে যুক্ত করে। মিত্রপক্ষে যোগ দেয়ার সুবিধার প্রতিও সিরিয়া লেবাননের অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ।
'স্বাধীন ফ্রান্স' সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল কাত্রোকে নিয়োগের প্রাক্কালে দ্য গল পত্রে সিরিয়া লেবাননে তার দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা দেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধিদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ । মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ, মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননে ফরাসি স্বার্থ সংরক্ষণ, বাহিরের আক্রমণের বিরুদ্ধে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি তার প্রাথমিক দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন। গণপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় ১৯৩৬ সালের চুক্তিকে আলোচনার প্রথম সোপান বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, ভিসি সমর্থক ম্যান্ডেটরি সরকার উৎখাতের পর সিরিয়ায় স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা বিজয়ী বৃটিশ সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। সিরিয়া লেবাননের ভবিষ্যত সম্পর্কে ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মকালে ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের মধ্যে আবার আলোচনা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে বৃটিশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি আলভার লিট্লটন দ্য গলকে যে পত্র দেন তাতে বলা হয় যে সিরিয়া লেবাননের উপর ব্রিটেনের কোন অভিসন্ধি নাই। এবং এ এলাকায় ফ্রান্সের প্রভাব ও ভাবামূর্তি খর্ব করার কোন ইচ্ছা ব্রিটেনের নেই ।
স্বাধীন ফ্রান্স সরকার ও ব্রিটেন যুগ্মভাবে সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও এ এলাকায় অন্য যে কোন শক্তি অপেক্ষা ফ্রান্সের বেশি প্রভাব থাকবে। এর উত্তরে দ্য গল যে পত্র প্রেরণ করেন তাতে তিনি সিরিয়া লেবানন প্রশ্নে ব্রিটিশ মনোভাবের প্রশংসা করেন । ম্যান্ডেটরি এলাকা স্বাধীনতা লাভ করার পরও সেখানে ফ্রান্সের নৈতিক প্রভাবের যৌক্তিকতা স্বীকার করে ব্রিটিশ সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। এ যুদ্ধে স্বাধীন ফ্রান্সে সরকার বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে ব্রিটেনের সাথে থাকবে বলে আশ্বাস
দেয়া হয়। এ পত্রালাপের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ 'লিটন দ্য গল' ঐক্যমত নামে পরিচিত ।
সিরিয়া লেবানন প্রশ্নে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়ও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ১৯৪১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হাউস অব কমনসে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি সিরিয়ার উপর ব্রিটেনের কোন অভিসন্ধি নেই বলে মন্তব্য করেন। কেবলমাত্র যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্রিটিশ সৈন্য সিরিয়া লেবাননে অবস্থান করছে। তবে যত শীঘ্র সম্ভব সিরিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এ ব্যাপারে অহেতুক বিলম্ব না করে ক্রমবর্ধমান হারে সিরিয়া জনসাধারণের হস্তে ক্ষমতা দেয়া উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। এমনকি স্বাধীন ফ্রান্স সরকার কর্তৃত সিরিয়া লেবাননের স্বাধীনতা ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দান সম্পর্কে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। এ প্রতিশ্রুতি কত দ্রুত ও কতটুকু আন্তরিকতার সাথে পালিত হয় সিরিয়া নেতৃবৃন্দ তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল কাত্রো শেখ তাজউদ্দিন আল হাসানিকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ করেন । এর কয়েকদিন পর কাত্রো সিরিয়াবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক ঘোষণায় দেশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন। নতুন সরকার গঠনের সময় হতেই সিরিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিরিয় সরকার প্রয়োজনবোধে যে কোন দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে পারবে। যেসব দেশের সিরিয়া সরকার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবে না, সেসব জায়গায় ফ্রান্সই সিরিয়ার স্বার্থ দেখবে। একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার পূর্ণ অধিকার সিরিয়ার থাকবে। এ ব্যাপারে ফরাসি সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। ফরাসি সরকার সিরিয়ার ভৌগলিক অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। সিরিয়ার বিভিন্ন অংশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন শক্তিশালী করার কাজে ফরাসি সরকার সহযোগিতা করবে। ফরাসি সরকার সিরিয়া ও লেবাননের মধ্যে ঘনিষ্ট অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত থাকবে। যুদ্ধচলাকালীন মিত্র শক্তি সিরিয়ার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। এ দায়িত্ব পালন সহজতর করার জন্য সিরীয় সরকার দেশের সেনাবাহিনী এবং যাতায়াত ব্যবস্থা মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তৃত্বে অর্পণ করবে। কাত্রোর এ ঘোষণা জাতীয়তাবাদী মহলে কিছুটা আশার
সঞ্চার করে।
ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট তাজউদ্দীন একটি মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব নিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ হাসান আল হাকিমের উপর অর্পণ করেন। হাকিম মন্ত্রি সভায় একজন দ্রুজ ও একজন আলাবি সদস্য ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ব্লক হতে কোন সদস্য নেয়া হয় নি। মন্ত্রিসভা ২৭ সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও এ স্বাধীনতা যে পূর্ণ স্বাধীনতা নয় তা সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধির ক্ষমতা পূর্বতন হাইকমিশনারে ক্ষমতার অনুরূপ ছিল। তদুপরি ছিল মিত্রবাহিনীর প্রায় স্বাধীনভাবে অবস্থান। এসব কারণে জাতীয়তাবাদী
মহল ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। ১৯৪২ সালের এপ্রিলে হাকিম মন্ত্রিসভার পতনের পর অতি দ্রুত আরো কয়েকটি মন্ত্রিসভার পরিবর্তন হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কেবল বাড়তেই থাকে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের ছিল না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সিরিয়ায় আতা আল আইয়ুবীর নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ১৯৪৩ সালের ১০-১১ জুলাই প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ২৬ তারিখে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দু'একটি জায়গা ছাড়া সাধারণভাবে জাতীয় ব্লক নির্বাচনে জয় লাভ করে। সাদ আল্লাহ আল- জাবিরীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার সকল সদস্যই জাতীয় ব্লক হতে গ্রহণ করা হয় ৷ লেবাননে এ নির্বাচনের পর রিয়াদ আল সুলহের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
স্বাধীনভাবে নির্বাচিত এ জাতীয়তাবাদী সরকার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উপর আরোপিত নারারূপে বিধি নিষেধ সম্পর্কে অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। এ ধরনের বিধি নিষেধের মধ্যে উল্লেখ করার মত কতগুলো এখানে তুলে ধরা হল । যেমন (এ) সংসদে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা ফরাসী প্রতিনিধির অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা দ্বারা সঙ্কোচিত হয়ে পড়ে। (বি) কয়েকটি পরিদপ্তরের প্রশাসন পুরোপুরিভাবে ফরাসী প্রতিনিধির হাতে অর্পিত ছিল। সিরিয়া সরকারের এখানে কোন ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। এগুলোর মধ্যে রাজস্ব বিভাগ এবং সিরিয়ায় কার্যত বৈদেশিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রক্ষীবাহিনী, স্বরাষ্ট্র বিভাগ, বেদুঈন নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ফরাসি প্রতিনিধির হাতে অর্পিত ছিল। (সি) ম্যান্ডেটরি আমলের প্রথম দিকের মত তখনো বিভিন্ন বিভাগে ফরাসি উপদেষ্টা ছিল এবং তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করার ক্ষমতা সিরিয় সরকারের ছিল না। (ডি) বিভিন্ন এলাকায় ফরাসি প্রতিনিধির তথ্য সরবরাহ আফিসার নিয়োজিত থাকত। তথ্য সরবরাহ করা ছাড়াও তারা নিজ নিজ এলাকায় সর্বময় প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মে নিয়োজিত থাকত এবং প্রয়োজনে তাদের পদবি ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করত ।
১৯৪৩ সালের অক্টোবর সিরিয়া ও লেবাননের সরকার ফরাসি প্রতিনিধি জাঁ হেলুর নিকট একই ধরনের স্মারকলিপি পেশ করেন। উভয় সরকারই সংবিধান পরিবর্তন করে ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান এবং নিজেদের হাতে পূর্ণ প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত প্রদান করে। ফরাসি প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি সুযোগ-সুবিধাসহ রাষ্ট্রদূতে রূপান্তরিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করা হয়। আলজিয়ার্সে অবস্থানরত ফরাসি জাতীয় কমিটির সাথে আলোচনার পর হেলু বৈরুতে প্রত্যাবর্তন করে ঘোষণা করেন যে, সার্বিক ক্ষমতা হস্তান্তর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মোটেই সম্ভব নয়। ১৯৩৬ সালের চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের গ্রহণযোগ্য পন্থা বলে তিনি মনে করেন। সিরিয়া লেবনাননের জাতীয়তাবাদী মহল এ ঘোষণাকে প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে
গ্রহণ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়। ফ্রান্সের এককালের একান্ত অনুগত লেবাননেই জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এ চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দেন । ৮ নভেম্বর এক বিশেষ অধিবেশনে সংসদ সংবিধান পরিবর্তন করে। সর্বসম্মতিক্রমে সংবাদ হতে ম্যান্ডেট সম্পর্কিত সকল ধারা এবং ফরাসিকে অন্যতম সরকারি ভাষা ঘোষণাকারী ধারা বাদ দেয়া হয়। এতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে লেবাননের অভ্যুদয় সম্পর্কিত ধারা সংযোজন করা হয়। এ ব্যবস্থাকে ফ্রান্সের মান- সম্মানের প্রতি চরম আঘাত হিসেবে গণ্য করে হেলু কঠোর শাস্তিসমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১১ নভেম্বরে সকাল বেলা ফরাসি ও ফরাসি ঔপনিবেশিক সৈন্যদল প্রেসিডেন্ট বিশারা আল খুরি এবং দুজন ছাড়া মন্ত্রিসভার সকল সম্মানিত সদস্যকে বন্দী করে রাশায়া দূর্গে অন্তরীণ করে রাখে। ফ্রান্সের প্রতিনিধি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানে বাতিল ও সংসদ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ফরাসি ঘেষা এমিল ইদ্দাকে রাষ্ট্র প্রধান বলে ঘোষণা করা হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল লেবাননবাসী এ হঠকারী ও অবমানাকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালের ফলে বৈরুতসহ সকল শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। জনজীবনে চরম দুর্দশা নেমে আসে । বহু বিক্ষোভ মিছিল বের হয় এবং ফরাসি বিরোধী দাঙ্গা সর্বত্র শুরু হয়। ফরাসি বাহিনীর অতর্কিত গুলি বর্ষণের ফলে বেশ কিছুলোক হতাহত হয়। কারফিউ জারি করে শহরের পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। বিক্ষোভ ও তীব্র আন্দোলন বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হাবিব সাহলা ও মাজিদ আর সাহলানের সুযোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে উঠে। এবং একটি স্বাধীন সরকার গঠন করা হয়। দলে দলে দ্রুজ যুবকেরা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। লেবাননের চাঞ্চল্যকর ঘটনাসমূহ সিরিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। জনতার হরতাল ও ফরাসি বিরোধী বিক্ষোভে দামেস্ক ও অন্যান্য শহর মুখর হয়ে উঠে। তবে অন্যান্য স্থানেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে নেন এবং সিরিয়া-লেবাননে ব্রিটিশ প্রতিনিধি জেনারেল স্পিয়ারম এর সাথে জরুরী আলাপ-আলোচনা করার উদ্দেশ্যে কায়রোস্থ ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ দূত আর.জি. কেসি বৈরুতে আগমন করেন। আলজিয়োর্সে ব্রিটিশ দূত ফরাসি জাতীয় কমিটির নিকট একপত্রে সিরিয়া লেবাননের ঘটনায় ব্রিটিশ সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা জানান। পত্রে আরো বলা হয় যে যুদ্ধের বিশেষ প্রয়োজনে এসব এলাকায় শান্তি বজায় রাখা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে অনতিবিলম্বে প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মুক্তিদানসহ ফরাসি প্রতিনিধি হেলুকে প্রত্যাহার করে নেয়া অপরিহার্য বলে মনে করেন। খুব দ্রুত এ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে পত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়। এদিকে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের সরকারও একপত্রে লেবাননে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে তা পরিবর্তন
করার জোর দাবি জানায় এবং সিরিয়া লেবাননের জনগণের স্বার্থে ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি সম্পর্কে স্থাপিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য প্রকাশ করে। ভবিষ্যতে যাতে এরূপ ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপরে সতর্ক করা হয় ।
ফরাসি জাতীয় কমিটি সিরিয়া লেবাননের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে সরেজমিনে তদন্ত করে উপযুক্ত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেনারেল কাত্রোকে প্রেরণ করেন। কাত্রো লেবাননে এসে অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করলেও ফ্রান্সের ‘মুখ রক্ষা' করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেন। ১৮ নভেম্বর তিনি জাতীয় কমিটির নিকট এ মত প্রকাশ করেন যে, প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া উচিত এবং প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বে একটি নতুন মন্ত্রিসভা ও গঠিত হওয়া উচিত। প্রেসিডেন্ট খুবি তার সহকর্মীদের বাদ দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। কাতো আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। বিরাজমান অস্বভাবিক অবস্থা দূর করার জন্য অনতিবিলম্বে আটক মন্ত্রিসভার হাতেই ক্ষমতা প্রদানের জন্য জেনারেল পিয়ারস ও দামেস্ক সরকার চাপ দিতে থাকে। এতেও কাজ না হওয়ায় ১৯ নভেম্বর আর.জি. কেসি ৩ দিন সময় সীমা নির্ধারণ করে একটি চরমপত্র দেন। বাধ্য হয়ে ২০ নভেম্বর কাত্রো আটক মন্ত্রিসভার হাতে ক্ষমতা অর্পণের জন্য আলজিয়ার্সে সুপারিশ করেন। ২৩ নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে অভ্যর্থিত হয়ে বৈরুতে প্রবেশ করেন ।
১ ডিসেম্বর সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন সে সিরিয়া ম্যান্ডেট ব্যবস্থা স্বীকার করে না। ক্ষমতা হস্তান্তর করার পূর্বশর্ত হিসেবে ফ্রান্সের সাথে চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা ও সরকার স্বীকার করে না। সকল বিভাগের প্রশাসন সরকারের হাতে অর্পণের জন্য তিনি ফরাসি কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান । সিরিয়া ও লেবাননে যৌথ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি উভয়ে একত্রে দেখাশুনা করতে সম্মত হয়েছে বলে জানানো হয়। ফরাসি জাতীয় কমিটি এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য প্ৰকাশ করে নি। তবে জেনারেল কাত্রো আলজিয়ার্সে নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে প্রত্যাবর্তন করে সিরিয়া লেবাননের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। ত্রিপক্ষীয় আলোচনার ফলে ২২ ডিসেম্বর ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থির হয় যে ১ জানুয়ারী, ১৯৪৪ শুল্ক ও বিদেশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নিয়েন্ত্রণসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্ব সিরিয়া ও লেবাননের উপর বর্তাবে। দু'দেশের যৌথ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একিট সম্মিলিত উচ্চ পর্যায়ের পরিষদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে স্থির হয়। ১৯৪৪ সালের বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পুরাতত্ত্ব, ট্রেডমার্ক, ডাক তার বিভাগ সহ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ, বেদুঈন নিয়ন্ত্রণ ইতাদি বিভাগ দু’সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে জেনারেল বিয়ে ফরাসি প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করে দুটি রাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তির জন্য আলোচনা করেন। ফ্রান্স এমন একটি চুক্তি সম্পাদনের আশা করছিল সে চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়া লেবাননে তার সাংস্কৃতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় থাকে। ফরাসী কর্তৃপক্ষের অনেকেই তখন ১৯৩৬ সালের চুক্তির অনুরূপ আরেকটি চুক্তির আশা করেছিলেন। সিরিয়া লেবাননের জনসাধারণের সে মানসিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। সে সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা বা উদাসীনতা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। স্বাভাবিকভাবেই ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নি। ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান বন্দর, হিজাজ রেলপথ, বৈরুত বন্দর এবং আরো কয়েকটি বিভাগের দায়িত্ব সিরিয়া লেবাননের সরকারদ্বয় গ্রহণ করেন ।
কিন্তু রক্ষীবাহিনীর হাতে কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে ফরাসি প্রতিনিধি গড়িমসি করে। চাপ প্রয়োগ করে সুবিধাজনক শর্তসহ চুক্তি আদায় করাই যে এ অসম্মতির উদ্দেশ্য তা সকলেই বুঝতে পেরেছিল। জাবাল আদ-দ্রুজ ও আলাবি এলাকায় ফরাসি কর্মচারীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারণা চালাতে থাকে ।
সিরিয় সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা হতে চাপিয়ে দেয়া ফরাসি প্রভাব দূর করতে প্রয়াস পেলে দুদেশের মধ্যে দামেস্ক ও অন্যান্য শহরে ফরাসি বিরোধী বিক্ষোভ বের হয়। এর উত্তরে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের আদেশ দেয়, প্যারিসে দ্য গল সিরিয়া লেবাননে ফ্রান্সের বিশেষ অধিকার সংরক্ষণে দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেন। দু'পক্ষের পরস্পর বিরোধী মনোভাবে ব্রিটিশ সরকার বিব্রত বোধ করে। ইয়াল্টা সম্মেলন শেষে দেশে ফিরার পথে চার্চিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট কুয়াতলীর সাথে মিলিত হয়ে পরিস্থিতির আলোচনা করেন এবং নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করার উপদেশ দেন। কিন্তু এপ্রিলে সিরিয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সন্তোষজনক চুক্তি আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স নতুন সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এ সংবাদ সিরিয়া লেবাননে দারুন উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ৪ মে এক ব্যক্তিগত পত্রে চার্চিল এ ধরনের পরিকল্পনা ত্যাগ করার জন্য দ্য গলকে অনুরোধ করেন। ৭ মে জনরব সত্যে পরিণত হয় এবং ফরাসি সেনেগালি সৈন্য বৈরুতে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। লেবানন ও সিরিয়ায় আবারো গণ বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৮ তারিখে জেনারেল বিয়েঁ প্যারিস হতে একটি চুক্তির খসড়া নিয়ে আসে। কিন্তু ১৯মে এক যুক্ত আলোচনা সভায় সিরিয় ও লেবাননী সরকার এ চুক্তি গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। ২০মে আলেপ্পোয় বিক্ষোভকারী মিছিলের উপর ফরাসি সৈন্যদের গুলিতে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। এ সংবাদে অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে উঠে। হিমস ও হামায় ফরাসী সৈন্যদের সাথে বিক্ষোভকারীদের খণ্ড যুদ্ধ হয়। দামেস্কে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ২৯মে অপরাহ্ন হতে অনবরত গুলাবর্ষণ ও উড়োজাহজ হতে বোমা বর্ষণ করতে থাকে। প্রায় ২৪ ঘন্টার এ ধ্বংসযজ্ঞে ভবনসহ বহু ঘর-বাড়ি বিনষ্ট ও অন্তত ৪০০ লোক নিহত হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১ জুন দামেস্কে অবস্থানরত ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক ফরাসি প্রতিনিধির নিকট মধ্যপ্রাচ্য মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের একটি লিখিত আদেশ প্রদান করেন । এ পত্রে অনতিবিলম্বে অস্ত্র সংবরণপূর্বক সকল ফরাসি সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে
আনার নির্দেশ দেয়া হয়। ব্রিটিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফরাসি বাহিনীকে শহরের বাইরে ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী ফরাসি বিরোধী মনোভাব সিরিয়া ও লেবাননে দেখা দেয়। ২১ জুন দুই সরকার এক যৌথ ঘোষণায় কোন ইউরোপীয় শক্তিকেই বিশেষ অধিকার দিতে অস্বীকৃতির কথা জানান। এই সাথে রক্ষিবাহিনী ও মিশ্র বিচারালয়সমূহের উপর অধিকার দাবি করা হয়। ৭ জুলাই এ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলি সিরিয় ও লেবাননি সরকারের উপর অর্পণ করা হয়। ঠিক এ সময় সিরিয়া ও লেবানন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৪৪ সালের জুলাই এ যথাক্রমে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দান করে। উভয় রাষ্ট্রই ১৯৪৫ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আরবলীগে যোগদান করে। ১৯৪৫ সালের মার্চেই জাপান ও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সাফ্রান্সিসকো সম্মেলনে যোগদানের যোগ্যতা অর্জন করে। এ সম্মেলনে মিত্রশক্তির বিশেষ করে ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতি জাতীয়তাবাদীদের মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করে। ১৯৪৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সিরিয় ও লেবাননি সরকার বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে। দীর্ঘ বিতর্কের পর ‘যথা শীঘ্র সম্ভব' সকল বিদেশী সৈন্য অপসারণ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অস্পষ্টতার অভিযোগে রুশ ভেটো দ্বারা বাতিল হলেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স এ প্রস্তাব মেনে চলতে সম্মত হয় এবং সৈন্য অপসারণ শুরু করে। ১৯৪৬ সালের ১৭ এপ্রিল ও ৩১ ডিসেম্বর যথাক্রমে সিরিয়া ও লেবানন থেকে শেষ বিদেশি সৈন্য অপসারিত হয়। ১৭ এপ্রিল সিরিয়ার ও ৩১ ডিসেম্বর লেবাননের জাতীয় দিবস। সিরিয়া ও লেবাননবাসীর চূড়ান্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের (১৯৪১-১৯৪৬) বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল ইতিহাস বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত