সউদি আরব রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও সংহতকরণ

মাত্র একটি ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এরপর আব্বাসীয় রাজবংশের (৭৫০-১২৫৮) রাজধানী হয় বাগদাদ। মোঙ্গলদের দ্বারা বাগদাদ নগরী ধ্বংস হওয়ার পর খেলাফত আর আরবদের হাতে ফিরে আসে নি। পরবর্তীতে ১৫১৭ সালে ওসমানিয় তুর্কিদের নেতৃত্বে ইসলামি বিশ্বের শেষ বড় সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কনস্টান্টিনোপল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত আরবীয় উপদ্বীপ তথা বর্তমান সউদি আরবের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলসমূহ কনস্টান্টিনোপল থেকেই শাসিত হত । তুর্কি শাসনামলে এ অঞ্চল কোন ব্যক্তি বা বংশের শাসনাধীনে ছিল না। বিভিন্ন বংশ তুর্কিদের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে নিজ নিজ অঞ্চল শাসন করত । উত্তর আরব তুর্কিদের করদমিত্র রশীদী বংশের অধীনে ছিল। হিজাজ, নজদ ও আল হাসা নিয়ে গঠিত ছিল মধ্য আরব। ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে হিজাজে মক্কার হাশেমি বংশের প্রতিপত্তি ছিল। দশম শতাব্দী থেকেই তারা মক্কায় শাসন করে আসছিল। নজদে ওহাবি মতবাদের অনুসারি সউদ বংশ ছিল প্রভাবশালী। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত আল হাসা এবং লোহিত সাগর তীরবর্তী আসিরও ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের অংশ। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ এবং জায়েদি ইমামদের দ্বারা শাসিত। আরবিয় উপদ্বীপের হিজাজ, নজদ ও আসির অঞ্চল নিয়ে বর্তমান সউদি আরব রাজ্য গড়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত মক্কা ও মদীনা শহর সউদি আরবেই অবস্থিত। এ দুটি স্থানে যথাক্রমে কাবাশরীফ ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাজার শরীফ রয়েছে।
সউদি আরব রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও সংহতকরণ
সউদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় মধ্য আরবের সউদ বংশ কর্তৃক। রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হতে দুই শতাব্দীরও বেশী সময় লাগে। এই দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় সউদ বংশের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সউদি আরব রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরপর দুই বার ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় বারের প্রচেষ্টা সফল হয়। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে আব্দুল আজিজ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে সউদের নেতৃত্বে আধুনিক সউদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সউদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও এর সুসংহতকরণের ইতিহাস নিম্নে তুলে ধরা হল :
আরবি ভাষাভাষী দেশসমূহের বিস্তৃতি পশ্চিমে মরক্কো থেকে পূর্বে ওমান পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য কথায়, ইরানকে বাদ দিলে সমগ্র মধ্য, নিকট প্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল নিয়ে আরবি ভাষাভাষি দেশের বিস্তৃতি। এ বিশাল অঞ্চলে বহুযুগ ধরে আরবরা রাজত্ব করেন এবং ইসলাম ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলির মধ্যে সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ফিলিস্তিন সহ আরব ভূ-খণ্ড ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগ হতে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সুদীর্ঘ চারশত বছর তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও আরবরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদের স্পৃহা হারায় নি ।
১৫১৬ সালে তুর্কি সুলতান সেলিম মিশর অধিকার করেন এবং মামলুকদের পতনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তুর্কি আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। সেলিম সিরিয়া ফিলিস্তিন ও মিশর জয় করে হেজাজের দিকে সৈন্য পাঠান। পবিত্র মক্কা ও মদিনা সহ সমগ্র হেজাজ তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর ইয়েমেন ও অধিকৃত হয় । ক্রীড়নক খলিফা মোতাওয়াক্কিলকে অপসারণ করে ১৫১৭ সালে সেলিম নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। হেজাজের শাসনভার অর্পিত হয় তুর্কি সুলতান কর্তৃক নিযুক্ত মিশরের পাশাদের উপর। মিশরের শাসন কর্তা মোহাম্মদ আলী পাশা (১৮০৫- ১৮৪৯) এবং তার উত্তরাধিকারীদের আমলে তুর্কিদের সাথে হেজাজের বিরোধ বাধে। উল্লেখ্য মধ্য আরবের নেজদ্ অঞ্চল স্বাধীন ছিল ।
'ওয়াহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে আধুনিক তেল সমৃদ্ধ সউদি আরবের গোড়াপত্তন হয়। মধ্য আরবের নেজদ্ অঞ্চলে উযাইনা নামক স্থানে মুহম্মদ ইবনে আবদ-আল-ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২) আরব দেশে সর্বপ্রথম একটি শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, গোঁড়াপন্থী ও অনমনীয় মনোভাবাপন্ন। ধর্মীয় সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামের পবিত্রতা ও প্রকৃত মূল্যবোধ রক্ষার্থে সকল প্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেন। তিনি ধর্মতত্ত্ব, আইনতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বাগদাদে গমন করে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি আহমদ ইবনে হাম্বল এবং আহম্মদ ইবনে তায়মিয়ার ভাবধারা ও মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তিনি হেজাজ, ইরাক ও সিরিয়া ভ্রমণ করে মুসলমানদের মধ্যে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা নীতি হতে তাদের বিচ্যুতিতে ব্যথিত হন ।
ইবনে সউদের ওয়াহাবী মতবাদ গ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়াহাব-স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে অনৈসলামিক কার্যকলাপ ও ভাবধারার বিরুদ্ধে মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। তিনি পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাকে অধিক গুরুত্ব দেন এবং জেনার শাস্তিস্বরূপ পাথর নিক্ষেপ করে দোষী ব্যক্তির প্রাণনাশের ফতোয়া দেন। কিন্তু স্থানীয় শেখরা এর বিরোধিতা করে তাকে তার নিজ শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি কবরপূজা, পীরপূজা, মানত প্রথার তীব্র নিন্দা করে ইসলামের মৌলিক অনুশাসনের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার আন্দোলন ওয়াহাবী আন্দোলন নামে পরিচিত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত মুসলমানরা যখন বিপথগামী, তখন তিনি কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথে তাদের পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পান। মতান্তরে ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’ ‘মুহম্মদী আন্দোলন' নামে পরিচিত। তার মতবাদ বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল তৌহিদ' এ সন্নিবেশিত হয়েছে। মুহম্মদ ইবনে আবদ আল ওয়াহাবের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল দারিয়ার আন-আসা গোত্রের দলপতি মুহম্মদ ইবনে সউদের সাথে সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাৎ তার জীবন ও মতাদর্শের জন্য ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ একদিকে যেমন আল ওয়াহাব তার মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য একজন পৃষ্ঠপোষক লাভ করেন। অন্যদিকে মুহাম্মদ ইবনে সাউদ আল- ওয়াহাবের সমর্থন লাভ করে তার শত্রুদের বিশেষত উযাইনার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন।
প্রথম সাউদি রাজবংশের ইতিহাসে দেখা যায় যে বর্তমান আরব দেশের সাউদি রাজবংশের পূর্ব পুরুষ ছিলেন মানী ইবনে রাবিয়া আল মরাইদি। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে তিনি হাসা অঞ্চল থেকে ওয়াদি হানিফায় এসে বসবাস শুরু করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে তার বংশধরেরা মধ্যে আরবের দারিয়ায় একটি ক্ষুদ্র আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২০ সালের কিছু পূর্বে সাউদ ইবনে মুহাম্মদ শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নাম হতেই সাউদি রাজবংশের নামকরণ হয়। তিনি ১৭২৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র মুহম্মদ ইবনে সাউদ আমীর হন ।
মুহম্মদ ইবনে সাউদ প্রথম (১৭২৫-১৭৬৩) দায়িত্ব পালন করেন। সাউদি রাজবংশের প্রথম আমীর ছিলেন নেজ়দের দারিয়ার এই দলনেতা মুহম্মদ ইবনে সাউদ। তিনি ১৭০৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। স্বীয় দক্ষতা, যুদ্ধকৌশল ও বুদ্ধিসত্তার দ্বারা পিতার মৃত্যুর পর ১৭২৫ সালে আমিরাত লাভ করেন। এ সময় নেদ অঞ্চলে মুহম্মদ আল-ওয়াহাবের শুদ্ধি ইসলামে (Puritan) তিনি আকৃষ্ট হন এবং ওয়াহাবী আন্দোলন সমর্থন ও ওয়াহাবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। উপরন্তু তিনি ওয়াহাবের কন্যাকে বিবাহ করে ওয়াহাবী মতবাদ সম্প্রচার এবং স্বীয় রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। বস্তুতপক্ষে শুদ্ধি আন্দোলনের শুরুতে আল- ওয়াহাব যখন স্বীয় নগরী আল-উযাইনা থেকে নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হন তখন মুহম্মদ ইবনে সাউদ তাকে আশ্রয় দেন। তিনি মুহাম্মদ আল ওয়াহাবাকে কেবলমাত্র তার মতবাদ প্রচার করার জন্যই সুযোগ সুবিধা দিলেন না; বরং এর স্থায়িত্বের জন্য একটি রাজনৈতিক পরিমন্ডল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালান ৷ মুহম্মদ আসাদের ভাষায়-"It was an alliance of the spirit and the sword; an alliance which was destined to change the entire history of Arabia." আল ওয়াহাবের ধর্মীয় চেতনাবোধে বেদুঈনরা যেমন উদ্বুদ্ধ হয়, অপরদিকে মুহম্মদ ইবনে সাউদের তেজদীপ্ত ও বলিষ্ঠ যুদ্ধ স্পৃহার ফলে আরব ভূ-খণ্ডের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র ও শহর সাউদি রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। মাত্র দশ বছরে দারিয়ার ক্ষুদ্র আমিরাত ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাপক প্রয়োগে ত্ৰিশ বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। প্রথম ইবনে সাউদ ১৭৫৭ সালে হাসার নৃপতিকে পরাজিত করেন। এর ফলে সাউদি রাজ্য পশ্চিম দিকেও বিস্তার লাভ করতে থাকে ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সাউদি রাজবংশ নেজদ্ েএবং ১৭৭৩ সালের মধ্যে রিয়াদে তাদের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯২ সালে আল ওয়াহাবের মৃত্যু হয়। বলা বাহুল্য যে সাউদি রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি ছিল ইবনে তায়মিয়ার ভাবাদর্শে উদ্ভাবিত ‘শুদ্ধি' ইসলাম ।
প্রথম আব্দুল আজিজ তাঁর পিতা মুহম্মদ ইবনে সাউদ-এর মৃত্যুর পর আমিরাত লাভ করেন। তিনি (১৭৬৩-১৭৮৩) সাল পর্যন্ত আমীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি আমিরাত লাভ করে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং শৌর্যবীর্যের ফলে সাউদি রাজ্য ১৭৮৮ সালে কুয়েতে বিস্তৃতি লাভ করে । তিনি আল ওয়াহাবের সমর্থন লাভ করেন। তিনি স্বীয় পুত্র সাউদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। সাউদি রাজবংশ নেজদ্ েবাংশগতভাবে রাজত্ব করার অধিকার লাভ করে । ওয়াহাবী মতবাদ এবং সাউদি রাজবংশের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে ওয়াহাবী বহিভূত পাশ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও শেখতন্ত্রগুলি শঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষত ইসলামের পবিত্র স্থান এবং প্রাণকেন্দ্র মক্কার শরীফ গালিবের সাথে তার বিরোধ বাধে। শরীফ গালিব আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু মক্কার বাহিনী ১৭৯০ সালে পরাজিত হয়। আব্দুল আজিজের সাথে শরীফ একটি শক্তি চুক্তি সম্পাদন করেন।
কিন্তু ওয়াহাবী শাসক স্বীয় আধিপত্য বিস্তার দ্বারা ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য ১৮০১ সালে কারবালা দখল করেন। ১৮৩৩ সালে মক্কা শরীফ সাউদি রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সেখানে পীর পয়গম্বরদের মাজারের উপর নির্মিত সমাদি সৌধ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। কারবালায় শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ইমাম হোসেনের সমাধি ধ্বংস প্রাপ্ত হলে ওয়াহাবি সাউদি রাজত্বের প্রতি গোড়াপন্থী শিয়া গোষ্ঠি চরম ষড়যন্ত্র ও বৈরিতা শুরু করে। এর ফলে একজন শিয়া ঘাতকের হাতে আব্দুল আজিজ ১৮০৩ সালে মারা যান ৷
দ্বিতীয় ইবনে সাউদ (১৮০৩-১৮১৪) সাল পর্যন্ত শাসনকর্তারূপে দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র দ্বিতীয় ইবনে সাউদ ১৮০৩ সালে সাউদি সিংহাসনের আরোহণ করেন। তিনি মক্কার শরীফ গালিবকে তার অধীনে শাসনের অধিকার দেন। ১৯০৪ সালে মহান ইবনে সাউদ মদিনা দখল করেন। মদিনা হতে তুর্কি নাগরিকদের বিতাড়িত করা হয়। অল্প দিনের মধ্যে সাউদের ক্ষমতা ওমান হতে পালমিরা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এতে তুর্কি সুলতান খুবই বিচলিত হলেন। এবং সাউদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপ বন্ধের জন্য মিশরের মুহম্মদ আলী পাশাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ১৮১১ সালের পূর্বে পাশার পক্ষে কোন অভিযান প্রেরণ করা সম্ভব হয় নি। এর ফলে সউদের আধিপত্য নাজাফ, আলেপ্পো এবং দামেস্কের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়াহাবীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তুর্কি সুলতান বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তার নির্দেশে মোহাম্মদ আলী পাশা তার পুত্র তুসুনকে একটি বিশাল বাহিনীসহ আরব দেশে পাঠান। সেই সাথে একটি নৌবহরও প্রেরিত হয়। সম্মিলিত তুর্কি বাহিনী ওয়াহাবীদের প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করে এবং ঐতিহাসিক বদরের প্রান্তরে শোচনীয় ভাবে ওয়াহাবীরা পরাজিত হয। ১৮১২ সালে তুর্কিরা মদিনা দখল করে এবং পরবর্তী বছর মক্কা ও তায়েফ তুর্কি শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়।

চূড়ান্ত পর্যায়ে মুহাম্মদ আলী স্বয়ং অভিযান করে তুসুনের মিশরীয়দের বিরুদ্ধাচারণ করে ওয়াহাবীদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এর ফলে তাকে বন্দী করা হয়। তারাবায় তুসুন পরাজিত হলে মোহাম্মদ আলী নেজ্‌দ হতে দক্ষিণে অভিযান করেন । তিনি উত্তর বাসালে ওয়াহাবীদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন ।
মহামতি দ্বিতীয় ইবনে সাউদ একজন বিচক্ষণ ও বীরশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। ১৮১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সনাতনী আরব শেখতন্ত্রের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং একজন মহান আরব শেখ হিসেবে দেশ শাসন করেন। তিনি খুবই সাধারণ ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তার আমলে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। পবিত্র কুরআনের আলোকে বেতনভুক্ত বিচারকগণ বিচারকার্য সমাধা করতেন। বিচারের জন্য তাদের কারও ফি গ্রহণ করার কোন সুযোগ ছিল না। ওয়াহাবীদের কোন প্রকার কর দিতে হত না। কেবলমাত্র যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক ছিল। তাদেরকে ধর্মযুদ্ধে নিজ ব্যয়ে অংশগ্রহণ করতে হত। যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যসামগ্রীর এক পঞ্চমাংশ তাদের মধ্যে বিতারণ করা হত ।
ইবনে সাউদের পুত্র আবদুল্লাহ (১৮১৪-১৯১৮) শাসন কার্য পরিচালনা করেন । তিনি ১৮১৪ সালে শাসনভার গ্রহণ করলে ওয়াহাবীদের সাথে মিশরীয়দের বিরোধ পুনরায় শুরু হয়। মোহাম্মদ আলী পাশা স্বীয় পুত্র ইব্রাহীমের উপর সামরিক অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করে মিশরে চলে যান। ১৯১৬ সালে ইব্রাহীম ওয়াহাবী রাজকুমার কাসিমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। কাসিম পৈত্রিক আবাসস্থল দারিয়ায় পলায়ন করতে বাধ্য হন। ওয়াহাবী শাসক আবদুল্লাহ ইব্রাহিমের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে ওয়াহাবী ভাবধারায় পুষ্ট মুহম্মদ ইবনে সাউদ যে রাজনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি করেন তা ১৮১৮ সালে ধ্বংপ্রাপ্ত হয় । আবদুল্লাহকে পদচ্যুত করে ইস্তাম্বুলে বন্দী হিসেবে নিয়ে গিয়ে তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। ওয়াহাবীদের রাজধানী দারিয়া ধুলিসাৎ করা হয় এবং একজন তুর্কি সামরিক কর্মচারী নেজ়দের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ইব্রাহিম মদিনায় প্রত্যাগমন করেন। নেজ্দ তুর্কি সুলতানের অধীনস্ত মিশরের পাশার দখলে থাকলেও দক্ষিণ আরবের আশীর অঞ্চলে (১৮২৫ - ১৮৩৭) সাল পর্যন্ত মিশরীয় অভিযান ব্যাহত হয়। মোহাম্মদ আলী পাশা মিশর ও সিরিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যস্ত থাকায় আরব দেশে যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে। তিনি আরব দেশের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তুর্কি সুলতানের উপর সরাসরি ন্যস্ত করেন। আরব দেশে মোহাম্মদ আলী পাশার অভিযানের ফলে দুটি উদ্দেশ্য কার্যকর হয়। যেমন ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রসারতা স্তিমিত হয় এবং তুর্কি সাম্রাজ্যে আরব দেশের প্রভাব ক্ষুন্ন হয়; পবিত্র মক্কা ও মদিনায় তুর্কি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।
দ্বিতীয় সাউদি রাজবংশ (১৮৭২) বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তুর্কি- মিশরীয় অভিযানের ফলে ওয়াহাবী আন্দোলন নেজদে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এ আন্দোলন পুনরায় ব্যাপক আকার ধারণ করে। মুহম্মদ আলী ও তার পুত্র ইব্রাহিম পাশা আরব দেশ হতে প্রত্যাগমন করলে ওয়াহবিরা তাদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে থাকে। মিশরীয় বাহিনী কর্তৃক দারিয়া বিধ্বস্ত হলে তুর্কি নামে আবদুল্লাহর একজন আত্মীয় রিয়াদে আত্মগোপন করেন। তিনি ১৮১৯ সালে রিয়াদে স্বীয় ক্ষমতা সুসংহত করে। স্বাধীনভাবে রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তুর্কি দ্বিতীয় সাউদি রাজবংশের সূচনা হয়। (১৮৩৩- ১৮৩৪) সালে তিনি নিহত হলে তার পুত্র ফয়সাল রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু মিশরের মোহাম্মদ আলী পাশা পুনরায় ১৮৩৮ সালের নেজদে অভিযান চালিয়ে ফয়সালকে বন্দী করেন। তিনি ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত মিশরে বন্দী জীবন-যাপন করার পর কৌশলে পলায়ন করে সাউদি রাজবংশের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৫ সালে তার মৃত্যুর পর সাউদি রাজপরিবারের মধ্যে কোন্দল ও বিভেদ দেখা দেয় । ফয়সালের ২ পুত্র আবদুল্লাহ ও সউদের মধ্যে এ বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ সুযোগে তুর্কিরা হাসা দখল করে এবং উচ্চাভিলাষী হাইলের শাসনকর্তা আবদুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে রশীদ ওয়াহাবী সাউদি রাজ পরিবারের দুর্বলতার সুযোগে মদিনায় তুর্কি শাসনকর্তার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। ইবনে রশীদের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং রিয়াদে সাউদি বংশের প্রাধান্য লোপ পেতে থাকে। নেজদের দুই ওয়াহাবী বংশ রিয়াদের আমিরাত এবং হাইলের আমিরাতের মধ্যে বহুদিন ব্যাপী দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ক্ষমতা লড়াইয়ে রিয়াদের সাউদি বংশ হাইলের রশীদী বংশের নিকট পরাজিত হয়। তারা কুয়েতে নির্বাসিত হয়। তুর্কিদের সাহায্যে রশীদী বংশের আমীর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রশীদ (১৮৭২-১৮৯৭) ফয়সালের তৃতীয় পুত্র ও উত্তরাধিকারী আবদুর রহমানকে রিয়াদ থেকে সপরিবারে বিতাড়িত করেন। ১৮৯১ সাল হতে তিনি কুয়েতে বসবাস করতে থাকেন ।
সুলতান আবদুল আজিজ ইবনে সউদ
সুলতান আবদুল আজিজ ইবনে সউদ (১৮৮০-১৯৫৩) তৃতীয় সাউদি রাজবংশের ইতিহাস খুবই বিখ্যাত। নির্বাসিত জীবন-যাপন করলেও তার পিতা আব্দুর রহমান স্বীয় রাজ্য পুনঃরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। তিনি মহামতি সউদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম সউদি রাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা ও ওয়াহাবী মতাদর্শকে সর্বদলীয় করার প্রয়াস পান। তার এ অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করেন তার সুযোগ্যপুত্র আব্দুল আজিজ। সাধারণভাবে “ইবনে সউদ' নামে পরিচিত আব্দুল আজিজ ১৮৮০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। আব্দুল আজিজ ছিলেন খুবই ধার্মিক ও উদার। তিনি যুদ্ধ বিদ্যায়ও খুবই পারদর্শি ছিলেন ।
রশীদী বংশের শাসনকর্তা মোহাম্মদ ইবনে রশীদ ১৮৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করলে সউদি বংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে। আব্দুল আজিজ ১৮৯৭ সালে রিয়াদ দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরবর্তী পর্যায়ে রশীদী রাজবংশের শক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়লে তিনি ১৯০২ সালে রাত্রির অন্ধকারে কতিপয় বেদুইনসহ রিয়াদ আক্রমণ ও দখল করেন। তার পিতা আবদুল রহমান তাকে নেজদের আমীর এবং ওয়াহাবীদের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি রশীদী পরিবারের শাসক আবদুল্লাহ আল আজিজ ইবনে মিতাবকে পরাজিত করে রিয়াদ দখল করেন এবং সউদি বংশ পুন: প্রতিষ্ঠিত করেন। তাকে পরস্পর কয়েকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। রশীদী সেনাবাহিনীকে তিনি পরাস্থ করতে সক্ষম হন। ১৯০৪ সালে সম্মিলিত তুর্কি ও রশীদী সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং ১৯১০ সালে তিনি মক্কার শরীফ ও আব্দুল আজিজ ইবনে মিতাব এর সম্মিলিত বাহিনীকে রিয়াদ থেকে বহিষ্কৃত করে সাউদি আধিপত্য পুনরুদ্ধার করেন। ইবনে মিতাব যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর ওয়াহাবী আন্দোলন এবং সাউদি রাজক্ষমতা সুদূরপ্রসারী হয় ।
১৯০১ -১৯১২ সাল পর্যন্ত আব্দুল আজিজ ইবনে সাউদকে রশীদী রাজ পরিবার, মক্কার শরীফ এবং তুর্কি সুলতানের বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়। এই তীব্র বিরোধীতা ও প্রতিবন্ধকতা নিরসনের জন্য তিনি 'আল -ইখওয়ান' বা ব্রাদার হুড আন্দোলনের সূচনা করেন। আরব উপজাতীয়দের বিরোধিতা বন্ধ করে আবরদের মধ্যে একটি জাতীয় চেতনাবোধের সৃষ্টিই ছিল এই গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য ।
ইখওয়ান সৃষ্টি দ্বারা শুধুমাত্র দুর্ধর্ষ বেদুঈন গোত্রের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণেই তিনি সমর্থ হননি বরং আরব বেদুঈনদের একতাবদ্ধ করে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। ঐতিহাসিক ইমামুদ্দীন যথার্থই বলেন, "Like the Sannusi order of Cyrenaica this Ikhwan movement was more of practical nature than of mystical ideas.” মূলত ইখওয়ান ছিল সামরিক শক্তিভিত্তিক একটি সংঘ। এর দ্বারা একদিকে যেমন ওয়াহাবী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। অপরদিকে শত্রুর মোকাবেলা করে সাউদি রাজবংশকে সুদৃঢ় করা সম্ভবপর হয়। এই সংঘের সদস্যদের সামরিক ছাউনি প্রতিষ্ঠিত হয় আবাতাউইয়ায়। সর্বমোট কতটি ‘হিজবা' প্রতিষ্ঠিত হয় তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও মনে করা হয় সে প্রায় দুশত সামরিক ছাউনি আব্দুল আজিজ প্রতিষ্ঠা করেন। এসব ছাউনিতে সর্বমোট দশ হাজার যোদ্ধা বসবাস করত। তিনি অসীম দূরবদর্শিতার সাথে একটি কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই সাথে একটি বিশাল বাহিনী দ্বারা তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপকে সুদৃঢ় করার প্রয়াস পান ।
১৯০১-১৯০৭ সাল পর্যন্ত আবদুল আজিজ সউদি রাজবংশের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির চেস্টা করেন। ১৯০৮-১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি স্বীয় রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কায়েমের প্রয়াস পান। কিন্তু তার পরম শত্রু
মক্কার শরীফ হোসাইন রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকেন । নব্যতুর্কিরা তুর্কিসাম্রাজ্য সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কুয়েতের আমীর শেখ মোবারক আব্দুল আজিজের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর ফলে শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত রিয়াদের সাউদি রাজবংশ বিচলিত হয়ে পড়ে। আবদুল আজিজ ১৯১৩ সালে পারস্য উপসাগরের তুর্কি অধিকৃত অঞ্চল আল-হাসা আক্রমণ করে দখল করেন। এর ফলে স্থল ও সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ তার অধিকারে আসে। তুর্কি সুলতান বলকান যুদ্ধে জড়িত হবার ফলে আরব দেশে সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হন। উপরন্তু তিনি আব্দুল আজিজকে তুর্কির স্বাধীন গভর্ণর হিসেবে স্বীকার করেন। এরপর বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুল আজিজ তার বিশাল সেনাবাহিনী সহ জুবাইল, কাতিফ, দাম্মাম এবং কুয়েতে কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম দখল করেন। তিনি জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় উইল হেলমের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। বার্লিন থেকে বাগদাদ যোগাযোগ স্থাপন করেন। বার্লিন থেকে বাগদাদ পর্যন্ত রেলপথ কুয়েতে সম্প্রসারিত করার জন্য উইলহেলমকে তিনি উৎসাহিত করেন। তার ক্ষমতা স্বীকার করে ব্রিটিশ সরকার (১৮১৫-১৮১৬) সময়কালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে নেদ, হাসা, কাতিফ, জুবাইল ইত্যাদি স্থানে আব্দুল আজিজ স্বীয় প্রভুত্ব (De facto, De-jure) সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠা করেন ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করে। তুর্কি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ইয়েমেন ও আসীরে প্রচণ্ড বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিভিন্ন স্থানে সংঘ স্থাপন করে তুর্কি শাসনের অবসানের জন্য প্রচারণা শুরু হয়। ত্রিপোলী বলকান যুদ্ধে আরবরা তুরস্কের বিরোধীতা না করলেও আরব ভূ-খণ্ডে তুর্কি আধিপত্য আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মারাত্মক অন্তরায় ছিল । ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে সম্মিলিত শক্তিবর্গ আরব দেশে তুরস্ক বিরোধী মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ করে। অপরদিকে আরব দেশে তুর্কি প্রাধান্য পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য ইস্তাম্বুলে নির্বাসিত শরীফ হোসাইনকে ১৯০৮ সালে নব্যতুর্কি সরকার পুনরায় মক্কায় প্রেরণ করেন। কিন্তু শরীফ হোসেন তুর্কি আধিপত্য সহ্য করতেন না। তিনি গোপনে মিশরের ব্রিটিশ শাসনকর্তা কিচেনারের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। ব্রিটেনের সাথে তুরস্কের সদ্ভাব থাকায় তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু মিশরের হাইকমিশনার শরীফ হোসাইনের সাথে পত্রালাপ "Sherif - Mac Mohan correspondence" নামে পরিচিত। ১৯১৫-১৯১৬ সালে উভয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলে আরবদের সমর্থনের পরিবর্তে যুদ্ধ শেষে আরব ভূ-খণ্ডকে বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অবশ্য শর্ত থাকে যে উত্তর মিশর ব্রিটিশ এবং লেবানন ফরাসী প্রভাবাধীনে থাকবে। মক্কার শরীফ হোসাইনকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয় এবং যুদ্ধে তার দুই পুত্র ফয়সাল ও আব্দুল্লাহকে প্রেরণ করা হয়। এভাবে সমগ্র হেজাজে শরীফ হোসাইন স্বীয় ক্ষমতা সুদৃঢ় করে ১৯১৭
সালে 'বাদশাহ' উপাধি ধারণ করেন। ইংরেজদের প্ররোচণায় আরবরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটা ছিল তুর্কি আধিপত্যের মূলে কুঠারাঘাত স্বরূপ । এর ফলে আরব ভূ-খণ্ড হতে তুর্কিদের বিতাড়িত করা সম্ভবপর হলেও বিজাতীয় ইউরোপীয়দের তারা প্রাধান্য স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। ১৯১৮ সালের চুক্তি মোতাবেক তুরস্ক মদিনা এবং ইয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে এবং ১৯২০ সালের মধ্যে সমগ্র আরব ভূ-খন্ডে তুর্কি প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় ।
ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে মক্কার শরীফ হোসাইনের সমর্থন লাভ যত সহজে সম্ভবপর হয় নেজদের আমীর ইবনে সাউদের পক্ষ হতে তা সম্ভবপর হয় নি বার্ষিক ভাতা ৫০০০ পাউন্ড স্টারলিং প্রদান করেও অন্যান্য আরব দলপতির মত ব্রিটিশ সরকার ইবনে সাউদের সমর্থন লাভ করতে পারে নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য শক্তির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও প্রসারে আরবদেশসমূহ শঙ্কিত হয়ে পড়ে । মিত্রশক্তি আরব দেশসমূহের জাতিয়তাবাদী আন্দোলন উপেক্ষা করে ম্যান্ডেটরি (Mandatory) ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলে প্রায় সকল আরব রাষ্ট্রই ইউরোপীয় শক্তির আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। আরব জাতির এ দুরাবস্থা লক্ষ্য করে আব্দুল আজিজ প্রকৃত স্বাধীনতা এবং পবিত্র মক্কা ও মদীনা সহ আরব ভূ-খণ্ড হতে বিজাতীয় প্রভাব দূরীকরণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শরীফ হোসাইনের দৃষ্টতায় আরব রাজ্য সমূহে তার কোন সুনাম ছিল না। ইবনে সাউদ হেজাজে স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এক বিশাল বাহিনী নিয়ে শরীফ হোসাইনের বিরুদ্ধে অভিযান করেন ।
তায়েফের নিকট তোরাবায় সংঘটিত যুদ্ধে শরীফ হোসেন পরাজিত হন । এবং তার সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত হয়। যা হোক আব্দুল আজিজ মধ্য আরব ভূ-খণ্ড স্বীয় দখলে আনতে সক্ষম হন। তুর্কি প্রাধান্য বিনষ্ট হওয়ায় জবল সামার সহজেই আব্দুল আজিজের করতলগত হয়। ১৯২১ সালে রশীদের পরিবারবর্গ রিয়াদে অন্তরীণ হন। ১৯২২ সালে তিনি রুয়ালা গোত্রকে দমন এবং জাওফ মরুদ্যান দখল করেন। ক্রমশ আবদুল আজিজ তার রাজ্যের সীমানা ট্রান্স-জর্ডান, সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৯২৪ সালে এক চুক্তির ফলে কুয়েতের সাথে তার মৈত্রী স্থাপিত হয়। ব্রিটেনের সাথেও আব্দুল আজিজের সখ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মক্কার শরীফ হোসাইনকে তখনো তার পক্ষে দমন করা সম্ভবপর হয় নি।
অবশেষে শরীফ হোসেইনের পতন হয়। ১৯২৪ সালে ব্রিটেন মক্কার শরীফ হোসাইন এবং নেজদের ইবনে সাউদের ভাতা প্রদান বন্ধ করলে শরীফ হোসেন মক্কা ও মদীনদার উপর কর চাপান। ইতোপূর্বে এ দুটি পবিত্র নগরী করমুক্ত ছিল। এর ফলে মক্কা ও মদীনার অধিবাসীরা শরীফ হোসেনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে এবং ইরানে সাউদকে আক্রমনের জন্য আহ্বান জানায়। ১৯২৪ সালে তুরস্কের
খেলাফত বিলুপ্ত হলে তিন দিন পরেই শরীফ হোসাইন নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে ইবনে সাউদ বিশাল সৈন্যবাহিনী সহ হেজাজে অভিযান করেন। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই আক্রমণ পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম তায়েফ অধিকৃত হয়। হোসেইন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এবং তার পুত্র আলীকে ক্ষমতা প্রদান করে ১৯২৫ সালের জুলাইয়ে সাইপ্রাসে আত্মগোপন করেন। তায়েফ বিজয়ের পর ওয়াহাবীরা প্রবল বিক্রমে অভিযান করে ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে পবিত্র মক্কানগরী দখল করে। উল্লেখ্য যে, ১২০ বছর পূর্বে তার পূর্ব পুরুষ প্রথম আব্দুল আজিজ সর্বপ্রথম ১৮০৩ সালে মক্কা জয় করেন। ইবনে সাউদ ক্রমশ মদিনা ও জেদ্দা দখল করেন। ১৯২৬ সালে তাকে হেজাজের ‘বাদশাহ' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি একই সাথে হেজাজ ও নেজদের একচ্ছত্র বাদশাহর সম্মান লাভ করে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন । তিনি আরব ভূ-খণ্ডের নামকরণ করেন ‘সউদি আরব’।
সুলতান আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ বহুমুখী কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিশাল দেশ সউদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু দক্ষ ও কৌশলী যোদ্ধাই ছিলেন না; দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদও ছিলেন। নেজ্‌দ ও হেজাজে স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে ওয়াহাবী বিরোধীসকল চক্র ও গোষ্ঠী ধুলিস্যাত করার সংকল্প করেন। বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা বিভিন্ন গোত্রের সাথে সখ্যতা স্থাপন করেন। ইয়েমেনের শাসনকর্তা ইমাম ইয়াহইয়ার বিরুদ্ধে তিনি সমরাভিযান করেন। ১৯৩০ সালের আসীর দখল করার পর তিনি ইয়েমেনে সউদি রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেন। এর ফলে সীমান্ত প্রশ্নে ইমাম ইয়াহইয়ার সাথে বিরোধ শুরু হয় এবং ১৯১৪ সালে আব্দুল আজিজ ইয়াহইয়াকে পরাজিত করেন। উভয়ের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হলে বৈরিতার নিরসন হয় ।
আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ একজন বিচক্ষণ শাসক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি মধ্যযুগীয় আরবের সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধন করেন । বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাপূর্ণ আরব দেশে তিনি সর্বপ্রথম শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা স্থাপন করেন। চুরি, রাহাজানি বন্ধ করার জন্য শরীয়তের কঠোর বিধান জারি করেন। চুরির জন্য হাত কেটে ফেলার আইন প্রবর্তনের ফলে লুণ্ঠন ও অরাজকতা কমে যায়। হত্যার পরিবর্তে হত্যা এবং ইসলামে বর্জিত অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য যেমন জেল, কোড়া এবং পাথর দ্বারা হত্যার বিধান কঠোর হস্তে পালন করা হয় ।
আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ একজন দূরদর্শি ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি শাসন ব্যবস্থায়, সুষ্ঠু বিন্যাস করেন। তার একটি মন্ত্রিসভা ছিল এবং এর পরামর্শ ও সহযোগিতায় তার শাসন সুদৃঢ় হয়। সমগ্র সউদি অ'কে ৪টি বিভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক বিভাগের শাসনভাগ ন্যাস্ত হয় একজন শাসন কর্তার উপর। এই বিভাগগুলি হচ্ছে নেজদ,
হেজাজ, হাসা ও আসীর। বিভাগের শাসনকর্তাকে বলা হয় আমীর। বিভাগগুলোকে কয়েকটি জেলায় এবং জেলাগুলিকে শহরভিত্তিক প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত করা হয়। ডেপুটি গভর্নর জেলায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। আমীরকে সাহায্য করেন কাজী ও উলামা শ্রেণী ।
ডেভিড হাওয়ার্থ তার বিখ্যাত জীবন চরিত "The Desert king” (The life of Ibn Soud) গ্রন্থে আবদুল আজিজ ইবনে সউদের কৃতিত্ব সম্পর্কে যথার্থই বলেন, “His kingdom was still his personal estate, his rule was patri- archal his God was all-knowing and his law was the seventh century law of the prophet; and the study of the Koran and Sunna was still the only teachig or learning the approved."
১৫৫৩ সালের ৯ নভেম্বর ৫১ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করে আব্দুল আজিজ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র সউদ আব্দুল আযীয বাদশাহ (১৯৫৩ ১৯৬৪) হিসেবে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। পিতার ন্যায় তিনিও সউদি আরবের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখেন ।
বাদশাহ আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ একটি বিশৃঙ্খল, বহু বিভক্ত, সর্বদা কলহে লিপ্ত, অশিক্ষিত বেদুঈন যাযাবর অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং সউদি আরবের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করেন। তিনি তার প্রথম জীবনে পূর্বপুরুষের হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেছিলেন। কুয়েতে নির্বাসিত সউদ পরিবারকে তিনি পিতৃভূমিতে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্রমাগত রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে তিনি লোহিত সাগর থেকে পারস্য সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-খণ্ডে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি তার রাজ্যের উন্নয়নের পথে পা বাড়ান। স্বদেশবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে সউদি আরবের আধুনিকায়ন করেন ।
আধুনিকীকরণ ও সংস্কারসমূহ
সউদি আরবের আধুনিকায়নের সূচনা করেন স্বনামধন্য সুলতান আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ। উল্লেখ্য যে, সউদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ইখওয়ানদের অবদানের কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ইখওয়ানদের প্রাচিনপন্থি ধ্যান-ধারণা ও কার্যকলাপ আধুনিক সউদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল। কেননা তারা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সকল প্রকার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিরোধিতা করে। তাদের কার্যকলাপ বাদশাহ আব্দুল আজীজকে বিভিন্ন সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। এবং কখনো কখনো বিপদে ফেলেছে। আব্দুল আজিজ সর্বতোভাবে তাদেরকে এসব প্রাচীনপন্থি কার্যকলাপ পরিহার পূর্বক আধুনিকতার পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইখওয়ান
সদস্যদের ধর্মান্ধতা ও আব্দুল আজিজের উন্নয়নশীল বাস্তব রাজনীতি বেশি দিন সমান্তরালভাবে চলা সম্ভব ছিল না। রক্ষণশীল গোড়া ইখওয়ান সদস্যদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য অবদান আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেন। ইখওয়ান সদস্যরা এর বিরোধীতা করলে আব্দুল আজিজ তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন। কিন্তু তারপরও সউদি আরবের আধুনিকায়নের পথে সকল বাধা অপসারিত হয় নি। এক্ষেত্রে তাকে প্রতিনিয়তই প্রাচীনপন্থি উলেমা, এমনকি তার উপদেষ্টাদেরও বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি শক্তি প্রয়োগ না করে অত্যন্ত কৌশলে যুক্তির মাধ্যমে তাদেরকে পরাস্থ করে এবং তার উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অগ্রসর হন। তবে উন্নয়ন আর আধুনিকায়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ। সউদি আরব রাজ্যের প্রতিষ্ঠা লগ্নে রাজ্যটির আয়ের উৎস ছিল অত্যন্ত সীমিত। কৃষি শিল্পে আয় ছিল একেবারেই নগণ্য। সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রাথমিক উৎস ছিল বার্ষিক হজ্জ মৌসুমে হাজীদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও যাকাত এবং সাধারণ শুল্ক থেকে কিছু আয়। কিন্তু এ আয়ের পরিমাণ এত নগণ্য ছিল যে, অর্থাভাব তখন দেশও সরকারের নিত্যসঙ্গী ছিল। তারপরও বাদশাহ আব্দুল আজিজ সউদি আরবের সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরো গতিশীল হয় এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সউদি আরব রাজ্য ও এর সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
তেল অবিস্কারের ফলে সউদি আরব রাজ্যের নব দিগন্তের সূচনা হয় । দেশের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। আব্দুল আজিজ তার পুত্র ফয়সালকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ফয়সালের প্রচেষ্টায়ই মার্কিন মালিকানাধীন Arabian Standard Oil Company যা পরবর্তীতে Arabian American Oil Company (Aramco) নাম ধারণ করে । ১৯৩৮ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিক তেল উত্তোলন শুরু করে। ১৯৫০ সাল নাগাদ তেল হতে আগত অর্থের পরিমাণ দাড়ায় ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তেল সউদির রপ্তানী দ্রব্যের ৯০% স্থান দখল করে নেয়। বিশ্বের মোট মওজুদকৃত তেলের এক চতুর্থাংশ সৌদি আরবে আবিষ্কৃত হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। তেল সম্পদ সউদি সরকারের হাতে অভাবিত পরিমাণ অর্থ এনে দেয়। তেল হতে আগত অর্থ দিয়েই আব্দুল আজিজ বিভিন্ন প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এছাড়া তেল কোম্পানী তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে সউদি আরবের আধুনিকায়নে অন্য ভূমিকা পালন করে। উপরন্ত, ১৯৪০ সাল নাগাদ তেল ক্ষেত্রগুলির নিকটবর্তী শহরগুলিতে ১,৫০০ এরও অধিক মার্কিন নাগরিক বসবাস করতে থাকে। সউদি আরব ছাড়া বিশ্বের খুব কম দেশেই এত সংখ্যক মার্কিন নাগরিক একসাথে বসবাস করত। সউদি শহরগুলিতে তারা এয়ারকন্ডিশনার,
রেফ্রিজারেটর সহ-আধুনিক সব উপকরণ সজ্জিত বাসগৃহে বসবাস করতে থাকে ৷ বিপুল পরিমাণ আমেরিকানের বসবাসের ফলে তেল সমৃদ্ধ দাহরান একটি আধুনিক শহরে রূপলাভ করতে থাকে। আরামকোর অনুসন্ধানের ফলে একের পর এক তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হতে থাকে । দাহরানের ৪০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নব আবিষ্কৃত আবকাইক তেল ক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন শুরু হলে দাহরানের উত্তরে অবস্থিত রাস তানুরাতে একটি তেল শোধনাগার স্থাপিত হয়। রাস তানুরা ও বাহরাইনের মধ্যে সমুদ্রের তেলদেশ দিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রেল লাইন স্থাপন করা হয়। এছাড়া দাহরান থেকে ভূ-মধ্যসাগর পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি মাপের ১,১০০ মাইল দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। আরামকো তেল কোম্পানী এসব কার্যক্রম ও এর সম্প্রসারণের ফলে সরকারের পাশাপাশি সউদি আরবের জনগণও উপকৃত হতে থাকে। কোম্পানিতে কর্মরত প্রায় ৭০,০০০ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। মাত্র কিছুদিন পূর্বেও যারা যাযাবর জীবন-যাপন করত তারা কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত ইটের তৈরী পাকা বাড়িতে বসবাস করতে থাকে। নিয়মিত বেতন প্রাপ্তির ফলে তারা পুষ্টিকর খাবার ক্রয়ের সামর্থ্য অর্জন করে। কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে তারা এমন সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায় যা পূর্বে কল্পনাও করে নি। শ্রমিকদের বাসস্থানগুলিতে কোম্পানি নিয়মিত পানি সরবরাহ, বৈদ্যুতিক সংযোগ, টিনজাত খাবার ও আধুনিক নানা উপকরণের ব্যবস্থা করে যা পূর্বে কেবল ধন্যঢ্যরাই ভোগ করতে পারত। শ্রমিকদের মধ্যে যাদের কিছুটা কারিগরি দক্ষতা ছিল তারা আরো উন্নত জীবন-যাপন করত। তারা বর্ধিত হারে বেতন, বস্ত্র ও বাসস্থান, আর্থিক, খাদ্যসামগ্রী সহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা ভোগ করত। কেউ কেউ কোম্পানির বণিকের পদেও উন্নীত হয়েছিলো। কারিগরি পদগুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষিতদের চাহিদা থাকায় শিক্ষার প্রতি আরবদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। কোম্পানি নিজ উদ্যোগে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য কোম্পানী পাশ্চাত্য চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করে। দাহরান ও রাস তানুরাসহ তেল সমৃদ্ধ শহরগুলিতে আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া যেখানেই শ্রমিকরা বসবাস করত সেখানেই কোম্পানি তাদের জন্য ফার্স্ট-এইডের ব্যবস্থা করেছিল ।
সউদি আরবের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় । উল্লেখ যে, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াল্টা সম্মেলন শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত রাশিয়া সরকারের প্রধান যোশেফ স্টালিন মিশরের Great Bitter Liake বা গ্রেট বিটার হৃদে এক রণতরীতে ইবনে সউদের সাথে আলোচনায় বসেন। এ আলোচনায় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইবনে সউদের নিকট সউদি আরবের রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য সম্পর্কে জানতে চান। ইবনে সউদ অতি সঙ্কোচের সাথে জবাব দেন যে প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধে টি. ই. লরেন্স কর্তৃক হিজাজি রেলপথ ধ্বংসের পর সউদি আরবে আর
নতুন কোন রেলপথ স্থাপন করা হয় নি। সউদি আরবের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম উট। উটের পিঠে করে দাহরান হতে রিয়াদ ১১ দিন, রিয়াদ হতে জেদ্দা ২১ দিন এবং কুয়েত থেকে মক্কা ছিল এক মাসের পথ। কয়েক বছর পূর্বে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সউদি আরবে ২,৩০০ টি ট্রাক আমদানি করা হয়। অদক্ষ চালক ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ১৯৪৫ সাল নাগাদ প্রায় ৭০০ ট্রাক অকেজো হয়ে পড়ে। ইবনে সউদ এ অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমেই রেল যোগাযোগ উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। উল্লেখ্য যে ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে যোগাযোগ বিষয়ক একদল প্রকৌশলী সউদি আরবে আসে। তারা জানায় রেলপথ নির্মাণে সড়কপথ নির্মাণের এক তৃতীয়াংশ খরচ হয়। এছাড়া রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হয় সড়ক পথ রক্ষণাবেক্ষণের এক চতুর্থাংশ। উপরন্তু অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ ও স্বল্প জনবলের মাধ্যমেই রেলপথ পরিচালনা করা সম্ভব। তাই আব্দুল আজিজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রকৌশলী ইবনে সউদকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, একটি আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য আকাশ হতে ভূ-পৃষ্ঠের ছবি (Aerial Photography) তোলা অত্যন্ত জরুরি। প্রকৌশলীরা তাদের কার্যক্রম শুরু করলে ছবি তোলা ইসলাম সম্মত নয় বলে ওলামারা এর বিরোধিতা করে। ইবনে সউদ ওলামাদের একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আলো' কি ভাল না মন্দ? ওলামারা উত্তর দিল আলো ভাল, কারণ পৃথিবীকে আলোকিত করার জন্য আল্লাহ আলো সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি প্রশ্ন করলেন ‘ছায়া' কি ভাল না মন্দ? ওলামারা উত্তর দিলেন এ সম্পর্কে কোরআনে কিছুই বলা নেই। তবে ওলেমারা উত্তর দিল ছায়াও ভাল। কেননা আলোর মধ্যেই ছায়া বিদ্যমান। এমনকি একজন মোমিন ব্যক্তি ও ছায়া ফেলে। তখন আব্দুল আজিজ বললেন, তাহলে ছবি তোলা ভাল । কেননা ছবি আলো ও ছায়ার সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই নয় । ওলামারা হার মানতে বাধ্য হল এবং প্রকৌশলীরা তাদের কাজ শুরু করল। আবদুল আজিজ প্রথমেই রিয়াদ হতে হোফুফ মরুদ্যান, তেল সমৃদ্ধ শহর আবকাইক ও দাহরানের মধ্য দিয়ে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত দীর্ঘ একটি রেলপথ নির্মাণ করেন। তারপর তিনি পুরাতন হিজাজ রেলপথ পুননির্মাণ করেন। ১৯৪৯-১৯৫১ সালের মধ্যে মার্কিন প্রকৌশলীদের সহায়তায় তিনি দাম্মাম ও রিয়াদের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর আব্দুল আজিজ সড়ক ও বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন । ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই সউদি আরবের উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ফুয়াদ বে হামজা যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, কৃষি, পানি সরবরাহ, স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণ সহ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের এক ঘোষণা দেন । এ প্রকল্পের আওতায় জেদ্দা, মক্কা মদিনা সহ দেশের বড় বড় শহরগুলির মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৪৬ সালের সউদি আরবে বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আব্দুল আজিজ 'Trans - Wrold Airways এর সাথে একটি চুক্তি
সম্পাদন করেন। মিশর থেকে ৫টি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২টি বিমান ক্রয় করে তিনি সউদি আরবে বিমান যোগাযোগের গোড়া পত্তন করেন। জেদ্দা, রিয়াদ, দাহরান ও তায়েফ ইত্যাদি বড় শহরের মধ্যে বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নয়নের জন্য তিনি সমুদ্র বন্দর আধুনিকায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯৪৬ সালে বাদশাহ আব্দুল আজিজের আমন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হতে একদল প্রকৌশলী সউদি আরবে আগমন করে। বাদশাহ তাদেরকে তার বহুমুখী পরিকল্পনার কথা অবহিত করেন। এবং প্রকৌশলীদের সহযোগিতা সেগুলো বাস্তবায়নের কাজে হাত দেন। সউদি আরবে দুই হাজার মাইলেরও অধিক সমুদ্র উপকূল থাকা সত্ত্বেও কোন আধুনিক সমুদ্র বন্দর ছিল না। সমুদ্রের তলদেশে ইতস্তত : বিক্ষিপ্ত ভাবে ছোট ছোট শৈল শ্রেণী থাকায় লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর জেদ্দায় সরাসরি জাহাজ নোঙ্গর করা সম্ভব ছিল না। উপকূল হতে দুই মাইল দূরে জাহাজ নোঙ্গর করতে হত। সেখান থেকে ছোট ছোট নৌকায় করে যাত্রী ও পণ্য বন্দরে পৌছাত। একই ধরণের সমস্যার কারণে লোহিত সাগরের তীরবর্তী আল ওয়েজ, ইয়ানবু এবং আল লিথ বন্দর ৩টিতেও কোন বড় জাহাজ আসতে পারত না। আরব বণিকদের ব্যবহৃত এক মাস্তুল বিশিষ্ট ক্ষুদ্র জাহাজ (Dhow) ছিল যাত্রী ও মালামাল পবিরহনের একমাত্র উপায়, রাস তানুরায় আরামকোর তেল রপ্তানির জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাহাজ ব্যবহার করতে হত। এসব জাহাজে তেল বোঝাই করার জন্য তেলবাহী ট্যাংকারগুলিকে ঘন্টার পর ঘন্টা বন্দরে অপেক্ষা করতে হত। পারস্য উপসাগারীয় বন্দরগুলিতে একই সমস্যা ছিল । তাই বাদশাহ আব্দুল আজিজ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এসব বন্দরকে সমস্যামুক্ত করার জন্য নানামুখী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বিদেশি প্রকৌশলীদের পরামর্শক্রমে তিনি উপকূল হতে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত পাথর, নুড়ি ও কাঁকর ইত্যাদি দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেন। এবং রাস্তার শেষ প্রান্তে জেটি নির্মাণ করেন সেখানে জাহাজ নোঙ্গরের ব্যবস্থা করেন। সমুদ্রের তলদেশে শৈল শ্রেণী থাকায় এসব রাস্তা নির্মাণ সহজ হয় এবং রাস্তাগুলির ভিত্তিও মজবুত হয়। এভাবে তিনি বন্দরগুলিকে সমস্যা মুক্ত করেন। হজ্জ্ব যাত্রীরা জাহাজ থেকে নেমে সরাসরি আরব ভূ-খন্ডে পা রাখার সুযোগ পায় । রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীলতা লাভ করে এবং বন্দরগুলি দিয়ে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ পণ্য অল্প সময়ের মধ্যে মক্কা, মদিনা ও তায়েফ সহ সউদি আরবের বড় বড় শহরগুলিতে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
টেলিযোগাযোগ ও বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আব্দুল আজিজ সউদি আরবকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসেন। বিশাল আয়তনের সউদি ভূ-খণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সাথে যোগাযোগও সমন্বয় সাধন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর, সংগ্রহ, আন্ত: গোত্রীয় বিরোধ মিমাংসা ও দস্যুতা
রোধ ইত্যাদি প্রয়োজনে আব্দুল আজিজ সউদি আরবে তারবিহীন টেলিযোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু তার উপদেষ্টা ও ওলামারা এর বিরোধিতা করে। তারা যুক্তি দেখায় যে, বাতাসের মধ্য দিয়ে শত মাইল দূরে মানুষের কথা বহন করে নিয়ে যাওয়া শয়তান ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের মতে বাদশাহ আব্দুল আজিজ অবিশ্বাসী মার্কিন শয়তানদের নিকট তার আত্মা বিক্রি করে দিয়েছেন। বাদশাহ এসব উপদেষ্টা ও ওলামাদেরকে একত্রিত করেন। তারপর তাদেরকে দুটি দলে বিভক্ত করে এক দলকে রাজধানী রিয়াদে তার সাথে অবস্থান করতে বলেন। এবং অন্যদলকে রিয়াদ হতে ৪০০ মাইল দূরে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকদিন পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে আব্দুল আজিজ মসজিদের একজন ইমামকে রিয়াদে ট্রান্স মিটারের সামনে কোরান তেলাওয়াত করতে বলেন এবং তা শুনার পর মক্কাতে পাঠানো ওলামাদের একজনও ট্রান্সমিটারের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করে যা রিয়াদের ওলামারা শুনতে পান। তারপর বাদশা তার উপদেষ্টা এবং ওলেমাদের কোরআনের একটি আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সেখানে বলা আছে পবিত্র কোরআনের একটি শব্দও উচ্চারণ ও বহন করা শয়তানের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বিরোধীরা পরাস্থ হয় এবং আব্দুল আজিজ সমগ্র সউদি আরবে আধুনিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। বহির্বিশ্বের সাথেও তিনি টেলিযোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেন। বেতার তরঙ্গের উপর ওলেমাদের বিরোধিতা দূর হওয়ার পর তিনি সউদি আরবে রেডিও স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের Mackay Radio- এর সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এই কোম্পানি জেদ্দায় একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রেডিও স্টেশন স্থাপন করে সৌদি আরবের অন্যান্য শুরুত্বপূর্ণ শহরের সাথে বেতার যোগাযোগ স্থাপন করে ৷ এসব বেতার কেন্দ্র হতে নিয়মিতভাবে স্থানীয় ও বিশ্ব সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে । তার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বারিদ-আল-হেজাজ নামে একটি দৈনিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয় ।
শিল্প ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। রাজতন্ত্রের সূচনালগ্নে সউদি আরবে গুটি কয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৮৭০ সালের ভারতীয় এক রমনী হজ্জ্ব পালন করতে গিয়ে সউদি আরবে শিক্ষার অনগ্রসরতা লক্ষ্য করে এ ক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষে আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৮৭১ সালে সাওলাতিয়াহ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার অনুসরণে পরবর্তীতে এ জাতীয় কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির উন্নতি সম্ভব নয় । একথা উপলব্ধি করে আব্দুল আজিজ সারা দেশে শিক্ষা বিস্তারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি উদার হস্তে ছাত্রদের সাহায্য করেন। দেশের মধ্যে বই পুস্তক প্রকাশনা এবং তা বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষায় আধুনিকায়নের
লক্ষ্যে তিনি ১৯২৬ সালে “জেনারেল ডাইরেক্টরেট অফ এডুকেশন” ও “সউদি বৈজ্ঞানিক ইন্সটিটিউট' স্থাপন করেন এবং বিচারক ও শিক্ষক তৈরীর উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মত দুটি কলেজ “কলেজ অব হিউম্যানিটিজ” ও “কলেজ অব শারিয়া” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র ও বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি শিক্ষা কমিশন সউদি আরবে এসে মুসলিম শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে স্কুল স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়৷ এছাড়া আব্দুল আজিজ সউদি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য মিশরসহ অন্যান্য আরব দেশ এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন। তারা সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শি হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে সউদি আরবের পুনর্জাগরণে বিশেষ অবদান রাখে। তাদের উদ্যোগে দেশে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার লাভ ঘটে। এরপর তিনি চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন করে জনগণকে আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে আরামকো কোম্পানির হাসপাতাল ও ফাস্ট এইড কেন্দ্রগুলি সফলতা অর্জন করে । জেদ্দায় প্রতিষ্ঠিত মার্কিন দূতাবাসের ক্লিনিকটিও অত্যন্ত সফলভাবে আধুনিক চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা প্ৰদান করছিল। আব্দুল আজিজ দেখলেন যে গুটি কয়েক চিকিৎসা কেন্দ্র দেশের মানুষের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এছাড়া দাহরান ও জেদ্দা থেকে হাজার মাইল দূরের মানুষ এই চিকিৎসা সেবার সুযোগ হতে বঞ্চিত। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর সহায়তায় রিয়াদ, তায়েফ, হেজাজ ও জেদ্দায় ৪০০ সদস্য বিশিষ্ট ৪টি অত্যাধুনিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এতে চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসারিত হয় ।
বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা ছিল অপরিহার্য। কেননা মরুময় সউদি আরবে পানির সমস্যা ছিল প্রকট। বাদশাহ আব্দুল আজিজ প্রথমেই জেদ্দা শহরের পানির সমস্যা সমাধানের প্রকল্প হাতে নেন। শহর ও শহরের বাইরের কিছু অগভীর কূপ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলধার, সমুদ্রের পানি বিশুদ্ধকরণের একটি পুরাতন জীর্ণশীর্ণ প্রকল্প এবং মিশর থেকে আমদানিকৃত পানির বোতল (যা মূলত বিদেশিরা পান করত) থেকে জেদ্দার খাবার পানি সংগৃহীত হত। বিশুদ্ধ খাবার পানির স্বল্পতার কারণে জেদ্দায় সারা বছর পানিবাহিত রোগ লেগেই থাকত। হজ্জ মৌসুমে যখন জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত তখন সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করত। ১৯৪৫ সালে পানি সমস্যার কারণে হজ্জ যাত্রীরা অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করে । আব্দুল আজিজ পরবর্তী হজ্জ মৌসুমের পূর্বেই এ সমস্যা সমাধানের ঘোষণা দেন। তিনি সমুদ্র উপকূল হতে ২৬ মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত উর্বর উপত্যকা ওয়াদি ফাতেমা এবং জেদ্দার ৩০ মাইল উত্তরে অবস্থিত ওয়াদি উসকান উপত্যাকা হতে পানি আনার ব্যবস্থা
করে জেদ্দা শহরের দীর্ঘকালের পানির সমস্যা সমাধান করেন। একইভাবে তিনি অন্যান্য শহরেও পানি সমস্যা সমাধানের প্রকল্প গ্রহণ করেন। এর ফলে সউদি আরবে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট বহুলাংশে দূরীভূত হয়। শুধু বিশুদ্ধ পানীয় জলই নয়, কৃষি ও সেচ ব্যবস্থারও উন্নয়নে তার অবদান অপরিসীম । সউদি আরবের পার্বত্যাঞ্চলগুলিতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলেও কৃষি ক্ষেত্রে এ বৃষ্টিপাত কোন কাজে আসত না। লোহিত সাগরের তীরবর্তী হিজাজ ও আসীর এবং নজদের পার্বত্যাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত। কিছু কিছু স্থানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ১২ ইঞ্চি। এসব বৃষ্টিপাতের অধিকাংশই ঝড়ের সময় মুষলধারে বর্ষিত হত এবং হঠাৎ করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসে বন্যার সৃষ্টি করত। এই অকস্মাৎ বন্যার হাত হতে শহরগুলিকে রক্ষা করে বৃষ্টির পানিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আব্দুল আজিজ একটি বিশেষজ্ঞ্য কমিটি গঠন করেন । পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে বেরিয়ে আসে যে অতীতে আরবরা পাহাড় থেকে নেমে আসা এই বৃষ্টির পানি ধরে রেখে চাষাবাদ ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করত । কমিটি শুধুমাত্র তায়েফেই ছয়টি বাধ আবিষ্কার করে। এছাড়া উপকূলবর্তী পার্বত্যাঞ্চলে অসংখ্য জলাধার ও ছোট ছোট বাঁধ দেখতে পায়। বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা আন্তঃগোত্রীয় বিরোধের ফলে এসব বাধ ও জলাধার সংস্কারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছিল। আব্দুল আজিজ বাঁধগুলি সংস্কার করে পাহাড়ি ঢলকে আটকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে অকস্মাৎ বন্যার হাত থেকে শহরবাসী রক্ষা পায়। উপরন্তু তিনি জলাধারগুলি সংস্কার করে অটককৃত পানি ধরে রেখে তা সেচের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তবে মধ্য আরবে সেচের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন সমস্যা ছিল। এখানকার Tuwayq পর্বতমালার বৃষ্টির পানি জনপদে নেমে না এসে ভূগর্ভস্থ চুনাপাথরের স্তরে জমা হত। এবং নজদ ও হাসার নিচ দিয়ে পারস্য উপসাগরে চলে যেত। বাহরাইন দ্বীপের জেলেরা পারস্য উপসাগরে বুদবুদ আকারে ভেসে উঠা এসব পানি সরবরাহ করে তা পান করত। ভূ-গর্ভস্থ পানির এই প্রবাহ সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে আরবের অভ্যন্তরে একটি কুপে হারিয়ে যাওয়া কাঠের পাত্র নাকি পরবর্তীতে পারস্য উপসাগরের ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছিল। এ থেকে বুঝা যায় মধ্য আরবের ভূগর্ভস্থ পানির সাথে পারস্য উপসাগরের যোগাযোগ রয়েছে। অনেক সময় এসব পানি মাটি ফুঁড়ে ভূ- পৃষ্ঠে ওঠে আসত। হাসার ভূ-গর্ভস্থ চুনাপাথরের বিচ্যুতির ফলে ৪০টির মত কূপ দিয়ে অনবরত পানি বের হয়ে আসার কারণে হোফুফ মরুদ্যানে দুই মিলিয়নেরও বেশি খেজুর গাছ পানি সরবরাহ পেয়ে থাকে। রিয়াদ, দিলাম, বুরায়দাহ ও উনায়জাহ অঞ্চলের মরুদ্যানগুলিও এভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির সরবরাহ পেয়ে সারা বছর উর্বর থাকে। ইবনে সউদ পাম্পের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহারে
ব্যবস্থা করে দেন। সেচ ব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে, রিয়াদের ৫০ মাইল দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত আল-খারয অঞ্চল। স্থানে স্থানে ভূ-গর্ভস্থ চুনাপাথরের স্তর ভেঙ্গে পড়ায় এখানে ছোট ছোট হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ মাইল গভীরে এসব হৃদ স্বচ্ছ পানিতে পূর্ণ ছিল। বাদশাহ আব্দুল আজিজ মার্কিন কৃষি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় সেচের মাধ্যমে এসব পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে মরুময় ২০০০ একর ভূ-খণ্ড শস্য শ্যামল হয়ে উঠে। এখানে গম, আলফালফা (পশু খাদ্যরূপে ব্যবহৃত উদ্ভিদ বিশেষ), তরমুজ, স্কোয়াশ, লেটুস, টমেটো, বেগুন, পেয়াজ, গাজর, ব্রকোলি ও বাঁধাকপি ইত্যাদি ফসল ফলানো সম্ভব হয় ।
আল-খারযের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আব্দুল আজিজ অন্যান্য অঞ্চলেও এই ধরনের প্রকল্পের সফলতার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেন। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি একটি water survey team গঠন করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ টিম তাকে অবহিত করে যে সউদি আরবের ভূ-গর্ভস্থ নালাগুলি দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ১০গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব । বাদশাহ আব্দুল আজিজ ভূ-গর্ভস্থ পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য জায়গায় জায়গায় কূপ খনন করে ডিজেল চালিত পাম্পের মাধ্যমে তা কৃষিকাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেন।
বৈদ্যুতিক সংযোগ ও শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৯৪০ এর দশকে রাজধানী রিয়াদের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৯০,০০০ । কিন্তু সন্ধ্যার পর রিয়াদে আলোর একমাত্র উৎস ছিল লণ্ঠন ও মোমবাতি। গুটি কয়েক অবস্থাপন্ন পরিবার জেনারেটর ব্যবহার করত। বাদশাহ আব্দুল আজিজ রিয়াদে একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যুত প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে রিয়াদের জীবনযাত্রার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এয়ার কণ্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, ডিপ ফ্রিজ ইত্যাদি অত্যাধুনিক উপকরণের ব্যবহার রিয়াদকে একটি আধুনিক শহরের মর্যাদা দান করে। সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলিতে সন্ধ্যার পরও কাজ করা সম্ভব হয়। ইতোপূর্বে ৩০০টিরও বেশি কূপ হতে গাধা ও উটের পিঠে করে চামড়ার ব্যাগের মাধ্যমে রিয়াদে পানি সরবরাহ করা হত। আব্দুল আজিজ এর পরিবর্তে বিদ্যুত চালিত পাম্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তিনি পবিত্র শহর মক্কা, মদিনাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতেও বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। বাদশাহ আব্দুল আজিজ দেশিয় শিল্পের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তেল আবিষ্কার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ফলে এসব শিল্পে গতিশীলতা আসে। ফলে পূর্বে যেখানে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু বাইরে থেকে আমদানি করতে হত, পরবর্তীতে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীই স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন করা সম্ভব হয় ।
সামরিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। আব্দুল আজিজ সউদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে একটি সুশৃঙ্খল এবং বিশাল সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার প্রচেষ্টায় আধুনিক সময়রাস্ত্রে সজ্জিত একটি সেনাবাহিনী গঠিত হয়। প্রথমে তুর্কি সেনাধ্যক্ষ এবং ১৯৩০ সালের পর ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা এই বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৩৪ সালের পর ব্রিটিশ কারিগর ও বৈমানিক নিযুক্ত হয়। ক্রমশ সউদি বাহিনী সউদি নাগরিকদের দ্বারা গঠিত হতে থাকে। আব্দুল আজিজ উপলব্ধি করেন যে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে বিদেশি কারিগর ও উপদেষ্টা প্রয়োজন। এই কারণে তিনি সিরিয়া, লেবাননী, দ্রুজ ও মিশরীয় কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। কূটনীতি ক্ষেত্রে আব্দুল আজিজ বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি বিচক্ষণতার দ্বারা ওয়াহাবী মতবাদের সাথে জাতীয়তাবাদী আরব ভাবধারার সমন্বয় সাধনে সক্ষম হন। এভাবে সউদি আরবে একটি প্রগতিশীল এবং বিত্তশালী আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষভাবে আগ্রহী আব্দুল আজিজ তার পুত্রদের ইউরোপ ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রেরণ করেন। ইরান, তুরস্ক ও মিশরের সাথে মিত্রতা স্থাপিত হয়। সউদি আরবকে মুসলিম বিশ্বে একটি প্রধান ও প্রভাবশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১৯২৬ সালে মক্কা শরীফে একটি প্যান-ইসলামিক কনফারেন্সের আয়োজন করেন। আব্দুল আজিজ ‘বাদশাহ' উপাধি ধারণ করে কৃতিত্বের সাথে সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি ইত্যাদি দেশের সাথে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন ।
সর্বোপরি, আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ একজন ওয়াহাবি হিসেবে নিজেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনেক কিছুর প্রতিই সন্ধিহান ছিলেন। একই সাথে এটাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শাসন ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার জন্য এবং মরুময় দেশবাসীর স্বাচ্ছন্দের জন্য পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তিনি অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার ভাল দিকগুলোর সুফল সউদি আরবের জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই কাজে তাকে প্রাচীনপন্থীদের বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এসব বিরোধ মোকাবেলা করে তিনি সউদি আরবকে উন্নয়নের পথে পরিচালিত করেন। তার এই নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টাকে পরবর্তীতে তার উত্তরসূরীরাও অব্যাহত রাখেন। যার ফলে সউদি আরব দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন যুগে প্রবেশ করে এবং প্রগতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাই আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ কর্তৃক সউদি আরবকে আধুনিকীকরণের লক্ষে পরিচালিত সংস্কারসমূহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ডেভিড হার্ডওয়ার্থ তার বিখ্যাত জীবনচরিত “The Desert King" (The life Ibn Saud) গ্রন্থে যথার্থই বলেন, "His kingdom was still his personal estate, his rule was patriarchal, his God was all-knowing and his law was the seventh century of the Koran and Sunna was still the only teaching or learning he approved."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]