আরব লীগ (The Arab League)

আরব লীগ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আঞ্চলিক রাজনৈতিক জোট হিসেবে পরিচিত। আরব জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত আরব লীগ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফেক্টর। যদিও এর উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। তবু প্রতিষ্ঠানটি আরব দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে।
এক নজরে আরব লীগ
প্রতিষ্ঠিত হয় : ২২ মার্চ ১৯৪৫ ।
প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য : ৭টি। ইরাক, সিরিয়া, মিশর, লেবানন, জর্ডান, ইয়ামেন ও সৌদি আরব।
বর্তমান সদস্য : ২২টি। আলজেরিয়া, বাহরাইন, কমোরোস, জিবুতি, মিশর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন ।
আরব লীগের পর্যবেক্ষক দেশ : ব্রাজিল, ইরিত্রিয়া, ভারত ও ভেনিজুয়েলা । ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ : মিশর ।
আরব লীগের সদর দফতর : কায়রো মিশর ।
(বি.দ্র. মিশর ইসরাইলের সাথে ১৯৭৮ সাল ক্যাম্প ডিভিড চুক্তি স্বাক্ষর করায় মিশরকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করায় সদর দফতর তিউনেসিয়ার রাজধানী তিউনিসে স্থানান্তর করা হয়। পরে আবারো কায়রোতে সদর দপ্তর ফিরিয়ে আনা হয়।
আরব লীগ বহির্ভূত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ : ইরান ।
পটভূমি : ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওসমানিয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল আরব অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয়তাবাদীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নি। তাই তুর্কি শাসনাধীনে বসবাস করা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরবদেরকে তুর্কি শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করার সুযোগ এনে দেয়। যুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষাবলম্বন করলে আরবরা মিত্রশক্তির পক্ষে যোগ দেয় । তুর্কি শাসন হতে মুক্ত হয়ে একটি বৃহত্তর আরব রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যুদ্ধে মিত্রশক্তি জয়লাভ করলেও যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি সম্মেলনে আরবদের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে নি। বরং যুদ্ধের পর তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আরব অঞ্চলসমূহ কয়েকটি ম্যান্ডেটরি শাসনাধীন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়। ইরাক ও ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ এবং সিরিয়া ও লেবাননে ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আরবরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তবে ম্যান্ডেটভুক্ত আরব অঞ্চলগুলির সমন্বয়ে একটি মাত্র আরব রাজ্য গঠনের প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে। কিন্তু তখনও আরবদের মন থেকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা নিঃশেষ হয়ে যায় নি। দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে প্যান আরব সম্মেলন এবং ফিলিস্তিন সমস্যাকে কেন্দ্র করে আরব ঐক্যের চেতনা জাগ্রত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে ব্রিটিশ সরকার আরবদের এই চেতনাকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে। আরবদের বন্ধুত্ব অর্জনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে অক্ষশক্তির তৎপরতাকে মোকাবেলা করাই ছিল ব্রিটেনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে কাঙ্খিত আরব ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথক পৃথকভাবে আরব রাষ্ট্রগুলি স্বাধীনতা লাভ করল। তবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুপ্ত বাসনা তখনও তাদের মন থেকে মুছে যায় নি। এ পর্যায়ে বৃহত্তর আরব রাজ্য গঠনের পরিবর্তে তারা একটি সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার আগ্রহ প্রকাশ করল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অক্ষশক্তির হুমকি না থাকলে ও ভিন্ন কারণে ব্রিটেন আরবদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই প্রচেষ্টায় উৎসাহ উদ্দীপনা যোগাতে লাগল । সাম্রাজ্যাবদী দেশ ব্রিটেন তার চিরাচরিত 'ভাগ কর শাসন কর' নীতি পরিত্যাগ করে আরব ঐক্যের প্রয়াসকে স্বাগত জানাল। ব্রিটেনের এ অভূতপূর্ব আচরণ আপাতঃ দৃষ্টিতে বিস্ময়কর মনে হলে তৎকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপেট এছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। উপনিবেশগুলি আর আগের মত লাভজনক ছিল না। বরং উপনিবেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করতে সেখানে প্রচুর সেনা সদস্য নিয়োগ করতে হতো। উপনিবেশের জনগণের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে প্রচুর অর্থব্যয় করতে হতো। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ব্রিটেন বুঝতে পেরেছিল যে এ উপনিবেশগুলিকে যুদ্ধের পর আর ধরে রাখা যাবে না। ম্যান্ডেটভুক্ত অঞ্চলগুলির ক্ষেত্রেও এই কথা সমভাবে প্রযোজ্য। তাই ব্রিটেন অঞ্চলগুলিকে একটি সংস্থার অধীনে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন এবং এর মাধ্যমে পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বজায় রাখতে চেয়েছিল। অবশেষে আরবদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা এবং ব্রিটেনের সহায়তায় ১৯৪৫ সালের ২২ মার্চ সাতটি আরব দেশের সমন্বয়ে আরব লীগের জন্ম হয়। এর সদস্য সংখ্যা ২২টি। সদস্য দেশগুলো হল- আলজেরিয়া, বাহরাইন, কমোরোস, জিবুতি, মিশর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। এর সদর দপ্তর মিশরের কায়রোতে অবস্থিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ব্রিটিশ নীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ব্রিটেন ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখার নীতি পরিত্যাগ করে এবং এর স্থলে একটি আরব রাজ্য অথবা রাজ্যসমূহকে সমন্বয়ে একটি ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্রিটেন দুইটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। এর একটি হচ্ছে ভারতবর্ষে যাতায়াত পথের উপর একটি বন্ধুভাবাপন্ন রাজ্য প্রতিষ্ঠা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল বন্ধুভাবাপন্ন রাজ্যটির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণমুখী সম্প্রসারণ নীতিকে প্রতিহত করা। অর্থাৎ আরব রাজ্যটি গঠন করে একে একটি বাফার জোন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ব্রিটেনের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্রিটেন মক্কার শরীফ হুসেইনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় উপনীত হয় এবং হাশেমি বংশের নেতৃত্বে আরবদের স্বাধীনতা প্রদানের অঙ্গীকার করে। কিন্তু ফ্রান্স ও ইহুদিদের সঙ্গে সম্পাদিত যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তির কারণে যুদ্ধশেষে ব্রিটেন তার এ অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে নি। ফলে আরব ঐক্যের বদলে যুদ্ধের পর আরবরা দেখল তাদের ভূ- খণ্ড বহুধা বিভক্ত এবং স্বাধীনতার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ম্যান্ডেটরি শাসন। বাদশাহ হুসেইন হতাশায় নিমজ্জিত হলেন এবং আবদুল আজিজ ইবনে সউদ কর্তৃক তাঁর রাজ্য হতে বিতাড়িত হলেন। ফয়সালের ভাগ্যেও একই পরিণতি জুটল। তিনি ফরাসিদের দ্বারা দামেস্ক হতে বিতাড়িত হলেন। হুসেইনের অপর পুত্র আব্দুল্লাহ ইরাকে শাসন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর সে আশা ভঙ্গ হল । তাঁকে জর্ডান নদীর পূর্ব তীরে মরুময় অনুর্বর ট্রান্স জর্ডানের শাসক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল ।
দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে ব্রিটেন তার আরব ঐক্যের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। কেননা এ জন্য তাকে আরবদের বন্ধুত্ব অথবা ফ্রান্স ও জাইয়নবাদীদের শত্রুতা এই দুইয়ের যেকোন একটিকে বেছে নিতে হতো। কিন্তু এ সময় ব্রিটেন আরবদের বন্ধুত্বের বিনিময়ে ফ্রান্স ও জাইয়নবাদীদের শত্রুতা অর্জনে ইচ্ছুক ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আরব বিশ্বে নাৎসী প্রচার প্রচারণা রোধে ব্রিটেন ফরাসি ও জাইয়নবাদীদের শত্রুতার বিষয়টিকে অনেকটা উপেক্ষা করেই আরবদের বন্ধুত্ব অর্জনের নীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। এ লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালের প্রথম দিকে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ব্রিটেন লন্ডনে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি ছাড়াও আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রতিনিধি আহ্বান করে ব্রিটেন আরবদের বন্ধুত্ব অর্জন করতে চেয়েছিল গোল টেবিল বৈঠকের পর পরই ব্রিটেন আরবদের ইচ্ছার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। আরবরা যাতে যুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগদান না করে সেদিকে লক্ষ রেখেই ব্রিটেন এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অন্যদিকে ইহুদিদের ব্রিটেনের পক্ষে না থেকে কোন উপায় ছিল না। কেননা ইহুদি বিদ্বেষী হিটলারের সঙ্গে তাদের সমঝোতার কোন সম্ভাবনাই ছিল না ।
১৯৪০ সালে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেয়ার পর দ্য গলের নেতৃত্বে লন্ডনে স্বাধীন ফ্রান্স সরকার গঠিত হয়। এই সরকার পুরোপুরিভাবে ব্রিটেনের উপর নির্ভরশীল ছিল। আর তখনই ব্রিটেন ফ্রান্সের বিরোধীতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ পায়। এ সময় ব্রিটেন আর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতি নির্ধারণে দ্য গল সরকারের মতামতকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। এভাবে ইহুদি ও ফরাসিদের প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্রিটেন আরবদের বন্ধুত্ব অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ১৯৪১ সালের ২৯মে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ইডেন এক ঘোষণায় বলেন—“গত বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আরব বিশ্ব দ্রুত উন্নয়নের পথে ধাবিত হচ্ছে এবং অনেক আরব চিন্তাবিদ আরবদের বৃহত্তর ঐক্যের প্রতি আশবাদী। এ ঐক্য বাস্তবায়নের জন্য তাঁদেরকে সমর্থন দেয়া প্রয়োজন। আরবরা এ ধরনের কোন সমর্থন চাইলে ব্রিটিশ সরকার নিশ্চুপ থাকবে না। ব্রিটিশ সরকার এ বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।” এই ঘোষণার এক সপ্তাহ পরেই ব্রিটেন জার্মান প্রভাবিত ফরাসি তাঁবেদার সরকারের কাছ থেকে সিরিয়া লেবানন দখল করে নেয়। ফলে ব্রিটেনের পক্ষে আরো স্বাধীনভাবে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতি নির্ধারণ সম্ভব হয়। বস্তুত এ সময় ব্রিটেন আবারও গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার মত অবস্থান ফিরে পায়। কেননা একমাত্র সউদি আরব ও ইয়েমেন ছাড়া গোটা মধ্যপ্রাচ্য তখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইতোমধ্যে ফ্রান্স জার্মানির নিকট আত্মমর্পণ করে এবং জার্মানির সঙ্গে পৃথকভাবে একটি মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষর করে ব্রিটেনের বিরাগভাজন হয় । এ সময় ফ্রান্স যে শুধু ব্রিটেনের পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তা-ই নয় বরং সে সিরিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে জার্মান প্রচার-প্রচারণার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে ব্রিটেনের শত্রুতাও অর্জন করেছিল। ফলে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের প্রতি ব্রিটেনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা আরো হ্রাস পায়। অবশ্য ব্রিটেনে নির্বাসিত স্বাধীন ফ্রান্সের সরকার মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল। তবে জার্মান প্রভাবিত সরকারের কাছ থেকে সিরিয়া-লেবানন দখলের সময় স্বাধীন ফ্রান্স সরকারের ভূমিকা ছিল অতি নগণ্য। তাই এই সরকারের কাছেও ব্রিটেনের তেমন কোন দায়বদ্ধতা ছিল, না। সিরিয়া লেবানন দখলের পর এর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা -ভাবনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্রিটেন চেয়েছিল সিরিয়া লেবানন হতে ফরাসি প্রভাবমুক্ত করে সমগ্র ফারটাইল ক্রিসেন্ট নিয়ে একটি আরব ইউনিয়ন গঠন করতে। তাই ১৯৪১ সালের পর হতেই ব্রিটিশ পদক্ষেপ ছিল সুসংহত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ। এবারও ব্রিটেনকে দ্য গলের স্বাধীন ফ্রান্স সরকার অথবা আরবদের বন্ধুত্ব এই দুইয়ের একটিকে বেছে নিতে হয়েছিল । ব্রিটেন দ্বিতীয়টিকেই বেছে নেয় অর্থাৎ আরবদের বন্ধুত্ব অর্জনকেই সে অগ্রাধিকার দেয়। কেননা তখন জাইয়ানবাদীদের মত স্বাধীন ফ্রান্স সরকারও দর কষাকষির অবস্থানে ছিল না । ফলে একমাত্র মৌখিকভাবে ব্রিটিশ নীতির প্রতিবাদ করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না ।
আরবদের দিক থেকে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নূরি আল সাঈদ পাশা। তিনি ১৯৪২ সালে একটি ব্লু বুকে প্রথম আরব ঐক্যের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ব্লু বুকটিকে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হতে আরব ইহুদি সমস্যার বর্ণনা দেন এবং বৃহত্তর সিরিয়া গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেন। তাঁর মতে ক্রমাগত ইহুদি আগমনের ফলে ফিলিস্তিনী আরবদের সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার ভয় রয়েছে। ফিলিস্তিনকে একটি বৃহত্তর আরব ঐক্যের অংশে পরিণত করা গেলে সেই ভীতি দূর হবে। ব্লু বুকে তিনি সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ট্রানস জর্ডানের সমন্বয়ে বৃহত্তর সিরিয়া গঠন এবং এই বৃহত্তর সিরিয়ার সঙ্গে ইরাকের সমন্বয়ে একটি ফেডারেশন গঠনের সুপারিশ করেন। ফেডারেশনটি ফারটাইল ক্রিসেন্টভুক্ত অঞ্চলসমূহকে একত্রিত করবে। পরে অন্যান্য আরব দেশও এতে যোগদান করতে পারবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এভাবে প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর ঐক্যের পথ সুগম হবে। পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ
(এ) সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ট্রান্স জর্ডান তাদের পৃথক অস্তিত্ব ত্যাগ করে একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে ।
(বি) ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রটি কি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হবে না ফেডারেশন হবে, রাষ্ট্রটিতে কী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্রের জনগণ ।
(সি) ঐক্যবদ্ধ এই সিরিয়ার সঙ্গে ইরাক যোগ দিয়ে একটি আরব লীগ গঠন করবে। ইচ্ছা করলে অন্য রাষ্ট্রগুলিও এতে যোগ দিতে পারবে ।
(ডি) ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদিদের আধাস্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের অধীনে থেকে ইহুদি অধ্যুষিত জেলাগুলিতে তারা নিজস্ব প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে।
(ই) জেরুজালেমে সকল ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ যাত্রার অধিকার থাকবে। তিনটি ধর্মের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি স্ব ধর্মের তীর্থ যাত্রীদের অধিকার নিশ্চিত করবে।
(এফ) লেবাননের সংখ্যালঘুরাও ইচ্ছা করলে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এই শাসন ব্যবস্থায় ওসমানিয় শাসনামলের শেষ দিকে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করত সেগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে ।
নূরি তাঁর এই পরিকল্পনা কায়রোতে অবস্থানরত মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিনিধি রিচার্ড কেসির নিকট প্রেরণ করেন এবং ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ আরব নেতাদের মধ্যে পরিকল্পনাটির প্রায় ৩০০ কপি বিতরণ করেন। তাঁর এই পরিকল্পনার প্রতি ব্রিটেনের পূর্ণ সমর্থন ছিল ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইডেন আবারও আরব ঐক্যের প্রতি ব্রিটিশ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন । তবে তিনি বলেন, আরবদেরই এর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং এর প্রতি আরব দেশসমূহের সমর্থন থাকতে হবে। কিন্তু নূরির এই পরিকল্পনা জাইয়নবাদকে প্রতিহত করার বদলে আরো বিস্তার লাভের সুযোগ করে দিবে। তিনটি পক্ষ এর বিরোধিতা করে। প্রথমত, মিশর ইরাকের নেতৃত্বে আরবের উত্তরাঞ্চলে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে উঠার বিরোধী ছিল। কেননা এতে এই অঞ্চলে মিশরের প্রভাব খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সউদি আরবের সউদ রাজবংশ হাশেমী বংশের শাসনাধীন ইরাকের নেতৃত্বে যে কোন প্রকারের ঐক্যের বিরোধী ছিল। তৃতীয়ত, সিরিয়া, এবং লেবানন তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল এবং উভয় পক্ষই পৃথক পৃথকভাবে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল । এমনতাবস্থায় একটি বৃহত্তর আরব রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হয় নি । ফলে নূরি আল সাঈদের পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয় ।
আরব ঐক্যের ব্যাপারে দ্বিতীয় পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন জর্ডানের আমীর আব্দুল্লাহ । তিনি তাঁর নেতৃত্বে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ট্রান্স জর্ডানের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর সিরিয়া গঠনের কথা বলেন। ১৯৪৩ সালের ৬ মার্চ জর্ডানের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কর্তৃক একটি আরব ফেডারেশন গঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু আব্দুল্লাহর এই প্রস্তাবে তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা প্রতিফলিত হওয়ায় এতে অন্য আরব দেশগুলির সাড়া মেলে নি। প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য করার জন্য তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ে ইরাকসহ অন্যান্য আরব দেশের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন এবং প্রস্তাবিত আরব ফেডারেশনের নেতৃত্ব পর্যায়ক্রমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আবর্তিত হবে বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপরও আরব দেশগুলো এই ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় নি ।
আরবী লীগ গঠনের চূড়ান্ত পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন মিশরের প্রধান মন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে তিনি মিশরের পার্লামেন্টে আরব ঐক্যের পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি একটি আরব ঐক্য সংস্থা গঠনে মিশরের সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আরব দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মিশরে আমন্ত্রণ জানান ।
আলোচনায় আরব দেশগুলির প্রতিনিধিবৃন্দ দুই ধরনের মত প্রকাশ করে। বেশির ভাগ দেশই পূর্ণ ঐক্যের বদলে একটি শিথিল-বন্ধন সংস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেয়। একমাত্র সিরিয়া তার সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে পূর্ণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল। অবশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতটিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু তারপরও সউদি
আরব ও লেবানন তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কিত ছিল। কায়রোতে অবস্থানরত মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিনিধি লর্ড মোন সউদি আরব ও লেবাননকে এই বলে আশ্বাস দেন যে, সংস্থাটিতে যোগদানের ফলে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হবে না। তারা এতে আশ্বস্ত হয় ।
১৯৪৪ সালের ৭ অক্টোবর মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের ৭টি আরব দেশ অদূর ভবিষ্যতে সকল দেশের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালার ভিত্তিতে আরব লীগ গঠনের ব্যাপারে একটি সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করে যা আলেকজান্দ্ৰিয়া প্রটোকল নামে পরিচিত। এই প্রটোকলে পূর্ণ ঐক্যের বদলে স্বাধীন আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আরব ঐক্যসংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবিত সংস্থার সংবিধান প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ছয়টি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। লেবাননকে আবারও তার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এছাড়াও প্রটোকলটিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংযোজিত হয়—প্রথমত, সদস্য রাষ্ট্রগুলো এমন কোন নীতি গ্রহণ করবে না যা আরব লীগের জন্য ক্ষতিকর। দ্বিতীয়ত, সদস্য রাষ্ট্রগুলো একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এই দুটি ধারায় যথাক্রমে ব্রিটিশ ও মিশরিয় নীতির সফলতা পরিলক্ষিত হয়। প্রথম ধারাটি সিরিয়া ও লেবানন কর্তৃক ফ্রান্সের সাথে কোন প্রকার চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছিল । ফলে এই অঞ্চলে ফরাসি প্রভাব হ্রাসের ব্রিটিশ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়। দ্বিতীয় ধারাটির মাধ্যমে মিশর তার প্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে রাজতান্ত্রিক প্রচার- প্রচারণা থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছিল। কেননা সউদি আরবসহ বেশ কিছু আরব রাষ্ট্র মিশরের প্রজাতন্ত্রকে তাদের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি মনে করত । তাই রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি যাতে মিশরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে প্রজাতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সে লক্ষ্যেই দ্বিতীয় ধারাটি সংযোজন করে মিশর কুটনৈতিক সফলতার পরিচয় দেয়। বিশেষ কমিটি সমূহের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে আরব লীগের সংবিধান প্রণীত হয়। ২২ মার্চ মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সউদি আরব ও ট্রান্স জর্ডান সংবিধানে স্বাক্ষর করে । ইয়েমেন স্বাক্ষর করে মে মাসের ১০ তারিখে
সাংবিধানকি কাঠামো
আরব লীগের সংবিধানের শুরুতেই লীগের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরব স্বার্থ রক্ষা করাই হচ্ছে আরব লীগের উদ্দেশ্য। পারস্পরিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উপর ভিত্তি করেই এই উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব বলে সংবিধানের মুখবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরব রাষ্ট্র সমূহের সাধারণ কল্যাণ সাধন, মর্যাদা বৃদ্ধি, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও রাষ্ট্রসমূহের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়ন ও আরব লীগের উদ্দেশ্য ছিল। আরব লীগের সংবিধানে ২০টি মূলধারা ও তিনটি সংযুক্তি রয়েছে। মূলধারা ২০টি নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১। আরব লীগের সনদে স্বাক্ষরকারী স্বাধীন আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হবে আরব লীগ। প্রত্যেক স্বাধীন আরব রাষ্ট্রেরই আরব লীগের সদস্য হওয়ার অধিকার থাকবে। সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রটিকে লীগ সচিবালয়ে একটি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে যা লীগ কাউন্সিলের পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে।
২। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়নে তাদের রাজনৈতিক কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে আরব লীগ। আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করা ও আরব লীগের দায়িত্ব। এছাড়া ও আরব লীগ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে ।
(এ) কৃষি, শিল্প, মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্ৰসমূহ ৷
(বি) রেলপথ, সড়কপথ, নদীপথ ও আকাশপথে যোগাযোগ এবং ডাক ও টেলিয়োগাযোগ ব্যবস্থা
(সি) জাতীয়তা, পাসপোর্ট, ভিসা ও বহিঃসমর্পণ ।
(ডি) সমাজ কল্যাণ, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি ।
৩। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল গঠিত হবে এবং এই কাউন্সিলে প্রত্যেক রাষ্ট্রের একটি করে ভোট থাকবে। লীগের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও পূর্ববর্তী ধারায় বর্ণিত বিষয়সমূহের অথবা অন্য যে কোন বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বাস্তবায়নের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে লীগ কাউন্সিল । এছাড়াও নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে লীগের সহযোগিতায় উপায় নির্ধারণ করাও কাউন্সিলের দায়িত্ব ।
৪। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২নং ধারায় উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি করে বিশেষ কমিটি গঠিত হবে। এ কমিটিগুলো এসব বিষয়ে সহযোগিতার নীতি ও ক্ষেত্র নির্ধারণ করবে। এ নীতিসমূহ খসড়া চুক্তি আকারে প্রণীত হবে এবং তা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহে প্রেরণের পূর্বে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য কাউন্সিলে উপস্থাপিত হবে। কমিটিগুলোতে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ ও অংশগ্রহণ করতে পারবে। তবে কী কী শর্তে ও নিয়মের অধীনে তারা এসব কমিটিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে তা নির্ধারণ করবে লীগ কাউন্সিল ।
৫। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। বিবদমান রাষ্ট্রসমূহ যদি মীমাংসার জন্য কোন
বিষয়লীগ কাউন্সিলে উত্থাপন করে তাহলে কাউন্সিল বিষয়টি আমলে নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিবে তা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করা হবে। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত হবে। এক্ষেত্রে বিবদমান রাষ্ট্রসমূহ কাউন্সিলের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। লীগভুক্ত দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে অথবা একটি লীগভুক্ত রাষ্ট্র ও লীগভুক্ত নয় এমন আরেকটি রাষ্ট্রের মধ্যকার মতপার্থক্যের ফলে যদি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে এ মত পার্থক্যের অবসানের জন্য লীগ কাউন্সিল মধ্যস্থতা করবে। কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে বিবাদ নিষ্পত্তি ও মধ্যস্থতার সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে ।
৬। কোন সদস্য রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্র কর্তৃক আগ্রাসনের শিকার হলে বা আগ্রাসনের হুমকিপ্রাপ্ত হলে সে কাউন্সিলের জরুরি সভার জন্য অনুরোধ করতে পারবে। এই আগ্রাসন মোকাবেলায় কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। যদি আগ্রাসী রাষ্ট্রটি লীগের সদস্য হয় তাহলে সেক্ষেত্রে আগ্রাসী রাষ্ট্রটির ভোট বিবেচিত হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আক্রান্ত রাষ্ট্রটির সরকার যদি লীগ কাউন্সিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কাউন্সিলে উক্ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি জরুরি সভার জন্য অনুরোধ করতে পারবে। আর যদি কোন কারণে উক্ত প্রতিনিধিও করতে ব্যর্থ হয় তাহলে লীগভুক্ত যে কোন রাষ্ট্র লীগ কাউন্সিলের জরুরি সভার জন্য অনুরোধ করতে পারবে ।
৭। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যাতমূলক । সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ভোটদাতা রাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক ।
৮। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র লীগভুক্ত অন্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে এবং এই সরকার পরিবর্তনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না ।
৯। সদস্য রাষ্ট্রগুলো সনদে বর্ণিত বিষয়সমূহে নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে যে কোন চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে ।
১০। লীগের স্থায়ী কার্যালয় হবে মিশরের রাজধানী কায়রোতে। তবে প্রয়োজনে অন্য স্থানেও লীগের অধিবেশন হতে পারবে ।
১১। বছরে দুই বার, মার্চ এবং অক্টোবর মাসে লীগ কাউন্সিলের সাধারণ অধিবেশন বসবে। এছাড়াও প্রয়োজনে কমপক্ষে দুইজন সদস্যের অনুরোধক্রমে বিশেষ অধিবেশনও বসতে পারবে।
১২। একজন মহাসচিব, সহকারি সচিব ও পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়ে লীগ সচিবালয় গঠিত হবে। কাউন্সিলের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে মহাসচিব নির্বাচিত হবেন। কাউন্সিলের অনুমোদন ক্রমে মহাসচিব সহকারি সচিবদের এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিবেন। লীগ সচিবালয়ের কার্যাবলি ও কর্মকর্তা কর্মচারি সংক্রান্ত প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করবে লীগ কাউন্সিল ।
লীগের মহাসচিব রাষ্ট্রদূত এবং সহকারি সচিবগণ মিনিস্টারস প্লিনিপটেনশিয়ারির মর্যাদা ভোগ করবেন।
১৩। প্রতি অর্থবছরের শুরুতে মহাসচিব লীগের খসড়া বাজেট প্রণয়ন করে কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন।
১৪। লীগ কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং লীগ সচিবালয়য়ের কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁদের কর্তব্য পালনকালে কূটনৈতিক সুযোগসুবিধা ভোগ করবেন।
কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন মিশরিয় সরকার প্রধানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী অধিবেশনগুলি মহাসচিব আহ্বান করবেন। লীগের সাধারণ সভাসমূহে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিবৃন্দ পর্যায়ক্রমে সভাপতিত্ব করবেন ।
১৫। কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন মিশরিয় সরকার প্রধানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত ।
১৬। লীগ সনদে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত বিষয়সমূহ ব্যতীত অন্যান্য বিষয় যেমন -লীগ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সম্পর্কিত কোন বিষয়, বাজেট অনুমোদন কাউন্সিলের প্রশাসনিক বিধান, কমিটি ও লীগ সচিবালয় সংক্রান্ত বিষয় এবং অধিবেশনের সমাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে কাউন্সিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে ।
১৭। লীগের সদস্য অথবা সদস্য নয় এমন কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন রাষ্ট্রের সম্পাদিত চুক্তি অথবা সম্পাদিতব্য চুক্তির কপি সদস্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ লীগ সচিবালয়ে জমা দিবে ।
১৮। কোন রাষ্ট্র যদি লীগ হতে তার সদস্য পদ প্রত্যাহার করতে চায় তাহলে তাকে কমপক্ষে এক বছর পূর্বে তা লীগ কাউন্সিলে অবহিত করতে হবে। এছাড়া কোন রাষ্ট্র যদি লীগ সনদে উল্লেখিত বাধ্যবাধকতাসমূহ মেনে না চলে তাহলে লীগ কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে অভিযুক্ত রাষ্ট্রকে লীগ থেকে বহিষ্কার করতে পারবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত রাষ্ট্রটির ভোট দানের অধিকার থাকবে না ।
১৯। সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে যেমন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুদৃঢ় বন্ধন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোন পদক্ষেপ, একটি আরব সালিশ নিষ্পত্তি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিতব্য যে কোন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে লীগের সম্পর্ক নির্ধারণের বিষয়ে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে লীগ কাউন্সিল দুই- তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে লীগ সনদে সংশোধনী আনতে পারবে ।
২০। সংযুক্তিসহ লীগের সনদটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী অনুমোদন করবে। যে কোন চারটি রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পনের দিনের মধ্যে তা রাষ্ট্রগুলির জন্য কার্যকর বলে বিবেচিত হবে। লীগ সনদটি আরবি ভাষায় রচিত হয়েছে যা লীগ সচিবালয়ে সংরক্ষিত থাকবে এবং এর একটি করে অনুলিপি সদস্য রাষ্ট্রসমূহে প্রেরণ করা হবে। সংযুক্ত ধারা ৩টি নিম্নরূপ :
১। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য আরব দেশগুলোর মত লিফিস্তিন ও স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে এবং তা কোন রাষ্ট্রের অধীনস্থ নয় । অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মতই আইনগতভাবে ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক সত্ত্বা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে কোন প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। যদিও বিভিন্ন কারণে বাহ্যিকভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা স্পষ্ট নয় তারপরও এ অবস্থায় ফিলিস্তিনের লীগ কাউন্সিলের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। ফিলিস্তিনের বিশেষ অবস্থার কথা বিবেচনা করে আরব লীগের সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিনের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত একজন ফিলিস্তিনী প্রতিনিধি লীগের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে ঐক্যমতে পৌছে।
২। যেহেতু আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলি কাউন্সিল ও বিভিন্ন কমিটিতে আরব বিশ্বের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করবে এবং যেহেতু কাউন্সিল আরব লীগের সদস্য নয় এমন আরব রাষ্ট্রসমূহের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের কাজ করবে, সেহেতু লীগ সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলির উচিত লীগের সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রগুলোর আশা-আকাঙ্খা ও স্বার্থ রক্ষার পথে লীগ কাউন্সিলকে পরিচালিত করা ।
৩। সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহ আবদুল রহমান আজম বে-কে আরব লীগের মহাসিচব হিসেবে নিয়োগের পক্ষে একমত হয়েছে। এ নিয়োগের মেয়াদ হবে দুই বছর। পরবর্তীতে কাউন্সিল মহাসচিব পদের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করবে ।
কার্যাবলির মূল্যায়ন
রাজনৈতিকভাবে শুরু থেকেই আরব লীগের সামনে দুটি সমস্যা বিদ্যমান ছিল। এর একটি হচ্ছে ফিলিস্তিন সমস্যা এবং অন্যটি হচ্ছে তখনও পর্যন্ত যেসব আরব অঞ্চল বিদেশী শাসনাধীনে ছিল সেগুলোর স্বাধীনতা সম্পর্কিত সমস্যা। ফিলিস্তিন হচ্ছে একমাত্র দেশ যার সদস্য পদের ব্যাপারে আরব লীগের সনদে একটি পৃথক সংযুক্তি রয়েছে। আরব লীগের মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানিয় শাসন হতে মুক্তি লাভের সময় থেকেই ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সে অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষায় আরব লীগ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালের ২ ডিসেম্বর লীগের কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি মালিকানাধীন সকল প্রকার বাণিজ্যিক তৎপরতা বর্জনের ঘোষণা দেয়। সকল আরব বাণিজ্যেক সংস্থা, পণ্য সরবরাহকারী, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিবর্গকে ইহুদি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানায় লীগ কাউন্সিল। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদানের পরদিনই আরব লীগের মহাসচিব আবদুল রাজ্জাক আজম পাশা ফিলিস্তিন হতে ইহুদিদের সমূলে বিনাশ করার ঘোষণা দেন। ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয় এবং যেসব বিদেশী -
শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের ইসরায়েলে শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলির স্থল, জল ও আকাশপথে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৮ ৪৯ সালে সংঘটিত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরব লীগ সম্মিলিত আরব বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে। যুদ্ধে পরাজিত আরবরা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করতে না পারলেও আরব লীগ ফিলিস্তিনী আরবদের পক্ষে তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে । ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতির পর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে জর্ডানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা একটি পাঁচ বছর মেয়াদি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি গ্রহণ করে । এর প্রতিক্রিয়ায় এপ্রিল মাসে আরব লীগ পৃথকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদনকারী যে কোন দেশকে আরব লীগ হতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । আরব লীগের এই চাপ এবং আততায়ীর হাতে আমীর আব্দুল্লাহর মৃত্যুর ফলে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে এককভাবে ফিলিস্তিনীদের স্বার্থবিরোধী কোন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে নি। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে আরব দেশগুলির নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। তাই ১৯৫০ সালের লীগভুক্ত দেশগুলো একটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং লীগের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে থাকে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটের সময় আরব লীগ মিশরের পক্ষ হয়ে ইসরায়েলের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি তারা ইসরায়েলের অংশগ্রহণ রয়েছে এমন আন্তর্জাতিক সম্মেলন বর্জন করে। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) গঠনের পিছনেও আরব লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমকিা রেখেছিল। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধের সময় লীগভুক্ত আটটি দেশের নেতৃবৃন্দ খার্তুমে মিলিত হয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাশ করে যা খাতুম রেজ্যুলেশন নামে পরিচিত। এই রেজ্যুলেশনের তৃতীয় অনুচ্ছেদটি ‘তিনটি না' নামে পরিচিত। এতে বলা হল : 1. No peace with Isreal. 2. No recognition of Isreal. 3. No negotiations with Israel. এভাবে আরব লীগ ফিলিস্তিনীদের স্বার্থ রক্ষার আপোসহীন মনোভাব গ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিশর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করার পর পরই মিশরকে আরব লীগ হতে বহিষ্কার করা হয় এবং আরব লীগের সদর দপ্তর কায়রো হতে তিউনিসে সরিয়ে নেয়া হয়। ফিলিস্তিনীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে মিশরের মত একটি শক্তিশালী দেশকে বহিষ্কার করে আরব লীগ ফিলিস্তিনী আরবদের প্রতি তার আন্তরিকতা প্রমাণ করে। ১৯৮৮ সালর ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন জাতীয় পরিষদ কর্তৃক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর পরই আরব লীগ নতুন রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি প্রদান করে ।
আরব অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের স্বাধীনতা অর্জনে আরব লীগের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। উত্তর আফ্রিকার পরাধীন আরব অঞ্চলসমূহের
প্রতিনিধিবৃন্দ আলোকজান্দ্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। এমনকি তাঁরা ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে আরব লীগ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। লীগ সনদের ২ নং সংযুক্তিতে লীগের সদস্য নয় এমন আরব রাষ্ট্রসমূহকেও সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়। পরাধীন আরব অঞ্চলসমূহের প্রতিনিধিদের তাঁদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়াও নানভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করেছে লীগ। লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও পারস্য উপসাগরীয় শেখ শাসিত অঞ্চল সমূহের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরবলীগ সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের উপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি পাশ্চাত্য দেশসমূহের সহানুভূতি অর্জনের মাধ্যমেও পরাধীন আরব অঞ্চলসমূহকে মুক্ত করার চেষ্টা চালায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৫৯ সালে আরব লীগভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের সামরিক তৎপরতাকে সমর্থন না করার জন্য NATO-কে অনুরোধ জানায়। কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত আলজেরিয়ার সামরিক সরকারকে সমর্থন করার জন্য আফ্রা-এশিয়ান ব্লকের অনারব সদস্যদেরকেও তারা কূটনৈতিকভাবে অনুরোধ জানায়। জাতিসংঘে ও লীগভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ পরাধীন আরব রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা যাচাইপূর্বক তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সাধারণ পরিষদ কিংবা নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবিতে আফ্রো-এশিয়ান ব্লক ও অন্যান্য শক্তির সমর্থন লাভের চেষ্টা করে। আরব লীগের প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের সংখ্যা সাতটি থেকে তেরটিতে উন্নীত হয়। ১৯৯৩ সালে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কমোরোস দীপপুঞ্জ কর্তৃক আরব লীগের সদস্য পদ লাভের পর লীগের সদস্য সংখ্যা হয় ২২। কিন্তু ২০১১ সালে লিবিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিলে কর্নেল গাদ্দাফি তা দমন করতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। এতে প্রচুর বেসামরিক জনগণের হতাহতের ঘটনা ঘটে। লিবিয়া সরকারের এই পদক্ষেপ আরব লীগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসা লিবিয়ার সদস্য পদ স্থগিতের ঘোষণা দেন। ফলে এ সময় আরব লীগের কার্যকর সদস্য সংখ্যা হয় ২১।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি আরব লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম প্রধান উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে। এবং লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। ১৯৫৩ সালে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আরব লীগের উদ্যোগে দুইটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (১) পারস্পরিক ব্যবসায় বাণিজ্য ও মালামাল পরিবহন সংক্রান্ত চুক্তি। চুক্তিটিতে এতদঞ্চলে উৎপাদিত প্রায় সকল কাঁচামালের উপর শুল্ক রহিত করা হয়। এছাড়া সদস্য রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের মধ্যে most favoured nation ভিত্তিতে শিল্পপণ্যের
অধিকাংশই কৃষিজাত পণ্য যেমন, ভেজিটেবল অয়েল, ময়দা, টিনজাত খাদ্য, বস্ত্ৰ ইত্যাদি। (২) সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক লেনদেনের হিসাব ও মূলধন আদান-প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি। এ চুক্তিতে পণ্যের মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত লেনদেন, ব্যবসায়িক লভ্যাংশ স্থানান্তর, সরকারি দফতরের ব্যয়, পর্যটক, তীর্থযাত্রী ও বাণিজ্যিক ভ্রমণের ব্যয়, পেটেন্ট ও কপিরাইট থেকে অর্জিত লভ্যাংশ, বীমা ব্যবস্থা, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও সিনেমার বিক্রয় ও গ্রাহক চাঁদা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সমঝোতায় পৌছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই লীগের কিছু সদস্য রাষ্ট্র একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। তবে ১৯৫৩ সালের পূর্বে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন প্রক্রিয়া শুরু হয় নি। ১৯৫৩ সালে লীগভুক্ত দেশগুলি অর্থমন্ত্রীদের অংশগ্রহণে এক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও মূল্যায়নের জন্য তা লীগ সচিবালয়ে প্রেরিত হয়। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে একটি খসড়া পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। এরও কয়েক বছর পর ১৯৫৭ সালে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিল যৌথ আরব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । এরই ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় Arab Financial Institution for Economic Development যা আরব উন্নয়ন ব্যাংক (Arab Development Bank) নামে পরিচিত। ১৯৫৯ সালের ১২ জানুয়ারি ২০০০ শেয়ার সমন্বিত ২০ মিলিয়ন মিশরিয় পাউন্ড (৫৭,৪০০,০০০ ইউএস ডলার) মূলধন নিয়ে আরব উন্নয়ন ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। পরে কুয়েতের যোগদানের ফলে মূলধনের পরিমান ২৫ মিলিয়ন মিশরিয় পাউন্ডে উন্নীত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সহযোগিতা করা আরব উন্নয়ন ব্যাংকের উদ্দেশ্য বলে স্থির হয়। আরব উন্নয়ন ব্যাংক তার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশ্বব্যাংকসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে । ইউরোপীয় অভিন্ন বাজারের সফলতা লীগভুক্ত দেশগুলিকে অনুরূপ একটি বাজার গঠনের পরিকল্পনা প্রনয়নে উৎসাহিত করে। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিল ইউরোপীয় অভিন্ন বাজারের অনুকরণে আরব লীগভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় যার উদ্দেশ্য ছিল (১) লীগভুক্ত দেশসমূহে অবাধ চলাচল, কাজকর্ম ও পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লীগভুক্ত দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। (৩) আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধি-নিষেধ যথাক্রমে হ্রাস করা (৪) এতদঞ্চলের যেকোন স্থানে অর্থনৈতিক প্রকল্প স্থাপনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ৷ এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিল লীগভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। ১৯৬৩ সালে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নবম সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য পণ্য লেনদেনে শুল্কের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাসের মাধ্যমে আগামী দশ বছরের মধ্যে একটি অভিন্ন আরব বাজার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয় ।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে খ্রিস্টান মিশনারিদের সহায়তায় আরব বুদ্ধিজীবীগণ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরবদের ঐতিহ্যকে পুনঃআবিষ্কার ও সমসাময়িক কালের চাহিদা অনুযায়ী স্থানীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়নের যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন আরবলীগ সনদের ২নং ধারায় সে প্রচেষ্টাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে আরব লীগভুক্ত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা লীগের অন্যতম উদ্দেশ্য। আরবদের অনেকেই মনে করে, ২নং ধারায় বর্ণিত বিষয়সমূহে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই আরব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আরব লীগকে তারা আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেন ।
১৯৪৬ সালে সম্পাদিত আরব লীগ সাংস্কৃতিক চুক্তি, লীগের স্থায়ী সাংস্কৃতিক কমিটি এবং লীগ সচিবালয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম বিষয়ক বিভাগ কর্তৃক আরব লীগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। লীগের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন, আরব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসার, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে সফলতা অর্জনে উৎসাহ প্রদান, বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলোর অনুবাদ, গ্রন্থাগার ও যাদুঘর স্থাপন, পেশাজীবী সংগঠনসমূহের উন্নয়ন এবং গণমাধ্যমের উন্নয়ন । আর সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সাধারণ সামাজিক অনুষ্ঠানাদির উন্নয়ন, সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাসমূহ অধ্যয়ন, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন এবং জনস্বাস্থ্য, ঔষধ, অপরাধ বিজ্ঞান ও শ্রম বিষয়ক কার্যক্রম। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে লীগ জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা যেমন-UNESCO, FAO, WHO, ILO প্রভৃতিকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে থাকে। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আরব লীগ বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ১৯৬৪ সাল নাগাদ আরব লীগ ছয়টি আরব সাংস্কৃতিক সম্মেলন, প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে চারটি সম্মেলন (১৯৪৭, ১৯৫৭, ১৯৫৯ ও ১৯৬৩), বেশ কয়কটি আরব সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। আরব লীগের উদ্যোগে পেশাগত রচনাকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্য ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ লেখার জন্য লীগের পক্ষ থেকে পুরস্কারের পাশাপাশি অর্থ সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়া আরব লীগ কমপক্ষে ছয়টি সামাজিক বিষয় সংক্রান্ত সম্মেলন, বেশ কয়েকটি দত্ত ও চিকিৎসা বিষয়ক সম্মেলন এবং অনেকগুলি আরব আইনজীবী সম্মেলনের আয়োজন করে । এসব সম্মেলন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন আরব দেশে অনুষ্ঠিত হয়। তবে কায়রোতে লীগ সচিবালয়ের নতুন ভবন নির্মিত হওয়ার পর এসব কার্যক্রম অনেকটাই কায়রোকে
কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে থাকে। এসব সম্মেলন ছাড়াও জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে লীগ সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও আরব বিশেষজ্ঞগণ অংশগ্রহণ করে থাকে। এসব সম্মেলনের বেশির ভাগই আরব বিশ্বের বাইরে অনুষ্ঠিত হলেও আরবদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ই ছিল সম্মেলনগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সামাজিক ক্ষেত্রে আরব লীগের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুব উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা। আরব লীগের উদ্যোগে চার বছর পর পর আরব অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সাল থেকে প্রতিবছর আরব লীগের উদ্যোগে এ্যাথলেটিক প্রশিক্ষক ও কোচদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যুব উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরব লীগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে ১৯৫৪ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পর পর আরব বয়েস স্কাউট জাম্বুরির আয়োজন করা। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্বের মত যুব সম্প্রদায় স্বেচ্ছাশ্রম প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করে ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আরব লীগের কার্যক্রম মূলত এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট। কেননা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মধ্যেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূলমন্ত্র নিহিত। উনবিংশ শতকের সূচনালগ্ন হতে আরব বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও ইসলামি ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে পরবর্তী দেড়শ বছরেও এক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি সাধিত হয় নি । আরব লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এতদঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালে সম্পাদিত সাংস্কৃতিক চুক্তিটিতে আরব বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলন আয়োজন, বিজ্ঞান গবেষণাগার ও এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ রচনাকে উৎসাহিত করা হয়। লীগ সচিবালয়ের সাংস্কৃতিক বিভাগ এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত হয়।
লীগের উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে প্রথম আরব বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব বিজ্ঞান ফেডারেশন । এ ফেডারেশনের উদ্যোগেই ক্ৰমান্বয়ে বেশ কিছু আরব প্রকৌশল সম্মেলনসহ অনেকগুলি বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারেশন কর্তৃক গৃহীত এসব পদক্ষেপ আরব বিশ্বে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। যেমন ১৯৫৯ সালে আয়োজিত আরব প্রকৌশল সম্মেলনে আরব বিশ্ব থেকে প্রায় ১৫০০ প্রকৌশলী অংশগ্রহণ করে। এসব সম্মেলনে বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । যেমন ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাগদাদে অনুষ্ঠিত নবম আরব প্রকৌশল সম্মেলনে আরব রাষ্ট্রগুলিতে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার, আরব বিশ্বে মজুদ খনিজ সম্পদ আহরণ ও কৃষির উন্নয়ন, জমি পুনরুদ্ধার প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হয়। আরব বিজ্ঞান ফেডারেশনের আরেকিট উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে আরবি ভাষায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষাগুলোর একটি স্ট্যান্ডার্ড রূপ প্রদান করা ।
প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে লীগ সচিবালয় অধিভুক্ত আরব টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এবং আরব পোস্টাল ইউনিয়নের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরব পোস্টাল ইউনিয়নের ধারানাটি লীগ কাউন্সিল কর্তৃক ১৯৪৬ সালে অনুমোদিত হলেও এর জন্য একটি উপযুক্ত কনভেনশন রচনা নিয়ে সদস্যা দেখা দেয়ায় তা ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর আরব টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের কনভেনশনটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৫৩ সাল। এ দুটি বিশেষায়িত সংস্থার কাজ হচ্ছে আরব দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত তথ্য ও পরামর্শ বিনিময় এবং সদস্য দেশগুলোর ডাক ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রমের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা ।
১৯৬১ সালে মিশর ও সিরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র ভেঙ্গে যাওয়ার পর আরব বিশ্বকে বেশকিছু আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কুয়েতের উপর ইরাকের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিকে কেন্দ্র করে ১৯৬১ সালে ইরাক-কুয়েত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ যাতে মিশর এবং সৌদি আরবও জড়িয়ে পড়েছিল, ১৯৭০ সালে জর্ডান ও ফিলিস্তিনী গেরিলাদের মধ্যে সংঘর্ষ যা সিরিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে জটিল আকার ধারন করে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত Dhofar বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ইয়েমেনে এবং ওমানের মধ্যে দীর্ঘ সংঘর্ষ, ১৯৭৭ সালে মিশর ও লিবিয়ার মধ্যে সংঘটিত সীমান্ত সংঘর্ষ, ১৯৭৬ সালে পূর্বতন স্পেনিয় সাহারার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে একদিকে আলজেরিয়া এবং অন্যদিকে মরক্কো ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ, ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া লেবাননের গৃহযুদ্ধ হতে পরবর্তীতে পিএলও এবং সিরিয়া জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬১ সালে সংঘঠিত ইরাক কুয়েত সংঘর্ষে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে আরব লীগের সেনাবাহিনী যথাসময়ে ঘটনাস্থলে পৌছে এবং তা প্রশমিত করতে সক্ষম হয়। এছাড়া আর কোথাও আরব লীগ এর আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব নিরসনে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারে নি ।
একটি আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে আরব লীগের অভ্যুদয় বিগত শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আরব অঞ্চলগুলির সমন্বয়ে একটি স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে আরব লীগের মধ্যেই আরবরা তাদের ঐক্যের পথ খুঁজে পায় । সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরবদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও কার্যক্ষেত্রে তা খুব একটা সফল হতে পারে নি। অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরব লীগের সাফল্য অত্যন্ত সীমিত। সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত ও বংশীয় শত্রুতা ইত্যাদির মোকাবেলায় আরব লীগের অসহায়ত্ব ছিল চোখে পড়ার মত। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, সদস্য রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রীয় নীতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে আরব লীগের নীতি ও উদ্দেশ্যের বিস্তর ব্যবধান ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদেশী শাসনাধীনে থাকার ফলে রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে তাদেরকে আরব লীগের নীতি ও উদ্দেশ্যের
পথে পরিচালিত করা একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন ও একটি অভিন্ন আরব বাজার প্রতিষ্ঠায় আরব লীগের ব্যর্থতাই এর প্রমাণ । তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরব লীগ আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। এবং আরব জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছে ।
আরব লীগের কার্যাবলির সার্বিক মূল্যায়ন থেকে এটি স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লীগ আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। তবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং আধুনিক পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে আরব লীগ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে রয়েছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]