হুমায়ুনের বিরুদ্ধে শেরশাহ চৌসার যুদ্ধে (১৫৩৯ খ্রি.) জয়লাভ করে বাংলার দিকে যাত্রা করেন এবং
অবিলম্বে গৌড় পুনরুদ্ধার করেন। গৌড়ে তিনি বৎসরকাল অবস্থান শেষে বাংলার শাসন ব্যবস্থা সুসংগঠিত
করে হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং হুমায়ুনকে কনৌজের যুদ্ধে (১৫৪০ খ্রি.) পরাজিত করে
ভারতবর্ষ ত্যাগে বাধ্য করেন (এসব যুদ্ধের বিবরণ পূর্ববর্তী পাঠে দেয়া হয়েছে)। অতপর শেরশাহ উত্তর
ভারতের সম্রাট হলেন এবং গৌড় থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন সেই সঙ্গে খিজির খান নামক
জনৈক কর্মকর্তাকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
খিজির খান
শেরশাহ দিল্লিতে প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে খিজির খান এক প্রকার স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন
করছিলেন। ১৫৪১ খ্রি. তিনি গৌড়ের শেষ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের এক কন্যাকে বিবাহ করে
স্বাধীন সুলতানের মত শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। খিজির খানের এসব কার্যকলাপের সংবাদ পেয়ে
শেরশাহ তড়িৎ গতিতে পাঞ্জাব হতে বাংলায় আসেন। তিনি খিজির খানকে পদচ্যুত করে তাঁর স্থলে কাজী
ফজীলতকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।
কাজী ফজীলত
কাজী ফজীলতের শাসন আমলে শেরশাহ বাংলার শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করেন। এই পরিবর্তনের
মূল লক্ষ্য ছিল বাংলায় প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ বন্ধ করা। নতুন শাসন ব্যবস্থায় বাংলাকে
অনেকগুলো প্রশাসনিক অঞ্চলে (সরকার) বিভক্ত করে প্রত্যেক অঞ্চলে একজন করে শাসনকর্তা (আমীর)
নিয়োগ করেছিলেন। এই সময় শেরশাহ যাতায়াতের সুবিধার জন্য সোনারগাঁও হতে সিন্ধু পর্যন্ত একটি
রাজপথ নির্মাণ করেন। যা ব্রিটিশ যুগে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত হয়।
ইসলাম শাহের আমলে বাংলা
শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান শূর ইসলাম শাহ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত
হন। তিনি আট বৎসর (১৫৪৫-৫৩ খ্রি.) রাজত্ব করেন। তাঁর শাসনামলে কালিদাস গজদানী নামক একজন
রাজপুত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলেমান খান নাম ধারণ করেন। তিনি বাংলায় এসে পূর্ববঙ্গের অংশবিশেষ
অধিকার করে সেখানকার স্বাধীন শাসকরূপে আসীন হন। ইসলাম খান তাঁকে দমন করবার জন্য তাজ খান
এবং দরিয়া খান নামক দু'জন সেনানায়ককে পাঠান। যুদ্ধের মাধ্যমে তাঁরা সুলেমান খানকে বশ্যতা স্বীকারে
বাধ্য করেন। কিন্তু অল্পকাল পরে সুলেমান বিদ্রোহ করলে ইসলাম খান পুনরায় তাজ খান ও দরিয়া খানকে
সসৈন্যে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তাঁরা সুলেমান খানকে সাক্ষাৎকারে আহŸান করে বিশ্বাসঘাতকতার
সঙ্গে তাঁকে হত্যা করেন। অতপর সুলেমান খানের দুইপুত্রকে তুরানি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
মুহাম্মদ আদিল শাহ এবং পরবর্তী শূর আফগানদের শাসনে বাংলা
ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ১২ বৎসরের পুত্র ফিরোজ শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মাত্র
কয়েকদিন রাজত্ব করার পর শেরশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র মুবারিজ খান তাঁকে হত্যা করে মুহাম্মদ আদিল শাহ নাম
ধারণ করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর এরূপ নিষ্ঠুর ব্যবহারে আফগান দলপতিদের অনেকেই তাঁর
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আফগানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ¡ চরমে ওঠে। অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্তা
স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৫৫৩-১৫৫৫ খ্রি.)
ইসলাম শাহের মৃত্যুর সময়ে (১৫৫৩ খ্রি.) বাংলার আফগান শাসনকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ খান। দিল্লিতে
আফগানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে মুহাম্মদ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি
শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ গাজী উপাধি ধারণ করে বাংলার স্বাধীন সুলতান রূপে অধিষ্ঠিত হন। শামসউদ্দিন
মুহাম্মদ শাহ রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে একদিকে আরাকানের ওপর হামলা করেন, অপরদিকে জৌনপুর
অধিকার করে আগ্রা ও দিল্লির অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পরেননি। মুহাম্মদ
আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি তাঁকে ছাপরঘাট নামক স্থানে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন (ডিসেম্বর,
১৫৫৬ খ্রি.)।
প্রথম গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর (১৫৫৬Ñ৬০খ্রি.)
শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ পরাজিত ও নিহত হবার পর দিল্লির বাদশাহ মুহাম্মদ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে
বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু শামসউদ্দিন শাহের পুত্র খিজির খান এলাহাবাদে অবস্থানকালে
পিতার মৃত্যু সংবাদ অবগত হয়ে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন এবং গিয়াসউদ্দিন
বাহাদুর নাম ধারণ করেন। অতপর শীঘ্রই তিনি বাংলা আক্রমণ করে শাহবাজ খানকে পরাজিত করে
বাংলার অধিপতি হন (১৫৫৬ খ্রি.)।
এ সময়ে দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে ওঠে। বিতাড়িত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন দিল্লির
সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। হুমায়ুন আফগান সুলতান সিকান্দার শাহ শূরকে
পরাজিত করে দিল্লি পুনরুদ্ধার করেন। কিছুদিন পরেই হুমায়ুন মৃত্যুবরণ করেন (২৬ জানুয়ারি, ১৫৫৬
খ্রি.)। অতপর হুমায়ুনের পুত্র আকবর ও তাঁর অভিভাবক বৈরাম খান মুহাম্মদ আদিল শাহের সেনাপতি
হিমুকে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রি.) পরাজিত ও নিহত করলে আদিল শাহ বাংলার দিকে পালিয়ে
যান। পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেপুরে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ তাঁকে আক্রমণ
করে পরাজিত ও নিহত করেন (১৫৫৭ খ্রি.)। অতপর সুলতান গিয়াসউদ্দিন জৌনপুর অভিমুখে যাত্রা
করেন, কিন্তু অযোধ্যার নিকট মুঘল সেনাপতি খান-ই-জাহান তাঁর গতিরোধ করেন। কুটকৌশলী
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর মুঘল সেনাপতি খান-ই-জাহানের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে বাংলায় ফিরে আসেন।
এবং ১৫৬০ খ্রি. পর্যন্ত বাংলা শাসন করে মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ (১৫৬০Ñ১৫৬৩ খ্রি.)
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তদ্বীয় ভ্রাতা জালালউদ্দিন দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে
বাংলার সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হন (১৫৬০ খ্রি.)। তিনিও তার ভ্রাতার ন্যায় মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন
করে বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু এ সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেকখানি
অংশ কররানী বংশীয় আফগানরা অধিকার করে নেয়। ফলে রাজ্য শাসনে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ১৫৬৩ খ্রি.
তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন (১৫৬০Ñ৬৪ খ্রি.)
দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই পুত্রের নাম জানা যায় না।
তিনি মাত্র কয়েক মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা
করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনিও বেশিদিন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেননি। এক
বৎসর পর কররানী বংশীয় তাজ খান কররানী তৃতীয় গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করে বাংলার অধিপতি হন।
এভাবে বাংলায় আফগান শূর বংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং তদস্থলে আফগান কররানী বংশের
আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
কররানী আফগান শাসনে বাংলা
তাজ খান কররানী
কররানী উপাধিধারী আফগানরা ছিল আফগান বা পাঠান জাতির একটি প্রধান গোত্রের লোক। তাদের আদি
নিবাস ছিল বঙ্গাশে (আধুনিক কুররম)। শেরশাহের প্রধান অমাত্যবর্গ ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন
কররানী বংশের লোক। এদের মধ্যে তাজ খান অন্যতম। তাজ খান শেরশাহের সঙ্গে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ
করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এবং রাজদরবারে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন। মুহাম্মদ আদিল শাহ দিল্লির
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পর তাজ খান রাজধানী থেকে পালিয়ে যান। বর্তমান উত্তর প্রদেশের গাঙ্গেয়
অঞ্চলের একাংশ তিনি অধিকার করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। কিন্তু মুহাম্মদ আদিল শাহ তাঁকে
পশ্চাদ্ধাবন করে ছিব্রাঘাউয়ের (বর্তমান ফরাক্কাবাদের ১৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত) যুদ্ধে পরাজিত করেন।
পরাজিত হয়ে তাজ খান খাওয়াসপুর তান্ডায় পালিয়ে গিয়ে সেখানকার জায়গীরদার তদ্বীয় ভ্রাতা ইমাম,
সুলেমান এবং ইলিয়াসের সঙ্গে মিলিত হন। অতপর চার ভ্রাতা জনসাধারণের নিকট হতে রাজস্ব আদায়
করতে থাকেন। এসঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গ্রামগুলো লুটপাট করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেন। তাঁরা
মুহাম্মদ আদিল শাহ-এর একশত হাতি অধিকার করে নেন। অনেক বিদ্রোহী আফগান তাঁদের সঙ্গে যোগ
দেন। কিন্তু মুহাম্মদ আদিল শাহের সেনাপতি হিমু চুনারের নিকট তাঁদেরকে পরাজিত করেন (১৫৫৪ খ্রি.)।
এ অবস্থায় তাজ খান ও ভ্রাতা সুলেমান বাংলায় পালিয়ে আসেন এবং সুযোগ বুঝে দক্ষিণ-পূর্ব বিহার ও
পশ্চিমবঙ্গের অনেকাংশ অধিকার করে আধিপত্য বিস্তার করেন। বাংলার পশ্চিম সীমান্তে তাজ খানের
আধিপত্যে বাংলার সুলতান তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন বিচলিত হন। তাঁকে সন্তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে সুলতান তাঁর
অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। অভ্যর্থনার সুযোগে তাজ খান তৃতীয় গিয়াসউদ্দনকে হত্যা করে নিজে বাংলার
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন (১৫৬৪ খ্রি.)। সিংহাসনে আরোহণ করে তাজ খান বিদ্রোহী কোকারদের
কঠোরভাবে দমন করেন। তবে পাঠানদের অপর একটি গোত্র তাজ খানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাঁকে
পরাজিত করেন। এই মনোবেদনায় অল্পকালের মধ্যে তাজ খান কররানী মৃত্যুমুখে পতিত হন (১৫৬৫ খ্রি.)
এবং তদস্থলে ভ্রাতা সুলেমান কররানী বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
সুলেমান কররানী (১৫৬৫Ñ৭২ খ্রি.)
সুলেমান কররানী একজন দক্ষ ও শক্তিশালী শাসক এবং বিজেতা ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্য সীমানা ক্রমশ
দক্ষিণে পুরী, পশ্চিমে শোন নদ, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র,
এলাহাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল মুঘলদের পদানত হলে হতাবশিষ্ট বহু সামরিক-বেসামরিক আফগান দলপতি
বাংলায় সুলেমান কররানীর আশ্রয়ে আসেন। তাঁদের পেয়ে সুলেমান বিশেষ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। গঠন
করেন শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এসঙ্গে ছিল সহস্রাধিক উৎকৃষ্ট রণহস্তি, যা তাঁকে অপরাজেয় সামরিক
শক্তিতে পরিণত করেছিল।
বাংলার অধিপতি হয়ে প্রথমেই তিনি বাংলায় শান্তি স্থাপনে সচেষ্ট হন। এসঙ্গে গৌড় থেকে রাজধানী
মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত তান্ডায় স্থানান্তরিত করেন। তিনি ছিলেন একজন ন্যায় বিচারক।
উলেমা ও দরবেশদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং শরীয়তের বিধান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুলেমান ছিলেন বেশ দূরদর্শী। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, দেশের নিরাপত্তা
ও শান্তি বজায় রাখতে হলে মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতা নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এজন্যে তিনি মুঘল
সম্রাট আকবর এবং তাঁর সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের (অযোধ্যা অঞ্চলের) শাসনকর্তা খান-ই-জামান আলী কুলী
খান ও খান-ই-খানান মুনিম খানকে উপহার প্রদান করে সন্তুষ্ট রাখতেন। তবে ভিতরে ভিতরে অনেকবার
মুঘল বিরোধীদের সাহায্য করলেও দুই একবার ছাড়া আর কখনও প্রকাশ্যে মুঘলদের বিরোধিতা করেননি।
১৫৬৫ খ্রি. খান-ই-জামান আলী কুলী খান আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সুলেমান কররানীর সহযোগিতা
কামনা করেন। এদিকে আকবর হাজী মুহাম্মদ খান সিস্তানী নামে একজন দূত পাঠিয়ে সুলেমান কররানীকে
আলী কুলী খানকে সাহায্য না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সুলেমানের নিকট উক্ত দূত আসার আগেই
তিনি আলী কুলী খান কর্তৃক বন্দি হন। ফলে সুলেমান আলী কুলী খানের সঙ্গে যোগদান করে রোটাস দুর্গ
জয়ের জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। দুর্গ জয় যখন আসন্ন তখন সংবাদ এলো যে, আকবরের
সৈন্যবাহিনী আসছে। তখনই সুলেমান তাঁর সৈন্যবাহিনী রোটাস দুর্গ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। অতপর
আলী কুলী খান, হাজী মুহাম্মদ সিস্তানী ও খান-ই-খানান মুনিম খানের মধ্যস্থতায় আকবরের সঙ্গে সন্ধি
স্থাপিত হয়। ১৫৬৭ খ্রি. পুনরায় আলী কুলী খান বিদ্রোহী হলে মুঘল সৈনীবাহিনী তাঁকে পরাজিত ও নিহত
করে। তখন আলী কুলী খান প্রতিষ্ঠিত জমানীয়া নগরের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আসাদুল্লাহ সুলেমানকে জমানীয়া
নগর সমর্পণ করার প্রস্তাব করলে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। সেখানে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু
ইতোমধ্যে খান-ই-খানান মুনিম খান আসাদুল্লাহকে বশে আনলে সুলেমান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে
বাধ্য হন। সুলেমানের প্রধান উজির লোদি খানের পরামর্শে মুনিম খানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপিত হয়। সুলেমান
পাটনায় মুনিম খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আকবরের নামে মুদ্রাঙ্কন ও খুৎবা পাঠ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
এই প্রতিশ্রুতি সুলেমান যথারীতি পালন করেছিলেন এবং আর কখনও আকবরের অধীনতা অস্বীকার
করেননি।
উড়িষ্যা বিজয়
সুলেমানের আমলে বাংলার প্রতিবেশী হিন্দু রাজ্যে একের পর এক দুর্বল রাজার সিংহাসনে অধিষ্ঠান এবং
অমাত্যবর্গের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দে¡র ফলে রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হরিচন্দন মুকুন্দদেব
নামে একজন মন্ত্রী খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। চন্দ্রপ্রতাপ দেব ও নরসিংহ জেনা নামক দু'জন রাজা
স্বল্পকাল রাজত্ব শেষে নিহত হলে মুকুন্দদেব রঘুরায় জেনা নামে একজন রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসান।
কিন্তু ১৫৬০Ñ৬১ খ্রি. মুকুন্দদেব নিজেই উড়িষ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং রাজ্যের শান্তি-শৃ´খলা
ফিরিয়ে আনেন। ইব্রাহিম শূর নামে মুহাম্মদ আদিল শাহের একজন প্রতিদ্বন্দ¡ী উড়িষ্যায় মুকুন্দদেবের নিকট
আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৫৬৫ খ্রি. মুকন্দদেব আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেন। এসঙ্গে প্রতিশ্রুতি দেন যে,
সুলেমান কররানী যদি আকবরের বিরোধিতা করেন তবে তিনি ইব্রাহিম শূরকে দিয়ে বাংলা আক্রমণ
করাবেন। তবে উড়িষ্যা রাজ মুকুন্দদেব নিজে একবার পশ্চিমবঙ্গের সাতগাঁও পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন।
১৫৬৭-৬৮ খ্রি. আকবর যখন চিতোর আক্রমণে ব্যস্ত ছিলেন সে সময়ে সুলেমান তাঁর পুত্র বায়েজিদ এবং
ভ‚তপূর্ব মুঘল সেনাপতি সিকান্দর উজবেকের যৌথ নেতৃত্বে উড়িষ্যায় সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। এদের
প্রতিরোধে মুকন্দদেব কর্তৃক প্রেরিত ছোট রায় ও রঘুভঞ্জু-এর নেতৃত্বে উড়িষ্যা বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করে
মুকুন্দদেবের বিরোধিতা করে। মুকুন্দদেব কটসামা দুর্গে আশ্রয় নেন এবং অর্থ দ্বারা শত্রু পক্ষের
(বায়েজিদদের) একদল সৈন্যকে হাত করে নেন। অতপর মুকুন্দদেবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক সৈন্যবাহিনীর
যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুকুন্দদেব ও ছোট রায় নিহত হন। এতে সুলেমান কররানীর কাজ সহজ হয়।
তিনি ইব্রাহিম শূরকে বন্দি করে হত্যা করেন।
পুরী অধিকার
এর পর সুলেমান কররানী পুরী অধিকারের জন্য তাঁর অন্যতম সেনাপতি কালাপাহাড়ের অধীনে একদল
অশ্বারোহী প্রেরণ করেন। কালাপাহাড় অতি দ্রুতগতিতে পুরী পৌঁছে প্রায় বিনা বাধায় পুরী অধিকার করে।
তাঁরা পুরীস্থ জগন্নাথ মন্দিরে রক্ষিত বিপুল ধনরতœ অধিকার করে। মন্দিরটি আংশিকভাবে ধ্বংস করে এবং
মূর্তিগুলোকে খন্ড-বিখন্ড করে। অনেকগুলো সোনার মূর্তিসহ বেশ কয়েকমণ সোনা তাঁরা হস্তগত করে।
অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র উড়িষ্যা সুলেমান কররানীর বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রথমবারের মত উড়িষ্যা
মুসলমান শাসনের অধীনে আসে।
কোচবিহার আক্রমণ
সুলায়মান কররানীর রাজত্বকালের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো কোচবিহার আক্রমণ। সুলেমান
কররানীর রাজত্বকালের প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বিশ্বসিংহের নেতৃত্বে কোচবিহারে এক রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। বিশ্বসিংহ বাংলার সুলতান ও অহোম রাজার সঙ্গে সর্বদা মৈত্রী সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছিলেন।
১৫৪০ খ্রি. বিশ্বসিংহ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি তাঁর
পিতার মৈত্রী নীতি অস্বীকার করে ১৫৬৮ খ্রি. বাংলা আক্রমণ করতে কোচবিহারের সেনাপতি শুক্রধ্বজকে
প্রেরণ করেন। সুলেমানের বাহিনী কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে শুক্রধ্বজকে পরাজিত ও বন্দি করে। অতপর
সুলেমানের বাহিনী কোচবিহার আক্রমণ করে সুদূর তেজপুর পর্যন্ত হানা দেয়। কিন্তু কোচবিহার ও কামরূপে
স্থায়ী আধিপত্য স্থাপন না করে শুধুমাত্র হাজো, কামাখ্যা ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলো ধ্বংসসাধন করে
সুলেমানের বাহিনী ফিরে আসে। এর কিছুদিন পর সুলেমান প্রধান উজির লোদি খানের পরামর্শে
শুক্রধ্বজকে মুক্তি দেন। কারণ ইতোমধ্যে মুঘল কর্তৃক বাংলা আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এই
পরিস্থিতিতে উত্তর সীমান্তে শক্তিশালী বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভ‚ত হয়। কোচবিহার রাজকে সন্তুষ্ট রাখতে
পারলে মুঘলরা আক্রমণ করলে তাঁর সাহায্য পাওয়া যাবেÑ এরূপ চিন্তা থেকে হয়তো শুক্রধ্বজকে মুক্তি
দেওয়া হয়েছিল। যাই হোক সুলেমানের জীবদ্দশায় মুঘলরা বাংলা আক্রমণ করেনি। মাত্র আট বৎসর
রাজত্ব শেষে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর সুলেমান কররানী মৃত্যুবরণ করেন।
বায়েজিদ কররানী (১৫৭২ খ্রি.)
সুলেমান কররানীর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়েজিদ কররানী বাংলার সিংহাসনে বসেন। বায়েজিদের
উদ্ধত আচরণ ও কর্কশ ব্যবহারের জন্য রাজ্যের আফগান অমাত্যদের নিকট অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে
একদল অমাত্য তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। সুলেমান কররানীর ভাগ্নে ও জামাতা হান্স এদের সঙ্গে
যোগদান করে বায়েজিদকে হত্যা করে। কিন্তু তিনি নিজে লোদি খান ও অন্যান্য বিশ্বস্ত অমাত্যদের হস্তে
গ্রেফতার হন। পরে তাঁদের হাতেই নিহত হন। বায়েজিদ কররানী মাত্র এক বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁর
স্বল্পকালীন রাজত্বের মধ্যেই তিনি আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন এবং নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা
জারী করেন।
দাউদ কররানী (১৫৭২-৭৬ খ্রি.)
বায়েজিদ কররানী নিহত হওয়ার পর অমাত্যবর্গ সুলেমান কররানীর দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররানীকে বাংলার
সিংহাসনে বসান। তরুণ দাউদ কররানী ছিলেন অত্যন্ত নির্বোধ, বদমেজাজী এবং নিচু চরিত্রের লোক। তিনি
কতলু খান, গুজর কররানী প্রমুখ স্বার্থপর আফগান অমাত্যদের পরামর্শে সুযোগ্য মন্ত্রী লোদি খানের জামাতা
(তাজ খানের জামাতা) ইউসুফকে হত্যা করে লোদি খানের বিরাগভাজন হন। এসঙ্গে তিনি বায়েজিদের মত
আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। ফলে আকবরের সঙ্গে সংঘর্ষ
অনিবার্য হয়ে ওঠে। এদিকে আফগানদের প্রধান সেনাপতি গুজর খান দাউদ-ভ্রাতা বায়েজিদের পুত্রকে
বিহারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। এ সংবাদ পেয়ে দাউদ বিহার নিজের অধীনে আনার জন্য এক বিশাল
সৈন্যবাহিনীসহ লোদি খানকে বিহারে প্রেরণ করেন। অন্যদিকে ইতোমধ্যে বিহার অধিকার করার জন্য
আকবর খান-ই-খানান মুনিম খানকে বিহারে পাঠিয়েছিলেন। মুনিম খানের বিহারে আসার সংবাদ পেয়ে
লোদি খান ও গুজর খান নিজেদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে ফেলেন এবং মুনিম খানকে উপঢৌকন দিয়ে
তাঁর সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। লোদি খানের এরূপ কার্যকলাপে দাউদ অতিশয় ক্রুদ্ধ হন। তিনি একদল
সৈন্য নিয়ে নিজেই বিহারে আসেন। এ পরিস্থিতিতে লোদি খান রোটাস দুর্গে পালিয়ে গিয়ে মুনিম খানের
সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুমিন খান তাঁকে মুঘল সৈন্যবাহিনী দিয়ে সহযোগিতা করেন। ইতোমধ্যে মুনিম
খানের অনুরোধে আকবর টোডরমলের নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। গঙ্গা ও সরযুর
সঙ্গমস্থলে উভয় বাহিনী সম্মুখীন হয়। এখানে যুদ্ধে দাউদের সেনাপতি নিজাম খান পরাজিত হয়ে পলায়ন
করেন। এ সময়ে কতলু খান লোহানী, গুজর খান এবং শ্রী হরি নামক একজন হিন্দুর পরামর্শে দাউদ খান
কররানী ছলনার আশ্রয় নিয়ে লোদি খানকে শিবিরে ডেকে এনে হত্যা করেন। এ হত্যার ফলে আফগানদের
মধ্যে ভাঙ্গন চরমে ওঠে। ইতোমধ্যে মুঘল বাহিনী পাটনায় পৌঁছে দাউদের প্রতিরক্ষাব্যুহ অবরোধ করে
রাখে। অতপর স্বয়ং আকবর বহু সংখ্যক কামান ও বিশাল রণহস্তিসহ নৌ-বহর নিয়ে বিহারে মুনিম খানের
সঙ্গে যোগ দেন (৩ আগস্ট, ১৫৭৪)। আকবর উপলব্ধি করেন, যেহেতু পাটনা দুর্গের সরবরাহ ঘাঁটি হচ্ছে
গঙ্গার ওপারে অবস্থিত হাজীপুর দুর্গ; কাজেই হাজীপুর দুর্গ অধিকার করতে পারলে পাটনা দখল সহজ
হবে। তাই তিনি হাজীপুর দুর্গ অধিকার করতে এগিয়ে যান। ৬ আগস্ট ১৫৭৪, মাত্র কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে
হাজীপুর দুর্গ অধিকার করে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে দাউদ কররানী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পাটনা দুর্গ থেকে
বাংলার রাজধানী তান্ডায় পালিয়ে যান। মুঘল সেনাবাহিনী পাটনার পরিত্যক্ত দুর্গ অধিকার করে নেন এবং
বিপুল ধনরতœ হস্তগত করেন।
পাটনা অধিকারের পর আকবর দিল্লিতে ফিরে যান। কিন্তু মুনিম খান আকবরের নির্দেশে ১৩ আগস্ট,
১৫৭৪ খ্রি. বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলা অধিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি বিনা বাধায় সুরজগড়,
মুঙ্গের, ভাগলপুর, কলহগাও অধিকার করে তেলিয়াগড়ি গিরিপথের পশ্চিমে গুনাহতে উপস্থিত হন। দাউদ
কররানীর সেনাবাহিনী এখানে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করেছিল। কিন্তু মুঘল বাহিনী সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ভেঙ্গে ফেলে বিনা বাধায় বাংলার রাজধানী তান্ডায় প্রবেশ করে। দাউদ খান সাতগাঁও হয়ে উড়িষ্যায়
পালিয়ে যান। মুনিম খান তান্ডায় তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। সেখান থেকে আফগানদের বিরুদ্ধে
সাতগাঁও, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর), বাকলা (বাকেরগঞ্জ), সোনারগাঁও (ঢাকা) এবং মুহাম্মদাবাদে (যশোরফরিদপুর) মুঘল সেনাবাহিনী পাঠান। আফগানরা সকল স্থানে মুঘল বাহিনীর প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।
ফলে বাংলার সকল অঞ্চলে মুঘলদের আধিপত্য স্থাপিত হয়।
এবার মুঘল সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে দাউদকে আক্রমণের জন্য উড়িষ্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মুঘল
বাহিনী বর্ধমান হতে হুগলী জেলার মান্দারণ হয়ে কোলিয়ায় এসে পৌঁছেন। এ সময়ে দাউদ খান হরিপুরে
অবস্থান করছিলেন। হরিপুরে তিনি পরিখা খনন ও প্রতিরোধ প্রাচীর নির্মাণ এবং জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তায় নানারূপ
বাধার সৃষ্টি করে মুঘল বাহিনীর গতিরোধ করতে প্রস্তুত হন। দাউদ খানের এই প্রতিরোধ কৌশল জানতে
পেরে মুঘল বাহিনী স্থানীয় লোকদের সহায়তায় এক অজানা ঘুর পথ আবিষ্কারের মাধ্যমে নানজুর নামক
গ্রামে এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে দাউদকে পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণ করার সুযোগ আসে। এতে
দাউদের পরিকল্পিত কৌশল ব্যর্থ হয় এবং তিনি পশ্চাৎদিক থেকে শত্রু বেষ্টিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায়
তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে কটকে প্রেরণ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন।
মুঘলদের তুলনায় আফগানগণ তেমন শক্তিশালী ছিলেন না। দাউদ খান তাই যুদ্ধ প্রস্তুতির সাথে মুঘলদের
সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব রাখেন। রাজা টোডরমল সন্ধির প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মুনিম খান সন্ধি
প্রস্তাব গ্রহণ করেন এই শর্তে যে, দাউদকে আসতে হবে এবং সম্রাটকে মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করে
তাঁর অধীনে চাকরি করতে হবে; একজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধিকে তার পক্ষে আলোচনার জন্য সম্রাটের দরবারে
পাঠাতে হবে। এ সঙ্গে আরো কিছু শর্ত ছিল যা দাউদের জন্য সম্মানজনক ছিল না। কাজেই দাউদ খান
মুঘলদের সন্ধি প্রস্তাবের শর্ত অগ্রাহ্য করেন। ফলে ৩ মার্চ ১৫৭৫, তুকারয় প্রান্তরে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে
আফগান বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম দিকে দাউদের বাহিনীর সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত
মুঘল বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে দাউদের প্রধান সেনাপতি গুজর খান সহ অসংখ্য আফগান
সৈন্য নিহত হয়। পরাজিত হয়ে দাউদ পালিয়ে যান। টোডরমল পশ্চাৎধাবন করলে দাউদ খান কটকের
দুর্গে আশ্রয় নেন। মুঘল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আর কোন সাফল্য লাভের আশা নেই দেখে তিনি মুঘলদের
নিকট আত্মসমর্পণ করেন (১২ এপ্রিল, ১৫৭৫)। মুনিম খান দাউদকে উড়িষ্যায় জায়গীর প্রদান করে তান্ডায়
ফিরে আসেন।
ইতোমধ্যে মুনিম খানের অনুপস্থিতির সুযোগে কালাপাহাড় ও বাবুই মনক্লী প্রভৃতি আফগান নায়করা
কোচবিহার থেকে এসে ঘোড়াঘাটে অবস্থিত মুঘলদের পরাজিত করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন। এই
সংবাদ পেয়ে মুনিম খান ঘোড়াঘাটের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু ঘোড়াঘাটে পৌঁছার পূর্বে গৌড় জয় করেন
এবং গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করার কথা ভাবেন। অনেক দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় সেখানকার
বাড়িঘরগুলো অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছিল। অসুস্থ হয়ে কয়েকশ' লোক মারা গেলে তিনি ঘোড়াঘাটে না গিয়ে
তান্ডায় প্রত্যাবর্তন করেন। এবং কয়েকদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন (২৩ অক্টোবর, ১৫৭৫)। তাঁর মৃত্যুর
পর হাসান কুলী বেগ ওরফে খান-ই-জাহানকে আকবর বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এসঙ্গে
টোডরমলকে তাঁর সহকর্মী নিযুক্ত করা হয়।
বাংলার শাসনকর্তা মুনিম খানের মৃত্যুর পর দাউদ খান বিহারে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ভদ্রক ও
জলেশ্বর প্রভৃতি মুঘল অধিভুক্ত অঞ্চল দখল করে বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করেন। নবনিযুক্ত বাংলার
শাসনকর্তা হাসান কুলী বেগ এবং টোডরমল দাউদকে দমনের জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে
যাত্রা করেন। হাসান কুলী বেগ ও টোডরমলের আগমনের সংবাদ পেয়ে দাউদ রাজমহলে আশ্রয় নেন।
হাসান কুলী বেগ সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজমহলের নিকটে কয়েক মাস অপেক্ষা করেন। সবশেষে সম্রাট
আকবরের নির্দেশে বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান ১০ জুলাই, ১৫৭৬ খ্রি. তাঁর সাহায্যে এগিয়ে
আসেন। ১২ জুলাই, ১৫৭৬ খ্রি. মুঘল বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে আফগান বাহিনী রাজমহলে সম্পূর্ণভাবে
পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে আফগানদের তরবারী নামে খ্যাত জনায়েদ নিহত হন এবং কালাপাহাড় ও কতলু
খান আহত হয়ে পলায়ন করেন। দাউদ কররানী বন্দি হন এবং সন্ধি ভঙ্গের অপরাধে তাঁকে প্রাণদন্ড দেয়া
হয়। এভাবে দাউদের পরাজয় এবং নিধনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় আফগান শাসনের অবসান ঘটে এবং
মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সারসংক্ষেপ
শেরশাহ ও তৎপুত্র ইসলাম শাহের আমলে খিজির খান, কাজী ফজীলত, সুলেমান খান (একবার বিদ্রোহ
করলেও) প্রমুখ শাসক দিল্লির অধীনস্থ প্রাদেশিক শাসক হিসেবে বাংলায় শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
শেরশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র আদিল শাহ ও তৎপরবর্তী শূর আফগানদের আমলে শামসউদ্দিন মাহমুদ শাহ,
প্রথম গিয়াসউদ্দিন, দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন, তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন এক প্রকার স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন
করেন। অতপর তাজ খান তৃতীয় গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করে নিজেকে বাংলার শাসনকর্তারূপে অধিষ্ঠিত
করার মাধ্যমে বাংলায় কররানী আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ভ্রাতা সুলেমান
কররানী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি বিজেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। রাজ্য সীমানা বৃদ্ধি করে
উত্তর-পূর্ব ভারতে শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হন। তাঁর পরবর্তী বাংলার শাসক বায়েজিদ কররানী, দাউদ
কররানী তেমন যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। বাংলায় আফগান কররানী বংশের শেষ শাসনকর্তা দাউদ
কররানী আকবরের সৈন্যবাহিনীর হস্তে পরাজিত ও নিহত হলে বাংলায় কররানী শাসনের অবসান ঘটে
এবং মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। শেরশাহ গৌড় থেকে রাজধানী কোথায় স্থানান্তরিত করেছিলেন?
(ক) আগ্রা (খ) দিল্লি
(গ) হায়দারাবাদ (ঘ) বিহার।
২। শেরশাহ কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার প্রথম শাসনকর্তার নাম কি?
(ক) খিজির খান (খ) কাজী ফজীলত
(গ) সুলেমান খান (ঘ) মুবারিজ খান।
৩। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর বাংলার কোন শাসক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন?
(ক) শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (খ) প্রথম গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর
(গ) দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর (ঘ) তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর।
৪। বাংলায় কররানী আফগান শাসন কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
(ক) সুলেমান কররানী (খ) বায়েজিদ কররানী
(গ) দাউদ কররানী (ঘ) তাজ খান কররানী।
৫। কত খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা দাউদ কররানীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে?
(ক) ১৫৭৪ খ্রি. (খ) ১৫৭৫ খ্রি.
(গ) ১৫৭৬ খ্রি. (ঘ) ১৫৭৭ খ্রি.।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। শেরশাহের আমলে বাংলার শাসনকর্তাদের কার্যাবলী বর্ণনা করুন।
২। ইসলাম শাহের আমলে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিন।
৩। শূর আফগান শাসক প্রথম গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরের শাসনকালের বর্ণনা দিন।
৪। বাংলার কররানী শাসন প্রতিষ্ঠায় তাজ খান কররানীর ভ‚মিকা লিপিবদ্ধ করুন।
৫। সুলেমান কররানীর উড়িষ্যা বিজয়ের বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। বাংলায় শূর আফগানদের শাসনকালের একটি বিবরণ দিন।
২। বিজেতা হিসেবে সুলেমান কররানীর কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
৩। আকবরের বাংলা অধিকারের বিশেষ উল্লেখপূর্বক দাউদ কররানীর শাসনকালের বর্ণনা দিন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত