সম্রাট আকবরের রাজ্য বিস্তারের একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দিন।
আকবরের উত্তর ভারত বিজয়ের বর্ণনা দিন।


বাবুরকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা বলা হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহামতি
আকবর। বাবুর মুঘল সাম্রাজ্যের যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হুমায়ুনের শাসনকালে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে
গিয়েছিল। আকবর সে লুপ্ত ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যোগ্যতার পরিচয়
দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে যুদ্ধ কৌশলে নয়, রাজকীয় কর্মকান্ডের বিভিন্ন বিভাগে
এবং স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার গুণে তিনি ভারতের ইতিহাসে যে অবিস্মরণীয় প্রভাব রেখে গেছেন সেজন্য
তাঁর ‘মহামতি' আখ্যা যথার্থ। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, “শুধুমাত্র ভারত ইতিহাসে নয়, বিশ্বের
ইতিহাসে আকবর একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।”
পিতা হুমায়ুন যখন শেরশাহের হস্তে রাজ্যচ্যুত হয়ে এবং ভ্রাতৃবর্গ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে সিন্ধু প্রদেশের
অন্তর্গত অমরকোটের রাণা প্রসাদের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন (১৫ অক্টোবর, ১৫৪২) আকবরের জন্ম
হয়। রাণা প্রসাদের সহযোগিতায় হুমায়ুন যখন থাট্টা ও ভাক্কার অভিযানে অগ্রসর হন পথিমধ্যে তার্দি বেগ
খান কর্তৃক হুমায়ুন পুত্রের জন্ম সংবাদ পান। হুমায়ুনের তখন এমনই দুঃসময় চলছিল, যার জন্য তাঁর পুত্রের



জন্মের সংবাদে কোন আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা কিংবা তাঁর সঙ্গীদের কোন পুরস্কার দিতেও তিনি অক্ষম
ছিলেন। তখন তিনি একটি কস্তুরী কেটে সঙ্গীদের মধ্যে বিতরণ করে বলেন, ‘আমার আজ আপনাদের
দেওয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই কস্তুরীর সুগন্ধ যেমন তাবুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে,
একদিন আমার পুত্রের যশ ও খ্যাতিও এই কস্তুরীর সুগন্ধের মতো সমগ্র দেশব্যাপী বিস্তৃত হবে।' উল্লেখ্য,
আকবর সিংহাসনে বসে পিতার এই আকাক্সক্ষা পূরণ করেছিলেন। তাঁর যশ ও খ্যাতি শুধুমাত্র ভারতবর্ষে
নয়, সমগ্র বিশ্বে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
হুমায়ুন হৃতরাজ্যের একাংশ পাঞ্জাব, দিল্লি ও আগ্রা পুনরুদ্ধার করার অব্যবহিত পরেই মৃত্যুবরণ (২৭
জানুয়ারি, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) করেন। তখন আকবরের বয়স ছিল মাত্র তের বৎসর। আকবর তখন পাঞ্জাবে
সিকান্দার শূরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।এই সংবাদ পেয়ে হুমায়ুনের বন্ধু ও অনুচর আকবরের অভিভাবক
বৈরাম খাঁ তৎক্ষণাৎ ইটের মঞ্চ তৈরি করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬, সেই ইটের মঞ্চে আকবরের সিংহাসন
আরোহণের অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। স্বভাবতই তের বছরের বালক আকবর শাসনকার্যের দায়িত্ব
গ্রহণের উপযুক্ত ছিলেন না। তাই বৈরাম খান তাঁর পক্ষে শাসনকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন।
আকবরের সিংহাসন আরোহণকালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা
আকবর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন মুঘল সাম্রাজ্য কেবলমাত্র পাঞ্জাব, দিল্লি ও আগ্রার মধ্যেই
সীমাবদ্ধ ছিল।এ সময়ে ভারতের রাজনৈতিক সংকট তীব্রভাবে ঘনীভ‚ত হয়েছিল এবং চারদিকে বিশৃ´খলার
দরুন বালক আকবর চরম সংকটে পতিত হন। শের শাহের উত্তরাধিকারীর সময় থেকে ভারতে বহু স্বাধীন
রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। হুমায়ুন সাম্রাজ্যের অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠা করতে পারলেও সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার
সময় পাননি। এ সময়ে দিল্লির সিংহাসনের প্রতি তিন জন নরপতির লোলুব্ধ দৃষ্টি ছিল।
প্রথমত, শেরশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র আদিল শাহের সেনাপতি হিমু দিল্লির সার্বভৌম ক্ষমতা দখলের জন্য তৎপর
হন।
দ্বিতীয়ত, শের শাহের অপর ভ্রাতুষ্পুত্র সিকান্দার শূর পাঞ্জাব থেকে দিল্লির সার্বভৌম ক্ষমতা দখল করে
আকবরের সিংহাসন দাবিকে বিনষ্ট করতে উদ্যত ছিলেন।
তৃতীয়ত, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মীর্জা মোহাম্মদ হাকিম স্বাধীনভাবে রাজত্ব
করছিলেন। তিনিও আকবরের সিংহাসনের দাবিকে বিনষ্ট করে নিজের দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট
হন।
এ সময়ে স্থানীয় এক মুসলমান বংশ কাশ্মীর শাসন করছিল। শেরশাহের দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলেই
সিন্ধু ও মুলতান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। বাংলায় শাসন করছিল শূর বংশীয়রা। ইব্রাহিম খাঁ শূরের দ্বারা
দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়ে আদিল শাহ আগ্রা থেকে মালব পর্যন্ত অঞ্চল শাসন করছিলেন। দিল্লির পশ্চিম
অঞ্চলে রাজপুতনায় মেবার, জয়শল্মীর, যোধপুর, বুঁদি প্রভৃতি রাজ্যের রাজপুত নরপতিগণ স্বাধীনভাবে
প্রবল প্রতাপের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। তাঁদের বিরোধিতা কোনমতেই আকবরের পক্ষে
উপেক্ষনীয় ছিল না। তদুপরি গুজরাট, মালব, উড়িষ্যা প্রভৃতি দিল্লির প্রাধান্য অস্বীকার করে স্বাধীনতা
ঘোষণা করেছিল। দক্ষিণ-ভারতের খান্দেশ, বেরার, বিদর, আহম্মদনগর, বিজাপুর ও গোলকুন্ডা স্বাধীন
নরপতিদের অধীনে শাসিত হচ্ছিল। তাছাড়া পর্তুগিজগণ গোয়া ও দিউ দখল করে পশ্চিম উপক‚লে
নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এমন কি এদের উপদ্রবে মক্কা যাত্রী মুসলমানগণ নিরাপদে সাগর পাড়ি
দিতে পারতেন না। প্রকৃতপক্ষে আকবরের সিংহাসন আরোহণের প্রাক্কালে ভারত শতধা বিচ্ছিন্ন ছিল।


উপরন্তু, শেরশাহের উত্তরাধিকারীদের দুর্বল শাসনের ফলে ভারতের তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত
শোচনীয় হয়ে পড়ে।এসঙ্গে ভারতের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলেও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দিল্লি ও
আগ্রাতেই হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সমকালীন ঐতিহাসিকগণ এই দুর্ভিক্ষকে ‘আদিল শাহ
দুর্ভিক্ষ' নামে অভিহিত করেছিলেন। এসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মহামারী ও প্লেগ।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১৫৫৬ খ্রি.
হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে আকবর সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী ও
সেনাপতি হিমু দিল্লি ও আগ্রা দখল করে ভারতবর্ষ থেকে মুঘলদের বিতাড়িত করার জন্য অগ্রসর হন।
আগ্রার মুঘল শাসনকর্তা ইস্কান্দার খান তাঁকে বাধা দিতে অসমর্থ হয়ে দিল্লিতে পালিয়ে আসেন। হিমু আগ্রা
দখল করে আগ্রা থেকে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। দিল্লির শাসনকর্তা তার্দি বেগ হিমুর হামলা প্রতিরোধ
করতে ব্যর্থ হয়ে তিনিও দিল্লি থেকে পালিয়ে পাঞ্জাবে চলে আসেন। অতপর হিমু আদিল শাহের অধীনতা
অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করে দিল্লির
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মুঘল সেনাবাহিনীর নৈতিক শক্তি ও মর্যাদায় আঘাত হানে। পাঞ্জাবে অবস্থানরত
আকবরের নিকট এই সংবাদ পৌঁছলে অধিকাংশ অভিজাত তাঁকে হিমুর কাছ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে
কাবুলে চলে যেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু আকবরের অভিভাবক বিচক্ষণ রাজনীতিক বৈরাম খাঁ ঐসব
পরাজয়প্রবণ অভিজাতগণের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। তিনি বিনা যুদ্ধে হিমুকে দিল্লির সিংহাসন ছেড়ে দিতে
রাজি ছিলেন না। বালক সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কাবুলে পালিয়ে না গিয়ে
হিমুর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুঘলদের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। অতপর সিকান্দার শূরকে দমন
করার জন্য আকবর খিজির খানকে পাঞ্জাবে রেখে বৈরাম খাঁ সহ দিল্লি অধিকারের জন্য সসৈন্যে অগ্রসর
হন। পথিমধ্যে সিরহিন্দে আগ্রার পলাতক শাসনকর্তা ইস্কান্দার খান ও দিল্লির পলাতক শাসনকর্তা তার্দি
বেগ তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। দিল্লি রক্ষা করতে না পারার অপরাধে বৈরাম খাঁ তার্দি বেগকে হত্যা করেন।
কর্তব্যে অবহেলা ও কাপুরুষতার ফলস্বরূপ তাঁর এই পরিণতি হয়।
সিরহিন্দ থেকে আকবর ও বৈরাম খাঁ তাঁদের প্রধান শত্রু দিল্লি ও আগ্রা দখলকারী হিমুকে পরাজিত করে
দিল্লি অধিকারের সংকল্প নিয়ে দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ইতিহাসখ্যাত পানিপথের প্রান্তরে মুঘল
সৈন্যবাহিনীকে হিমু বাধা প্রদান করলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে হিমুর আফগান সৈন্যবাহিনী
মুঘল সৈন্যবাহিনীকে স্থানচ্যুত করলে মুঘল সৈন্যবাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ হিমুর দক্ষিণ চক্ষু
তীরবিদ্ধ হলে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। ফলে নেতৃত্বের অভাবে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং
হিমুর আফগান সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে থাকে। হিমু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন
এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ধৃত হন। অতপর বন্দি অবস্থায় তাঁকে আকবরের নিকট আনা হয়। বৈরাম খাঁ
আকবরকে হিমুর শিরচ্ছেদ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু আকবর এতে অসম্মতি জানালে বৈরাম খাঁ নিজে
হিমুর শিরচ্ছেদ করেন। আকবর বিজয়ীবেশে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর দিল্লি প্রবেশ করেন। কালবিলম্ব
না করে তিনি আগ্রা অধিকার করেন এবং সিকান্দার শূরের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে
সিকান্দার শূর ১৫৫৭ খ্রি. বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। আকবর তাঁকে বিহারে জায়গীর প্রদান করেন। কিন্তু
অল্পকালের মধ্যে সিকান্দার শূর বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাঁকে জায়গীর চ্যুত করা হয়। তিনি আত্মরক্ষার্থে
বাংলায় আশ্রয় নেন। বাংলায় অবস্থানকালে ১৫৫৯ খ্রি. তাঁর মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে ইব্রাহিম শূর মুঘল
বিরোধিতা ত্যাগ করেন এবং আদিল শূর বাংলা অধিকারের বৃথা চেষ্টা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে (১৫৫৬)
নিহত হন। ফলে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা আকবরের নিকট
দাবি করার মতো আর কোন প্রবল আফগান প্রতিদ্বন্দ¡ী রইল না। ১৫২৬ খ্রি. পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয়
লাভ করার পর বাবুর যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন, ১৫৫৬ খ্রি. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে
আকবরের জয়লাভের ফলে সেই সাম্রাজ্য বিপদমুক্ত হয়ে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর আফগানগণ
আর কখনো সমগ্র ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনাও করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পানিপথের

জয়লাভই আকবরের এবং ভারতবর্ষে মুঘল ভাগ্য নির্ধারণ করে। এরপর থেকে মুঘলদের নতুন শক্তিতে
যাত্রা শুরু হয়। এসব দিক বিবেচনা করলে সত্যিই পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ আকবর ও বৈরাম খাঁর অত্যন্ত
বিবেচনাপ্রসূত ও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। উপরন্তু বাবুরের সময়ে যে মুঘল-আফগান সংঘাতের সূচনা হয়েছিল,
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে এর অবসান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধকে আকবর তথা মুঘলদের সর্বশেষ
আত্মরক্ষার যুদ্ধ বলা যায়। এরপর আকবর যেসব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেসব ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের
যুদ্ধ। মূলত মুঘলদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সীমা-মীমাংসমূলক যুদ্ধ ছিল পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ।
বৈরাম খাঁর পদচ্যুতি ও সাম্রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ
সিংহাসনে অধিষ্ঠানের পর প্রথম চার বৎসর (১৫৫৬-১৫৬০ খ্রি.) বালক আকবর নামে মাত্র শাসক ছিলেন।
এই সময়ে তাঁর অভিভাবক পিতৃবন্ধু বৈরাম খাঁ মূলত শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ
করে তাঁর কর্মদক্ষতা ও দূরদর্শিতার দ্বারা বালক আকবরকে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে
সাম্রাজ্যকে সকল ক্ষেত্রে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধের কয়েক বৎসরের মধ্যে
তিনি আজমীর, গোয়ালিয়র, জৌনপুর প্রভৃতি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। আকবর বৈরাম খাঁর নিকট
নানাভাবে ঋণী। কিন্তু বালক আকবরের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একদিকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন অন্যদিকে
ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা তাঁর আচার-আচরণে প্রকাশ পেলেও বৈরাম খাঁ তা উপলব্ধি করতে পারেননি। তাছাড়া
বৈরাম খাঁ রাজক্ষমতা হাতে পেয়ে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা লিপ্সু ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। এসব কর্মকান্ডে
আকবর ক্রমে তাঁর ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠেন। আকবরও নামে মাত্র সম্রাট না থেকে কার্যত সম্রাট হতে
আগ্রহী হন।
তাছাড়া আকবরের মাতা হামিদা বানু, ধাত্রী মাতা মাহম্ অন্গ এবং অপরাপর শুভাকাক্সক্ষী আত্মীয়স্বজন
বৈরাম খাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আকবরকে তাঁর অভিভাবকের কর্তৃত্ব বর্জন করতে
উপদেশ দেন। ক্রমে আকবরও বৈরাম খাঁর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠেন। ফলে ১৫৬০ খ্রি. আকবর বৈরাম
খাঁকে অভিভাবকত্ব থেকে অপসারিত করেন এবং স্বহস্তে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।
আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার
১৫৬০ খ্রি. আকবর ব্যক্তিগত শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ফলে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে এক নতুন
অধ্যায়ের সূচনা হয়। আকবর তাঁর রাজত্বের সূচনা হতে মৃত্যুর অল্প কয়েক বৎসর পূর্ব পর্যন্ত অপ্রতিহত
গতিতে সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ১৫৬১ খ্রি. আকবর যে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির সূত্রপাত
করেন ১৬০১ খ্রি. খান্দেশের আসিরগড় দুর্গ অধিকার পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এই দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর
স্থায়ী ধারাবাহিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে আকবর সমগ্র উত্তর ভারতে এবং মধ্য ভারতে ঐক্য স্থাপন করে এক
বিশাল সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে আবুল ফজল বলেন, “ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অত্যাচারী ও
স্বার্থানে¦ষী শাসকদের শাসন থেকে জনসাধারণকে শান্তি ও সমৃদ্ধিদানের জন্য আকবর রাজ্য বিস্তার নীতি
গ্রহণ করেন।”
উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার
মালব
আকবর স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ করে উত্তর ভারতের যে অঞ্চলটি অধিকার করেন তা হলো মালব।
সেখানকার শাসনকর্তা ছিলেন বাজবাহাদুর। তিনি ছিলেন শের খান ও তাঁর পুত্র ইসলাম শাহের সময়ের
শাসনকর্তা সুজ্জাত খানের পুত্র। বাজবাহাদুর শাসনকার্যে অমনোযোগী হয়ে সঙ্গীত ও বাইজি নিয়ে দিন


অতিবাহিত করছিলেন। ১৫৬১ খ্রি. আকবর ধাত্রীমাতা মাহ্ম আন্গ-এর পুত্র আদম খানকে মালব
অধিকারের জন্য পাঠান। আদম খান বাজবাহাদুরকে পরাজিত করে মালব অধিকার করেন এবং রাজধানী
সারাংপুর লুণ্ঠন করেন। এসঙ্গে মালবের জনসাধারণ ও নারীদের ওপর আদম খান অত্যাচার শুরু করেন।
এই অত্যাচারের সংবাদ আকবরের কানে পৌঁছালে সঙ্গে সঙ্গে আদম খানকে শান্তি দেবার উদ্দেশ্যে আগ্রা
থেকে মালবের দিকে যাত্রা করেন (১৫৬১ খ্রি. ২৭ এপ্রিল)। ১৩ মে, ১৫৬১ খ্রি. আকবর মালবে পৌঁছলে
আদম খান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান এবং আকবরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু আকবর আদম
খানকে পদচ্যুত করে পীর মহম্মদকে মালবের শাসনকর্তা নিয়োগ করে আগ্রায় ফিরে আসেন। পীর
মহম্মদের দুর্বল শাসনের সুযোগে বাজবাহাদুর পুনরায় মালব অধিকার করলে আকবর সেনাপতি আব্দুল্লা খাঁ
উজবেককে বাজবাহাদুরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি মালব অধিকার করেন। অতপর মালবে আকবরের
প্রত্যক্ষ শাসন শুরু হয়। পরবর্তীকালে বাজবাহাদুর আকবরের বশ্যতা স্বীকার করলে তাঁকে ‘একহাজারী'
মনসবদার পদে নিয়োগ দান করেন।
গন্ডোয়ানা
১৫৬৪ খ্রি. আকবর কারা ও পূর্ব অঞ্চলের শাসনকর্তা আসফ খাঁকে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী দিয়ে
মধ্য প্রদেশের গড় কাটাঙ্গার রাজ্য গন্ডোয়ানা জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। তখন গন্ডোয়ানার রাজা
বীরনারায়ণ ছিলেন নাবালক। এই সময়ে রাণী মাতা দূর্গাবতী বীরনারায়ণের অভিভাবিকা রূপে রাজ্য শাসন
করছিলেন। রাজমাতা দূর্গাবতী যেমনি ছিলেন সাহসী তেমনি ছিলেন বিদূষী। তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে
গড়ের পূর্বদিকে নারহীতে দুদিন মুঘল সৈন্যকে প্রতিহত করেন। কিন্তু প্রতিহত করতে গিয়ে মুঘল সৈন্যের
তীরের আঘাতে আহত হন এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আত্মহত্যা করেন। বালক রাজা বীরনারায়ণ
বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেন। আসফ খাঁ বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য মণিমুক্তার গন্ডোয়ানা রাজ্য
থেকে হস্তগত করেন। এভাবে গন্ডোয়ানা রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আকবর তথাকার পুরাতন
রাজবংশের চন্দ্র শাহ নামক এক ব্যক্তির হস্তে গন্ডোয়ানার শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
বিনিময়ে গন্ডোয়ানাকে স্বীয় রাজ্যের কিছু অংশ মুঘল শাসনাধীনে ছেড়ে দিতে হয়। চন্দ্র শাহ আকবরের
প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
উজবেক বিদ্রোহ
গন্ডোয়ানা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৫৬৫ খ্রি. মালবের শাসনকর্তা আবদুল্লা খাঁ উজবেক, জৌনপুরের শাসনকর্তা
উজবেক নেতা খান জামান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের বিদ্রোহের সুযোগে আকবরের ভ্রাতা মীর্জা
হাকিমও নিজেকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে পাঞ্জাব আক্রমণ করেন। আকবর একে একে তিনটি
বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করেন এবং বিদ্রোহীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন।
রাজপুতনা
উজবেক বিদ্রোহ দমন করে আকবর রাজপুতনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ
আকবর উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, মুঘল সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হলে
রাজপুতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন অপরিহার্য। এছাড়া রাজপুতনার মধ্যে দিয়েই উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্যান্য
অংশের বাণিজ্য পথ ছিল। এসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আকবর প্রথম থেকেই রাজপুত জাতির
সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৫৬২ খ্রি. তিনি মানসিক শান্তি ও পুত্র কামনায়
পদব্রজে আজমীরে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির মাজার পরিদর্শন করতে যান। পথিমধ্যে অম্বরের রাজা
বিহারীমল এবং বহু রাজপুত দলপতি বশ্যতা স্বীকার করে তাঁর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। বিহারীমল নিজ
কন্যার সঙ্গে আকবরের বিবাহ দেন। এই রাজপুত কন্যাই জাহাঙ্গীরের মাতা। বিহারীমল, তৎপুত্র ভগবান

দাস ও পৌত্র মানসিংহ আকবরের সৈন্যবাহিনীতে উচ্চপদ লাভ করে পরবর্তী সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারে
গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছিলেন।
কালক্রমে মুঘল-রাজপুত মৈত্রী আকবরের সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সকল রাজপুত রাজা এ
নীতি গ্রহণ করেননি। মেবারের রাণা রাজপুত প্রতিরোধকারীদের মধ্যমণি ছিলেন। এ সময়ে মেবারের রাণা
ছিলেন উদয় সিংহ। রাণা সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উদয় সিংহ মেবারের রাণা হন। তবে তিনি
বিহারীমলের মত বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। ১৫৬৭ খ্রি. আকবর মেবার আক্রমণ করে চিতোর
দুর্গ অবরোধ করেন। মেবারের রাজা উদয় সিংহ পালিয়ে আরাবল্লীর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন
করেন। প্রায় চার মাস চিতোর দুর্গ অধিকারের চেষ্টার পর একদিন আকস্মিকভাবে আকবরের গুলিতে
রাজপুত বীর জয়মলের মৃত্যু হলে চিতোর দুর্গের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং মুঘল সেনাবাহিনী
চিতোর দুর্গে প্রবেশ করে। রাজপুত সৈন্যগণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেয়। রাজপুত রমণীগণ
‘জওহর ব্রত' অবলম্বন করে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেন। এভাবে চিতোর দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে।
চিতোর দুর্গের পতনে অন্যান্য রাজপুত রাজাগণ দারুনভাবে ভীত হয়ে পড়েন। একে একে রণথম্ভোরের
অধিপতি সুজন, কালিঞ্জরের অধিপতি রাজা রামচাঁদ বাঘেল, যোধপুরের রাজা মালদেবের পুত্র চন্দ্র সেন,
বিকানীর রাজা কল্যাণমল এবং তাঁর পুত্র রাই সিং এবং জয়সলমীরের রাজা রাওয়াল হর রাই আকবরের
বশ্যতা স্বীকার করেন।
প্রায় বিনাযুদ্ধে সমগ্র রাজপুতনা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করলেও মেবার আকবরের বশ্যতা স্বীকার
করেনি, যদিও মেবারের রাজধানী চিতোরের পতন ঘটেছিল। ইতোমধ্যে মেবারের রাণা উদয় সিংহের মৃত্যু
(১৫৭২ খ্রি.) হলে তাঁর পুত্র প্রতাপ সিংহ মেবারের রাণা হন। তিনি উদয়পুর, কুম্ভল ও গোগুন্ডায় শক্তি
সঞ্চয় করে চিতোর পুনরুদ্ধারের সংকল্প করেন। আকবর অত্যন্ত উদার শর্তে রাণা প্রতাপ সিংহকে আনুগত্য
স্বীকারের আহŸান জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নেন। আকবর ১৫৭৬
খ্রি. এপ্রিল মাসে রাজা মানসিংহ ও আসফ খাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।প্রতাপ সিংহ মুঘল
সৈন্যবাহিনীকে মন্ডলগড়ের মধ্য দিয়ে গোগুন্ডায় অগ্রসর হবার মুখে হলদিঘাট নামক গিরিপথে প্রতিরোধ
করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন তারিখে উভয় বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রতাপ
সিংহ মুঘল সৈন্যবাহিনীর হস্তে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। ফলে গোগুন্ডা মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত
হয়। অতপর সিরোহি, ইদার, বনস্ওয়ারা, দুঙ্গরপুর, ওর্ছা প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজপুত রাজ্যসমূহ আকবরের
নিকট তথা মুঘলদের নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করে। ১৫৭৮ খ্রি. পুনরায় আকবর শাহবাজ খানকে রাণা
প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুঘল সেনাবাহিনী কেলওয়ারা, কুম্ভলগড় ও গোগুন্ডায় প্রবেশ করলে
রাণা প্রতাপ সিংহ চবন্দ নামক স্থানে আত্মগোপন করেন। অতপর সুযোগ বুঝে তিনি কুম্ভলগড় পুনরুদ্ধার
করতে সক্ষম হন এবং বনস্ওয়ারা ও দুঙ্গরপুরের ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। শাহবাজ খান তাঁকে
দমন করতে পারেননি। ১৫৮৪ খ্রি. আকবর রাণা প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে জাফর বেগ ও জগন্নাথকে প্রেরণ
করেন। তাঁরাও ব্যর্থতার পরিচয় দেন। ১৫৯৭ খ্রি. রাণা প্রতাপ সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর পূর্বে
তিনি আজমীর, চিতোর ও মন্ডলগড় ব্যতীত তাঁর হৃতরাজ্যের অনেকাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম
হয়েছিলেন। রাণা প্রতাপের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী অমর সিংহের বিরুদ্ধে আকবর ১৫৯৯ খ্রি.
শাহজাদা সেলিম ও রাজা মানসিংহকে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে অমরসিংহ পরাজিত হন। তথাপি সমগ্র মেবার
মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মেবারের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে এক
রোমাঞ্চকর কাহিনী।
পশ্চিম ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার
গুজরাট

মালব ও রাজপুতনা অধিকারের পর আকবর উত্তর ভারতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন। অতপর তিনি
পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপক‚লবর্তী অঞ্চল গুজরাট জয়ে মনস্থ করেন। গুজরাট শস্যে, সম্পদে এবং ব্যবসাবাণিজ্যে খুব সমৃদ্ধ ছিল। দিল্লির সুলতানি আমলেই বস্ত্রশিল্পে গুজরাট ভারতে বিশেষ মর্যাদার আসনে
সমাসীন হয়। অবশ্য আকবরের গুজরাট অভিযানের পশ্চাতে নি¤œলিখিত কারণ ছিলÑ
(১) বিদ্রোহী মীর্জারা গুজরাটে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাঁদের দমন করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
(২) গুজরাট ছিল সমুদ্রপথে ভারতের বাইরের দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্র।
(৩) পর্তুগিজদের কর্মকান্ডের ওপর নজর রাখার প্রয়োজনে গুজরাট মুঘলদের অধিকারে রাখা জরুরি ছিল।
(৪) গুজরাটের কিছু সংখ্যক আমীর আকবরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন।
(৫) গুজরাটের প্রভুত সম্পদ ও বাণিজ্য ঘাঁটি আকবরকে গুজরাট অধিকারে উৎসাহিত করে।
৭ নভেম্বর ১৫৭২ খ্রি. আকবর ইতিমদ নামে স্থানীয় একজন আমীরের আহŸানে গুজরাটের পাটল নামক
স্থানে সসৈন্যে উপস্থিত হন। সেখান থেকে আহমেদাবাদ যান। আকবর সহজেই গুজরাট জয় করেন।
অতপর তিনি ৮ ডিসেম্বর ১৫৭২, আহমেদাবাদ থেকে ক্যাম্বেতে যান। সেখান থেকেই তিনি বিদ্রোহী
মীর্জাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। বিদ্রোহীদের মধ্যে ইব্রাহিম হুসেন মীর্জা বরোদায়, মহম্মদ হোসেন মীর্জা
সুরাটে এবং শাহ মীর্জা চাম্পানেরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। ১৫৭৩ খ্রি. জানুয়ারি মাসে মীর্জা গোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা
মুঘল সৈন্যদের হাতে পরাজিত হয়। গুজরাটের শাসনভার খান আজমের হস্তে অর্পণ করে আকবর ফতেপুর
সিক্রীতে ফিরে আসেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে পলাতক বিদ্রোহীরা বিক্ষুব্ধ আমীরদের সহায়তায় সুরাট,
ব্রোজ, ক্যাম্বে ও আহমেদাবাদ অধিকার করে নেয়। আকবর আগস্ট থেকে অক্টোবর ১৫৭৩ খ্রি. তাঁদের
বিরুদ্ধে অভিযান করে পুনরায় সেসব এলাকা মুঘলদের অধিকারে এনে গুজরাটকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম
‘সুবা'য় পরিণত করেন।
গুজরাট বিজয় আকবরের রাজত্বকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। কারণ এর ফলাফল
হয়েছিল সুদূর প্রসারী।
প্রথমত, গুজরাট অধিকার করার ফলে সমুদ্রে এবং পশ্চিম উপক‚লের সমৃদ্ধশালী বন্দরগুলোর ওপর
মুঘলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয়ত, গুজরাট বিজয়ের ফলে আকবর পর্তুগিজদের সংস্পর্শে আসেন। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং
পর্তুগিজরা মক্কা যাত্রীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আকবর পরিচিত হন।
তৃতীয়ত, সমুদ্র উপক‚ল অধিকৃত হওয়ায় মুঘলরা নৌবাহিনী গঠনের সুযোগ লাভ করে।
চতুর্থত, রাজা টোডরমল প্রথম গুজরাটে জমি-জরিপ করে আধুনিক রাজস্ব ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন।
পঞ্চমত, গুজরাট বন্দর থেকে আদায়কৃত শুল্ক ও রাজস্ব মুঘল রাজকোষকে স্ফীত করে।
ষষ্ঠত, গুজরাট বিজয়ের ফলে দাক্ষিণাত্যের দ্বার মুঘলদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
পূর্ব ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার


বাংলা ও উড়িষ্যা
গুজরাট বিজয়ের পর আকবর ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে বাংলায় মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। সুলেমান
কররানী নামে একজন আফগান সর্দার বাংলার শাসক ছিলেন। তিনি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে
শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। ১৫৭২ খ্রি. সুলেমান কররানীর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র দাউদ বাংলার শাসক
হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তিনি মুঘলদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে ১৫৭৪ খ্রি.
স্বয়ং আকবর তাঁর বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। দাউদকে পাটনা ও হাজীপুর থেকে বিতাড়িত করে আকবর
দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। সেনাপতি মুনিম খাঁ ও রাজা টোডরমল একে একে মুঙ্গের, তেলিয়াগড়ি, কোলগা,
ভাগলপুর প্রভৃতি স্থান দখল করে নেন। এ সময়ে দাউদ উড়িষ্যায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। দাউদকে
পশ্চাৎধাবন করে মুনিম খাঁ ও টোডরমল ১৫৭৫ খ্রি. বালেশ্বরের নিকট তুকারয় নামক স্থানে তাঁকে পরাজিত
করে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে দাউদ পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মুঘল
সেনাবাহিনী ১৫৭৬ খ্রি. রাজমহলের যুদ্ধে দাউদকে পরাজিত করে। যুদ্ধে তিনি নিহত হন। ফলে বাংলা
মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু বাংলার বার ভ‚ঁইয়া নামে পরিচিত ঢাকা ও ময়মনসিংহের ঈশা খাঁ,
যশোহরের প্রতাপাদিত্য, বিক্রমপুরের কেদার রায় প্রমুখ স্থানীয় জমিদারগণ মুঘলদের আক্রমণ বহুদিন
প্রতিরোধ করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। পূর্বাঞ্চলের অপর রাজ্য উড়িষ্যা আরও কিছুকাল এক প্রকার
স্বাধীন থেকে ১৫৯২ খ্রি. মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল
উত্তর-পশ্চিমে এবং পূর্ব ভারতে মুঘল আধিপত্য বিস্তার করার সময় আকবর সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
অঞ্চল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল সম্বন্ধেও সচেতন ছিলেন। ভৌগোলিক কারণেও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ছিল
যেকোন ভারতীয় সাম্রাজ্যের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ। আকবর এই সীমান্ত নিরাপদ ও নিজ অধিকারে রাখার জন্য
সচেষ্ট হন।
কাবুল
আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মীর্জা হাকিম উত্তরাধিকার সূত্রে কাবুলের অধিপতি ছিলেন। মীর্জা হাকিম
আকবরের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে আকবর ১৫৭৮
খ্রিস্টাব্দে আনুগত্য চেয়ে কাবুলে দূত পাঠান। এতে মীর্জা হাকিম সাড়া না দেওয়ায় ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে
আকবর তাঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাঁকে পরাজিত করেন। কিন্তু তাঁকে ক্ষমা করে পুনরায় কাবুলের শাসক
নিযুক্ত করেন। ১৫৮৫ খ্রি. মীর্জা হাকিমের মৃত্যুর পর কাবুল সম্পূর্ণভাবে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং
আকবর মানসিংহকে কাবুলের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।
কাশ্মির
আকবরের সময় কাশ্মিরের শাসক ছিলেন ইউসুফ শাহ। কাবুল অধিকারের পর কাশ্মিরকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত
করার জন্য ইউসুফ শাহের সঙ্গে ক‚টনীতি ব্যর্থ হলে আকবর আক্রমণের পথ গ্রহণ করেন। ১৫৮৬ খ্রি. তিনি
ভগবান দাস ও কাসিম খাঁকে সসৈন্যে কাশ্মির অধিকারের জন্য প্রেরণ করেন। মুঘল সৈন্যবাহিনী ইউসুফ খাঁ
ও তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে যুদ্ধে পরাজিত করে কাশ্মির মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
সিন্ধু


কাশ্মির অধিকারের পর আকবর বৈরাম খাঁর পুত্র মুলতানের শাসনকর্তা আবদুর রহিমকে সিন্ধু আক্রমণের
নির্দেশ প্রদান করেন। আবদুর রহিম ১৫৯১ খ্রি. এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিন্ধু জয়ের জন্য অগ্রসর হন। তিনি
তথাকার শাসক জানি বেগকে আকবরের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।
কান্দাহার
উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সামরিক দিক বিবেচনা করলে কান্দাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই সিন্ধু ও কাশ্মির
অধিকার করার পর আকবর ১৫৯৫ খ্রি. মধ্যযুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মীর মাসুমের নেতৃত্বে ক‚টকৌশলের
মাধ্যমে বিনা-রক্তপাতে বেলুচিস্তান ও কান্দাহার অধিকার করেন। কান্দাহার অধিকারের ফলে উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত বৈদেশিক আক্রমণ হতে সুরক্ষিত হয়।
দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তার
উত্তর ও মধ্য ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তৃত করার পর আকবর দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কৃতসংকল্প
হন। কারণ, দক্ষিণ ভারতের বিজাপুর, গোলকুন্ডা, আহম্মদনগর ও খান্দেশ অধিকৃত হলে ভারতবর্ষ মুঘল
শাসনের অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরন্তু আকবর বিচক্ষণ রাষ্ট্রনীতিকের মতো তাঁর ভারত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য
পর্তুগিজদের ক্ষমতা দমন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যাতে পর্তুগিজরা দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের
দরবারে আধিপত্য বিস্তার করে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে না পারে। বরং
তাদের আধিপত্য সমুদ্রের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। সুতরাং আকবর সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
নিয়েই তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি পরিচালনা করেন।
আত্মকলহে লিপ্ত দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের মুঘল আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। তথাপি আকবর
১৫৯১ খ্রি. দূত মারফত দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের নিকট তাঁর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার প্রস্তাব করেছিলেন।
কিন্তু একমাত্র খান্দেশ ব্যতীত অন্য কোন রাজ্যই তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এই ক‚টনৈতিক ব্যর্থতার ফলেই
তিনি যুদ্ধ দ্বারা দাক্ষিণাত্য বিজয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বৈরাম খাঁর পুত্র আবদুর রহিম এবং আকবরের দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ১৫৯৫ খ্রি.
আহম্মদনগর অবরোধ করেন। কিন্তু আহম্মদনগরের বিধবা রাজকন্যা চাঁদ সুলতানা দক্ষ সেনাপতির মতো
অমিত বিক্রমে নগর রক্ষায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু চাঁদ সুলতানা নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করে সৈন্যদের প্রেরণা
দিলেও দীর্ঘ অবরোধে তাঁর শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিকে মুঘল সেনাপতিদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দি¡তা
বৃদ্ধি পাওয়ায় মুঘলগণ চাঁদ সুলতানার সঙ্গে ১৫৯৬ খ্রি. সন্ধি স্থাপন করে। এই সন্ধির ফলে বেরার মুঘলদের
ছেড়ে দেওয়া হয় এবং আহম্মদনগরের নাবালক সুলতান মুঘলদের প্রাধান্য স্বীকার করেন। কিন্তু এই চুক্তির
শর্ত নিয়ে আহম্মদনগরে শীঘ্রই দলীয় সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। চাঁদ সুলতানা চুক্তিভঙ্গের বিরুদ্ধে মত দেওয়ায়
বিরুদ্ধবাদীগণ তাঁকে হত্যা করে এবং বেরার পুনরুদ্ধারের জন্য মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রায় চার
বছর যুদ্ধ চলবার পর ১৬০০ খ্রি. আকবরের পুত্র দানিয়েল ও মুঘল সেনাপতি আবদুর রহিম আহম্মদনগর
জয় করেন।
খান্দেশের শাসক সুলতান আলি খাঁ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করলে তাঁর পুত্র মীরণ বাহাদুর আকবরের
সার্বভৌমত্ব গ্রহণে অস্বীকৃত হন। আকবর স্বয়ং ১৫৯৯ খ্রি. দাক্ষিণাত্য অভিমুখে যাত্রা করেন। আকবর
সহজেই খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুর অধিকার করে শক্তিশালী আসিরগড় দুর্গ অবরোধ করেন। দীর্ঘ ছয়
মাস অবরোধের পরও যখন আসিরগড় দুর্গের পতন হল না, তখন আকবর কৌশলে আসিরগড়ের
সুলতানকে নিজ শিবিরে এনে তাঁর সৈন্যগণকে যুদ্ধ ত্যাগের আদেশ দিতে বাধ্য করেন। অতপর


আসিরগড়ের রাজ কর্মচারীগণকে বাদশাহ অর্থ দিয়ে বশীভ‚ত করেন। আকবরের জীবনে এটাই ছিল শেষ
দুর্গ বিজয়।
অতপর নববিজিত দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে আকবর আহম্মদনগর, বেরার ও খান্দেশ এই তিনটি সুবায়
বিভক্ত করেন। শাহজাদা দানিয়েলকে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের সুবাগুলোর শাসক নিযুক্ত করেন।
সম্প্রসারিত সাম্রাজ্যের সংহতি ও দৃঢ়ীকরণে আকবরের ভ‚মিকা
আকবর দক্ষিণ ভারতের উত্তরাংশসহ প্রায় সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মুঘলদের এই ক্ষমতার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আকবর তাঁকে সুসংঘবদ্ধ
করেছিলেন। এখানে আকবরের অনন্যসাধারণ শাসন প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বিদেশী সত্তা পরিত্যাগ
করে মুঘলরা যে মহান জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল আকবর ছিলেন তার প্রকৃত রূপকার। তাঁর বিচক্ষণতা,
দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এই ঐক্য সুদৃঢ় করেছিল। তাঁর প্রতি প্রজাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য তাঁর
সাম্রাজ্যের শক্তির প্রধান উৎস ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল প্রজার প্রতি সমব্যবহার করে আকবর
যে জাতীয় ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিলেন তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ও সংহত করেছিল। শক্তিশালী
রাজপুতদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক নীতি ও তাঁর উদ্দেশ্য সফল করতে সাহায্য করেছিলো। তিনি উপলব্ধি
করেছিলেন যে বন্ধু রাজপুতেরা যেমন সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির স্তম্ভ হবে, শত্রু রাজপুতেরা তেমনি
সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করবে। আকবর রাজপুতদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব
এনেছিলেন। হিন্দুদের প্রতি উদার ব্যবহার তাঁর সাম্রাজ্যকে স্থায়ী ও শক্তিশালী করেছিল। হিন্দুরা বিভিন্ন
রাজপদে থেকে সাম্রাজ্যের সুপরিচালনায় তাঁদের শক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তিনি যখনই কোন রাজ্য
অধিকার করতেন, তৎক্ষণাৎ সেখানে তিনি শান্তি ও শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা করে এক সুশৃ´খল রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে
তোলার উদ্দেশ্যে উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ করতেন। নতুন বিজিত রাজ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা অবলম্বন
করতেন। সেই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে আকবর সামাজিক, ধর্মনৈতিক, অর্থনৈতিক ও
শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করতেন। আকবর বিজিত সাম্রাজ্যের সব রাজ্যে একই রকম শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা
প্রয়োগ করে সমগ্র সাম্রাজ্যকে দৃঢ়ীকরণ ও সংহতি দান করেছিলেন।
সারসংক্ষেপ
আকবর যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তখন তাঁর সাম্রাজ্য পাঞ্জাব, দিল্লি ও আগ্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর (১৫৬১-১৬০১খ্রি.) সামরিক অভিযান পরিচালনা
করেন। তিনি উত্তর ভারতের মালব, গন্ডোয়ানা, রাজপুতনা, গুজরাট, পূর্ব ভারতে বাংলা, উড়িষ্যা,
দক্ষিণ ভারতের আহম্মদনগর, বেরার, খান্দেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সিন্ধু, বেলুচিস্তান,
কাবুল, কাশ্মির, কান্দাহার প্রভৃতি রাজ্য অধিকার করে উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং
পশ্চিমে হিন্দুকুশ থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্য সম্প্রসারণের
ব্যাপারে আকবর সমর অভিযানের পাশাপাশি ক‚টনীতিকে একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে ব্যবহার করে
সফলতা লাভ করেছিলেন।

পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। সম্রাট আকবর কত খ্রি. সিংহাসনে বসেন?
(ক) ১৫২৬ (খ) ১৫৫৬
(গ) ১৫৫৭ (ঘ) ১৬২৬।
২। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ কত খ্রি. সংঘটিত হয়েছিল?
(ক) ১৫৫৬ (খ) ১৬৫৬
(গ) ১৫২৬ (ঘ) ১৭৫৬।
৩। আকবরের সর্বশেষ আত্মরক্ষার যুদ্ধ কোনটি?
(ক) হলদিঘাটের যুদ্ধ (খ) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
(গ) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ (ঘ) রাণাঘাট যুদ্ধ।
৪। আকবর কত খ্রি. স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ করেন?
(ক) ১৫৬০ (খ) ১৬০১
(গ) ১৫৫৬ (ঘ) ১৫৬৪।
৫। বালক আকবরের অভিভাবক হিসেবে কে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন?
(ক) আদম খাঁ (খ) মানসিংহ
(গ) বৈরাম খাঁ (ঘ) সিকান্দার শূর।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। হিমু কে ছিলেন? তিনি কিভাবে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেছিলেন?
২। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
৩। আকবর কিভাবে বাংলা অধিকার করেন?
৪। বৈরাম খাঁর পদচ্যুতি ও স্বহস্তে আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
৫। গন্ডোয়ানা অধিকারের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লিখুন।
৬। গুজরাট অধিকারের প্রধান কারণসমূহ উল্লেখ করুন।
৭। আহম্মদনগর রক্ষার্থে চাঁদ সুলতানা কি ভ‚মিকা রেখেছিলেন?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। সম্রাট আকবরের রাজ্য বিস্তারের একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দিন।
২। আকবরের উত্তর ভারত বিজয়ের বর্ণনা দিন।
৩। আকবর কিভাবে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]