সম্রাট আকবরের অনেকগুলো সন্তান পরপর শৈশব অবস্থায় মারা যাওয়ার পর ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের
জন্ম হয়। তিনি ছিলেন অম্বররাজ বিহারীমলের কন্যার গর্ভজাত সন্তান। শেখ সেলিম চিস্তির দয়ায় এই
সন্তানের জীবন রক্ষা পেয়েছে বলে আকবর সন্তানের নাম রাখেন সেলিম। ¯েœহভরে ডাকতেন ‘সেখুবাবা'
বলে। আকবরের জীবিতকালেই আকবরের অপর দুই পুত্র মুরাদ ও দানিয়েল অল্প সময়ের ব্যবধানে
মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। স্বভাবতই আকবরের উত্তরাধিকারী হিসেবে সেলিমের দাবি অগ্রগণ্য ছিল।
১৬০৫ খ্রি: আকবরের মৃত্যু হলে সেলিম ‘নুরুদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর' নাম ধারণ করে ছত্রিশ বৎসর বয়সে
দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৬০০ খ্রি: আকবরের জীবদ্দশায় সেলিম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
করায় অনেকে মনে করেছিলেন যে, সম্রাট আকবর সেলিমের পুত্র খসরুকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী
মনোনীত করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আকবর সেলিমকে ক্ষমা করেন এবং মুত্যুশয্যায় সেলিমকে
উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গীর তাঁর বিরোধিতাকারীদের ক্ষমা করেন। তাঁদেরকে পূর্ববর্তী পদে বহাল করেন।
এসঙ্গে কতগুলো জনহিতকর কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করেন। মহান পিতার প্রজা বাৎসল্যের দিকে তাকিয়ে
প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য আগ্রা দুর্গ হতে যমুনা পর্যন্ত ষাটটি ঘন্টাযুক্ত ত্রিশ গজ লম্বা একটি সোনার
শিকল ঝুলিয়ে দেন। এর ফলে যেসব প্রজা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতো তারা শিকলে টান দিয়ে সম্রাটের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো। সম্রাটও সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। ইতিহাসে এই ঘন্টা ইবষষ ড়ভ
ঔঁংঃরপব বা ন্যায়বিচারের ঘন্টা নামে পরিচিত। এছাড়া সাম্রাজ্যের শান্তি-শৃ´খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১২টি
শাসনতান্ত্রিক বিধি জারি করেন। যথাÑ
১। তামঘা ও মীর-বাহরী নামক পণ্য ও বাণিজ্য শুল্ক রহিতকরণ।
২। মদ ও অন্যান্য নেশার দ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধকরণ।
৩। বলপূর্বক অন্যের সম্পত্তি দখল নিষিদ্ধকরণ।
৪। গরীব জনসাধারণের জন্য হাসপাতাল স্থাপন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থাকরণ।
৫। অপরাধীর নাক-কান কেটে শাস্তি দেওয়ার প্রথা বাতিলকরণ।
৬। নির্দিষ্ট দিনে পশুহত্যা নিষিদ্ধকরণ।
৭। মনসবদার ও জায়গীরদার প্রথার স্থিতিশীলতার জন্য তাদের নিজ পরগনায় বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন
নিষিদ্ধকরণ।
৮। রবিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
৯। আইমা বা ওয়াক্ফ জমির নির্দিষ্টকরণ।
১০। দুর্গ ও কারাগারের সকল বন্দিদের প্রতি রাজনৈতিক ক্ষমা প্রদান।
১১। রাহাজানি ও চুরি বন্ধ করার ব্যবস্থাকরণ।
১২। উত্তরাধিকারী বিহীন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি জনসাধারণের কল্যাণে ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান।
পুত্র খসরুর বিদ্রোহ
মেবার
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো পিতার বিরুদ্ধে পুত্র খসরুর বিদ্রোহ। জাহাঙ্গীর
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র পাঁচ মাস পর খসরু কয়েকশত অনুচর নিয়ে আগ্রা ত্যাগ করে পিতার
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হন। মথুরায় তাঁর সাথে হোসেন বেগ
বাদাকশালী এবং পানিপথে লাহোরের দেওয়ান আবদুর রহিম যোগ দিয়ে খসরুর শক্তি বৃদ্ধি করেন। খসরু
অচিরেই লাহোর দুর্গ অবরোধ করেন। পুত্রের বিদ্রোহের সংবাদ অবগত হয়ে সম্রাট স্বয়ং পুত্রকে দমন করার
জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন। খসরু সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর হস্তে পরাজিত হয়ে হোসেন বেগকে সঙ্গে নিয়ে কাবুলের
দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু চেনাব নদী অতিক্রম করার সময় সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর হাতে অনুচরসহ খসরু
বন্দি হন। জাহাঙ্গীর খসরুকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন। তাঁর অনুচরদের হত্যা করা হয়। খসরুকে এবং
সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে শিখগুরু অর্জুনকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রুদ্ধ সম্রাট কারাগারে নিক্ষেপ
করেন এবং কারারক্ষীদের অত্যাচারে অর্জুনের মৃত্যু ঘটে। কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর পিতৃ¯েœহবশত
খসরুর প্রতি সম্রাটের মনোভাব নরম হয়। কিন্তু ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের
সঙ্গে খসরু জড়িত আছেন মনে করে সম্রাট চারজন ষড়যন্ত্রকারীকে প্রাণদন্ড দেন এবং খসরুকে অন্ধ করে
দেওয়ার নির্দেশ দেন। যথারীতি সম্রাটের নির্দেশ প্রতিপালিত হয়। অবশ্য খসরু পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাননি
এবং পরে সম্রাট অনুতপ্ত হয়েছিলেন।
দশ বৎসর পর সম্রাটের আদেশে অর্ধঅন্ধ খসরুকে মুক্তি প্রদান করা হয়। ইতোমধ্যে সম্রাজ্ঞী নুরজাহান
জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ার সঙ্গে নিজের পূর্ব বিবাহজাত কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দিয়ে
শাহরিয়ারকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে উদ্যোগী হন। এই পথকে নিষ্কণ্টক করার উদ্দেশ্যে
নুরজাহান শাহজাদা খসরুকে তাঁর ভ্রাতা আসফ খাঁর হস্তে সমর্পণ করেন। আসফ খাঁ তাঁকে শাহজাদা
র্খুরমের (শাহজাহান) তত্ত¡াবধানে রাখেন। খসরুর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষানি¦ত হয়ে র্খুরম ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাজা
বাহাদুর নামে এক দুর্বৃত্ত ব্যক্তির দ্বারা খসরুকে হত্যা করান। এভাবে হতভাগ্য খসরুর জীবনাবসান ঘটে।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নুরজাহানের বিবাহ ও তাঁর প্রভাব
১৬১১ খ্রি: সম্রাট জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে বিবাহ করেন। নুরজাহানের বিবাহপূর্ব জীবনের নাম ছিল
মেহেরুন্নিসা। তিনি ছিলেন বর্ধমানের জায়গীরদার শের আফগানের পতœী এবং মির্জা গিয়াস বেগ-এর কন্যা।
মেহেরুন্নিসার সঙ্গে যুবরাজ সেলিমের প্রণয় নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে, সম্রাট আকবর
অসাধারণ সুন্দরী মেহেরুন্নিসার প্রতি সেলিমের আসক্তি দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী শের আফগানকে হত্যা করে মেহেরুন্নিসাকে বিবাহ
করেন। মেহেরুন্নিসার বিবাহের পর নতুন নামকরণ হয় ‘নুরজাহান'। শীঘ্রই জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে প্রধান
বেগমের মর্যাদা দান করেন। আরবি ও ফারসি সাহিত্যে নুরজাহানের যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। রাজনৈতিক ও
কুটনৈতিক সমস্যা অনুধাবন করার যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। তিনি সৌন্দর্য-প্রিয় নারী ছিলেন এবং
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে শিল্পকলার যে অভ‚তপূর্ব উন্নতি ঘটে তা প্রধানত নুরজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায়
সম্ভবপর হয়েছিল। রাজ্য শাসন ব্যাপারে জাহাঙ্গীর ক্রমশ: নুরজাহানের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে
পড়েন। নুরজাহান নিজ ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য একটি গোষ্ঠিচক্র গঠন করেন। এই গোষ্ঠিচক্রে তাঁর পিতা
মির্জা গিয়াস বেগ (ইতিমাদ উদ্দৌলা), ভ্রাতা আসফ খাঁ এবং প্রথম দিকে যুবরাজ খুররমও ছিলেন। পরবর্তী
সময়ে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে প্রথম বিবাজহাত কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দিলে
খুররম নুরজাহানের ¯েœহদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হন। অন্যদিকে নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খাঁর কন্যা আরজুমন্দ
বানুর সঙ্গে শাহজাদা র্খুরমের বিবাহ হলে আসফ খাঁ নিজের জামাতাকে দিল্লির সিংহাসনের পরবর্তী
উত্তরাধিকারী করার বাসনা পোষণ করতে লাগলেন।
জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বিস্তার
পিতা আকবরের মতোই জাহাঙ্গীর সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেন। আকবর সমগ্র রাজপুতনায়
আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও মেবারের রানা প্রতাপসিংহ আকবর তথা মুঘলদের প্রতি আনুগত্য
স্বীকার করেননি। প্রতাপসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অমরসিংহ ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রানা পদে
অধিষ্ঠিত হন। তিনি পিতার ন্যায় কষ্টসহিষ্ণু ও দৃঢ়চিত্তের অধিকারী না হলেও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে
তিনিও মুঘলদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেননি। জাহাঙ্গীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই দ্বিতীয় পুত্র
পারভেজ-এর নেতৃত্বে মেবারের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। এই অভিযানের ফলাফল অনিশ্চিত হলে সম্রাট
জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খ্রি: মহব্বৎ খাঁর নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী মেবারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু
রাজপুতদের প্রবল বিরোধিতার ফলে এবারও মুঘলদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে ১৬১৬ খ্রি. জাহাঙ্গীরের তৃতীয়
পুত্র র্খুরমের নেতৃত্বে মুঘল সৈন্যবাহিনী মেবার আক্রমণ করে। মুঘল সৈন্যবাহিনী মেবারের গ্রামগুলোতে
লুণ্ঠন, অত্যাচার ও ধ্বংসকার্য চালায়। মুঘল বাহিনী মেবার বিধ্বস্ত করতে থাকলে অমরসিংহ বাধ্য হয়ে
সন্ধির জন্য প্রার্থনা জানান। মুঘল ও রাজপুতদের মধ্যে এক সম্মানজনক শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মেবারের রানা এই প্রথম মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেন। এ কারণে ঐতিহাসিকগণ একে মুঘল-মেবার
সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করেন। এভাবে মেবারের রাজবংশের সঙ্গে মুঘল
সম্রাটের বিবাদের অবসান ঘটে। মেবারের রানার আনুগত্য লাভে খুশি হয়ে জাহাঙ্গীর অমরসিংহ ও তাঁর পুত্র
কিরণসিংহের মর্মর মূর্তি নির্মাণ করে আগ্রা দুর্গে স্থাপন করেন।
বাংলা বিজয়
বাংলায় আফগান শক্তি বিনষ্ট করে আকবর মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু
বাংলায় আফগান দলপতিগণ মুঘল সম্রাটের আনুগত্য পুরোপুরি স্বীকার করেননি। বার ভ‚ঁইয়া নামে পরিচিত
কয়েকজন শক্তিশালী জমিদার ও আফগান ওমরাহ বাংলার বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে শাসন করছিলেন।
সম্রাট বিচক্ষণ সুবাদারদের প্রেরণ করা সত্তে¡ও সেসব স্থানে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি।
কুতুবউদ্দিন খাঁ, কোকা ও জাহাঙ্গীর কুলি খাঁর পর ইসলাম খাঁকে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিয়োগ
করেন। ১৬১৩ খ্রি: পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল থাকেন। প্রধানত তাঁরই প্রচেষ্টায় পাঁচ বৎসরের মধ্যে প্রায়
সমগ্র বাংলায় মুঘল আধিপত্য স্থাপিত হয়। ইসলাম খাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় মুঘল সৈন্যবাহিনী সোনারগাঁওএর জমিদার মুসা খাঁ (ঈশা খাঁর পুত্র), সিলেট জেলার বুকাইনগরের আফগান জমিদার ওসমান খাঁ ও
যশোরের সামন্তরাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে। এভাবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
দাক্ষিণাত্য অভিযান
আকবরের মতো জাহাঙ্গীরও দাক্ষিণাত্যে সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেন। আকবরের সময় আহম্মদনগরের
পতন ঘটলেও উক্ত রাজ্য সম্পূর্ণভাবে মুঘলদের অধীন হয়নি। আকবরের মৃত্যুর সময় (১৬০৫ খ্রি:) সমগ্র
খান্দেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু আহম্মদনগরের একাংশ মাত্র মুঘল শাসনাধীনে ছিল। অন্য
অংশের স্বাধীন শাসক ছিলেন নিজামশাহী বংশের জনৈক শাহজাদা দ্বিতীয় মুর্তজা নিজাম শাহ। তাঁর মন্ত্রী
ছিলেন মালিক অম্বর। মালিক অম্বর শাসনকার্য, যুদ্ধ পরিচালনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রতিভার পরিচয়
দিয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের হাত থেকে তিনি আহম্মদনগরের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা
চালান। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগরের স্বাধীন অংশটি জয় করার উদ্দেশ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র
শাহজাদা পারভেজের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী প্রেরিত হয়। আহম্মদনগরের অসাধারণ যোগ্যতা সম্পন্ন মন্ত্রী
মালিক অম্বর সাফল্যের সঙ্গে বাধা প্রদান করলে মুঘল অভিযান ব্যর্থ হয়। ফলে ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে শাহজাদা
পারভেজের স্থলে শাহজাদা র্খুরমকে মুঘল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। মালিক অম্বরের
নেতৃত্বাধীন আহম্মদনগর বাহিনীকে এবার পরাজয় স্বীকার করতে হয়। তিনি বালাঘাট অঞ্চল ও
আহম্মদনগরের দুর্গ মুঘলদের হস্তে সমর্পণ করেন। দাক্ষিণাত্যে সাফল্যের জন্য র্খুরমকে সম্রাট জাহাঙ্গীর
‘শাহজাহান' উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মুঘল
সৈন্যবাহিনীর মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃ´খলার সুযোগ নিয়ে মালিক অম্বর পুনরায় তাঁর কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি
করেন। শাহজাহানকে পুনরায় দাক্ষিণাত্যে পাঠানো হয়। মালিক অম্বর পুনরায় বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন।
১৬২৩ খ্রি: শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে মালিক অম্বর তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু
শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকারের পর মালিক অম্বর পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই মুঘল
সৈন্যবাহিনীকে কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপৃত হতে হয়। ফলে মুঘল সৈন্যবাহিনীকে দাক্ষিণাত্য থেকে
ফেরত আনা হয়। এভাবে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্য বিজয় প্রচেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটে।
কাংড়া বিজয়
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে অপর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো কাংড়া বা নগরকোট দুর্গ জয়। উত্তর
পাঞ্জাবের শতদ্রু ও রাভী নদীর মধ্যবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলে দুর্ভেদ্য কাংড়া দুর্গটির অবস্থান। পাঞ্জাবের
শাসনকর্তা মর্তুজা খানকে কাংড়া দুর্গ অধিকারের জন্য সসৈন্যে প্রেরণ করা হয়। এই অভিযান ব্যর্থ হলে
শাহজাদা র্খুরমের নেতৃত্বে মুঘল সৈন্যবাহিনী দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর অবরোধের পর অবশেষে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে
বিখ্যাত কাংড়া দুর্গ অধিকার করেন।
কান্দাহার নিয়ে পারস্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দি¡তা
মধ্যযুগে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র ছিল কান্দাহার। কান্দাহারের ওপর প্রভুত্ব
স্থাপনের জন্য পারস্যের শক্তিশালী অধিপতিদের সঙ্গে মুঘল সম্রাটদের দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদ্বন্দি¡তা চলছিল।
১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর কান্দাহার অধিকার করে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক
পারস্যের অধিপতি শাহ আব্বাস ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং সুদক্ষ শাসক। আকবরের মৃত্যুর পর তিনি
কান্দাহার অধিকারের জন্য বিশেষ ব্যগ্র হয়ে ওঠেন। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কান্দাহার দুর্গ অবরোধের চেষ্টা
করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। অতপর তিনি প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ
ব্যবহার করতে থাকেন। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ তিনি বিভিন্ন সময়ে জাহাঙ্গীরের নিকট উপহার পাঠান।
সম্রাট জাহাঙ্গীর পারস্যের সম্রাটের ব্যবহারে প্রীত হয়ে কান্দাহার দুর্গের সুরক্ষার ব্যাপারে অবহেলা দেখান।
শাহ আব্বাস এরূপ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অতর্কিতে কান্দাহার আক্রমণ করে
অধিকার করে নেন। জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে কান্দাহার পুনরৃদ্ধার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই সময় সম্রাট
জাহাঙ্গীরের বিরৃদ্ধে শাহজাহান বিদ্রোহ করলে সম্রাটকে বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্যাপৃত থাকতে হয়। ফলে
কান্দাহার মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়।
শাহজাহানের বিদ্রোহ
অতিরিক্ত মদ ও আফিম সেবন করার ফলে শেষ জীবনে জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। নুরজাহানই সে
সময়ে প্রকৃতপক্ষে রাজ্য শাসন করেন। জাহাঙ্গীরের অবর্তমানে কে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন তা
নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। নুরজাহান এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ শুরু করলে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে।
জাহাঙ্গীরের চার পুত্রÑ খসরু, পারভেজ, র্খুরম ও শাহরিয়ার-এর মধ্যে তৃতীয় পুত্র র্খুরম (শাহজাহান)ই
সকল দিক দিয়ে যোগ্যতম ছিলেন। ইতোমধ্যে র্খুরমের ষড়যন্ত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরুর মৃত্যু ঘটে। কনিষ্ঠ পুত্র
শাহরিয়ারের সঙ্গে নুরজাহান তাঁর পূর্ব বিবাহজাত কন্যা লাড্লী বেগমকে বিবাহ দিয়ে তাঁকে সিংহাসনে
বসানোর ষড়যন্ত্র করেন। ইতোমধ্যে পারস্যের শাসক কান্দাহার অধিকার করলে জাহাঙ্গীর শাহজাদা
শাহজাহানকে কান্দাহার অভিযানের নির্দেশ দেন। কিন্তু শাহজাহান মনে করেন যে, এতে নুরজাহানের
ষড়যন্ত্র রয়েছে। দিল্লি ছেড়ে সুদূর কান্দাহার গেলে পিতাকে (জাহাঙ্গীর) দিয়ে নুরজাহান শাহরিয়ারকে
সিংহাসনের উত্তরাধিকারীরূপে মনোনয়ন করিয়ে নেবেন। তাই শাহজাহান পিতার আদেশ অমান্য করে
বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে মালিক অম্বরের
সাহায্য লাভের জন্য দাক্ষিণাত্যে গমন করেন। সেখানে কোন সাহায্য না পেলে তিনি উড়িষ্যার পথে বাংলায়
এসে রাজমহল অবরোধ করে পাটনায় প্রবেশপূর্বক বিহার অধিকার করেন। সেনাপতি মহব্বৎ খাঁ ও
পারভেজ তাঁর পশ্চাদধাবন করে এলাহাবাদের কাছে পরাজিত করলে শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে পলায়ন
করেন।
সেখানে আহম্মদনগরের একাংশের শাসক মালিক অম্বরের সঙ্গে যোগ দেন। পুনরায় মহব্বৎ খাঁ ও পারভেজ
তাঁর পশ্চাদধাবন করে দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হলে শাহজাহান আত্মসমর্পণ করেন। এবং পিতার কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করে। উদার হৃদয় জাহাঙ্গীর পুত্র¯েœহে শাহজাহানকে ক্ষমা করেন।
সেনাপতি মহব্বৎ খাঁর বিদ্রোহ
শাহজাহানের বিদ্রোহ দমনে মহব্বৎ খাঁর কৃতিত্বে নুরজাহান শঙ্কিত হন। মহব্বৎ খাঁকে শক্তিশালী ও
প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠতে দেখে নুরজাহান তাঁকে পারভেজের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য বাংলায় প্রেরণের
ব্যবস্থা করেন। নুরজাহানের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে মহব্বৎ খাঁ বিদ্রোহ করেন। নুরজাহান ও জাহাঙ্গীর কাশ্মির
বেড়াতে যাবার পথে ঝিলাম নদীর তীরে সম্রাটের শিবিরে হানা দিয়ে মহব্বৎ খাঁ তাঁদের বন্দি করেন। কিন্তু
নুরজাহানের কৌশলে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে উভয়েই পলায়ন করতে সক্ষম হন। রোটাস নামক স্থানে
জাহাঙ্গীর উপস্থিত হয়ে তাঁর অনুচরদের সহায়তায় সৈন্য সংগ্রহ করেন। পরিস্থিতির এরূপ পরিবর্তন হলে
মহব্বৎ খাঁ দক্ষিণাত্যে অবস্থানরত শাহজাহানের নিকট আশ্রয়প্রার্থী হন। ইতোমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের
ফলে শাহজাদা পারভেজের মৃত্যু ঘটে। ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মির থেকে ফেরার পথে জাহাঙ্গীর মৃত্যুবরণ
করেন।
ইউরোপীয়দের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক
আকবরের রাজত্বকালেই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় শক্তি পর্তুগিজদের সঙ্গে মুঘলদের পরিচয় ঘটে। এই সূত্র ধরে
পরবর্তীকালে ইউরোপীয় জাতি বিশেষত ওলন্দাজ ও ইংরেজগণ ভারতে আগমন করেছিল। ১৬০৮
খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে ক্যাপ্টেন হকিন্স নামে জনৈক ইংরেজ এক
অনুরোধপত্র সহ জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। জাহাঙ্গীর ইংরেজ দূতকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অনুরোধ
পত্রের বক্তব্য অনুযায়ী ইংরেজ বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। অতপর
পর্তুগিজদের প্ররোচণায় ইংরেজ বণিকগণ উল্লেখিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে এডওয়ার্ডস নামক
জনৈক ইংরেজ পুনরায় জেমসের পত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। কিন্তু দৌত্য ব্যর্থ হলে ১৬১৫ খ্রি:
প্রথম জেমসের দূত হিসেবে দরবারে আগমন করেন স্যার টমাস রো। তিনি ছিলেন একজন সুশিক্ষিত
বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ। পর্তুগিজদের প্রবল বিরোধিতা সত্তে¡ও তিনি সফল হন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ইংরেজ
কোম্পানিকে সুরাটে একটি কুঠি স্থাপন এবং অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান করেন। জাহাঙ্গীরের
দরবারে আগত এসব ইউরোপীয় ব্যক্তি মুঘল যুগের বেশকিছু তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এসব তথ্য
থেকে মুঘল দরবারের রীতি-নীতি, আইন-অনুষ্ঠান, সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
জাহাঙ্গীরের চরিত্র ও কৃতিত্ব
মধ্যযুগে ভারতের মহান সম্রাট আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর ভারত-ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে
আছেন। মুঘল সংস্কৃতিমনা পরিবারের তাঁর জন্ম। জাহাঙ্গীর তাঁর পিতা আকবর এবং মুঘল সাম্রাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা বাবুরের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী না হলেও মুঘলদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে
একেবারে দূরে সরে পড়েননি। তিনি পিতামহের মতো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যাতে রয়েছে
মধ্যযুগের ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। এ গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, মুঘল রাজপরিবারের নিখুঁত
ঐতিহাসিক তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। তিনি আকবরের ন্যায় বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত না হলেও বুদ্ধিমান,
সংস্কৃতিপরায়ণ, রুচিশীল ও কৌশলী রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। এসব গুণের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও তাঁর
সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল মদ্যপান ও আফিম সেবন। তবুও তাঁকে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ ঞধষবহঃবফ
ফৎঁহশধৎফ বলে অভিহিত করেছেন।
সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে জাহাঙ্গীর একজন সফল শাসক ছিলেন। শাসনকার্য স্বয়ং পরিচালনা
করতেন। তিনি কারও পরমার্শ গ্রহণ করতেন না। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে জাহাঙ্গীর যে অবিচল ছিলেন তার
প্রমাণ পাওয়া যায় বহু প্রচেষ্টা সত্তে¡ও নুরজাহান যখন শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে ব্যর্থ হন।
একমাত্র যোগ্য পুত্র র্খুরমকে (শাহজাহান) সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে জাহাঙ্গীর ভুল
করেননি। এখানেই তাঁর ব্যক্তিত্বে দৃঢ়তার পরিচিতি মেলে। শিকারে তাঁর অনুরাগ লক্ষণীয়। তিনি ছিলেন
একজন উৎকৃষ্ট শিকারী। সেনাপতি হিসেবেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সামরিক অভিযানের
যাবতীয় পরিকল্পনা তিনি নিজেই করতেন। ন্যায়বিচারের জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। বিচারকার্যে তিনি ব্যক্তি ও
ব্যষ্টির মধ্যে কোন প্রভেদ করতেন না। ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে তিনি রাজ দরবারে ঘন্টা ঝুলিয়ে
রেখেছিলেন। যে কেউ সুবিচারের জন্য ঘন্টা বাজিয়ে সম্রাটের নিকট উপস্থিত হতে পারতো। মুঘল
সম্রাটদের মধ্যে জাহাঙ্গীরই সর্বপ্রথম বারটি লিখিত আইন প্রণয়ন করেছিলেন। শান্তি-শৃ´খলা বজায় রাখার
জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। অপরাধী কঠোর দন্ডে দন্ডিত হতো, তবে প্রাণদন্ড খুব সতর্কতার সঙ্গে
দেওয়া হতো। তাতে মনে হয় জাহাঙ্গীর নিষ্ঠুর ছিলেন না। তবে মাঝে মাঝে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলে নিষ্ঠুরতার
পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হতেন না।
জাহাঙ্গীরের অন্তর ছিল কোমল। আত্মীয়-স্বজন এমনকি পশুপক্ষীর জন্যও তাঁর দয়া ও মমত্ববোধ লক্ষণীয়।
পিতার বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহী হয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু পিতার প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা যা তাঁর
আত্মজীবনীতে স্বীকৃত হয়েছে।
আকবরের মতো জাহাঙ্গীর ধর্মের ব্যাপারে উদার ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও আকবরের
মতো তিনি বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা শুনতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি এমন কিছু আচরণ করতেন , যার
ফলে তাঁর ধর্মনীতি সম্পর্কে কোন কোন ঐতিহাসিক সন্দেহ পোষণ করেছেন। তিনি হিন্দু যোগীদের সঙ্গ
দিতেন। হোলি উৎসবে যোগদান করতেন। কিন্তু তা সত্তে¡ও জ্বালামুখী মন্দিরে তাঁর আচরণ ও শিখ গুরু
অর্জুন হত্যার ব্যাখ্যা অন্যভাবে হতে পারে। তবে একথা সত্যি যে, কোন ধর্মীয় উম্মাদনায় তিনি শিখ গুরু
অর্জুনকে হত্যা করেননি। তিনি মুঘল দরবারের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন বিধায় জাহাঙ্গীর তাঁকে
হত্যা করেন। বাস্তবে তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন। পিতার মতোই তাঁর রাজদরবারে
হিন্দুদের মর্যাদা দেন। রাষ্ট্রীয় কার্যে হিন্দুদের অংশগ্রহণে কোন বাধা সৃষ্টি করেননি। মানসিংহ ও অন্যান্য
হিন্দু মনসবদারগণ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীর শিল্প ও সাহিত্যের পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শিল্পের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি স্বয়ং
চিত্রাঙ্কন ও চিত্র সমালোচনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। আগ্রার প্রাসাদের দেওয়াল চিত্রের কতকাংশ তিনি
নিজে অঙ্কন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে মুঘল চিত্রশিল্প চরম উৎকর্ষতা লাভ করে গৌরবের স্বর্ণ শিখরে
আরোহণ করে। মূলত তাঁর আমলেই মুঘল চিত্রকর্ম সম্পূর্ণ ভারতীয় চরিত্র পায়। সমকালীন ভারতবর্ষ এবং
পারস্যের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি ফারসি ও তুর্কি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ
ছিলেন। মদ-শিল্প-সাহিত্যকে তিনি একই সঙ্গে ভালোবেসেছিলেন। তাঁর লেখা ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী'
মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। তিনি তাঁর রাজদরবারে হিন্দি কবি ও বিভিন্ন ধর্মতত্ত¡বিদদের
স্থান দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। সঙ্গীত শিল্পের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। সংক্ষপে বলা যায়,
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর মুঘল রাজবংশের একজন অন্যতম সফল ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি কান্দাহার ছাড়া
সর্বত্র পিতার অর্জিত সাম্রাজ্য অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতার প্রদর্শিত পথেই প্রজাদের কল্যাণ ও
রাষ্ট্রে সুশাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন এবং মুঘল শাসনের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।
আমরা যেন ভুলে না যাই, ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই রাজত্বকালে স্যার টমাস রো ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম
জেমসের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দরবারে এসে নতজানু হয়ে সম্রাটের অনুগ্রহ চেয়েছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের
রীতিনীতি, ঐশ্বর্য ইংরেজ দূতকে বিস্মিত করেছিল। তাই ঐতিহাসিক ড. বেণীপ্রসাদ যথার্থ বলেছেন,
“জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল ছিল সাম্রাজ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধির সূচক। শিল্প ও বাণিজ্য চরম উৎকর্ষ লাভ করে।
স্থাপত্যের অগ্রগতি সামান্য বটে, কিন্তু চিত্রশিল্প গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করে।”
সারসংক্ষেপ
মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীর অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। রাজ্য বিস্তার,
বিদ্রোহ দমন ও রাজ্য শাসনে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাঁর সময়ে ইউরোপীয় বণিক বিশেষত
ইংরেজ বণিক ভারতবর্ষে আগমন করে। তাঁরা সম্রাটের অনুমতি নিয়ে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ
পায়। তিনি ছিলেন উদার প্রকৃতির। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ। তাঁর আমলে
ভারতে চিত্রকলার প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি ছিলেন একজন সুশাসক ও ন্যায় বিচারক। তাঁর
শাসনামলে সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। জাহাঙ্গীরকে আকবর ¯েœহ করে কি নামে ডাকতেন?
(ক) সেখুবাবা (খ) সেলিম বাবা
(গ) জাহাবাবা (ঘ) জহুবাবা।
২। সিংহাসনে বসে সম্রাট জাহাঙ্গীর কয়টি শাসনতান্ত্রিক বিধি জারি করেছিলেন?
(ক) ১৫টি (খ) ১০টি
(গ) ১২টি (ঘ) ২০টি।
৩। কত খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে বিবাহ করেন?
(ক) ১৬০০ খ্রি: (খ) ১৬০৫ খ্রি:
(গ) ১৬১১ খ্রি: (ঘ) ১৬১২ খ্রি:।
৪। কোন ইংরেজ রাজা প্রথম জেমসের চিঠি নিয়ে সর্বপ্রথম সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন?
(ক) ক্যাপ্টেন হকিন্স (খ) এডওয়ার্ডস
(গ) স্যার টমাস রো (ঘ) উইলিয়াম কেরী।
৫। ধর্মীয় ব্যাপারে জাহাঙ্গীর কেমন ছিলেন?
(ক) গোঁড়া (খ) উদার
(গ) মধ্যপন্থী (ঘ) সংস্কারপন্থী।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনতান্ত্রিক বিধিসমূহের বিবরণ দিন।
২। জাহাঙ্গীর কর্তৃক খসরুর বিদ্রোহ দমন সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
৩। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বাংলা অভিযানের বর্ণনা দিন।
৪। ইউরোপীয়দের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক সংক্ষেপে বিবৃত করুন।
৫। শাসক হিসেবে জাহাঙ্গীরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
রচনামূলক ঃ
১। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজ্য বিস্তারের একটি বিবরণ দিন।
২। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সংঘটিত বিদ্রোহসমূহের বর্ণনা দিন।
৩। সম্রাট জাহাঙ্গীরের চরিত্র ও কৃতিত্ব বর্ণনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত