প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের বিদেশীদের বিবরণ

(গ) বিদেশীদের বিবরণ
সাহিত্যিক ও প্রতœতাত্তি¡ক উৎস ছাড়াও আমাদের কাছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের অন্য এক
ধরনের উৎস রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিদেশীরা ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ
এ দেশে এসে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে এবং কেউ এদেশে না এসেও লোকমুখে শুনে ভারতবর্ষ
সম্পর্কে তাঁদের বিবরণ লিখেছিলেন।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে যাঁদের বিবরণ পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম উল্লেখ করতে হয় হেরোডোটাস
ও টেসিয়াসের নাম। দুজনের একজনও এদেশে আসেন নি। জনশ্রুতি এবং অন্যান্য উৎসের ওপর ভিত্তি
করে তাঁরা তাঁদের বিবরণ লিখেছিলেন।
গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (আনুমানিক ৪৮৪-৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তদানীন্তন পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত
এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚লে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসের জনক হিসাবে পরিচিত
হেরোডোটাসের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হচ্ছে ‘হিস্ট্রি'। তিনি কখনও ভারতবর্ষে আসেন নি, তবে তিনি
জানতেন যে ভারতবর্ষ তখন পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রদেশ ছিল। তাঁর বিবরণে ভারতবর্ষ
সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়।
টেসিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে জন্ম) বিশ বছর (৪১৮-৩৯৮ খ্রিস্টপূর্ব) পারস্যের রাজা আর্টাজারেক্সের
চিকিৎসক ছিলেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি একটি বিবরণ লিখেছিলেন যা খন্ডিত আকারে পরবর্তী
লেখকদের রচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। রলিনসন যথার্থই বলেছেন যে টেসিয়াসের ইন্ডিকা
“দানব সদৃশ্য মানুষের ও অদ্ভুত জীবজন্তুর অসংযত গল্পে ভরপুর। এটা থেকে ভারত সম্পর্কে আমাদের
জ্ঞান বৃদ্ধি পায় না।”
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে তিনজনÑ নিয়ারকস, অ্যারিস্টোবোলাস এবং
অনেসিক্রিটাস ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবরণ লিখেছিলেন। নিয়ারকস সমুদ্রপথে দেশে ফিরেছিলেন এবং তাঁর
বিবরণে সমুদ্রপথের এবং ভারতীয় বন্দর, আমদানী-রপ্তানী দ্রব্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারিত বর্ণনা
রয়েছে। তাঁর বিবরণ থেকেই ভারতের জাহাজ-নির্মাণ শিল্প ও ভারতীয় বণিকদের পশ্চিম সাগরপথে
বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। আলেকান্ডারের অপর সঙ্গী অ্যারিস্টোবোলাস শেষ জীবনে তাঁর অভিজ্ঞতার
কাহিনী লিখেছিলেন। অনেসিক্রিটাস সমুদ্র যাত্রায় নিয়ারকসের সঙ্গী ছিলেন এবং তিনিও একটি বিবরণ
লিখেছিলেন। নিয়ারকস সিন্ধু নদ থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত জলপথে গিয়েছিলেন।
বিদেশীদের মধ্যে ভারতবর্ষ সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবরণ লিখেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারে
আগত গ্রিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস। তিনি ভারতে আট বছর অবস্থান করেছিলেন এবং মৌর্য সম্রাটের
শাসনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘ইন্ডিকা' বর্তমানে সম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া না গেলেও
পরবর্তীকালের লেখকদের রচনায় উদ্ধৃতির আকারে ইন্ডিকার বিষয়বস্তু প্রচুর স্থান পেয়েছে। পরবর্তীকালে
স্ট্র্যাবো (খ্রি: পূ: ৬৩-২১ খ্রি:), ডায়াডোরাস (খ্রি:পূ: ৬৯-১৬ খ্রি:) এবং অ্যারিয়ান (খ্রিস্টিয় ২য় শতক)
ইন্ডিকার ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের বিবরণ লিখেছিলেন। মেগাস্থিনিস পুরুর সঙ্গেও সাক্ষাত করেছিলেন।
মহেঞ্জোদারো ও
হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ
থেকে ভারতীয়
সভ্যতার প্রাচীনতম
নিদর্শন পাওয়া
যায়। এ শহর দুটির
ধ্বংসাবশেষ
আবিষ্কারের ফলে
ভারতীয় সভ্যতার
সময়কাল সহস্রাধিক
বছর পিছিয়ে গেছে।
বিভিন্ন সময়ে
বিদেশীরা ভারতবর্ষ
সম্পর্কে বিবরণ
লিখেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে কেউ
এ দেশে এসে
তাঁদের প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতার
আলোকে এবং কেউ
এদেশে না এসেও
লোকমুখে শুনে
ভারতবর্ষ সম্পর্কে
তাঁদের বিবরণ
লিখেছিলেন।
বিদেশীদের মধ্যে
ভারতবর্ষ সম্পর্কে
সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য বিবরণ
লিখেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের দরবারে
আগত গ্রিক রাষ্ট্রদূত
মেগাস্থিনিস।

গ্রিক ভ‚গোলবিদ স্ট্র্যাবো (জন্ম আনুমানিক ৬৩ খ্রি:পূ:) লিখেছিলেন ভ‚গোল। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা
জানার জন্য তাঁর গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান। গ্রিক ঐতিহাসিক অ্যারিয়ান (আনুমানিক ৯৬-১৮০ খ্রি:)
আলেকজান্ডারের জীবনী রচনা করেছিলেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে অ্যারিস্টোবোলাসের রচনা
থেকে তিনি তাঁর উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকার ভিত্তিতে তিনি ভারতের বর্ণনা
দিয়েছেন। অ্যারিয়ান পুরুর সঙ্গে আলোকজান্ডারের সাক্ষাতের এবং তাঁদের আলোচনার বিবরণ দিয়েছেন।
ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস যাঁরা বর্ণনা করেছেন তাঁদের বিবরণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থের অজ্ঞাতনামা
লেখক। লেখকের নাম উল্লেখিত না হলেও গ্রন্থের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে তিনি ছিলেন
জাতিতে গ্রিক। তিনি মিশরে বাস করতেন এবং নিজেও সক্রিয়ভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ
ব্যবসা উপলক্ষেই ৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি সমুদ্রপথে লোহিত সাগর দিয়ে ভারতে এসেছিলেন। ফলে
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতীয় বাণিজ্যের প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর বিবরণ অত্যন্ত
মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য একটি উৎস।তাঁর গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর শেষার্ধে। তাঁর
বিবরণ থেকে ভারতীয় বন্দর, পোতাশ্রয় এবং বাণিজ্য সামগ্রী সম্পর্কে জানা যায়।
রোমান ঐতিহাসিক প্লিনির (২৩-৭৯ খ্রি:) রচিত গ্রন্থের নাম ‘প্রকৃতির ইতিহাস'। ভারতের জীবজন্তু,
গাছপালা এবং খনিজ সম্পদ সম্পর্কে বিবরণ রয়েছে এ গ্রন্থে। গ্রিক লেখক এবং ব্যবসায়ীদের প্রতিবেদনের
ওপর ভিত্তি করে প্লিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্লুটার্ক (আনুমানিক ৪৬-১২০ খ্রি:) জন্মগ্রহণ করেন
গ্রিসে। তিনি গ্রিস ও রোমের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী রচনা করেছিলেন। আলেকজান্ডারের জীবনী
আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয়
শতকে টলেমী ভারতের ভৌগোলিক বিবরণ লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে অঙ্কশাস্ত্রবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ,
জ্যোতির্বিদ ও ভ‚গোলবিদ। পরোক্ষ উৎস থেকে নেওয়া বিধায় তাঁর তারিখগুলো সব ক্ষেত্রে নির্ভুল নয়।
গ্রিক ও রোমান লেখকদের পর ভারত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণে।
তাঁদের মধ্যে তিনজন সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এরা হচ্ছেন ফা-হিয়েন (৩৯৯-৪১৪ খ্রি:), হিউয়েন সাং
(৬৩০-৬৪৫ খ্রি:) এবং ইৎ-সিং (৬৭১-৬৯৫ খ্রি:)। এরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করেছিলেন
এবং ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন। তাঁরা ভারতের বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সবাই
ছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধর্মীয়। তাঁদের ভারতে আগমন ও ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ
পূণ্যস্থানগুলো দর্শন এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত পুস্তক সংগ্রহ করা। ফা-হিয়েন এবং ইৎ-সিং প্রসঙ্গক্রমে মাঝে
মাঝে পার্থিব বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। যে সকল রাজ্য তাঁরা ভ্রমণ করেছিলেন সেগুলোর রাজাদের নাম
পর্যন্ত তাঁরা উল্লেখ করেন নি। হিউয়েন সাং অবশ্য এতটা সীমাবদ্ধ নন এবং তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক সম্রাট
হর্ষবর্ধন এবং অন্যান্য ভারতীয় নৃপতিদের সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। যেসব রাজ্যে হিউয়েন সাং
গিয়েছিলেন সেগুলোর রাজনৈতিক অবস্থাও তিনি বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বিবরণও ফা-হিয়েন এবং ইৎসিং এর বিবরণের মত ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থার বিশদ বিবরণে ভরপুর। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মানুষ্ঠান,
আচারাদি, পূন্যস্থান, মন্দির, স্মৃতিস্তম্ভ, বিভিন্ন সম্প্রদায়, মতবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলোর পু´খানুপু´খ ও
বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ায় এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা ধর্মীয় হওয়ায়
তাঁদের বিবরণ রাজনৈতিক ইতিহাস পুনরুদ্ধারে বিশেষ কোন কাজে আসে না। তাঁরা সব কিছুই বৌদ্ধ
ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ফলে তাঁদের বিবরণ সতর্কতার সাথে দেখা প্রয়োজন। প্রধানত শুধুমাত্র বৌদ্ধ
মঠ, মন্দির পরিদর্শন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে মেলামেশা করার কারণে তাঁদের বিবরণে অনেক ভুল উক্তি
রয়েছে। যেমন ফা-হিয়েন বলেছেন যে, ভারতীয়রা মাছ-মাংস খায় না, তারা নিরামিষাশী এবং কড়ি হচ্ছে
তাদের একমাত্র বিনিময় মাধ্যম। দুটি তথ্যই ভুল, কেননা গুপ্তযুগে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল এবং মানুষ
মাছ-মাংসও খেত। সে আমলের বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণমুদ্রা আমাদের হাতে এসেছে। সে আমলে ভারতীয়রা
যে মাছ-মাংস খেত সে রকম বর্ণনাও সমসাময়িক বহু গ্রন্থে রয়েছে। সীমিত এলাকায় বিচরণ এবং বৌদ্ধ
ভিক্ষুদের সঙ্গে থাকার ফলেই তাঁর মনে এ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিরামিষাশী
গ্রিক ও রোমান
লেখকদের পর
ভারত সম্পর্কে
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পাওয়া যায় চৈনিক
পরিব্রাজকদের
বিবরণে।

এবং তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন অতি সামান্য হওয়ায় কড়ি দিয়েই তারা প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনতে
পারতেন।
খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দী থেকে আরব লেখকদের দৃষ্টি ভারতের দিকে আকৃষ্ট হয়। বহুকাল আগে থেকেই
ভারতের সঙ্গে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আরব নাবিক ও বণিকদের বিবরণ ছাড়াও খ্রিস্টিয় অষ্টম
শতকের প্রথম দিকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবদের রচিত ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জিতেও ভারত
গুরুত্বপূর্ণস্থান লাভ করে। যে সকল আরব লেখক ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবরণ লিখেছেন তাঁদের মধ্যে সুলেমান
(মৃত্যু ৮৫১ খ্রি:), ইবনে খুর্দাদবে (মৃত্যু ৯১২ খ্রি:), আল-মাসুদী (মৃত্যু ৯৫৬ খ্রি:), ইদ্রিসী (একাদশ
শতকের শেষ ভাগে জন্ম) উল্লেখযোগ্য। সুলেমান পাল বংশের রাজা দেবপালের রাজত্বকালে ভারতে
এসেছিলেন। ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মাসুদী প্রতীহার রাজ্যে এসেছিলেন।
আরবি ভাষায় ভারত সম্পর্কে গ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন আল-বেরুনী। তাঁর আসল
নাম হচ্ছে আবু রায়হান মুহাম্মদ বিন আহমদ। এক ইরানি পরিবারে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়েছিল।
আল-বেরুনী তাঁর ‘তাহকিক-ই-হিন্দ' রচনা শেষ করেন ১০৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে, সুলতান
মাহমুদের মুত্যুর পাঁচ মাসের মধ্যে। তাঁর এ গ্রন্থ ‘কিতাবুল-হিন্দ' রূপেও পরিচিত। সুলতান মাহমুদের সঙ্গে
ভারতবর্ষে এসে তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখেন এবং ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন।
বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর বই পড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা জন্মেছিল সেটাই তিনি লিপিবদ্ধ
করেছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে। আল-বেরুনী ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত ছিলেন এবং তাঁর কোন জাত্যাভিমানও
ছিলনা। তিনি মুসলমান, ইসলামের শ্রেষ্ঠতার কথাও তিনি বলেছেন, কিন্তু হিন্দুদের প্রতি তাঁর ঘৃণা ছিল না।
তাদের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, মূর্খতা, আত্মম্ভরিতা, সঙ্কীর্ণতা ইত্যাদির তিনি নিন্দা করেছেন। কিন্তু যেখানে
তাদের কৃতিত্ব ও মহৎ চিন্তার পরিচয় পেয়েছেন সেখানে সংক্ষেপে হলেও তাদের প্রশংসা করেছেন।
প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার জন্য আল-বেরুনীর গ্রন্থটি একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ। তবে
গ্রন্থের ত্রুটিও রয়েছে। প্রথমত, তিনি ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু বলেননি। ফলে
রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনে এ গ্রন্থ আমাদের কোন সাহায্য করে না। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর বই
লিখেছিলেন ভারতীয় ভাষায় লেখা বিভিন্ন বিষয়ে বহু বই পড়ে। তাঁর গ্রন্থে ভারতের গণিত, পদার্থবিদ্যা,
রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভ‚গোল, দর্শন, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত
বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু এসব বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি বই পড়ে, নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নয়।
অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে তিনি ভারতকে দেখেছিলেন বই এর মাধ্যমে, নিজের চোখে নয়। স্মিথ মনে
করেন যে প্রায় পাঁচশত বছর পরে আবুল ফজল কোন স্বীকারোক্তি ছাড়াই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আইন-ইআকবরীর আদর্শ হিসাবে তাহকিক-ই-হিন্দকে গ্রহণ করেছিলেন।
প্রাচীন ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতি, রীতিনীতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে
বিদেশীদের বিবরণে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এসব বিবরণ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত
প্রয়োজন, কারণ তাঁদের বর্ণনায় তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে। তাছাড়া অতিশয়োক্তি, প্রকৃত
অবস্থা জানার অসুবিধা, লোকমুখে শুনে বিবরণ লেখা, সীমিত পরিসরে এবং সমাজের বিশেষ শ্রেণীর সঙ্গে
বসবাস, স্থানীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব প্রভৃতি কারণে তাঁদের বর্ণনায় যথেষ্ট ভুল থাকার সম্ভাবনা থাকে। তবুও
অন্যান্য উৎস দ্বারা এসব বিবরণ যাচাই করে এগুলো থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রাচীন
ভারতের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।
তাঁরা সব কিছুই
বৌদ্ধ ধর্মের
দৃষ্টিকোণ থেকে
দেখার ফলে তাঁদের
বিবরণ সতর্কতার
সাথে দেখা
প্রয়োজন।

সারসংক্ষেপ
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠন সহজসাধ্য নয়। এর প্রধান কারণ, প্রাচীন ভারতে ইতিহাস সম্পর্কে
লিখিত কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের অন্যান্য উৎসের সন্ধান করতে হয়। প্রাপ্ত
উৎসসমূহকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়Ñ সাহিত্যিক উৎস, প্রতœতাত্তি¡ক উৎস ও বিদেশীদের
বিবরণ। সাহিত্যিক উৎসের মধ্যে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ছাড়াও পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী,
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাণভট্টের হর্ষচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, কলহণের রাজতরঙ্গিনী ইত্যাদি
গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে আধুনিক বিচারে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস বলা যায় শেষোক্ত গ্রন্থটিকে।
প্রতœতাত্তি¡ক উৎসের মধ্যে রয়েছে লেখ বা লিপি, মুদ্রা, সৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভ। গ্রিক, রোমান লেখক,
চৈনিক পরিব্রাজক, আরব নাবিক, বণিক ও লেখকদের বিবরণও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের
গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই বিবরণগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়Ñ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত
এবং জনশ্রুতি অথবা অন্যান্য উৎসের ভিত্তিতে লিখিত। সর্বশেষে বলা যায়, উপর্যুক্ত তিন ধরনের উৎস
ত্রুটিমুক্ত নয়। তবে এসব উৎসে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রাচীন ভারতের সভ্যতা,
সংস্কৃতি, রীতিনীতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ধর্মীয় অবস্থার নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা
সম্ভব।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১. অর্থশাস্ত্র কে লিখেছেন ?
(ক) সন্ধ্যাকর নন্দী (খ) কল্হণ
(গ) কৌটিল্য (ঘ) হরিষেণ
২. ইন্ডিকার লেখক কে ?
(ক) মেগাস্থিনিস (খ) বাণভট্ট
(গ) ফা-হিয়েন (ঘ) স্ট্র্যাবো
৩. কল্হণ লিখেছেন-
(ক) রামচরিত (খ) হর্ষচরিত
(গ) রাজতরঙ্গিনী (ঘ) বেদ
৪. ফা-হিয়েন ছিলেন-
(ক) সম্রাট (খ) সেনাপতি
(গ) পরিব্রাজক (ঘ) মন্ত্রী
৫. ভারতে প্রতœতত্ত¡ বিভাগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল-
(ক) বেন্টিঙ্ক (খ) ডালহৌসী
(গ) কার্জন (ঘ) মিন্টো-এর আমলে।
৬. অশোকের লিপির প্রথম পাঠোদ্ধার করেছিলেন-
(ক) স্যার জন মার্শাল (খ) রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়
(গ) জেমস প্রিন্সেপ (ঘ) আহমদ হাসান দানী

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। প্রাচীনকালে ভারতীয় পন্ডিতগণ কেন ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেননি?
২। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে মুদ্রা কতটুকু সহায়ক?
৩। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনকালে চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণকেন সতর্কতার সাথে অবলম্বন
করা প্রয়োজন?
৪। ‘কিতাবুল-হিন্দ' সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের সাহিত্যিক উৎসগুলো আলোচনা করুন।
২. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের প্রতœতাত্তি¡ক উৎসগুলোর মূল্যায়ন করুন।
৩. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বিদেশীদের বিবরণ কতটুকু সহায়ক?
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঞযব ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঈঁষঃঁৎব ড়ভ ঃযব ওহফরধহ চবড়ঢ়ষব, ঠড়ষ-১,ঠবফরপ অমব.
৬। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]