সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে হর্ষবর্ধনের মূল্যায়ন করুন।


পুষ্যভ‚তি বংশের পরিচয় ও উত্থান
প্রাচীন ভারতের শেষ সাম্রাজ্যবাদী রাজবংশ পূর্বপাঞ্জাবের পুষ্যভ‚তি রাজবংশ। শশাঙ্কের ওপর
আলোচনাকালে পুষ্যভ‚তিদের সম্পর্কে কিছু ধারণা ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে। পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত
থানেশ্বর অঞ্চলে সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুষ্যভ‚তি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশের প্রথম
গুরুত্বপুর্ণ শাসক ছিলেন প্রভাকরবর্ধন। পুষ্যভ‚তি রাজাদের নামের শেষে ‘বর্ধন' শব্দটি যুক্ত করে একটি
বৈশিষ্ট্য স্থাপন করা হয়েছে। প্রভাকরবর্ধন ছিলেন খুবই প্রতাপশালী রাজা। হ‚ন আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি
পাঞ্জাব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে যে ঐক্যহীন বিশৃ´খল
পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তার অবসানে পুষ্যভ‚তি বংশের উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রয়েছে। প্রভাকরবর্ধনের নেতৃত্বে
পুষ্যভ‚তিরা ভারতে চতুর্থবারের মতো এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। প্রাচীনকালে ভারতে
রাজবংশগুলোর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের রীতি ছিল।এ ধরনের বিবাহের ছিল রাজনৈতিক ও
সামরিক গুরুত্ব। আপনারা ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছেন যে, সমকালীন যুগধর্ম অনুসারে প্রভাকরবর্ধনও
কনৌজের মৌখরী বংশের সাথে বৈবাহিক সূত্রে মিত্রতা স্থাপন করেন। প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর সঙ্গে
কনৌজের মৌখরী রাজপুত্র গ্রহবর্মণের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এভাবে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে মৌখরীপুষ্যভ‚তি মৈত্রী জোট গড়ে ওঠে। এই মৈত্রী জোটের বিরুদ্ধে মালবের দেবগুপ্ত এবং গৌড়রাজ শশাঙ্ক পাল্টা
মিত্রতা গঠন করেন। প্রভাকরবর্ধন যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন এই দুই পক্ষ পরস্পরকে আক্রমণ
করেনি। কিন্তু আকস্মিকভাবে প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন সিংহাসনে বসেন।
এদিকে মালব-গৌড় শক্তি জোট থানেশ্বরে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। তাদের হাতে
গ্রহবর্মণ নিহত হন এবং বন্দি হন রাজকন্যা রাজ্যশ্রী। রাজ্যবর্ধন বোনকে উদ্ধারের জন্য সসৈন্যে দেবগুপ্তের
বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তকে হত্যা করেন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে গৌড়রাজ শশাঙ্কের হাতে
রাজ্যবর্ধন নিহত হন বলে সমসাময়িক উৎসে উল্লেখ পাওয়া যায়। শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে ন্যায্য যুদ্ধে নাকি
চক্রান্ত করে নিহত করেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। এভাবে প্রাচীন ভারতের শেষ
সাম্রাজ্যবাদী রাজবংশের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রাজপুরুষ হর্ষবর্ধন (রাজ্যবর্ধনের ছোট ভাই) থানেশ্বরের সিংহাসনে
আরোহণ করেন এবং ভারতবর্ষকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ শাসনাধীনে আনার প্রয়াস চালান। হর্ষবর্ধন সম্ভবত
৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৬১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে থানেশ্বর ও কনৌজ রাজ্যকে সংযুক্ত
করার মাধ্যমে গাঙ্গেয় উপত্যকায় তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। কনৌজ তাঁর সাম্রাজ্যের
কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
হর্ষবর্ধন সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদান
প্রাচীন ভারতের সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক ইতিহাসে হর্ষবর্ধনই শেষ উল্লেখযোগ্য সম্রাট। তাঁর রাজত্বকালকে
অধিকাংশ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।তাঁর সম্পর্কে জানার বেশ কিছু উপাদান রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত' একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও এই
গ্রন্থটিতে হর্ষের রাজত্বকালের সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না, তদুপরি ঐতিহাসিক উপাদান
হিসেবে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং-এর
রচনা ‘সি-ইউ-কাই' এবং তাঁর জীবনী গ্রন্থ। হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধন সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন।
অবশ্য এই বিবরণে কিছুটা পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কেননা ভারত ভ্রমণকালে তিনি হর্ষের আনুক‚ল্য
লাভ করেছিলেন। তদুপরি এটিও হর্ষবর্ধনের ইতিহাস জানার একটি অমূল্য উৎস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
হর্ষের রাজত্বকালে খোদিত কয়েকটি লিপিও উপাদান হিসেবে যথেষ্ট মূল্যবান। এগুলোর মধ্যে (১)
বাঁশখেরা তাম্রপট্ট; (২) নালন্দা শীখ; (৩) সোনাপৎ তাম্রপট্ট; (৪) মধুবনী তাম্রপট্ট; ও (৫) চালুক্যরাজ
দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল শিলালিপি হর্ষবর্ধন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধারণ করে আছে। হর্ষবর্ধন
এবং সমকালীন ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এগুলোর ‘বিশ্বস্ততা' ও ‘গুরুত্ব' সবচাইতে বেশি। এছাড়াও
প্রাপ্ত কিছু মুদ্রা থেকেও হর্ষের রাজত্বকাল সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়।
হর্ষবর্ধনের কনৌজ অধিকার
সিংহাসনে আরোহণ করেই হর্ষবর্ধন কনৌজ অধিকার করার জন্য অগ্রসর হন। কথিত আছে যে, কনৌজের
শূন্য সিংহাসন গ্রহণ করার জন্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কনৌজ দখল করেই তিনি ‘হর্ষ
সম্বৎ'(৬০৬খ্রি:) প্রচলন করেন। যাহোক, ঐতিহাসিকদের মতে, বিনা বাধায় কনৌজ দখল সম্ভবত
গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা কনৌজ ছিল মৌখরীদের রাজধানী। মৌখরীরাজ গ্রহবর্মণের ছোট ভাই শূরসেন
সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। একটি উৎস থেকে অনুমিত হয় শূরসেন সম্ভবত শশাঙ্কের পক্ষে ছিলেন।
হর্ষবর্ধন কামরূপের ভাস্কর বর্মণের সাথে মৈত্রী জোট গড়ে তুললে কনৌজের শক্তিসাম্য কিছুটা দুর্বল হয়ে
পড়ে। কনৌজের সম্মুখ ও পশ্চাৎ উভয় দিক থেকে আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় এ সময় গৌড়রাজ শশাঙ্ক
শূরসেনকে ‘তাবেদার রাজা' হিসেবে স্থাপন করে কনৌজ ত্যাগ করেন। এরপর হর্ষবর্ধন সম্ভবত কণৌজ
দখল করে নেন। হিউয়েন সাং সূত্রে জানা যায়, রাজ্যশ্রী কনৌজের সিংহাসনে বসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলে
কনৌজের মন্ত্রীগণ হর্ষকে রাজ্যটি গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। প্রথমে অনিচ্ছা থাকলেও বোধিসত্তের এ
অনুরোধ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে কেবল রাজপ্রতিনিধিরূপে রাজ্যপরিচালনা করেন এবং কিছুকাল পর
পরিস্থিতি অনুক‚লে বুঝে রাজসদৃশ উপাধি গ্রহণ এবং থানেশ্বর ও কনৌজ যুগ্ম রাজ্যের রাজধানী কনৌজে
স্থাপন করেন। তবে হিউয়েন সাং-এর বর্ণনা সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। যাহোক, হর্ষবর্ধন যেকোন প্রকারেই
কনৌজের সিংহাসনে আরোহণ করুক না কেন তা উত্তর ভারতের রাজনৈতিক শক্তি পুন:স্থাপনে সাহায্য
করেছিল।
হর্ষবর্ধনের সামরিক অভিযান
হর্ষবর্ধন ‘পৃথিবীব্যাপী' বিজয় অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তাঁর স্বপক্ষীয় উৎসে উল্লেখ আছে।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর পূর্বদিকে হর্ষবর্ধনের সামরিক সাফল্য সম্পর্কে জানা যায়। চৈনিক সূত্রে বলা হয়েছে, হর্ষ
পূর্বদিকে অভিযানে রওনা হয়ে যে-সকল রাজ্য তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে সম্মত হয়নি তাদের বিরুদ্ধে ছয়
বৎসর অবিরাম যুদ্ধ করে ‘পঞ্চভারত' নিজ আনুগত্যাধীনে আনেন। তিনি তাঁর ভাই রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারীর
ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে ভারতবর্ষের ওপর প্রভুত্বের আসনে স্থাপন করেন বলেও জানা যায়।

লাট, মালব, গুজরাট, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলের সাথে পুষ্যভ‚তিদের বংশ পরম্পরায় দ্বন্দ¡ বিরাজমান ছিল। হর্ষের
আমলে গুজরাটের বলভী নামক রাজ্যের সাথে যুদ্ধে বলভীর পরাজয় ঘটে, যদিও বলভী বংশ পরে স্বাধীনতা
পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, বলভী বংশ হর্ষের অনুগত সামন্ত রাজ্য ছিল।
হর্ষবর্ধনের সাথে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সংঘর্ষ সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। হর্ষ যখন উত্তর ভারতে
তাঁর একচ্ছত্র অধিকার স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন, সে সময় দক্ষিণে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীও তুঙ্গভদ্রা নদীর
উত্তর তীরে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে আপন অধিকার স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন। লাট, মালব, গুর্জর প্রভৃতি রাজ্য
পুলকেশীর সামন্ত রাজ্য ছিল বলে জানা যায়। এ কারণে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের কালে
রাজ্যগুলো পুলকেশীর সাহায্যে এগিয়ে আসে। যাহোক, পুলকেশীর লিপি বিশ্লেষণ থেকে অনুমিত হয়
হর্ষবর্ধন সম্ভবত পরাজিত হয়েছিলেন। তবে পুলকেশীর সাথে যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন, হর্ষবর্ধন
যে দাক্ষিণাত্যে অগ্রসর হয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সিন্ধু রাজ্যের বিরুদ্ধেও পুষ্যভ‚তিদের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বাণভট্ট উল্লেখ করেছেন যে, হর্ষ ‘সিন্ধুর
রাজাকে চূর্ণ করিয়া তাহার সম্পত্তি অধিকার করিয়া লইয়াছেন'। তবে অন্যান্য উৎস বিশ্লেষণ থেকে অনুমিত
হয়, সিন্ধুদেশে হর্ষ সাময়িক সাফল্য হয়তো পেয়েছিলেন, কিন্তু অচিরেই সিন্ধুদেশ তাদের স্বাধীনতা
পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। হিউয়েন সাং বলেন, হর্ষ কাশ্মিরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানেও সাফল্য অর্জন
করেন। কাশ্মিরের রাজা হর্ষের আনুগত্য স্বীকারে এবং তাঁকে বুদ্ধের দেহাবশেষ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে
জানা যায়।
হর্ষের সাম্রাজ্যসীমা
বেশ কিছু উৎসে হর্ষবর্ধনকে ‘সকলোত্তরপথনাথ” বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো ‘সমগ্র উত্তর
ভারতের অধিপতি'। কিন্তু বাস্তবে হর্ষ সমগ্র উত্তরাপথের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন বলে জানা যায় না।
এমনকি পন্ডিতগণের মধ্যে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বা প্রকৃত সীমা নির্ধারণ প্রসঙ্গেও বিতর্ক বিদ্যমান
রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য থানেশ্বর, কনৌজ, অহিচ্ছত্র, শ্রাবস্তী, প্রয়াগ
প্রভৃতি নিয়ে গঠিত ছিল। হিউয়েন সাং-এর বিবরণে মগধ ও উড়িষ্যা তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে
উল্লিখিত আছে। আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে, হর্ষবর্ধনের সৈন্য সমগ্র উত্তর
ভারত পদানত করেছিল। উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত এবং পূর্বে গঞ্জাম হতে পশ্চিমে
বলভী পর্যন্ত সমগ্র ভ‚-ভাগ হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। ড. কে.এম. পানিক্কর তাঁর ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়ান
হিস্ট্রি' গ্রন্থে বলেন যে, ‘বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরের সকল দেশ, নেপাল ও কাশ্মির হর্ষের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল'।
তবে প্রাপ্ত উৎস এবং সেই উৎসের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকগণ যে সকল মন্তব্য করেছেন তা থেকে হর্ষের
রাজ্যের প্রকৃত সীমা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া মন্তব্যগুলোর মধ্যে যথেষ্ট অসঙ্গতিও
রয়েছে।
হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব
হর্ষবর্ধন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন।তাঁর শাসননীতি ছিল স্বৈরাচারের আশ্রয় না নিয়ে, নিজ
ক্ষমতায় শাসনকার্য পরিচালনা করা।এইরূপ ব্যবস্থায় সম্রাটের ব্যক্তিগত প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব এবং জনকল্যাণের
আদর্শ ছিল প্রকৃত ভিত্তি।শাসনকার্যে তিনি ব্যক্তিগত প্রাধান্যের পাশাপাশি সাম্রাজ্যব্যাপী পরিদর্শনের ওপরও
গুরুত্ব আরোপ করেন। ‘হর্ষবর্ধন ছিলেন অক্লান্ত, এবং তাঁর দিনগুলো কাজের তুলনায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল'Ñ
এই মন্তব্য প্রকাশ করে হিউয়েন সাং হর্ষের কর্মকুশলতায় বিস্ময় প্রকাশ করেন।যাহোক, হর্ষবর্ধনের
শাসনব্যবস্থা ছিল দৃশ্যত স্বৈরতন্ত্রী, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, একেবারে গ্রামীণ
প্রশাসন পর্যন্ত যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসনের প্রাধান্য।বলা যেতে পারে, হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থা ছিল স্বৈরাচার

(ধঁঃড়পৎধপু) ও স্বায়ত্বশাসনের (ধঁঃড়সড়হু) এক অভ‚তপূর্ব সমন¦য়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে
ভুক্তি (বিভাগ), বিষয় (জেলা), বীথি (উপজেলা বা থানা) এবং গ্রামে ভাগ করা হয়েছিল। তাছাড়া মূল
প্রশাসন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিকÑ এই দুই ভাগে ছিল বিভক্ত। কেন্দ্রীয় সরকার তথা সমগ্র সাম্রাজ্যের
প্রশাসনের সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন স্বয়ং। তাঁকে পরামর্শ দেবার জন্য সম্ভবত একটি মন্ত্রী পরিষদ
ছিল। মন্ত্রীগণ বৈদেশিক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণেও ভ‚মিকা
রাখতেন। যেমন শশাঙ্কের সাথে আলোচনার জন্য তাঁর শিবিরে যাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রীপরিষদ রাজ্যবর্ধনকে
পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত
মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক (যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ক মন্ত্রী), মহাবলাধিকৃত (সেনাধ্যক্ষ),
অক্ষপটালিক (দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষক), ভোগপতি (রাজস্ব সংগ্রাহক) ইত্যাদি। হর্ষবর্ধনের বিশাল
সেনাবাহিনী ছিল। তাঁর বাহিনীতে ৫০ হাজার পদাতিক, ৫ হাজার যুদ্ধহস্তি ও ২ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য
ছিল বলে জানা যায়। সুসংগঠিত সেনা সংগঠনও তিনি গড়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
হর্ষের সময় রাজস্বের হার ছিল খুবই কম। কৃষকেরা তাদের উৎপাদনের এক ষষ্টাংশ রাজস্ব হিসেবে প্রদান
করতেন। ভ‚মি রাজস্ব ছাড়াও বাণিজ্য ও খনিশুল্ক ছিল সরকারি আয়ের উৎস। আদায়কৃত রাজস্ব তিনি
রাজ্যশাসন ও ধর্মীয় উপাসনা; রাজকর্মচারীদের বেতন ও ভরণ-পোষণ; শিক্ষিতদের মধ্যে বৃত্তি; বিভিন্ন
ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দান; রাস্তাঘাট তৈরি, খাল খনন, বিধবাদের বৃত্তি ইত্যাদি কাজে ব্যয় করতেন।
হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যে দন্ডবিধি কঠোর ছিল। যাবজ্জীবন কারাদন্ড, নির্বাসন এবং অঙ্গচ্ছেদ ছিল সাধারণ
শাস্তি। লঘু অপরাধের জন্য সাধারণত অর্থদন্ড হতো। অনেক সময় অপরাধ নির্ণয়ের জন্য অগ্নি, জল,
তুলাদন্ড প্রভৃতি দৈব পরীক্ষার প্রথা প্রচলিত ছিল। দন্ডবিধির কঠোরতা সত্তেও গুপ্তযুগের তুলনায় এ সময়
অপরাধ বেশি হতো। অথচ হিউয়েন সাং ভারতীয়দের চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘ভারতীয়রা
অন্যায়ভাবে কিছু গ্রহণ করে না। ..... তারা অপরের পাপের শাস্তি দেখে ভীত হয় এবং তাদের কাজকর্ম
ইহলোকে কতখানি ফল দেয় সেদিকে দৃষ্টি দেয় না। তারা প্রবঞ্চনা করে না এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে।'
হর্ষের শাসনব্যবস্থাকে একটি উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্র বলা যেতে পারে। এই শাসনব্যবস্থার সাফল্য হর্ষের
ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার ওপরই বেশিরভাগ নির্ভরশীল ছিল। অবশ্য এই ব্যবস্থা গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক
দক্ষতার সমতুল্য না হলেও অথবা মৌর্য সাম্রাজ্যের বহুমুখী কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে না
পারলেও জনসাধারণের নৈতিকতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিচারে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল।
হর্ষবর্ধন শিক্ষা ও সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও স্বীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। নালন্দা বিহার বা
বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখনকার অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র। সমকালের বিখ্যাত পন্ডিতবর্গ এখানে আলোচনা,
বিতর্ক, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতিতে নিযুক্ত থাকতেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষ শিক্ষা, সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের
পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান কবি ও নাট্যকার ছিলেন।তাঁর রচিত তিনখানি
নাটক বিদ্বজ্জন সমাজে সমাদৃত হয়েছে।এগুলো হচ্ছে নাগানন্দ, রতœাবলী ও প্রিয়দর্শিকা। হর্ষচরিত রচয়িতা
বাণভট্ট ছিলেন তাঁর সভাকবি। ময়ূরও কিছুকাল তাঁর সভাকবি ছিলেন।
যাহোক, সামগ্রিকভাবে হর্ষবর্ধনের কৃতিত্বের কথা বলতে গেলে তাঁর ধর্ম সহিষ্ণু নীতি, প্রজাহিতৈষণা, শিক্ষাসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, সুবিন্যস্ত শাসন কাঠামো এবং সর্বোপরি থানেশ্বরের ক্ষুদ্র রাজ্যকে উত্তর ভারতীয়
চরিত্র দানের বিষয় উল্লেখ করতে হবে। ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার এবং শশাঙ্কের বিরুদ্ধে সাফল্য তাঁর সময়ের
এক কৃতিত্বপূর্ণ অধ্যায়। তদুপরি খাদ্য, সামাজিক অবস্থা, বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও হর্ষবর্ধনের আমলে
স্থিতি বিদ্যমান ছিল।সাম্রাজ্য স্থাপয়িতা হিসেবেও হর্ষের কৃতিত্ব সুবিখ্যাত। চালুক্য লিপিতে তাঁকে
‘সকলোত্তরপথনাথ' বা সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি বলা হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক হর্ষবর্ধনকে ‘প্রাচীন
ভারতের শেষ গুরুত্বপূর্ণ শাসক' হিসেবে উল্লেখ করেন। ঐতিহাসিক আর.কে. মুখার্জী বলেন, ‘হর্ষের চরিত্রে
সমুদ্রগুপ্তের সমরকুশলতা ও অশোকের প্রজাহিতৈষণার সমন¦য় ঘটেছিল'।

সারসংক্ষেপ
প্রাচীন ভারতের শেষ সাম্রাজ্যবাদী রাজবংশের গুরুত্বপুর্ণ শাসক হচ্ছেন হর্ষবর্ধন। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি
সিংহাসনে আরোহণ এবং ৬১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে থানেশ্বর ও কনৌজ রাজ্যকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে
গাঙ্গেয় উপত্যকায় এক বিরাট সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। হর্ষবর্ধনের ইতিহাস সম্পর্কে জানার বেশকিছু
উৎস রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে তাঁর কনৌজ অধিকার বা কনৌজের রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা,
অন্যান্য সামরিক অভিযান ও অপরাপর কৃতিত্ব বিষয়ে জানা যায়। বেশ কিছু উৎসে হর্ষবর্ধনকে
‘সকলোত্তরপথনাথ' বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরের সকল দেশ, নেপাল ও কাশ্মির
তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী একজন শাসক। স্বৈরাচার ও স্বায়ত্বশাসনের
সমন¦য়ে তাঁর শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আদায়কৃত রাজস্বে হর্ষবর্ধন অনেক জনহিতকর কর্মকান্ড
করতেন। হর্ষবর্ধন নিজে একজন কবি ও নাট্যকার এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপোষক
ছিলেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। হর্ষবর্ধনের পিতার নামÑ
(ক) গ্রহবর্মণ (খ) প্রভাকরবর্ধন
(গ) রাজ্যবর্ধন (ঘ) রূপবর্ধন।
২। হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যসীমা ছিলÑ
(ক) সমগ্র উত্তর ভারত, নেপাল ও কাশ্মির (খ) সমগ্র ভারত, নেপাল ও কাশ্মির
(গ) সমগ্র দক্ষিণ ভারত, উড়িষ্যা ও বঙ্গ (ঘ) সমগ্র উত্তর ভারত, চালুক্য ও নর্মদা।
৩। ‘সকলোত্তরপথনাথ' অর্থকি?
(ক) উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জনকারী রাজা (খ) উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করেন যিনি
(গ) সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি (ঘ) সমগ্র ভারতের অধিপতি।
৪। হর্ষের শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি কি ছিল?
(ক) স্বৈরতান্ত্রিক (খ) গণতান্ত্রিক
(গ) উদারতান্ত্রিক (ঘ) উদার ও স্বৈরতান্ত্রিক।
৫। কোন্ পর্যটক হর্ষবর্ধনের আতিথ্য গ্রহণকরেন?
(ক) হিউয়েন সাং (খ) ইৎ-সিং
(গ) শেংচি (ঘ) ফা-হিয়েন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। হর্ষবর্ধনের পূর্ববর্তী পুষ্যভ‚তি বংশীয় রাজাদের ওপর একটি টীকা লিখুন।
২। হর্ষবর্ধন সম্পর্কে জানার জন্য সহায়ক ঐতিহাসিক উপাদানগুলো বর্ণনা করুন।
৩। কনৌজ কিভাবে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়Ñ ব্যাখ্যা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে হর্ষবর্ধনের মূল্যায়ন করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]