আরবদের সিন্ধু অভিযানের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করুন।


ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ ছিল। এ যোগাযোগ ছিল
বাণিজ্যিক। আরব বণিকরা ভারতের উপক‚লবর্তী বন্দরসমূহে এসে এদেশের পণ্যদ্রব্য নিজ দেশে এবং
মধ্য-এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপে পাঠাতো। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে আরবদেশে ইসলামের
আবির্ভাব ও প্রচারের পর আরব মুসলমানরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। তারাও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে
ভারতে আসতে থাকে। তাঁরা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং চীন সাম্রাজ্যের সঙ্গেও বাণিজ্য করতো। আরব
বণিকরা প্রধানত: পাকিস্তানের উপক‚লবর্তী মাকরান এবং সিংহল, মাদ্রাজ উপক‚ল ও বঙ্গোপসাগরের
উপক‚লবর্তী বন্দরগুলোতে আসতো।
ভারত আক্রমণকারী মুসলমানদের মধ্যে আরবরাই প্রথম ভারতে এসেছিল। মহানবীর (দ:) মৃত্যুর কুড়ি
বছরের মধ্যেই তারা সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর এবং পারস্য জয় করে। এরপর তারা পূর্বদিকে আরো
অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করতে থাকে। ভারত-প্রত্যাগত ব্যবসায়ীদের কাছে ভারতের বিশাল সম্পদের কথা
শুনে তারা ভারতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। হজরত ওমরের (রাঃ) শাসনামলে ৬৩৬-৬৩৭ সালে মুসলমানরা
প্রথম ভারতে অভিযান করে।কিন্তু এ ধরনের অভিযান অত্যন্ত বিপজ্জনক বিবেচিত হওয়ায় তা পরবর্তীকালে
নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
হযরত ওমরের (রাঃ) উত্তরাধিকারীগণ পরবর্তীকালে আবার ভারতে অভিযান পাঠাতে শুরু করেন। ৬৪৩-
৬৪৪ সালে আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন রাবির নেতৃত্বে মুসলমানরা কিরমান আক্রমণ করে। তিনি সিজিস্তান
পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সেখানকার শাসনকর্তা প্রচুর অর্থ দিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন।
এরপর তিনি মাকরান আক্রমণ করেন। মাকরান ও সিন্ধুর রাজা যৌথভাবে বাধা দিয়েও মুসলমানদের কাছে
পরাজিত হন। মুসলমান সেনাপতি এই বিজয়ের ধারাবাহিকতায় আরো অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু
খলিফার সাবধানী নীতির ফলে তা সম্ভব হয়নি।
উমাইয়া খলিফাদের আমলে মুসলমানদের সাম্রাজ্য আরো পূর্বদিকে বিস্তার লাভ করে। ইরাকের শাসনকর্তা
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনামলে তাঁর উৎসাহে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করেন।
সিন্ধু বিজয়ের কারণ
আরবদের সিন্ধু অভিযানের বহু কারণ ছিল।উমাইয়া শাসনামলে মুসলমানরা রাজ্যজয়ে বিশেষভাবে উৎসাহী
হয়ে ওঠে। উমাইয়া খলিফারা ছিলেন সম্প্রসারণবাদী। কাজেই মুসলমান সাম্রাজ্য বিস্তারের অংশ হিসেবে এ
সময় ভারতে অভিযান পরিচালিত হয়।



এ সময় খলিফা প্রথম ওয়ালিদের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তিনি
ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী এবং পূর্বদিকে মুসলমান সাম্রাজ্যের বিস্তারে প্রচন্ড আগ্রহী। এ সময় মুসলমানরা
বোখারা, সমরকন্দ এবং ফারগানা জয় করে। কাশগড়ের বিরুদ্ধেও অভিযান প্রেরিত হয় এবং সেখানকার
চৈনিক শাসক মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। কাবুলের রাজার বিরুদ্ধেও সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা
হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সিন্ধুতেও মুসলমানরা অভিযান করেছিল।
মুসলমানদের পারস্য অভিযানের সময় কিছু কিছু ভারতীয় রাজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারস্যকে সাহায্য
করেছিল। এর প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যেও আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করেছিল।
হাজ্জাজের কঠোর শাসনে কিছু আরব বিদ্রোহ করে এবং তারা সিন্ধুতে আশ্রয় গ্রহণ করে। হাজ্জাজ তাদের
ফেরৎ চাইলে সিন্ধুর রাজা দাহির তাদের ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। ফলে হাজ্জাজ রাগানি¦ত হয়ে সিন্ধু
আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ভারতের অতুল ঐশ্বর্য অতি প্রাচীনকাল থেকেই তাঁর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আরবদের সিন্ধু
আক্রমণের আগে ও পরে বহু বিদেশী শক্তিই ভারতের ধন-সম্পদের লোভে এদেশ আক্রমণ করেছিল।
আরবরা ছিল তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। কাজেই ভারতের ধন-সম্পদ দিয়ে নিজেদের দারিদ্র্য মোচনও ছিল
আরবদের সিন্ধু অভিযানের অন্যতম কারণ।
সিন্ধু উপক‚লে জলদস্যু কর্তৃক আরবদের জাহাজ লুণ্ঠন ছিল আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ।
সিংহলে বাণিজ্যরত কয়েকজন আরব বণিকের মৃত্যু হলে সিংহলের রাজা মৃত বণিকদের আত্মীয়-স্বজনদের
এবং হাজ্জাজের জন্য প্রচুর উপহার জাহাজযোগে পাঠান। দেশে ফেরার পথে এ জাহাজগুলো ঝড়ের কারণে
সিন্ধুর দেবল বন্দরে আশ্রয় নেয় এবং জলদস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। জলদস্যুরা হাজ্জাজের জন্য প্রেরিত
উপহার সামগ্রী লুট করে এবং মৃত বণিকদের বিধবা স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনদের বন্দি করে। এ খবর পেয়ে
হাজ্জাজ সিন্ধুর রাজা দাহিরের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করলে দাহির ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেন।
হাজ্জাজ এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিন্ধুর বিরুদ্ধে হাজ্জাজের
প্রেরিত প্রথম দুটি অভিযান ব্যর্থ হয় এবং দুজন সেনাপতিই নিহত হন। এতে হাজ্জাজ সিন্ধু অভিযানের জন্য
ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম ৬০০০ অশ্বারোহী ও ৬০০০ উষ্ট্রারোহী নিয়ে সিন্ধু অভিযানে যাত্রা করেন। এই বিশাল
বাহিনীর রসদ বহনের জন্য ৩০০০ উট ছিল। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাসিম সিরাজ ও মাকরানের পথ
ধরে দেবলের দিকে অগ্রসর হন। হিন্দু শাসকের প্রতি বিরূপভাবাপন্ন স্থানীয় বহু জাট ও মেভ কাসিমের
বাহিনীতে যোগদান করেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে কাসিম দেবলে উপস্থিত হন। হাজ্জাজ দুর্গ অবরোধ
করার জন্য বিরাট আকারের ‘মনজানিক' (প্রস্তর-নিক্ষেপক) সমুদ্রপথে প্রেরণ করেন। দেবলেও বহু স্থানীয়
অধিবাসী কাসিমের বাহিনীতে যোগদান করে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর হিন্দুরা পরাজিত হয়। মুসলমান সৈন্যরা
লুট-তরাজ শুরু করে এবং অবরুদ্ধ হিন্দু সৈন্যদের হত্যা করে। দুর্গাধিপতি পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। মুহাম্মদ
বিন কাসিম মুসলমানদের জন্য থাকার জায়গা ঠিক করে দেন। তিনি একটি মসজিদও তৈরি করেন এবং
দুর্গের শাসন পরিচালনার জন্য ১০০০ সৈন্য রেখে যান।
দেবল অধিকারের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম নিরুণ অভিমুখে অগ্রসর হন। নিরুণের অধিবাসীরা মুসলমানদের
কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং অর্থের বিনিময়ে নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা করে। এরপর কাসিম সেহওয়ান জয়
করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম এরপর নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করে সিন্ধু নদ পার হয়ে রাওয়ারে দাহিরের
বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন। উভয় পক্ষই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে, কিন্তু আরব সেনাপতির দক্ষতা ও
আরব ধনুর্বিদদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে দাহিরের সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়। দাহির যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন।
দাহিরের মৃত্যুর পর তাঁর সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় দাহিরের স্ত্রী রানীবাঈ রাওয়ারের দুর্গে
আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের প্রতিরোধ
করতে ব্যর্থ হয় এবং রাণী ও দুর্গের অন্যান্য মহিলা জওহর ব্রত পালন করেন। রাওয়ার দুর্গ মুসলমানদের
দখলে আসে। এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রায় বিনা যুদ্ধেই ব্রাহ্মণাবাদ অধিকার করেন। মুহাম্মদ বিন


কাসিম এর পর থেকে একে দাহিরের রাজধানী আড়র এবং মুলতান দখল করেন। এরপর মুহাম্মদ বিন
কাসিম তাঁর এক সেনাপতিকে কনৌজে প্রেরণ করেন। কিন্তু এই অভিযান শুরু হওয়ার আগেই তিনি তাঁর
নিজের প্রত্যাবর্তনের আদেশ লাভ করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু সম্পর্কে বিতর্কিত তথ্যাদি পাওয়া যায়। একটি উৎসানুসারে দাহিরের মৃত্যুর পর
তাঁর দুই কন্যাকে খলিফার কাছে পাঠানো হয়। তাঁরা খলিফার কাছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে তাঁদের
শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে খলিফা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কাঁচা চামড়ার থলিতে ঢুকিয়ে তাঁর কাছে
পাঠাবার নির্দেশ দেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজেই কাঁচা চামড়ার থলিতে ঢুকেন এবং দুএকদিনের মধ্যেই
মারা যান। চামড়ার থলি খলিফার কাছে পৌঁছালে দাহিরের কন্যারা তাঁদের মিথ্যা অভিযোগের কথা স্বীকার
করে। ক্রুদ্ধ খলিফা দাহিরের দুই মেয়েকে ঘোড়ার লেজের সঙ্গে বেঁধে মারা না যাওয়া পর্যন্ত তাদের রাস্তায়
রাস্তায় টানার আদেশ দেন। অনেকের মতে এটা একটা বানানো বাহিনী, তবে মুহাম্মদ বিন কাসিমের শেষ
জীবন যে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্য একটি উৎসানুসারে বন্দি করে
মুহাম্মদ বিন কাসিমকে খলিফার কাছে পাঠানোর পরে খলিফার আদেশে অত্যাচার করে তাঁকে মারা হয়।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন কাসিমের বেদনাদায়ক শেষ পরিণতির জন্য দামেস্কে উমাইয়া
খলিফার পরিবর্তন এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বংশের প্রতি নতুন খলিফার নিষ্ঠুর নীতিকে দায়ী করেন।
খলিফা ওয়ালিদের আমলে সিন্ধু বিজিত হয় এবং তখন হাজ্জাজের ছিল প্রবল প্রতিপত্তি। কিন্তু পরবর্তী
খলিফা সোলায়মান ছিলেন হাজ্জাজের শত্রু। ইতোমধ্যে হাজ্জাজের মৃত্যু হলে খলিফার রোষ পড়ে তাঁর
বংশধর মুহাম্মদ বিন কাসিমের ওপর এবং এ কারণেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের এ করুণ পরিণতি ঘটে।
মাত্র তিন বছরের মধ্যে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করে সেখানে খলিফার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন।
সাফল্যের কারণ
সিন্ধু বিজয়ে আরবদের সাফল্যের অনেকগুলো কারণ ছিল।
সিন্ধুবাসীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাফল্যের একটি কারণ। দাহিরের নিজের
পরিবারেও কোন ঐক্য ছিল না যার ফলে কোনো সংঘবদ্ধ বা সমনি¦ত কর্মপন্থা গ্রহণ করা ছিল দুষ্কর।
সিন্ধুর রাজা দাহির মোটেও জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যাচারী যার ফলে তিনি প্রজাদের সর্বাÍক
সহযোগিতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সিন্ধুবাসীর ধর্মীয় বিভেদও আরবদের সাফল্যে অবদান রেখেছিল। বর্ণবিভক্ত হিন্দু সমাজে সাম্যের কোন
স্থান ছিল না, বরং ছিল এক বর্ণের প্রতি অন্য বর্ণের বিরূপ মনোভাব। তাছাড়া, এ বর্ণ বিভক্ত সমাজে
শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়রাই যুদ্ধ করতে পারতো যার ফলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আরবদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ
করেনি। বর্ণ-বিভক্ত এ সমাজে সামাজিক বৈষম্যও ছিল প্রকট। বিশেষ করে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা ছিল
উৎপীড়িত ও অবহেলিত। তাদের জন্য ঘোড়ায় চড়া, মিহিবস্ত্র পরিধান করা ইত্যাদি ছিল নিষিদ্ধ। এসব
কারণে তারা শুধুমাত্র এক শ্রমজীবী শ্রেণী হিসাবেই বিবেচিত হতো যা প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের
মনকে বিষিয়ে তুলেছিল। এ শ্রেণীর বহু মানুষ স্বেচ্ছায় আরব বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল যা আরবদের
সাফল্যের একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরবদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল আরব সেনাপতির নৈপুণ্য এবং আরবদের উন্নত সামরিক পদ্ধতি।
আরব সৈন্যবাহিনী ছিল অত্যন্ত সুশৃ´খল ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দেশ জয়ের উৎসাহ ও শক্তি তাদের সাফল্য
অর্জনে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে সিন্ধুরাজের সৈন্যবাহিনী আকারে বিশাল হলেও শৃ´খলা, প্রশিক্ষণ বা
সাজ-সরঞ্জামে ছিল আরব বাহিনীর তুলনায় হীনতর।
সিন্ধু বিজয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম সেখানে একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। বিজিত জনগণের
প্রতি তাঁর নীতি ছিল বুদ্ধিমত্তা ও সহিষ্ণুতামন্ডিত। অবাধ্যদের প্রতি নিষ্ঠুর হলেও বশ্যতা স্বীকার করার পর

তিনি কখনও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেননি। যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের তিনি দাসত্ব ও জিজিয়া
কর প্রদান থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। অমুসলমানদের কাছ থেকে তিনি কর আদায় করে তাদের জমি ও
সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার দিয়েছিলেন। রাজস্ব আদায়কারীদের কৃষকদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার
আদেশ দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয় এবং তাদের প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করা
হয়। সকলকেই ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে একটি চিঠিতে
এদেশীয়দের জানমালের ওপর হস্তক্ষেপ না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সকলকেই তাদের নিজ নিজ
ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেওয়ার নির্দেশও সে চিঠিতে ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর বিধর্মীদের মন্দির
মেরামত করার অনুমতিও দিয়েছিলেন।
প্রয়োজনের তাগিদেই প্রশাসনিক কাজে এদেশীয়দের নিযুক্ত করা হয়েছিল। আগে থেকেই ব্রাহ্মণরা যে সব
পদে নিযুক্ত ছিল মুহাম্মদ বিন কাসিম তাদের সে সব পদে বহাল রাখেন। বিজিত রাজ্যগুলোকে তিনি
কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক জেলায় একজন সামরিক কর্মচারীকে শাসন কাজের দায়িত্ব
অর্পণ করেন। সরকারি কর্মচারীদের তাদের কাজের পরিবর্তে জায়গীর হিসেবে জমি দেওয়া হয়। কোনো
কোনো ক্ষেত্রে নগদ অর্থেও বেতন দেয়া হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মশাস্ত্রবিদদের সরকারি জমি
ভোগ করতে দেওয়া হতো।
রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভ‚মি-রাজস্ব, যাকাত, জিজিয়া, গণিমাৎ ইত্যাদি। উৎপন্ন ফসলের একচতুর্থাংশ থেকে দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত জিজিয়া কর আদায় করা হতো। জমির খাজনা ছিল উৎপন্ন ফসলের
এক-চতুর্থাংশ থেকে দুই-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত। গণিমাৎ বা যুদ্ধে লুণ্ঠিত ধনের চার-পঞ্চমাংশ সৈন্যদের দেওয়া
হতো, এক-পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা হতো। বিচারের দায়িত্ব ছিল কাজির। মুসলমান আইন অনুসারে
বিচার করা হতো। হিন্দুদের ক্ষেত্রে কোনো কোনো অপরাধে অমানুষিক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
হিন্দুদের মধ্যে পরস্পরের বিবাদের বিচার করতো হিন্দু পঞ্চায়েত।
সিন্ধু জয় করলেও আরবরা সেখানে স্থায়ীভাবে কোনো শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর অবশ্য বেশ
কয়েকটি কারণও ছিল।
প্রথমত, বিভিন্ন গোত্রের মানুষ নিয়ে গঠিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেছিলেন।
যুদ্ধ জয়ের উম্মাদনা শেষ হয়ে গেলে তাদের মধ্যে আগের গোত্রগত প্রতিদ্বন্দি¡তা ও শত্রুতা আবার মাথাচাড়া
দিয়ে ওঠে। ফলে তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা যায় যা তাদের দুর্বল করে ফেলে। শিয়া-সুন্নি ধর্মীয়
দ্বন্দ¡ তাদেরকে আরো দুর্বল করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, সিন্ধুর অনুর্বরতার কারণে আরবরা এদেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল
এমন একটা অঞ্চল অধিকারে রাখা আরবদের কাছে খুব লাভজনক মনে হয়নি।
তৃতীয়ত, আরবরা কেবলমাত্র সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলই অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল।এর বাইরে উত্তর ও
পূর্বদিকে শক্তিশালী রাজপুতদের পরাজিত করে এদেশে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করা আরবদের পক্ষে সম্ভব
ছিলনা।
চতুর্থত, মুহাম্মদ বিন কাসিমের আকস্মিক অপসারণ ও মৃত্যু এদেশে মুসলমান শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।
তাঁর বিজয় অভিযান অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং তাঁর মৃত্যুর পর এর স্থায়িত্ব খলিফাদের সহযোগিতা ও
সমর্থনের অভাবে আরো স্বল্পস্থায়ী হয়ে পড়ে। এ সময় খিলাফতের শক্তিরও অবনতি ঘটে যার ফলে দূরবর্তী
প্রদেশগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। সিন্ধু কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত
হয়ে পড়ে এবং সিন্ধুতে বসবাসকারী আরবরা বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিজেদের বংশ প্রতিষ্ঠা করে শাসন
করতে থাকে। মুলতান, মনসুরা এবং সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে এ ধরনের ছোট ছোট মুসলমান শাসিত
অঞ্চল দেখা যায়। এ সমস্ত কারণে সিন্ধু বিজয়ের পর সিন্ধুতে আরব-শাসন স্থায়িত্ব লাভ করেনি।

সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। ঐতিহাসিক টড
তাঁর রাজস্থানের ইতিহাস গ্রন্থে আরবদের সিন্ধু বিজয়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারূপে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে ঐতিহাসিক স্টেনলি লেনপুল আরবদের সিন্ধু বিজয়কে ফলাফলবিহীন এক অকিঞ্চিৎকর ঘটনা
বলে বর্ণনা করেছেন।
রাজনৈতিক ফলাফল বিচার করলে লেনপুলের মতকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন কারণে সিন্ধু বিজয়কে
কেন্দ্র করে সেখানে বা ভারতে স্থায়ী মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি যা ওপরে আলোচনা করা
হয়েছে। অধ্যাপক এ.বি.এম. হাবিবুল্লাহ্ও বলেছেন যে, আরবরা ভারতে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তা সত্তে¡ও আরবদের সিন্ধু বিজয়কে নিষ্ফল বলা যায় না।
রাজনৈতিক ফলাফলবিহীন এ বিজয়ের সামাজিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ফলাফল ছিল অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে আসা বহু আরব সৈনিক আর দেশে ফিরে যায়নি। স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে
তাঁরা সিন্ধুতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ফলে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের বসতি গড়ে ওঠে। স্থানীয়
অধিবাসীদের কাছে ইসলাম হয়ে ওঠে সাম্য, মুক্তি ও অগ্রগতির প্রতীক। ফলে বহু স্থানীয় অধিবাসী ইসলাম
ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুসলমানরা জনগোষ্ঠীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মনসুরা, মুলতান, দেবল
এবং নিরুণে আরবদের বেশ ঘনবসতি ছিল এবং এসব স্থানে বড় বড় জামে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
এসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের সঙ্গে তাদের প্রীতি ও সদ্ভাব
বজায় ছিল। সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের ভাবানুভ‚তির দিকে লক্ষ রেখে মুসলমানরা এসব জায়গায়
গরু জবেহ নিষিদ্ধ করেছিল। কালক্রমে আরবরাও এদেশীয় রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। মনসুরার আরব
শাসনকর্তা হাতি টানা রথে ভ্রমণ করতেন এবং হিন্দু রাজাদের অনুকরণে কানে দুল এবং গলায় হার
পরতেন। আরবদের স্থায়ীভাবে সিন্ধুতে বসবাস করার ফলে সিন্ধি ভাষায় ও সামাজিক রীতিনীতিতে আরবীয়
প্রভাব দেখা যায়। এখনও সিন্ধি ভাষায় আরবি হরফ ব্যবহৃত হয় এবং সিন্ধি ভাষার ওপর আরবি ভাষার
প্রভাব দেখা যায়। সিন্ধুর সমাজব্যবস্থাও অনেকাংশে আরবদের অনুকরণে উপজাতীয় ভিত্তির ওপর গড়ে
ওঠেছে। আরবদের উপজাতীয় প্রধানকে বলা হয় ‘শেখ', সিন্ধুতে তাঁকে বলা হয় ‘ওয়াদেরা'। আরবদের
মত সিন্ধিরাও অতিথিবৎসল।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরবরা প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষতা ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিল এবং ভারতের সঙ্গে তাদের
বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর ভারতের সঙ্গে আরবদের বাণিজ্যিক
তৎপরতা এবং যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। আরব শাসনামলে সিন্ধুর কৃষি ও বাণিজ্য উন্নতি লাভ করে।
আরবদের সঙ্গে ভারতের এবং এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের বাণিজ্য চলতো।
বাণিজ্যের জন্য স্থলপথ ও জলপথ উভয়ই ব্যবহৃত হতো। সিন্ধুর হিন্দুরা বহির্বাণিজ্যে অগ্রণী ভ‚মিকা গ্রহণ
করেছিল।ভারতীয় রাজারা নিজেদের বাণিজ্যিক উন্নতির আশায় আগের মতই এখন আরব মুসলমান
বণিকদের স্বাগত জানায় এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদান অব্যাহত রাখে।
ধর্মের ক্ষেত্রেও সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল লক্ষ করা যায়। স্থায়ীভাবে বসবাস ও স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করার
ফলে সিন্ধুতে ক্রমে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ইসলামের সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্তে
অনুপ্রাণিত হয়ে বহু স্থানীয় অধিবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল দেখা যায় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। মুসলমান
সংস্কৃতি ভারতীয়দের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। আরবরা এদেশে এসে এখানকার উঁচু মানের
সভ্যতা দেখে বিস্মিত হয়েছিল। আরবরা ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, পন্ডিত ও কারিগরদের
ভ‚য়সী প্রশংসা করেছিল। তাবারির বিবরণ থেকে জানা যায় যে অসুস্থ হয়ে পড়লে খলিফা হারুন-উর-রশিদ
ভারত থেকে একজন চিকিৎসক নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর চিকিৎসাতেই খলিফা আরোগ্য লাভ
করেছিলেন। ভারতীয় বহু চিকিৎসাশাস্ত্র গ্রন্থও আরবি ভাষায় অনুদিত হয়। এগুলোর মধ্যে শশ্রু ও চরকের


গ্রন্থ দুটি আরবে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পশু-চিকিৎসা এবং সর্পদংশন চিকিৎসা সম্পর্কিত
কয়েকটি গ্রন্থও আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, আরবরা ভারতীয়
চিকিৎসাশাস্ত্রের কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
শাসনব্যবস্থায়ও আরবরা ভারতীয়দের কাছ থেকে বহু কিছু শিখেছিল। তাদের প্রশাসনিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা
এবং দক্ষতার কারণেই মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণদের শাসনকাজে ব্যাপকভাবে নিয়োগ করেছিলেন।
আরবীয় সংস্কৃতির বহু কিছুই পরবর্তীকালে ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু মনে রাখা
দরকার যে এগুলোর অধিকাংশই আরবরা প্রথমে ভারতীয়দের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল। আরবরা দর্শন,
জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন ইত্যাদির জ্ঞান ভারতীয় পন্ডিতদের কাছ থেকেই পেয়েছিল।
আব্বাসীয় খলিফারা ভারতীয় পন্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। খলিফা মনসুরের শাসনামলে ভারতীয়
পন্ডিতগণ বাগদাদে গিয়েছিলেন। ভারতীয় পন্ডিতদের সহায়তায় আল-ফাজরী ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত এবং
খাদ্যক নামে দুটি সংস্কৃত গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এ দুটি ছিল জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ।
আল-বেরুনীর মতে ভারতীয়দের কাছ থেকেই আরবরা প্রথম জ্যোতির্বিদ্যায় জ্ঞান লাভ করেছিল। গাণিতিক
সংখ্যা সম্পর্কে জ্ঞানও আরবরা হিন্দুদের কাছ থেকে লাভ করেছিল, সে কারণে আরবরা সংখ্যাকে বলে
‘হিন্দসাস'। আব্বাসীয় খলিফা হারুন-উর-রশিদের সময়ও ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশেষ নজর
দেওয়া হয়। তাঁর মন্ত্রী ইয়াহিয়া বারমকী ও তাঁর দুই পুত্র মুসা ও আমরান বারমকী ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের
প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। বারমকীরা ধর্মান্তরিত মুসলমান হলেও ভারতীয় প্রবণতার ফলে তাঁরা চিকিৎসা
বিজ্ঞান, জ্যোতিষবিদ্যা, ওষুধ-বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য আরব পন্ডিতদের ভারতে
পাঠাতেন। তাঁরা হিন্দু পন্ডিতদের বাগদাদে আসতেও আমন্ত্রণ জানাতেন। এসব ভারতীয় পন্ডিত সংস্কৃত
ভাষায় লেখা চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিষবিজ্ঞান, জ্যোতিষবিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ক বহু গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ
করেছিলেন। বাগদাদের বহু হাসপাতালে ভারতীয় চিকিৎসকরা নিয়োজিত ছিলেন।
অনেকেই মনে করেন যে আরব্যোপন্যাসের কয়েকটি গল্প ভারত থেকে নেয়া। হিন্দু পঞ্চতন্ত্র আরবি ভাষায়
‘কলিলা ও দিমনা' নামে আজও প্রচলিত রয়েছে। দাবা খেলাও আরবরা এদেশ থেকে নিয়েছিল। ভারতীয়
সঙ্গীতও আরবদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। বিখ্যাত আরব কবি জাহিজ হিন্দুদের সঙ্গীত বিদ্যার প্রশংসা
করেছেন। আরবরা ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেছিল। সুফি মতবাদেও
আরবদের সঙ্গে সিন্ধুর যোগাযোগ ছিল। কথিত আছে যে সুফি সাধক হযরত বায়েজিদ বোস্তামী ছিলেন
একজন সিন্ধি সুফি সাধকের শিষ্য। আরব সাহিত্য, স্থাপত্য-শিল্প ও সুকুমার শিল্পও ভারতীয় প্রভাবের ফলে
চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। হ্যাভেল যথার্থই বলেছেন যে গ্রিস নয়, ভারতই ইসলামের প্রভাবযোগ্য
যৌবনাবস্থায় ইসলামকে শিক্ষা দিয়েছিল, তাঁর দর্শন, দুর্বোধ্য ধর্মীয় আদর্শকে রূপদান করেছিল এবং এর
সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রকাশকে উদ্দীপ্ত করেছিল।
আব্বাসীয় বংশের পতনের পর সিন্ধুর আরব শাসকগণ বস্তুত স্বাধীন হয়ে পড়েন এবং দুদশের মধ্যে
সাংস্কৃতিক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।


সারসংক্ষেপ
ভারত আক্রমণকারী মুসলমানদের মধ্যে আরবরাই প্রথম ভারতে এসেছিল। বস্তুত, ইসলাম ধর্মের
আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে আরবদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। খ্রিস্টিয় সপ্তম
শতকে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ও প্রচারের পরও তা অব্যাহত থাকে। হযরত ওমর (রাঃ)-
এর শাসনামলে ৬৩৬-৬৩৭ সালে মুসলমানরা প্রথম ভারতে অভিযান করে সাফল্য অর্জন সত্তে¡ও এ
সময় এবং পরবর্তী সময়ে খলিফাদের সাবধানী নীতির কারণে বিজয় তৎপরতা অব্যাহত থাকেনি।
সম্প্রসারণবাদী ওমাইয়া খলিফাদের আমলে মুসলমান সাম্রাজ্য বিস্তারের অংশ হিসেবে ভারতে
অভিযান পরিচালিত হয়। ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উৎসাহে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ
করে। এই অভিযান প্রেরণের পিছনে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল। প্রথম দুটি অভিযান ব্যর্থ হয়।
অত:পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে তৃতীয় অভিযান
প্রেরিত হয়। সুশৃ´খল ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরব সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে সহজেই সিন্ধুর রাজা দাহিরকে
পরাজিত ও নিহত করে। কাসিম একে একে দেবল, নিরুন, সেহওয়ান, রাওয়ার, ব্রাহ্মণাবাদ, দাহিরের
রাজধানী আড়রসহ মুলতান দখল করে খলিফার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু তাঁর আকস্মিক অপসারণ ও মৃত্যু এদেশে মুসলমান শাসনকে দুর্বল করে দেয়। কারণ, তাঁর
অসম্পূর্ণ বিজয়াভিযান ও পরবর্তী সময়ে খলিফাদের সহযোগিতা ও সমর্থনের অভাবে সিন্ধু অঞ্চলে
আরব শাসন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কিন্তু তা সত্তে¡ও আরবদের সিন্ধু বিজয়কে নিষ্ফল বলা যায় না।
রাজনৈতিকভাবে ফলাফলবিহীন হলেও এর সামাজিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ফলাফল
ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১. আরবরা সিন্ধু জয় করেনÑ
(ক) ৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে (খ) ৬৪৩-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ৭১২ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে
২. আরবদের সিন্ধু অভিযানের সফল সেনাপতি ছিলেনÑ
(ক) আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন রাবি (খ) মুহাম্মদ বিন কাসিম
(গ) সুলতান মাহ্মুদ (ঘ) মুহাম্মদ ঘোরী
৩. সিন্ধু বিজয়ের সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেনÑ
(ক) দাহির (খ) পৃথ্বিরাজ
(গ) জয়চন্দ্র (ঘ) আনন্দ পাল
৪. তখন সিন্ধুর রাজধানী ছিলÑ
(ক) দেবল (খ) নিরুণ
(গ) সেহওয়ান (ঘ) আড়র
৫. আরবদের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ঘটেÑ
(ক) মহানবীর সময়ে (খ) খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে
(গ) উমাইয়া যুগে (ঘ) আব্বাসীয় যুগে
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সিন্ধু বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে আরবদের ভারত অভিযান বর্ণনা করুন।


২। সংক্ষেপে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক সিন্ধু অভিযানের কারণ বর্ণনা করুন।
৩। সিন্ধুতে আরব শাসন স্থায়িত্ব লাভ করেনি কেন?
৪। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সামাজিক ফলাফল কি ছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। আরবদের সিন্ধু অভিযানের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]