গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।


তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খলজী
বংশের আকস্মিক পতনের পরই তুঘলক বংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এ বংশের রাজত্বকাল ইতিহাসের
সময় বিচারে স্বল্পায়ূ হলেও (১৩২০Ñ১৪১২ খ্রি:) উপমহাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৩২০ খ্রিস্টাব্দের শেষে খলজী শাসক কুতুবুদ্দিন মোবারক খলজী তাঁর অনুগৃহীত গুজরাটের পারওয়ারী
বংশোদ্ভূত নিচু বর্ণের হিন্দু স্বধর্মত্যাগী খসরু কর্তৃক নিহত হন। ফলে খলজী শাসনের অবসান ঘটে।
সুলতানের হত্যাকারী খসরু নাসিরউদ্দিন খসরু শাহ নামে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। খসরু শাহ
খলজী বংশের প্রতি অনুরক্ত আমীরদের হত্যা করেন এবং নিজ বংশের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
করেন। এ সময় দিল্লিতে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা শুরু
হয়। ফলে মুসলমান অভিজাতদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা খসরু শাহ-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ
হতে শুরু করেন।
মালিক ফখরুদ্দিন জুনা খান এ সময় দিল্লিতে “আমীর-ই-আখুর” পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর পিতা গাজি
মালিক পাঞ্জাব অঞ্চলের শাসনকর্তা এবং সফল সেনাপতি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। মালিক জুনা কৌশলে
দিল্লি ত্যাগ করে পাঞ্জাবে পিতার সাথে মিলিত হন। পুত্রের কাছে প্রভু হত্যা ও ধর্ম দলনের খবর পেয়ে গাজি
মালিক অন্যান্য শাসনকর্তাদের সাথে মিলিত হয়ে দিল্লি অভিযান করেন। গাজি মালিকের সম্মিলিত বাহিনীর
কাছে খসরু শাহ পরাজিত ও নিহত হন। খলজী বংশের কোন উত্তরাধিকারী বেঁচে না থাকায় দিল্লির
অভিজাত শ্রেণীর একান্ত অনুরোধে গাজি মালিক ‘সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক' নামে দিল্লির সিংহাসনে
আরোহণ করেন। এভাবে তুঘলক বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তুঘলকের বংশ পরিচয়
তুঘলক শাসকদের বংশ পরিচয় সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণত মনে করা
হয়ে থাকে যে, তুঘলক শাসকরা মূলত তুর্কি এবং তুর্কিদের করৌনা গোত্রভুক্ত। যতটুকু জানা যায়, গাজি
মালিকের পিতা মালিক তুঘলক দিল্লির প্রবল প্রতাপানি¦ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ক্রীতদাস ছিলেন।
মালিক তুঘলক পাঞ্জাবের জনৈকা জাঠ নারীকে বিয়ে করেন। এ নারীর গর্ভজাত সন্তান হলেন গাজি
মালিক।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০Ñ১৩২৫)



একজন সাধারণ সৈন্য হিসেবে জীবন শুরু করে তিনি নিজ যোগ্যতাবলে ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে সুলতান
আলাউদ্দিন খলজীর শাসনকালে সালতানাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
১৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সে পদে বহাল ছিলেন।এ সময়কালে তিনি বীরত্বের
সাথে মোঙ্গল হামলা প্রতিহত করে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা
সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সালতানাতে শান্তি-শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট
হন। পূর্ববর্তী দুজন শাসকের অনাচার ও অবহেলার কারণে প্রশাসন ও অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছিল। তিনি
অত্যন্ত কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে অর্থনৈতিক শৃ´খলা ফিরিয়ে আনেন। প্রদেশগুলোতে যোগ্য শাসক
নিযুক্ত করে প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলেন। জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি
রাজস্ব হ্রাস এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। তিনি দরিদ্র জনসাধারণের জন্য সাহায্য এবং কৃষকদের
জন্য ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। প্রশাসনের অন্যান্য শাখাও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি পুলিশ ও
বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠন করে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের এবং
গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ডাক বিভাগের পুনর্গঠন ও সংস্কার করে তিনি সালতানাতের মাঝে সংবাদ
আদান-প্রদানের ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সামরিক চৌকি ও দুর্গ স্থাপন করে
তিনি সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। দিল্লির অদূরে তিনি বিখ্যাত ‘তুঘলকাবাদ' দুর্গ নির্মাণ করেন।
রাজ্য বিজয়
সৈনিক হিসেবে অসাধারণ সাফল্যের অধিকারী সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সালতানাতের সর্বত্র নিজের
কৃতিত্ব স্থাপন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি-শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা করে তিনি দাক্ষিণাত্যের
বিদ্রোহী রাজাদের দমন করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি মূলত সামরিক প্রাধান্য স্থাপন এবং সাম্রাজ্য
বিস্তারের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। দাক্ষিণাত্য এবং বাংলায় তিনি সামরিক সাফল্য অর্জন করেন।
দাক্ষিণাত্য ও উড়িষ্যা
সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর মৃত্যুর পর থেকেই দাক্ষিণাত্যের তেলিঙ্গানা রাজ্যের কাকাতীয় বংশের রাজা
দ্বিতীয় প্রতাপ রুদ্রদেব দিল্লির আনুগত্য অস্বীকার করে নজরানা প্রদান বন্ধ করে দেন। সুলতান তাঁর বড়
ছেলে এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মালিক জুনা খানকে তেলিঙ্গানার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুবরাজ জুনা
খান বরঙ্গল দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু কাকাতীয় সৈন্যবাহিনীর চরম প্রতিরোধ ও সৈন্যবাহিনীতে মহামারী
দেখা দেওয়ায় জুনা খান অবরোধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এর অল্পদিন পরে তিনি আবার বরঙ্গল
আক্রমণ করে দ্বিতীয় প্রতাপ রুদ্রদেবকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। বরঙ্গলের নতুন নাম রাখা হয়
সুলতানপুর। এ সময় জুনা খান মাদুরার পান্ড্যরাজ্য আক্রমণ করেন বলেও জানা যায়। যুবরাজ জুনা খানের
নেতৃত্বে দিল্লি বাহিনী উড়িষ্যা আক্রমণ করে রাজা দ্বিতীয় ভানুদেবকে পরাজিত করেন। বিজয়ী যুবরাজ
রাজধানীতে ফিরে এলে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁকে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা
জানান।
বাংলা বিজয়
১৩২২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ মারা গেলে তাঁর ছেলেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ¡ দেখা
দেয়। এ সুযোগ গ্রহণ করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। তিনি


শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের বড় ছেলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরকে পরাজিত ও বন্দি করেন এবং ছোট ছেলে
নাসিরউদ্দিন ইব্রহিমকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দিল্লি ফিরে যান।
বাংলায় সামরিক সাফল্য অর্জন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সর্বশেষ কৃতিত্ব। সকল অভিযান শেষে
দিল্লি ফেরার পথে তিনি দিল্লির অদূরে আফগানপুর নামক স্থানে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্ঘটনায় মারা যান। কোন
কোন ঐতিহাসিক সুলতানের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে শাহজাদা জুনা খানের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। তবে এ
বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোন সূত্র নেই।
চরিত্র
তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক একজন উদার মনোভাবাপন্ন শাসক ছিলেন। সে
কালের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণীর মতে, সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বহুবিধ গুণের অধিকারী
ছিলেন। সামাজিক কলঙ্কের কালিমামুক্ত নির্মল চরিত্রের অধিকারী সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ব্যক্তিগত
আচার-আচরণ ছিল অত্যন্ত সাধারণ। সুরা পান ও সেকালে প্রচলিত আমোদ-প্রমোদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র
আসক্তি ছিল না।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক একজন ধর্মভীরু নরপতি ছিলেন। একজন সুন্নী মুসলমান হিসেবে তিনি ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান হলেও ধর্মান্ধতার কলুষকালিমা কখনোই তাঁর উদার হৃদয়কে কলুষিত
করতে পারেনি। তিনি আলেম সমাজকে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু প্রয়োজনে তাদের প্রতি কঠোর হতে কুণ্ঠিত
হননি। নিরপেক্ষ বিচার, ইসলাম ধর্মের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাবোধ, আইনের প্রতি নিষ্ঠা প্রভৃতি ছিল তাঁর
চরিত্রের কতিপয় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মাত্র পাঁচ বছরের রাজত্বকালে দিল্লি সালতানাতের মধ্যে তিনি
শৃ´খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলায় দিল্লির কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনাও তাঁর কৃতিত্ব।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)
তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে তাঁর বড় ছেলে এবং
উত্তরাধিকারী শাহজাদা জুনা খান সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক নামে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তাঁর রাজত্বকাল উপমহাদেশের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। মুসলিম শাসনের সূচনালগ্ন
থেকে তাঁর মত বিদ্বান, জ্ঞানী ও প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার অধিকারী আর কোন সুলতান দিল্লির সিংহাসনে
আরোহণ করেননি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক মধ্যযুগের ইতিহাসের এক
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। অতুলনীয় গুণাবলীর অধিকারী সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকাল মূলত
ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিয়োগান্তক অধ্যায়।
অভ্যন্তরীণ নীতি
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দীর্ঘ রাজত্বকালকে (১৩২৫-১৩৫১) মোটামুটিভাবে দুটো ভাগে ভাগ করা
যেতে পারে, প্রথম ভাগ ১৩২৫-১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়কালে সুলতান সফলতার সাথে প্রশাসন
পরিচালনা এবং বিভিন্ন সংস্কারমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ভাগ ১৩৩৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময় সুলতান নানাবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হন। এ সকল সমস্যার মোকাবেলা
করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর মাধ্যমে অন্তহীন সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পান।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক চতুর্দশ শতকের ভারতের ইতিহাসে এক নতুন শাসনব্যবস্থার সূচনা
করেছিলেন। মধ্যযুগের ইতিহাসে ধর্মীয় নেতাদের শক্তিশালী প্রভাব বলয় ছিন্ন করে রাজতন্ত্রকে একচ্ছত্র
করে তোলার যে চেষ্টা সুলতান আলাউদ্দিন খলজী করেছিলেন, (১২৯৬-১৩১৬) মুহাম্মদ বিন তুঘলক সে


ধর্মীয় নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার বাস্তব রূপায়ণ করতে সচেষ্ট হন। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক গভীর
পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ফলে তিনি সহজেই আলেমদের মন-মানসিকতা বুঝতে পারতেন। তিনি
যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পছন্দ করতেন বলে আলেমদের এড়িয়ে চলতেন। এমনকি তাদের বহুবিধ
সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে তাদেরকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এর অর্থ এ নয় যে
তিনি ধর্মবিরোধী ছিলেন, বস্তুত তিনি প্রশাসনকে আলেমদের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন
মাত্র। রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার জন্যই সুলতান ধর্মীয় আইন-কানুনের পরিবর্তে যুক্তি ও ন্যায়ের
ভিত্তির ওপর প্রশাসন গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন।এ প্রচেষ্টা যুগের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রগতিশীল হওয়ায়
সালতানাতে গভীর সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য তিনি তাঁর এ মনোভাব ধরে রাখতে পারেননি। সংস্কার
বিমুখ প্রতিক্রিয়াশীল চতুর্দশ শতকের ভারতে মহান সুলতানের এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি। রাজনৈতিক
পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সুলতান ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে আপোষ করতে বাধ্য হন।
বিদ্রোহ দমন
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দেয়। তিনি দৃঢ়হাতে
এগুলো দমন করেন। ১৩২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতানের ফুপাতো ভাই বাহাউদ্দিন দাক্ষিণাত্যের গুলবর্গায়
বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুলতান বিদ্রোহী বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। বাহাউদ্দিন
পরাজিত হয়ে কামপিল রাজের আশ্রয় ভিক্ষা করেন। এ অভিযানে সুলতানের বাহিনী কামপিল রাজকে যুদ্ধে
পরাজিত ও নিহত করে। বিদ্রোহী বাহাউদ্দিন হয়সলরাজ তৃতীয় বল্লালের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন।
কামপিল বিজয়ের পর সুলতানের বাহিনী হয়সল রাজ্য আক্রমণ করে। যুদ্ধে তৃতীয় বল্লাল পরাজিত হয়ে
বাহাউদ্দিনকে সুলতানের সৈন্যদের কাছে হস্তান্তর করে। বিদ্রোহী বাহাউদ্দিনকে প্রাণদন্ড দেয়া হয়। এ সময়
তিনি দাক্ষিণাত্যের বিজিত রাজ্যগুলোকে সরাসরি দিল্লির শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। ফলে দাক্ষিণাত্যে
মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর পরপরই মুলতানের শাসনকর্তা বাহরাম আইবা ফিচ্লু খান বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন। সুলতান এ সময়ে দৌলতাবাদে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে তিনি দিল্লি হয়ে মুলতান
গমন করেন এবং সম্মুখ যুদ্ধে বাহরামকে পরাজিত করে বন্দি করেন এবং প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন।
রাজপুত কাহিনী থেকে জানা যায়, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক রাজপুতনায় রাজা হাম্মির-এর বিরুদ্ধে স্বয়ং
সৈন্য পরিচালনা করে পরাজিত ও বন্দি হয়েছিলেন। সুলতান অর্থ প্রদান এবং বেশ কিছু এলাকার অধিকার
ছেড়ে দিয়ে নিজের মুক্তি অর্জন করেন। সমকালীন ফার্সি রচনাবলীতে এর কোন উল্লেখ বা ইঙ্গিত না থাকায়
আধুনিক পন্ডিতগণ এ বিষয়কে কাল্পনিক বলে মনে করেন। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজত্বের
প্রথম দিকেই মোঙ্গল হামলার শিকার হয়েছিলেন। ১৩২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দ মোঙ্গল নেতা তারমাশিরীন উত্তরপশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে এবং পাঞ্জাব ও মুলতান লুণ্ঠন করে দিল্লির কাছে এসে পড়ে।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক হামলাকারীদের পরাজিত করে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেন। কোন কোন
ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান অর্থ প্রদানের মাধ্যমে হামলাকারীদের শান্ত করেন। যেভাবেই হোক, এটা
সত্য যে, তিনি মোঙ্গল হামলা থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
রাজত্বকালের দ্বিতীয় ভাগে বিদ্রোহ ও পতন
সুলতান তাঁর রাজত্বের এ সময়ে বেশ কয়েকটি সংস্কারমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন (পরিকল্পনাগুলো
পরবর্তী পাঠে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে)। কিন্তু তাঁর এই সামরিক সাফল্য স্থায়ী হয়নি। ১৩৩৫
খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর সৌভাগ্য রবি অস্তমিত হতে শুরু করে। মহতী পরিকল্পনাসমূহের ব্যর্থতা রাজকোষ শূন্য
করে ফেলে এবং সুলতানের মন-মানসিকতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তিনি অস্থির ও নিষ্ঠুর হয়ে
ওঠেন। এ সময় সালতানাতের মৌলবাদী ধর্মীয়গোষ্ঠী প্রকাশ্যে সুলতানের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন।
আলেমদের প্রতি বিরূপ মনোভাবসম্পন্ন সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক বাস্তব ব্যবস্থা হিসেবে মিশরের
খলিফার কাছ থেকে তাঁর অনুক‚লে ফরমান আনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এতেও অবস্থার তেমন কোন উন্নতি
ঘটেনি।


১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ মাবারের শাসনকর্তা জালালউদ্দিন আহসান শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সুলতান স্বয়ং তার
বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু বরঙ্গলের কাছে পৌঁছালে তাঁর সেনাবাহিনীতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
ফলে তিনি দৌলতাবাদে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মাবার অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায়। বাংলার ওপর দিল্লির
নিয়ন্ত্রণ কখনো তেমন কার্যকরী ছিল না। মূলত দিল্লি থেকে বাংলার দূরত্ব এবং অন্যান্য ভ‚-প্রাকৃতিক কারণে
বাংলাকে দিল্লির কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো না। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ
সোনারগাঁয়ে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক
বাংলার বিরুদ্ধে কোন সামরিক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। ফলে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ একজন স্বাধীন
সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়, সুলতান
দু'চারটি ছোট খাট বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলেও সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। ১৩৪০-৪১
খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার শাসনকর্তা সালতানাতের প্রধান আমীর মালিক আইন-উল-মুলক মুলতানীকে
দাক্ষিণাত্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলে তিনি বিদ্রোহ করেন। সুলতান নিজেই তার বিরুদ্ধে
অগ্রসর হয়ে তাকে পরাজিত করেন। তিনি আইন-উল-মুলককে ক্ষমা করে দেন এবং অন্য এক সম্মানজনক
পদে নিযুক্ত করেন।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রতি আর কখনও সৌভাগ্য রবি সুপ্রসন্ন হয়নি। একের পর এক বিদ্রোহের
শিখা প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর ভারতে সুলতান তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে
সক্ষম হলেও দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে কাকাতীয়
রাজপুত্র নায়ক দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য হিন্দু সামন্তদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে
আন্দোলন গড়ে তোলেন। হয়সলরাজ তৃতীয় বীর বল্লাল এতে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করেন। ফলে
দাক্ষিণাত্যের এক উল্লেখযোগ্য অঞ্চলে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন হিন্দুরাজ্যের অভ্যুদয়
ঘটে।
বস্তুত, এ সময় গুজরাট ও দেবগিরিতে সুলতানের কর্তৃত্ব বহাল ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলও অল্পদিনের মধ্যে
সুলতানের হাতছাড়া হয়ে যায়। দেবগিরির শাসনকর্তার অপসারণকে কেন্দ্র করে দেবগিরিতে বিদ্রোহ দেখা
দেয়। বিদ্রোহী অভিজাতগণ নতুন শাসনকর্তাকে বন্দি করে কোষাগার লুট করে এবং দুর্গ দখল করে নেয়।
এ অবস্থায় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে দেবগিরিতে আসেন। কিন্তু কোন
কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার পূর্বেই তিনি দেবগিরির বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব জনৈক সেনাপতির ওপর অর্পণ
করে গুজরাটের বিদ্রোহ দমন করতে ছুটে যান। এর ফলে বিদ্রোহী নেতা হাসান দাক্ষিণাত্যের গুলবর্গায়
স্বাধীন বাহমনী রাজ্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করেন। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ তিনি সুলতান আলাউদ্দিন বাহমান শাহ
নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতানের দেবগিরি ত্যাগের ফলে সারা দাক্ষিণাত্যই তাঁর হাতছাড়া হয়ে
যায়। গুজরাটে এসেও সুলতান তেমন সুবিধা করতে পারেননি। গুজরাটের বিদ্রোহ দমন করতে তিনি খুবই
সচেষ্ট ছিলেন। বিদ্রোহীদের তাড়া করে তিনি সিন্ধুর থাট্টার দিকে অগ্রসর হন। এখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে
১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের শেষের দিকে কয়েক বছর সুলতানকে বিদ্রোহ দমনে ব্যতিব্যস্ত থাকতে
হয়। সুলতানের ব্যর্থতা ও আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের চারিদিকে বিদ্রোহের প্রবণতা দেখা দেয়।
এক বিদ্রোহ দমন করতে না করতেই আরেক বিদ্রোহের উদ্ভব হয়।সংস্কার প্রচেষ্টাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই
দীর্ঘ রাজত্বকালের শেষের দিকে তাঁকে এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়েছিল।
সারসংক্ষেপ
তুঘলক বংশের ইতিহাস উপমহাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক এ বংশের অন্যতম সুলতান। তাঁর স্বল্পকালীন রাজত্বে দিল্লি সালতানাতের মধ্যে শৃ´খলা
ফিরে আসে। দাক্ষিণাত্যে, উড়িষ্যা এবং বাংলা অঞ্চলে তাঁর কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁরই পুত্র মুহাম্মদ
বিন তুঘলক নানা কারণে আলোচিত চরিত্র। মুহাম্মদের রয়েছে অভ্যন্তরীণ নীতি, বিদ্রোহ দমন ইত্যাদি
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস পৃষ্ঠা ২৫৯
ক্ষেত্রে সাফল্য। মোঙ্গল আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্য রক্ষায় তিনি সফল হন। রাজত্বকালের দ্বিতীয় ভাগে
তাঁকে বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি পিছু হঠে আসেন। তাঁর সংস্কার
প্রচেষ্টাগুলোর ব্যর্থতা এবং আর্থিক দূর্বলতার কারণেই তুঘলক বংশের পতন ত্বরানি¦ত হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। মোঙ্গল হামলা প্রতিহত করে অত্যন্ত জনপ্রিয় হনÑ
(ক) মুহাম্মদ বিন তুঘলক (খ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
(গ) ফিরোজ শাহ তুঘলক (ঘ) এঁদের কেউই নন।
২। উড়িষ্যা বিজয়ী জুনা খান হলেনÑ
(ক) মুহাম্মদ বিন তুঘলকের কনিষ্ঠ পুত্র (খ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কনিষ্ঠ পুত্র
(গ) মুহাম্মদ বিন তুঘলকের জ্যেষ্ঠ পুত্র (ঘ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের জ্যেষ্ঠ পুত্র।
৩। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলা আক্রমণ করেনÑ
(ক) ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে (গ) ১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে।
৪। মুহাম্মদ বিন তুঘলক রাজত্ব করেনÑ
(ক) ২৬ বছর (খ) ১৬ বছর
(গ) ৬ বছর (ঘ) ৩৬ বছর।
৫। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেনÑ
(ক) ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে।
৬। মুহাম্মদ বিন তুঘলক মৃত্যুবরণ করেনÑ
(ক) ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। কিভাবে গাজি মালিক দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকরেন?
২। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের প্রথম ভাগে বিদ্রোহ দমনের বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
২। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করুন। >

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]