প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গ্রন্থাকারে লিখিত উৎসের গুরুত্ব নিরূপণ করুন।


আলোচনার সুবিধার্থে বাংলার ইতিহাসের উৎসসমূহ দুভাগে ভাগ করা যায়: প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের উৎস
এবং সুলতানি যুগের ইতিহাসের উৎস। উল্লেখ্য যে, মুসলিম-পূর্ব যুগের এবং মুসলিম যুগের উৎসের প্রকৃতি
সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাষা ভিন্ন, উপাদান ভিন্ন এবং সেই কারণে পুনর্গঠিত ইতিহাসেরও রূপ ভিন্ন। প্রাচীন যুগে
গ্রন্থাকারে রচিত লেখনির একান্ত অভাব। তাই ইতিহাস প্রতœতাত্তি¡ক উৎসের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল।
কিন্তু সুলতানি যুগে গ্রন্থাকারে লিখিত উপকরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।তবে সে উপকরণ দিল্লিকেন্দ্রিক
হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকদের প্রতœতাত্তি¡ক উপাদান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। আমরা প্রাচীন যুগ ও
সুলতানি যুগের উৎস সমূহ আলাদাভাবে আলোচনা করবো।
(ক) প্রাচীন যুগের ইতিহাসের উৎস
প্রাচীন ভারতের ন্যায় প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনও সহজবোধ্য ব্যাপার নয়।কারণ উৎসের
অপ্রতুলতা। প্রাচীন যুগে লিখিত গ্রন্থাদি নেই বললেই চলে। যাও আছে তার মধ্যে ইতিহাসের বিষয়বস্তু খুব
বেশি নাই, আছে ধর্ম-কর্ম আর দেবদেবীর কথা। মানুষের কর্মকান্ড তার মধ্যে তেমন প্রাধান্য পায়নি। এই
কারণে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে ঐতিহাসিকদের নির্ভরশীল হতে হয়েছে প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানের
ওপর। প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানের ওপর নির্ভর করেই দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে প্রাচীন যুগে বাংলার ইতিহাসের
অবকাঠামো।তাই একথা বললে খুব একটা ভুল হবে না যে যদি আমরা কেবল গ্রন্থাগারে লিখিত উপাদানের
ওপর নির্ভরশীল হতাম তাহলে আমরা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস খুব কমই জানতে পারতাম।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসসমূহ দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারেÑ
(১) গ্রন্থাকারে লিখিত উপাদান; (২) প্রতœতাত্তি¡ক উপাদান। আবার প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানের মধ্যে রয়েছেÑ
(ক) অভিলেখমালা (খ) মুদ্রা এবং (গ) প্রতœতাত্তি¡ক ধ্বংসাবশেষ।
আমরা এখন বিভিন্ন প্রকারের উৎস সম্বন্ধে একে একে আলোচনা করবো।



গ্রন্থাকারে লিখিত উপাদান
প্রাচীন যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার ভ‚খন্ডে লিখিত গ্রন্থ তেমন একটা নেই বললেই চলে। বাংলার বাইরে
লিখিত কিছু গ্রন্থে বাংলা সম্পর্কে যৎসামান্য কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বৈদিক বা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে
বাংলার প্রাচীন জনপদ সমূহের নাম উল্লেখ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তেমন কোন বিস্তারিত তথ্য নেই।
সম্ভবত: খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে বাংলা সম্বন্ধে বিধৃত তথ্যই এতদাঞ্চল
সম্পর্কে প্রাচীনতম তথ্য।এই গ্রন্থে বাংলার সূ² সুতিবস্ত্রের উল্লেখ এ কথাই প্রমাণ করে যে, বাংলায়
বয়নশিল্পের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এছাড়া অর্থশাস্ত্রে তেমন কোন তথ্য নেই।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুপ্ত যুগ স্বর্ণ যুগ বলে বিবেচিত।এ যুগের অন্যতম কৃতিত্ব সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ।
সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটলেও ইতিহাস সম্পর্কিত লেখনির তেমন কোন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়
না। মহাকবি কালিদাস রচিত রঘুবংশ কাব্যে রঘুর চরিত্র হয়েছিল গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের জীবনী অবলম্বনে।
নৌযুদ্ধে পারদর্শী বঙ্গীয়দের বিরুদ্ধে রুঘুর বা সমুদ্রগুপ্তের যুদ্ধের কিছু বর্ণনা রয়েছে এই কাব্যে। বাংলা গুপ্ত
সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল, যার প্রমাণ অন্যান্য সূত্র থেকেও পাওয়া যায়।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত' গ্রন্থে হর্ষবর্ধনের
সাথে বাংলার সম্রাট শশাঙ্কের সংঘর্ষের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তবে বাণভট্টের বিবরণে একপেশে ভাব
লক্ষণীয়। তাঁর বিবরণে হর্ষবর্ধনকে অতি উজ্জ্বল করে চিত্রিত করা হয়েছে; আর শশাঙ্ককে শত্রু হিসেবে হীন
চরিত্রের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য উৎসের অভাবে শশাঙ্কের ইতিহাস শত্রুপক্ষের লেখনির
ওপরই নির্ভরশীল।
নবম-দশম শতাব্দীতে রচিত (রচয়িতার নাম জানা যায় না) ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প' গ্রন্থে বাংলার ইতিহাসের
কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তবে এই গ্রন্থে সমগ্র উত্তর ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাও আবার এক
বিশেষ ঢং-এ। গ্রন্থকার সব নামের আদ্যাক্ষর ব্যবহার করেছেন, কখনও পুরো নাম ব্যবহার করেননি। ফলে
হয়তো জানা বিষয়ে কিছু সাহায্য পাওয়া যেতে পারে এই গ্রন্থ থেকে, কিন্তু অন্য সূত্র থেকে না পাওয়া তথ্য
বোঝাই কঠিন। তবে এই সব অসুবিধা থাকা সত্তেও সপ্তম থেকে নবম শতাব্দী সময়ের বাংলার ইতিহাসের
বেশ কিছু তথ্য এই গ্রন্থ সরবরাহ করে।
দ্বাদশ শতাব্দীর কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতম্' কাব্যে বাংলার পাল যুগের বিশেষ কিছু ঘটনা বিধৃত
রয়েছে। শেষ পাল সম্রাট মদনপালের রাজত্বকালে রচিত এই গ্রন্থে দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে সংঘটিত
বরেন্দ্র বিদ্রোহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। তবে কাব্যটি প্রায় দুর্বোধ্য। দ্ব্যর্থবোধক কাব্যটির
প্রতিটি শ্লোকের দুরকম অর্থ হয়; এক অর্থে বহুল পরিচিত রামায়ণের কাহিনী, যা বুঝতে তেমন অসুবিধা
হয় না। দ্বিতীয় অর্থে রয়েছে সমসাময়িক ঘটনা। এই অর্থ বুঝতে কষ্টই হতো। তবে কাব্যটির একটি
পান্ডুলিপিতে প্রথম দুই ভাগের গদ্য-ব্যাখ্যা আছে। তাই সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব।
দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে বরেন্দ্রে (উত্তরবঙ্গ) পাল শাসনের অবসান ঘটে, কৈবর্ত-প্রধান দিব্যের বা
দিব্যোকের শাসন সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে পাল সম্রাট রামপাল দিব্যের ভ্রাতুস্পুত্র ভীমকে পরাজিত
করে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করে পাল সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনেন। এসব ঘটনার জন্য রামচরিত
কাব্যই একমাত্র উৎস। তাছাড়া সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যে বরেন্দ্রের সুন্দর বর্ণনা রয়েছে।
সেনযুগে বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যেও ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। তবে অধিকাংশ রচনারই বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম-
কর্ম, পূজা-পার্বণ আর দান-দক্ষিণা।পার্থিব বিষয় খুব একটা স্থান পায়নি। তবে সেনযুগের কিছু
কাব্যসংকলনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার, গ্রামীণ জীবনের কিছু ছবি বা অর্থনৈতিক অবস্থার যৎসামান্য
বিবরণ পাওয়া যায়। অল্প হলেও এসব তথ্য সামাজিক ইতিহাসের অমূল্য উৎস। কাব্য সংকলনের মধ্যে
শ্রীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত', বিদ্যাকরের ‘সুভাষিতরতœকোষ' এবং গোবর্ধনের ‘আর্যসপ্তশতী' বিশেষ
উল্লেখযোগ্য।


তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস' (তিব্বতী ভাষায় রচিত) গ্রন্থে প্রাচীন
বাংলার ইতিহাসের কিছু উপকরণ পাওয়া যায়; বিশেষ করে নবম-দশম শতাব্দীর বঙ্গ-সমতট সম্পর্কে বা
পাল বংশের উত্থান সম্পর্কে। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, তারনাথ তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ১৬০৮
খ্রিস্টাব্দে। তাঁর গ্রন্থের মুখ্য বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্ম। সুতরাং এতে অন্যান্য পার্থিব বিষয়াদি তেমন গুরুত্ব
পায়নি। তাছাড়া তারনাথ তাঁর সময়ের অনেক পূর্বের বিষয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন তা যথাযথভাবে যাচাই
না করে গ্রহণ করা যায় না।
বিদেশীদের বর্ণনা সব সময়ই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে প্রথম খ্রিস্টাব্দের
মধ্যে রচিত কিছু গ্রিক ও লাতিন লেখনিতে বাংলা সম্বন্ধে সামান্য তথ্য পাওয়া যায়। এদের মধ্যে অজানা
লেখকের ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী' গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গ্রিক ও লাতিন লেখনিতে বাংলার
ভ‚ভাগে ‘গঙ্গারিডাই' নামক শক্তিশালী রাষ্ট্রের এবং ‘গাঙ্গে' বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের সূক্ষè
সুতিবস্ত্রের খ্যাতি সেই সময়েই গ্রিক-রোমান জগৎ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল।
পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে বেশ কয়েকজন চৈনিক বৌদ্ধ পন্ডিত বাংলায় এসেছিলেন; তাঁদের ভ্রমন
বৃত্তান্তে বাংলা সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। তবে এরা সবাই ভারতে এসেছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম এবং রীতিনীতি
সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে। দেশে ফিরে এরা সবাই স্বদেশবাসীকে জানাবার উদ্দেশ্যে তাঁদের
অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁদের বিবরণ স্বাভাবিক কারণেই বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক। প্রসঙ্গক্রমে অন্যান্য
বিষয় তাঁদের লেখনিতে স্থান পেয়েছে। চৈনিকদের মধ্যে প্রথম এসেছিলেন ফা-হিয়েন্, গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে। বাংলা সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য তাঁর বৃত্তান্তে নেই। তাম্রলিপ্তি বন্দরের এবং ঐ
বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যের কিছু তথ্য তাঁর লেখা বিবরণ থেকে পাওয়া যায়।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে এসেছিলেন হিউয়েন সাং, উত্তর ভারতীয় পুষ্যভ‚তি বংশের সম্রাট হর্ষবর্ধনের
রাজত্বকালে।তিনি সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে দীর্ঘকাল ভারতে কাটিয়েছেন।হর্ষবর্ধনের
সমসাময়িক বাংলার সম্রাট ছিলেন শশাঙ্ক। শশাঙ্ক-হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষের কথা হিউয়েন সাং-এর বিবরণে
পাওয়া যায়। তবে স্বাভাবিক কারণেই তিনি হর্ষবর্ধনের পক্ষ অবলম্বন করেই বক্তব্য রেখেছেন। শশাঙ্ককে
তিনি চিত্রিত করেছেন হীনচরিত্রের বৌদ্ধবিদ্বেষী রাজা হিসেবে। তাই শশাঙ্ক সম্পর্কে তাঁর দেওয়া সব তথ্যই
বিশ্বাসযোগ্য নয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হিউয়েন সাং বাংলায় এসেছিলেন; কর্ণসুবর্ণ হয়ে পুন্ড্রনগর, সেখান
থেকে কামরূপ হয়ে সমতট, তারপর তাম্রলিপি থেকে উড়িষ্যার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের
দিকে। প্রায় সমগ্র বাংলাই তিনি পরিভ্রমণ করেছিলেন। বাংলার এসব অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে
তাঁর বিবরণে। তিনি পুন্ড্রনগর ও আশেপাশের এলাকায়, সমতটে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনাদির উল্লেখ
করেছেন। তাঁর দেওয়া তথ্যসমূহ সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা সম্পর্কে ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান। তৃতীয় চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং, সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, বাংলায় এসেছিলেন। সমতট
এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বৌদ্ধরাজ বংশ খড়গদের সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাঁর বিবরণে।
নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে লিখিত আরব নাবিক ও ভৌগোলিকদের বিবরণে বাংলা সম্পর্কে বেশ
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এই সময়কালে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্যে আরবদের
একাধিপত্য ছিল। বাংলার উপক‚ল দিয়েই আরবদের বাণিজ্যতরী যাতায়াত করতো। তাই আরবদের বর্ণনায়
বাংলার সমৃদ্ধ সমুদ্র-বাণিজ্যের চিত্র পাওয়া যায়। আল ইদ্রিসি, সোলায়মান, মাসুদি, ইবন খুর্দাদবে প্রমুখদের
বিবরণে চট্টগ্রাম এলাকায় আরবদের প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের বাণিজ্যিক
সমৃদ্ধির চিত্র আরবদের বিবরণের ওপরই নির্ভরশীল।
বিদেশীদের বিবরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই যে, বিদেশীরা এদেশীয় রাজনীতি নিয়ে কিছু না
লিখলেও তাঁদের লেখায় সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এমন অনেক দিক ধরা পড়েছে যা দেশীয় সূত্রে
অনুপস্থিত। ফলে বিদেশী বিবরণে তথ্য কম থাকলেও, তাদের গুরুত্ব অপরিসীম।


ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, গ্রন্থাকারে লিখিত উৎসে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস খুব কমই পাওয়া
যায়। যাও পাওয়া যায় তা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং অপর্যাপ্ত। সেই কারণেই ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য আমরা
প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানের ওপর অধিক নির্ভরশীল।
প্রতœতাত্তি¡ক উপাদান
অভিলেখমালা ঃ প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানসমূহের মধ্যে অভিলেখমালাই প্রধান। আবার বিভিন্ন ধরনের অভিলেখ
পাওয়া গিয়েছে। তবে এদের মধ্যে তাম্রফলকে উৎকীর্ণ ভ‚মি লেনদেন সংক্রান্ত দলিলাদি, যা সাধারণভাবে
তাম্রশাসন বলে অভিহিত হয়, সংখ্যায়ও বেশি এবং ইতিহাসের উৎস হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাম্রশাসন
ছাড়া রয়েছে বহু মূর্তিলিপি।প্রস্তরখন্ডে উৎকীর্ণ বেশ কিছু লিপির মধ্যে রয়েছে প্রশস্তিগাঁথা ও বিভিন্ন
স্মারকলিপি।এইসব অভিলেখমালায় বিধৃত তথ্য থেকেই পুনর্গঠিত হয়েছে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের মূল
কাঠামো।
অভিলেখমালা সম্বন্ধে আলোচনার প্রারম্ভেই উল্লেখ করতে হয় বাংলার প্রাচীনতম লিপিটির। বগুড়া জেলার
মহাস্থানে প্রতœতাত্তি¡ক খননে একটি প্রস্তরখন্ডে ব্রাহ্মি লিপিতে উৎকীর্ণ অভিলেখটিই বাংলার প্রাচীনতম লিপি
প্রমাণ। সম্রাট অশোকের সময়কার ব্রাহ্মি লিপির সাথে এই অভিলেখটির লিপির মিল থাকায় পন্ডিতগণ একে
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর বলে সনাক্ত করেছেন। এই লিপিতে পুন্ড্রনগরের মহামাত্রের প্রতি রাজকীয় আদেশ
লিপিবদ্ধ রয়েছে। আদেশে জনকল্যাণমুখী শাসনের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এই লিপি প্রাপ্তি থেকেই মনে
করা হয় যে, বাংলার উত্তরাংশ মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকেই পুন্ড্রনগর
(মহাস্থান) ছিল এই অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিলেখসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাম্রশাসন। এগুলোতে উৎকীর্ণ
রয়েছে ভ‚মি লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় বা দান সংক্রান্ত তথ্যাদি, যা রাজকীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত বা রাজা কর্তৃক
প্রকাশিত। সব তাম্রশাসনেই উল্লেখিত হয়েছে রাজার ‘জয়স্কন্ধভার' বা রাজধানীর নাম, যেখান থেকে
তাম্রশাসন অনুমোদন লাভ করতো বা প্রকাশিত হতো। ভ‚মির অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখিত হয়েছে
প্রশাসনিক স্তরসমূহ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ। অধিকাংশ তাম্রশাসনে ভ‚মি সংক্রান্ত তথ্যাদি উল্লেখের
আগে এবং তাম্রশাসনের প্রারম্ভেই স্থান পেয়েছে রাজপ্রশস্তি। রাজাদের সভাকবি কর্তৃক রচিত প্রশস্তিতে
রাজার এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের গুণকীর্তন করা হয়েছে। কাব্যাকারে রচিত এই প্রশস্তিতে কবি রাজাদের
কৃতিত্বকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন ঠিকই। তা সত্তেও অতিরঞ্জিত বক্তব্যের মধ্যেই ধরা পড়েছে
ঐতিহাসিক সত্য। আধুনিক ঐতিহাসিককে এই অতিরঞ্জিত বক্তব্য থেকে সত্য উদ্ঘাটনে সতর্ক থাকতে
হয়; বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে এবং অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদির সাথে মিলিয়ে পুনর্গঠন করতে হয় প্রাচীন
যুগের ইতিহাস।তাম্রশাসনসমূহের প্রশস্তি অংশই প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের প্রধান উপকরণ, একথা বললেও
বোধ হয় ভুল হবে না। মোট কথা, তাম্রশাসনসমূহে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যই প্রাচীন যুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে
মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেছে।
তাম্রশাসনের প্রশস্তি ছাড়াও কিছু প্রশস্তি প্রস্তর খন্ডে বা স্তম্ভে উৎকীর্ণ হয়েছে। বাদল স্তম্ভলিপিতে বিধৃত
রয়েছে পাল সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপাল-এর সময়কার মন্ত্রীপরিবারের কীর্তিগাঁথা। তেমনি দেওপাড়া প্রশস্তি
আমাদের জন্য রয়েছে সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়সেনের কৃতিত্বের বিস্তারিত বিবরণ।
মূর্তিলিপি বা স্মারকলিপি সমূহে খুব সামান্য তথ্যই থাকে। মূর্তি তৈরি বা কোন সৌধ/মন্দির নির্মাণের কাল
এবং ঐ সময়ের রাজার নাম হয়তো এইসব লিপিতে থাকে, রাজাদের কাল নির্ণয়ে তা কিছুটা সাহায্য করে।
তবে বাংলার প্রাচীন যুগের লিপিসমূহের একটা বৈশিষ্ট্য এ ব্যাপারে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। বাংলার
অভিলেখসমূহে সময়কাল উল্লেখিত হয়েছে রাজাদের রাজ্যাঙ্কে, কোন নির্দিষ্ট সনে নয়। তাই রাজাদের
সময়কাল নির্ধারণে অনেক ক্ষেত্রেই লিপিতাত্তি¡ক বিচারের সাহায্য নিতে হয়।


(খ) মুদ্রা
বাংলার প্রাচীন যুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে মুদ্রা সাহায্যকারী ভ‚মিকা পালন করে। মৌর্য যুগ থেকে এই অঞ্চলে
ছাপাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন ছিল। কুষাণ-পরবর্তী যুগ থেকে ছাঁচে ঢালা মুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। সমগ্র বাংলার
বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত সম্রাটদের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা বিপুল সংখ্যায় আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলার সম্রাট শশাঙ্কের
আমলের ও স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বেশ কিছু স্থানীয় রাজাদের রৌপ্য
মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলার পাল বা সেন বংশের রাজাদের কোন মুদ্রা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত
হয়নি।
মুদ্রা সার্বভৌমত্বের পরিচয় বহন করে। তবে যুগের অর্থনৈতিক অবস্থার সূচক হিসেবে মুদ্রাকে ধরা যায়।
গুপ্ত যুগে বাংলার সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় ঐ যুগের বিপুল সংখ্যক মুদ্রা প্রাপ্তি থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়
রৌপ্য মুদ্রা প্রাপ্তিও ঐ অঞ্চলের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিরই পরিচয় বহন করে। বাণিজ্যের মাধ্যমেই সোনা বা রূপা
আসতো, আর তা দিয়েই মুদ্রা তৈরি করা হতো। বড় আকারের বাণিজ্যিক লেনদেনে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রার
ব্যবহার হতো। সাধারণ কেনা বেচায় ব্যবহৃত হতো কড়ি। এ দেশের অর্থনীতিতে কড়ির ব্যবহার বহু দিন
পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
পাল-সেন শাসনামলের মুদ্রার অনুপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কথাই বলা যায় যে, ঐ সময়ে বাংলার
অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর, বহির্বিশ্বের সাথে তেমন একটা বাণিজ্য ছিল না। অন্তর্ভারতীয় যে বাণিজ্য ছিল তা
সম্ভবত পূর্বের স্বর্ণ বা রৌপ্য বা রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহার করেই চলতো। পাল বা সেন রাজারা নিজেদের মুদ্রা
জারি করার প্রয়োজনবোধ করেননি। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বহির্বাণিজ্যের যে
পরিচয় আরবদের লেখনি থেকে পাওয়া যায়, তারই সমর্থন মেলে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত রৌপ্য মুদ্রা থেকে।
তবে একথা বলতেই হয় যে, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে মুদ্রা সম্পূরক ভ‚মিকা পালন করে।
(গ) প্রতœতাত্তি¡ক ধ্বংসাবশেষ
প্রতœতাত্তি¡ক উদ্ঘাটনের ফলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এখন অনেক সমৃদ্ধ। বিগত অর্ধশতাব্দীর অধিক সময়ে
বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় প্রতœতাত্তি¡ক উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রতœস্থল। এসব আবিষ্কার বাংলার প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাসের
অনেক নতুন উপকরণ সংযোজন করেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রতœতাত্তি¡ক ধ্বংসাবশেষ অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বর্তমান বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রতœতাত্তি¡ক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বগুড়া জেলার মহাস্থান, নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর,
নরসিংদী জেলার ওয়ারি-বটেশ্বর এবং কুমিল্লা জেলার ময়নামতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহাস্থানে আবিষ্কৃত
হয়েছে বাংলার প্রাচীনতম নগর- পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী
পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে মহাস্থানে প্রাপ্ত বিভিন্ন
প্রতœসামগ্রীতে।করতোয়া নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ নগরসভ্যতা।বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের
জীবনযাত্রার অনেক ইঙ্গিতই মেলে মহাস্থানের ধ্বংসাবশেষে। প্রাচীন যুগের শিল্পকলা- ভাস্কর্য, পোড়ামাটির
ফলক, স্থাপত্য- নিদর্শনাদি উৎঘাটিত হয়েছে এই প্রতœস্থলে।
পাহাড়পুরে উদ্ঘাটিত হয়েছে পাল সম্রাট ধর্মপালের কীর্তি সোমপুর মহাবিহার। এই বৌদ্ধ বিহারটি ভারতীয়
উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ বিহার। এই বিহারের স্থাপত্য পরিকল্পনা ও নির্মাণশৈলী ঐ যুগের শৈল্পিক উকর্ষের
প্রমাণ বহন করে। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকসমূহ এক দিকে যেমন বাংলায় এই শিল্পের চরম
উৎকর্ষের প্রমাণ, অন্যদিকে এই ফলকসমূহে বিধৃত রয়েছে আবহমান বাংলার জনজীবনের চিত্র। এই দিক
থেকে এ ফলকসমূহ ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ উপাদান। জনজীবনের চিত্র অন্যান্য উৎসে খুবই বিরল।
ওয়ারী-বটেশ্বরে ইদানিং কিছু প্রতœানুসন্ধানে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, এখানেও প্রাচীন যুগের মানব সভ্যতার
নিদর্শনাদি রয়েছে।


বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রতœস্থল ময়নামতি। লালমাই পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছিল
এক বিশাল বৌদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্র, সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে। লালমাই-ময়নামতি
এলাকায় প্রতœ খননের ফলে উদ্ঘাটিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষÑ শালবন বিহার,
আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার প্রমুখ। খড়গ, দেব ও চন্দ্র বংশীয় রাজাদের কীর্তিসমূহ আমাদের ইতিহাসে
সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা।তাম্রশাসনাদিতে উল্লেখিত দেব বংশীয় রাজাদের রাজধানী শহর ‘দেবপর্বত'-
এর অবস্থান যে লালমাই এলাকাতেই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, তবে এখনও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা
সম্ভব হয়নি এর অবস্থান। ময়নামতির প্রতœসামগ্রী বাংলার ইতিহাসে, তথা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ইতিহাসে
অনেক নতুন তথ্য সরবরাহ করেছে, যার ফলে এই অঞ্চলের ইতিহাস এখন অনেকখানি স্পষ্ট, অনেকখানি
বিস্তারিত।
পশ্চিম বাংলার প্রতœস্থলসমূহের মধ্যে বাকুড়া জেলার পান্ডুরাজার ঢিবি, মেদেনীপুর জেলার তমলুক, উত্তর
চব্বিশ পরগণার চন্দ্রকেতুগড়, মালদা জেলার জগ্জীবনপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়ীডাঙ্গা আর পশ্চিম
দিনাজপুর জেলার বাণগড় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পান্ডুরাজার ঢিবিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তাম্রপ্রস্তর যুগের
সভ্যতার নিদর্শন। তমলুকের প্রতœনিদর্শানাদিকে সনাক্ত করা হয়েছে প্রাচীন বন্দরনগরী তাম্রলিপ্তির বলে।
তাম্রলিপ্তিকে অনেকেই গ্রিক-লাতিন লেখনির ‘গাঙ্গে' বন্দর বলে মনে করেন। চন্দ্রকেতুগড় ধরে রেখেছে
বাংলার ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ের নগর সভ্যতার নিদর্শন। বাণিজ্য-ভিত্তিক সমৃদ্ধির ওপর গড়ে উঠেছিল
এই নগর, যার ছায়ায় বিকাশ লাভ করেছিল শিল্পকলার বিভিন্ন দিক। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পোড়ামাটির
শিল্পনিদর্শনাদি বিস্ময়কর উৎকর্ষের প্রমাণ বহন করে। জগ্জীবনপুরে পাল যুগের একটি তাম্রশাসনসহ বৌদ্ধ
সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন অধুনা আবিষ্কৃত হয়েছে।রাজবাড়ীডাঙ্গায় আবিষ্কৃত হয়েছে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের
ধ্বংসাবশেষ, আর তারই উপকণ্ঠে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ। বাণগড়ের ধ্বংসাবশেষ বহন করেছে প্রাচীন
‘বিষয়'-এর অধিষ্ঠান কোটিবর্ষ নগরের চিহ্ন।
এই সব প্রতœস্থান উদ্ঘাটনের ফলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের কঙ্কালসার কাঠামোতে সংযোজিত হয়েছে
রক্ত-মাংস। অন্যান্য প্রতœতাত্তি¡ক এবং লিখিত উপাদান থেকে আহরিত তথ্যাদির ওপর নির্ভর করে যে
ইতিহাস পুনর্গঠিত হয়েছে তা অনেকটা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে প্রতœ খননে প্রাপ্ত নিদর্শনাদির আলোকে।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এখন অনেকটা স্পষ্ট। তবে স্থান বিশেষে যে এখনও অস্পষ্টতা বিরাজ করছে, সে
কথা স্বীকার করতেই হয়।
(খ) সুলতানি যুগের ইতিহাসের উৎস
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আগমনের পর ইতিহাসের উৎসের অভাব অনেকাংশে কমেছে। মুসলমান
শাসকগণ তাঁদের কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধকরণের দিকে যথেষ্ট যতœবান ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ
করে অনেকেই রচনা করেছেন ঘটনাপঞ্জি। এই সব রচনা প্রকৃত অর্থে ইতিহাস না হলেও, এদের মধ্যে ধরা
পড়েছে অনেক তথ্য যা ইতিহাস পুনর্গঠনে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস
শাস্ত্রেরও বিকাশ ঘটেছিল ভারতবর্ষে। সুতরাং মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে এসব লেখনি অত্যন্ত মূল্যবান
উপাদান।বাংলার সুলতানি যুগের ইতিহাস রচনায় দিল্লিতে লেখা গ্রন্থাদি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত।
তাছাড়া স্থানীয়ভাবে রচিত বাংলা সাহিত্য থেকেও ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়।এদের সাথে
সাহায্যকারী ভ‚মিকা পালন করে বিদেশীদের বিবরণ। গ্রন্থাকারে লিখিত উপাদান ছাড়াও সুলতানি যুগের
ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায় সে যুগের লিপিমালায় এবং মুদ্রায়।আমরা আলোচনার সুবিধার্থে
সুলতানি যুগের ইতিহাসের উৎসসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একে একে আলোচনা করবো।
দিল্লিতে রচিত ঘটনাপঞ্জি ও ইতিহাস
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাসের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় দিল্লি
কেন্দ্রিক ফার্সি ভাষায় রচিত গ্রন্থাদির ওপর। দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহ্মুদের শাসনামলে রচিত
মিনহাজ-উস-সিরাজের ‘তাবকাৎ-ই-নাসিরি' গ্রন্থে বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয় থেকে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ


পর্যন্ত সময়ের তথ্য পাওয়া যায়। মিনহাজের গ্রন্থটি সামগ্রিকভাবে ইসলামী বিশ্বের ইতিহাস। সেই
প্রেক্ষাপটে ভারতে ইসলামের বিস্তার এবং সেই সূত্র ধরে বাংলায় মসলিম শাসন বিস্তার তাঁর গ্রন্থে স্থান
পেয়েছে। মিনহাজ স্বল্পকালের জন্য বাংলায় এসেছিলেন, তবে দিল্লিতে বসেই তিনি তাঁর গ্রন্থটি রচনা
করেছিলেন। বখতিয়ারের বাংলা বিজয় এবং তদ্পরবর্তী খলজী মালিকদের ইতিহাসের জন্য মিনহাজই
একমাত্র উৎস। যেহেতু তিনি দিল্লির সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন, সেহেতু দিল্লির সুলতানের
পক্ষ অবলম্বন তাঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। দিল্লি-বাংলা দ্বন্দে¡র ক্ষেত্রে তিনি দিল্লির পক্ষেই কথা বলেছেন।
মিনহাজের বর্ণনায় অনেক অস্পষ্টতা এবং ভুলভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। এতদ্সত্বেও ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
সময়ের জন্য মিনহাজই একমাত্র উৎস। হাসান নিজামি রচিত ‘তাজুল মাসির' গ্রন্থে কুতুবউদ্দিন আইবকের
সময়ের কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও বাংলার ইতিহাসের জন্য তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাংলার তথা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের জন্য জিয়াউদ্দিন বারাণী রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী' গ্রন্থটি
অত্যন্ত মূল্যবান উৎস। বারাণী গ্রন্থ রচনায় দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ
করেছিলেন। এ গ্রন্থে ১২৬৬ থেকে, অর্থাৎ বলবনের রাজত্বকাল থেকে ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম
সাত বছরের (১৩৫৭ পর্যন্ত) ইতিহাস স্থান পেয়েছে। দিল্লি সালতানাতের ইতিহাস লেখাই ছিল বারাণীর
মুখ্য উদ্দেশ্য। সেই সূত্রে দিল্লির সাথে বাংলার বিরোধের তথ্যাদি বারাণীর গ্রন্থে ধরা পড়েছে। বলবনের
বাংলা আক্রমণ ও তদ্পরবর্তী সময়ে বাংলার ঘটনাবলি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের বাংলা আক্রমণ, মুহাম্মদ
বিন তুঘলকের নেয়া বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ফিরোজ তুঘলকের সাথে বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের
সংঘর্ষ প্রভৃতি বিষয়ে বারাণীর গ্রন্থই প্রধান উৎস। তবে বারাণীর ইতিহাসে কিছুটা আধুনিক ঐতিহাসিক
দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ করা গেলেও তিনি যে দিল্লির পক্ষের লোক এ কথা তিনি কখনও ভুলে যাননি। তবে তাঁর
সময়ের ইতিহাসের জন্য আমরা তাঁর কাছে ঋণী। অবশ্য বারাণীর সমসাময়িক ঐতিহাসিক শামস্-ই-সিরাজ
আফিফ রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী' গ্রন্থেও অনেক সম্পূরক তথ্য পাওয়া যায়।
আমীর খসরু রচিত ‘কিরান-উস-সাদাইন' গ্রন্থে বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ ঘটনা স্থান পেয়েছে। এ
কথা সবারই জানা যে, আমীর খসরুর প্রতিটি রচনাই এক একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ওপরে
উল্লেখিত গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল বাংলার সুলতান বুঘরা খান ও তাঁর ছেলে কায়কোবাদের মধ্যে বিরোধ এবং
বিরোধ অবসানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সুলতান বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান দিল্লির সিংহাসন
অধিকারের আহŸান প্রত্যাখ্যান করে বাংলাতেই থেকে যান, দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন বুঘরা খানেরই
পুত্র কায়কোবাদ। পুত্র দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকায় বুঘরা খান নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন।
কিন্তু পুত্র প্রাদেশিক শাসনকর্তা পিতার স্বাধীন আচরণ মেনে নিতে অস্বঈকার করেন এবং পিতাকে বশে
আনার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ যাত্রা করেন। পিতাও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যান।
বিহারের সরজু নদীর তীরে পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎ হয়। পরে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়। এই ঘটনাকে
বিষয়বস্তু করে রচিত হয়েছিল আমীর খসরুর ‘কিরান-উস-সাদাইন' গ্রন্থ।বুঘরা খান ও কায়কোবাদের মধ্যে
এই সংঘর্ষের একমাত্র সূত্র আমীর খসরুর এই গ্রন্থ।
বাংলায় স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে।ইলিয়াস শাহ কর্তৃক স্বাধীন সুলতানি দৃঢ়ভাবে
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলা দীর্ঘকাল স্বাধীনতা ভোগ করে, দিল্লির সাথে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে।
ফলে দিল্লিতে লেখা ইতিহাসে বাংলা সম্বন্ধে তথ্য তেমন আর পাওয়া যায় না। বাংলার স্বাধীনতার সমাপ্তি
ঘটে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে, শেরশাহ সুরের বাংলা অধিকার করার মধ্যদিয়ে। শের শাহের বাংলা অধিকারের
ইতিহাস পাওয়া যায় আব্বাস শেরওয়ানীর ‘তারিখ-ই-শেরশাহী' গ্রন্থে।
মুঘল যুগের বিভিন্ন গ্রন্থে বাংলার সুলতানি যুগের ঘটনাবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আবুল
ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী' ও ‘আকবরনামাহ', নিজামউদ্দিন আহমদ বখশীর ‘তাবাকাৎ-ই-আকবরী'
ইত্যাদি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। মুগল যুগের লেখকগণ সমসাময়িক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে পূর্বের
ঘটনাবলির জের টেনে সুলতানি যুগের অনেক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তাদের কাছে এমন অনেক গ্রন্থ বা


সূত্র ছিল যার ভিত্তিতে তারা ঐসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আমাদের কাছে ঐসব সূত্র এসে পৌঁছায়নি।
তাই মুগল যুগের ইতিহাস গ্রন্থাদিতে সুলতানি যুগের বাংলার ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলার ভ‚খন্ডে সুলতানি যুগে বা মুগল যুগে এমন কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি যার মধ্যে সুলতানি যুগের ইতিহাস
ধরা পড়েছে। পলাশীর যুদ্ধের ২১ বছর পর ফার্সি ভাষায় রচিত গোলাম হোসেন সলিমের ‘রিয়াজ-উসসালাতীন'-ই প্রথম গ্রন্থ যার মধ্যে বাংলার মুসলিম শাসনামলের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইংরেজ
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জর্জ উড্নীর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর মুনশী গোলাম হোসেন সলিম ‘রিয়াজউস-সালাতীন' রচনা করেছিলেন বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ ও গ্রন্থাদির ভিত্তিতে, যেগুলো তাঁর সময়ে ছিল।
সেসব সূত্রের অনেকগুলোই আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। সলিম বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা থেকে
তাঁর সময়কাল পর্যন্ত অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী
হয়েছিলেন। তবে তথ্যের অভাবের কারণে জায়গায় জায়গায় তিনি স্পষ্ট বা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করতে
পারেননি। সলিমের কাছাকাছি সমাজের জন্য ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন' অনেক মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে।
তবে পূর্বের ঘটনার জন্য রিয়াজে প্রাপ্ত তথ্য কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য যখন অন্য কোন সূত্র থেকে সমর্থন
পাওয়া যায়। এসব দুর্বলতা থাকা সত্তে¡ও ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন' বাংলার ইতিহাসের একটি আকর গ্রন্থ
হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
স্থানীয় সাহিত্য
সুলতানি বাংলার দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি। তবে সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। মুসলমান সুলতানদের
পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এ যুগে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিশেষ করে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা ও
দিল্লির সাথে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কচ্ছেদের পর সুলতানগণ এদেশের জনগণের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে উদার
শাসননীতির প্রবর্তন করেন। এই উদার শাসননীতির ক্রমধারায় তাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন এদেশীয়
ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে। ফলে সুলতানি যুগের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় বাংলা সাহিত্যের বিকাশ।
হিন্দু-বৌদ্ধ শাসনামলে এদেশের জনগণের ভাষায় সাহিত্যের বিকাশ ঘটতে পারেনি; রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা
পেয়েছে দেবভাষা সংস্কৃত। বাংলার সুলতানি যুগে তাই হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অবদানের ফলে
বাংলা ভাষায় যে অসংখ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে তাতে ধরা পড়েছে সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক ইতিহাসের অনেক তথ্য। মঙ্গল কাব্যে বিধৃত সমাজচিত্র, বা মুসলিম সাহিত্যে তদানীন্তন ইসলাম
সম্পর্কিত তথ্য ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। ধর্মীয়-সামাজিক ইতিহাসের জন্য এসব সাহিত্যিক উপকরণের
মূল্য অপরিসীম।
বিদেশী বিবরণ
সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিদেশীদের বর্ণনাও গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যায় কম হলেও কয়েকটি
বিদেশী বিবরণ পাওয়া যায় তাতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা দেশীয়
সূত্রে বিরল। এ কারণেই বিদেশী বিবরণের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৩৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এসেছিলেন
মরক্কোর বিশ্ব-পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি অবশ্য দিল্লিতে এসেছিলেন ১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে; উত্তর ভারতে
বেশ কিছুকাল অবস্থান করে দক্ষিণ ভারত হয়ে তিনি বাংলায় এসেছিলেন সমুদ্রপথে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর
হয়ে সোনারগাঁয়ে আসেন, সেখান থেকে যান সিলেটে বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রাঃ)-এর
সাথে দেখা করতে। সিলেটে কিছুকাল অবস্থান করে সোনারগাঁয়ে এসে এক চীনা নৌযানে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন। এই স্বল্পকালীন বাংলা সফরের বর্ণনা রয়েছে তাঁর ‘রেহালা'তে। ইবনে
বতুতা যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, তেমনি অবাক হয়েছিলেন বাংলার সুলভ
জীবনযাত্রা দেখে। বাংলার বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্যের উল্লেখ রয়েছে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে। নদীপথে ভ্রমণের
সময় ডাকাতের ভয়ের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন, তেমনি উল্লেখ করেছেন হাটে-বাজারে ছেলেমেয়ে
ক্রয়-বিক্রয়ের কথা।বাংলার আবহাওয়া তাঁর ভাল লাগেনি। তাই বাংলাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন,
‘দোযখ-আজ পুর-ই-নিয়ামত' (নিয়ামতপূর্ণ দোযখ) বলে। ইবনে বতুতার বিবরণে যে ধরনের আর্থ-


সামাজিক তথ্য রয়েছে তা দেশীয় উপাদানে অনুপস্থিত। সেই কারণেই তাঁর বিবরণ এতো গুরুত্বপূর্ণ বলে
বিবেচনা করা হয়।
পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চীনের সাথে বাংলার সুলতানদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এবং
বেশ কয়েকবার দূত বিনিময় হয়েছিল। চীনা দূতদের সাথে দোভাষী হিসেবে চার বার বাংলায় এসেছিলেন
মা-হুয়ান। ফিরে গিয়ে মাহুয়ান তাঁর বাংলার অভিজ্ঞতা লিখে রেখে গেছেন। এই বিবরণ তদানীন্তন বাংলার
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বেশভ‚ষা, রীতিনীতি, আমোদ-প্রমোদ, কৃষি
উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায় মা-হুয়ানের বিবরণে। তবে এই
বিবরণে কেবল স্থান পেয়েছে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর কথা, কারণ মা-হুয়ান উচ্চ শ্রেণীর সাথেই মেশার
সুযোগ পেয়েছিলেন। আংশিক হলেও মা-হুয়ানের দেওয়া তথ্য সেই সময়কার আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের
অতি মূল্যবান উপাদান।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে লিখিত পর্তুগিজ টোমে পিরেজের ‘সুমা ওরিয়েন্টালা' গ্রন্থে বাংলা সম্বন্ধে,
বিশেষ করে বাংলার ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। তেমনি বারবোসার বিবরণেও
অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন বাংলার ইতিহাসে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।বাংলার অর্থনীতিতে ইউরোপীয়দের আগমন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ষোড়শ
শতাব্দীতে বাংলায় পর্তুগিজদের অবস্থান বাংলার বাণিজ্যে যেমন প্রভাব রেখেছে, তেমনি বাংলার সমাজসংস্কৃতিতে, কৃষিতে, ভাষা ও সাহিত্যে পর্তুগিজদের প্রভাবের কথা সবাই স্বীকার করেছেন। ফলে
পর্তুগিজদের লেখনিসমূহ বাংলার ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, গ্রন্থাকারে রচিত সাহিত্যিক উপকরণকে ভিত্তি করেই মূলত
সুলতানি যুগের ইতিহাস পুনর্গঠিত হয়েছে। তবে প্রতœতাত্তি¡ক উপাদান থেকেও যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া যায়।
প্রতœতাত্তি¡ক উপাদানের মধ্যে এ যুগের ইতিহাসে মুদ্রার ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লিপিমালারও সাহায্যকারী
ভ‚মিকা রয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতœস্থল থেকেও ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
মুদ্রা
বখতিয়ার খলজী থেকে শুরু করে সুলতানি যুগের শেষ পর্যন্ত প্রায় সব সুলতানেরই মুদ্রা বাংলার বিভিন্ন
জায়গা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এই মুদ্রার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়েছে বাংলার সুলতানদের
কালানুক্রম এবং রাজত্বকাল। এক্ষেত্রেই মুদ্রার ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশি। মুসলমান শাসকদের মুদ্রায় উৎকীর্ণ
থাকে সন-তারিখ, শাসকদের উপাধি ও টাকশালের নাম। অনেক সময় কোন বিশেষ বিজয় বা ঘটনাকে
উদ্দশ্য করেও মুদ্রা জারি করা হতো। মুদ্রায় অনেক সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা বিভাগেরও উল্লেখ পাওয়া
যায়। মুদ্রায় প্রাপ্ত তথ্যসমূহের প্রমাণিকতা সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না। খিলাফতের প্রতি
বাংলার সুলতানদের মনোভাব অনেক সময় মুদ্রায় উৎকীর্ণ উপাধি থেকে অনুমান করা সম্ভব।
তাছাড়া মুদ্রার ভিত্তিতে সমসাময়িক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। মুদ্রার ওজন, মুদ্রায়
ব্যবহৃত সোনা বা রূপার মান এবং প্রাপ্ত মুদ্রার সংখ্যা থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া।
টাকশালের নাম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়।
লিপিমালা
বাংলার সুলতানি যুগের অধিকাংশ লিপিই প্রস্তরখন্ডে উৎকীর্ণ নির্মাণ-স্মারক লিপি।মসজিদ বা মাদরাসা
নির্মাণের স্মৃতিবহনকারী লিপিসমূহে নির্মাতাদের নাম ও নির্মাণের সময়কাল, অবস্থানের প্রশাসনিক পরিচয়,
নির্মাতাদের পদবী এবং উপাধি সব তথ্যই ইতিহাস পুনর্গঠনে সাহায্য করে।এই লিপিমালায় ঐ যুগের
একটি বিশেষ শিল্পের উৎকর্ষেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম শাসনকালে হস্তলিপি শিল্পের বিশেষ বিকাশ
ঘটে। আর এই বিকাশের সাক্ষ্য রয়েছে অসংখ্য লিপিতে। বাংলার ভ‚ভাগে বিশেষ কিছু লিপিরীতিরও উন্মেষ
ঘটেছিল; তার মধ্যে তীর-ধনুকের আকৃতিকে ভিত্তি করে বাংলার তুঘরা রীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।


ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতœস্থল
সুলতানি যুগের অনেক নগরই আজ আর তাদের আদিরূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। ধর্মীয় স্থাপত্য ছাড়া অন্যান্য
স্থাপত্য কর্ম আজ প্রায় বিলীন হবার পথে। গৌড়-লখনৌতি, পান্ডুয়া বা সোনারগাঁ সবই আজ স্মৃতি।
মধ্যযুগীয় আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ আজ আর চোখে পড়ে না। ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই খুঁজতে হয় অতীতকে।
বিদেশী বা দেশীয় লেখনিতে এককালের সমৃদ্ধ নগরের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা আর মিলবে না আজকের
ধ্বংসপ্রাপ্ত অবয়বের সাথে। তবুও ধ্বংসের মধ্যেই ঐতিহাসিকরা খুঁজে বেড়ান অতীতের উপাদান।
তবে সুলতানি যুগের ধর্মীয় স্থাপত্যের বেশ কিছু নিদর্শন এখনও বিদ্যমান। মুসলিম শাসনকালের
স্থাপত্যশিল্পের চরম উৎকর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায় এদের মধ্যেই। গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ, ছোট সোনা
মসজিদ, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বা সোনারগাঁর সন্নিকটে গোয়াল্দী মসজিদÑ সবই শিল্পকলার
উৎকর্ষের পরিচায়ক।
উপসংহারে একথা বলা যায় যে, সুলতানি যুগের ইতিহাস বহুলাংশে দিলি কেন্দ্রিক লিখিত উপাদানের ওপর -
নির্ভরশীল। বাংলার সুলতানদের দরবারে ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের কোন প্রচেষ্টাই লক্ষ করা যায় না। তাই
হয়তো প্রথম দিকে অনেকটা দিল্লির চোখ দিয়ে বাংলার ইতিহাসকে দেখতে হয়। স্থানীয় সাহিত্যের
বিকাশের ফলে এই অভাব কিছুটা দূর হলেও, সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। তাই জায়গায়
জায়গায় এ যুগের ইতিহাসেও রয়েছে অস্পষ্টতা। লিপি প্রমাণ বা মুদ্রার সাক্ষ্যে এই অস্পষ্টতা কিছুটা দূর
হলেও, একেবারে কাটেনি।


সারসংক্ষেপ
প্রাচীন ভারতের ন্যায় বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনও কষ্টসাধ্য। এর প্রধান কারণ উপাদানের স্বল্পতা।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস প্রতœতাত্তি¡ক উৎসের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল। গ্রন্থাকারে লিখিত উপাদান
যেটুকু আছে তা একান্তই অপর্যাপ্ত এবং ধর্ম-সামাজিক ভিত্তিক। তাই গ্রন্থাকারে লিখিত উৎসের ওপর
নির্ভরশীল হলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস খুব কমই জানা যেতো। এ জাতীয় উৎসের মধ্যে
‘রামচরিতম্' বিখ্যাত। দ্ব্যর্থবোধক এ কাব্যগ্রন্থটিতে পাল ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিধৃত
রয়েছে। গ্রিক ও লাতিন লেখনি, চৈনিক বর্ণনা এবং আরব ভৌগোলিক ও বণিকদের বিবরণও প্রাচীন
বাংলার ইতিহাসের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে আলোকপাত করে। এসকল বিদেশীর বিবরণে বাংলার
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্র ধরা পড়েছে। প্রতœতাত্তি¡ক উৎসের মধ্যে তাম্রশাসনই বাংলার ইতিহাসের
প্রধান অবলম্বন। এছাড়া মুদ্রা, ধ্বংসাবশেষ, শিলালিপি ইত্যাদিও বিশ্বস্তভাবে তথ্য সরবরাহ করে।
মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলতানি আমলে ‘ইতিহাস' রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মূলত
দিল্লিকেন্দ্রিক এসকল রচনার মধ্যে তাবাকাৎ-ই-নাসিরি, তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, কিরান-উস-সাদাইন
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্বেও এ সকল রচনা থেকে বাংলার সুলতানি আমলের
উৎস সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া মুদ্রা, লিপিমালা ও বিদেশীদের বিবরণেও গুরুত্বপূর্ণ
তথ্য রয়েছে। স্থানীয় সাহিত্য থেকেও আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের তথ্য মেলে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। ‘অর্থশাস্ত্র' রচয়িতার নাম কি?
(ক) মেগাস্থিনিস (খ) বাণভট্ট
(গ) আনন্দভট্ট (ঘ) কৌটিল্য।
২। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত কাব্যের নাম কি?
(ক) ইন্ডিকা (খ) হর্ষচরিত
(গ) রামচরিত (ঘ) বল্বালচরিত।
৩। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত' কাব্যের সংকলক কে?
(ক) শ্রীধর দাস (খ) বিদ্যাকর
(গ) গোবর্ধন (ঘ) শরণ।
৪। বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম লিপি-প্রমাণ কোনটি?
(ক) খালিমপুর লিপি (খ) বাদল লিপি
(গ) দামোদরপুর লিপি (ঘ) মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি।
৫। ‘ওয়ারি বটেশ্বর' প্রতœস্থল কোথায় অবস্থিত?
(ক) রাজশাহী জেলায় (খ) নরসিংদী জেলায়
(গ) কুমিল্লা জেলায় (ঘ) ঢাকা জেলায়।
৬। ‘রক্তমৃত্তিকা বিহার' কোথায় পাওয়া গেছে?
(ক) রাঙ্গামাটিতে (খ) রাজবাড়ীডাঙ্গায়
(গ) লালমাই পাহাড়ে (ঘ) ময়নামতিতে।
৭। আমীর খসরু রচিত গ্রন্থের নাম কি?
(ক) কিরান-উস-সাদাইন (খ) তাবাকাৎ-ই-নাসিরি
(গ) তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (ঘ) তাজুল মাসির।
৮। ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন' রচয়িতা কে?
(ক) মিনহাজ-উস-সিরাজ (খ) জিয়াউদ্দিন বারাণী
(গ) গোলাম হোসেন সলিম (ঘ) শামস্-ই-সিরাজ আফীফ।
৯। কোন পর্যটক হযরত শাহজালাল (রাঃ) সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন?


(ক) মা-হুয়ান (খ) ইবনে বতুতা
(গ) সোলায়মান (ঘ) আল-ইদ্রিসী।
১০। টোমে পিরেজের বিবরণে কোন সময়ের তথ্য পাওয়া যায়?
(ক) ত্রয়োদশ শতাব্দীর (খ) চতুর্দশ শতাব্দীর
(গ) পঞ্চদশ শতাব্দীর (ঘ) ষোড়শ শতাব্দীর।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎস হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব বর্ণনা করুন।
২। পশ্চিমবাংলার প্রতœস্থলসমূহের বিবরণ দিন।
৩। সুলতানি যুগে বাংলা সাহিত্যের বিকাশের কারণ নির্ণয় করুন।

রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গ্রন্থাকারে লিখিত উৎসের গুরুত্ব নিরূপণ করুন।
২। প্রাচীন যুগে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসসমূহ পর্যালোচনা করুন। এ সকল উৎসের সীমাবদ্ধতা
চিহ্নিত করুন।
৩। সুলতানি যুগে বাংলার ইতিহাসে বিদ্যমান উৎসগুলোর গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা মূল্যায়ন করুন।
৪। দিল্লিতে রচিত গ্রন্থের ভিত্তিতে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে
হয়? এক্ষেত্রে বিদেশীদের বর্ণনা কিভাবে সাহায্য করতে পারে?
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ইবহমধষ.
২। ঝযধযধহধৎধ ঐঁংধরহ, ঊাবৎুফধু খরভব রহ ঃযব চধষধ ঊসঢ়রৎব.
৩। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)
৪। আবদুর রহিম, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]