শশাঙ্ক পরবর্তী বাংলায় অরাজকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে গোপাল বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন
এবং পালবংশের শাসনের সূচনা করেন। গোপালের ক্ষমতা লাভ সম্বন্ধে খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে জানা
যায়। সেখানে বলা হয়েছে Ñতাঁর ছেলে শ্রীগোপালকে, যিনি রাজাদের মধ্যে মুকুটমণি ছিলেন, মাৎস্যন্যায়ের
অবসান ঘটানোর জন্যে প্রকৃতিগণ ল²ীর হাত গ্রহণ করিয়েছিল।তারনাথ গোপালের উত্থান সম্বন্ধে এক
কাহিনীর অবতারণা করেন। তাঁর কাহিনীর সারকথা হল, বহুদিন ধরে অরাজকতা চলায় বাংলার জনগণের
দু:খ কষ্টের সীমা ছিল না। দেশের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সবাই মিলে আইনানুগ শাসন
প্রতিষ্ঠা করতে একজন রাজা নির্বাচিত করেন। কিন্তু সেই রাজা রাতে এক নাগ রাক্ষুসী কর্তৃক নিহত হয়।
এরপর প্রতি রাতে একজন করে নির্বাচিত রাজা নিহত হতে থাকে। এভাবে কয়েক বছর পার হয়ে যাবার
পর একদিন চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়িতে আসে। ঐ বাড়ির এক ছেলের ওপর ঐ দিন নির্বাচিত রাজা
হওয়ার ভার পড়ায় বাড়ির সকলে খুব বিষণœ ছিল। আগন্তুক ঐ ছেলের পরিবর্তে স্বেচ্ছায় রাজা নির্বাচিত
হন। রাজা হিসেবে বহাল থাকেন। এক রাতে নাগ রাক্ষুসী আসলে তিনি চুন্ডাদেবীর মহিমাযুক্ত এক লাঠি
দিয়ে আঘাত করলে রাক্ষুসী মরে যায়। পরের দিন তাঁকে জীবিত দেখে সবাই অবাক হয়। এভাবে পরপর
সাতদিন তিনি রাজা নির্বাচিত হন। এরপর জনগণ তাঁকে স্থায়ী রাজারূপে নির্বাচিত করে এবং তাঁকে গোপাল
নাম দেয়া হয়।
খালিমপুর তাম্রশাসন ও তারনাথের কাহিনীর ওপর নির্ভর করে অধিকাংশ ঐতিহাসিক গোপালকে জনগণ
কর্তৃক নির্বাচিত রাজা বলে মনে করেন। তারনাথের কাহিনীতে রূপক ছলে কিছু ঐতিহাসিক সত্য থাকলেও
থাকতে পারে। কিন্তু আক্ষরিকভাবে এই কাহিনীর ওপর বিশ্বাস করে কোন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
ঠিক হবে না। ঐতিহাসিকগণ তাই সমর্থন খোঁজেন খালিমপুর তাম্রশাসনে। সেখানে বলা হয়েছে,
মাৎস্যন্যায় অবস্থার অবসান ঘটাতে প্রকৃতিগণ গোপালকে রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। প্রকৃতি শব্দ বলতে
বিশেষ অর্থে “জনগণ” বা “প্রধান কর্মচারী” বুঝায়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীতে অরাজকতাপূর্ণ অবস্থায়
জনগণের একমত হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। কিংবা সে সময় কেন্দ্রীয়
শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে প্রধান কর্মচারীগণেরও নির্বাচন করার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং দেখা যায়
খালিমপুর তাম্রশাসনে ব্যবহৃত ‘প্রকৃতি' শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ নয়। এই ‘প্রকৃতির' অন্য
রকম ব্যাখ্যা করা সম্ভব। গোপাল হয়ত কয়েকজন ‘প্রকৃতির' (নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা কর্মচারী যারা তাঁর
অনুগামী ছিল) সাহায্যে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সাফল্যই অরাজকতার অবসান
ঘটিয়েছিল।সভাকবি এই ঘটনাই পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে খালিমপুর তাম্রশাসনে।ঐতিহাসিকগণ নির্বাচনের
পক্ষে ব্যাখ্যা করেন তারনাথের কাহিনী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।তারনাথের কাহিনীর অন্তর্নিহিত অর্থ এটিও হতে
পারে যে, গোপাল অরাজকতা সৃষ্টিকারী শক্তিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই সাফল্যই তাঁকে
ক্ষমতাসীন করেছিল এবং তাঁর সমর্থন সৃষ্টি করেছিল। তারনাথের কাহিনীর এই অর্থ খালিমপুর তাম্রশাসনের
শ্লোক এবং শ্লোকের ভিত্তিতে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে তাতে খুব একটা অসঙ্গতি নেই। সুতরাং
গোপাল একজন সমর নেতা হিসেবে কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় অরাজকতার অশুভ শক্তিকে পরাস্ত
করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। অষ্টম শতাব্দীতে গণ নির্বাচনের কথা চিন্তা করা যায় না। তাছাড়া নির্বাচন ঘটে
থাকলে পাল তাম্রশাসনগুলোতে প্রাপ্ত প্রশস্তিসমূহে এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট উল্লেখ থাকতো।
গোপালের বংশ পরিচয়
গাপালের বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। একমাত্র খালিমপুর তাম্রশাসনে গোপালের পিতা
বপ্যট (যিনি শত্রু ধ্বংসকারী ছিলেন) এবং পিতামহ দয়িতবিষ্ণুর (যাকে সর্ববিদ্যা বিশুদ্ধ বলা হয়েছে) উল্লেখ
আছে। এ থেকে বলা যায়, গোপালের পিতা বপ্যট যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। তবে পরবর্তী পাল রাজাগণ
তাঁদের তাম্রশাসনে গোপালের পিতা বা পিতামহের কথা আর উল্লেখ করেননি।
গোপালের রাজত্বকাল সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে উল্লেখ আছে যে, তিনি
২৭ বছর রাজত্ব করেন। অনুমান করা হয় গোপাল ৭৫৬ হতে ৭৮১ খিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল সম্বন্ধে তথ্যের অভাব থাকায় বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। বাংলায়
অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে নতুন এক রাজশক্তি প্রতিষ্ঠাই তাঁর প্রধান কীর্তি। গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাল
রাজবংশের শাসন বাংলায় প্রায় চারশ' বছর স্থায়ী হয়েছিল।
বাংলায় পাল শাসন
গোপালের উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় পাল রাজবংশ। প্রায় চারশত বছর ধরে ১৭ জন পাল
নৃপতি বাংলা শাসন করেন। এই সুদীর্ঘ শাসনকালে এই বংশের ইতিহাসে বিভিন্ন ভাগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা
যায়। উত্থান ও পতনের ক্রমধারায় পাল রাজত্বকালকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়কে
উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগ বলে আখ্যায়িত করা যায়।এ যুগের মধ্যে ছিল ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকাল।
এরপর পাল রাজবংশে উৎসাহ ও উদ্যোগের অভাব দেখা যায় এবং শুরু হয় সাম্রাজ্যের অবনতি। এই
অবস্থার উন্নতি সাধন করে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের সাফল্য দেখান প্রথম মহীপাল। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের
নামকরণ করা যায় অবনতি ও পুনরুদ্ধারের পর্যায়। কিন্তু মহীপাল কর্তৃক পাল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারকার্য
বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে সাম্রাজ্য বিপদের সম্মুখীন হয়। রামপাল সাম্রাজ্যকে
এই বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন বটে, কিন্তু রামপালের পর পাল বংশীয় শাসন বেশি দিন টিকে থাকেনি।
তাই তৃতীয় পর্যায়কে অবনতি ও বিলুপ্তির পর্যায় বলে ধরা যায়।
উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগ
গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শাসনের ওপর ভিত্তি করে তাঁর পরবর্তী দুই উত্তরাধিকারী ধর্মপাল ও দেবপাল পাল
সাম্রাজ্যকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করতে সক্ষম হন। ধর্মপাল ও দেবপালের নেতৃত্বে বাংলা ও বিহারে
পাল সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাখার মত শক্তি অর্জন
করে। তাই পাল সাম্রাজ্যের প্রথম পর্যায়কে ‘উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগ' বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে মনে
রাখা প্রয়োজন যে, সাহিত্যিক উপাদানের অভাবে এ সময়ের বাংলার ইতিহাসের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ উৎস
হলো বিভিন্ন লিপিমালা। সৌভাগ্যের বিষয় যে, পাল রাজাদের অনেকগুলো তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে।
এসব তাম্রশাসনে ভ‚মিদান সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আদেশাবলি লিপিবদ্ধ করার আগে প্রায় সবক্ষেত্রেই একটি
প্রশস্তি রয়েছে। পাল রাজাদের কৃতিত্ব ও সাফল্য এই প্রশস্তির বিষয়বস্তু। সভাকবি কর্তৃক রচিত হওয়ায় এ
প্রশস্তিতে অতিরঞ্জন রয়েছে।তাই অন্য কোন সূত্রে সমর্থন ব্যতিত প্রশস্তিতে উল্লেখিত সব তথ্য ঐতিহাসিক
সত্য বলে মনে করা উচিত হবে না।সুতরাং এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে ইতিহাস পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে
ঐতিহাসিককে সবসময়ই অতিরঞ্জনের প্রতি সজাগ থাকতে হবে।