প্রথম মহীপাল ঃ পাল সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার
দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পর তাঁর পুত্র প্রথম মহীপাল পাল বংশের রাজা হন। তাঁর রাজত্বের ৪৮ বছরে ইমাদপুর
লিপি প্রকাশিত হয়। সুতরাং অনুমান করা হয় প্রথম মহীপাল প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল (৯৯৫-১০৪৩ খ্রি:)
রাজত্ব করেন। এই দীর্ঘ রাজত্বকালে তিনি পাল সাম্রাজ্যকে নবজীবন দান করেন। তাই পাল বংশের
ইতিহাসে প্রথম মহীপাল স্মরণীয় হয়ে আছেন।
প্রথম মহীপালের পূর্বে পাল সাম্রাজ্যের যথেষ্ট সংকোচন ঘটে। এমনকি পালদের আদি বাসস্থান উত্তর
বাংলায়ও ভিন্ন রাজশক্তির উদ্ভব ঘটে। প্রথম মহীপাল সিংহাসনে আরোহণ করার সময় পাল সাম্রাজ্য অঙ্গ ও
মগধে সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। মহীপাল অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সাম্রাজ্যের বিলুপ্ত অংশ পুনরুদ্ধার
করে পুনরায় পাল সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান। তাঁর বেলওয়া (পঞ্চম রাজ্যাঙ্কে) ও বাণগড় (নবম রাজ্যাঙ্কে)
তাম্রশাসনে এই পুনরুদ্ধারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ দুটি তাম্রশাসন দ্বারা পুন্ড্রবর্ধনভুক্তিতে (উত্তর
বাংলা) ভ‚মিদান ঐ অঞ্চলে পাল আধিপত্যই প্রমাণ করে।
কুমিল্লা জেলার বাঘাউরা ও নারায়ণপুরে প্রাপ্ত দুটি মূর্তিলিপির প্রমাণে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে,
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও প্রথম মহীপালের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল।অল্প সময়ের ব্যবধানে পালবংশে
দুজন মহীপাল রাজত্ব করেছিলেন। ফলে মূর্তিদ্বয়ে উল্লেখিত মহীপাল প্রথম মহীপাল না দ্বিতীয় মহীপাল তা
স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, এই মূর্তি লিপিদ্বয় দ্বিতীয় মহীপালের
সময়কার। কিংবা মূর্তিদ্বয় বহিরাগত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
মগধ অঞ্চলে প্রথম মহীপালের আধিপত্যের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজত্বের শেষদিকে তিনি উত্তর
বিহার অঞ্চলেও আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। বারাণসীর নিকটবর্তী প্রাচীন বৌদ্ধতীর্থ সারনাথে প্রাপ্ত প্রথম
মহীপালের রাজত্বের ১০৮৩ বিক্রম সম্বতে (১০২৬ খ্রি:) উৎকীর্ণ একটি লিপি প্রমাণে অনুমান করা হয় যে,
বারাণসী পর্যন্ত মহীপালের রাজত্ব বিস্তার লাভ করেছিল।কেবলমাত্র এই একটি লিপি প্রমাণে এই সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করা যুক্তসঙ্গত কিনা তা বিচার সাপেক্ষ। যদি বাস্তবিকই রাজ্যের এই সম্প্রসারণ হতো তাহলে পাল
লিপিমালায় লিপিবদ্ধ প্রশস্তিসমূহে এ বিষয়ে আরও প্রত্যক্ষ উল্লেখ থাকতো। কিন্তু মহীপাল বা পরবর্তী
রাজাদের তাম্রলিপিতে এ বিষয়ে কোন উল্লেখ না থাকায় সারনাথে মহীপালের ক্ষমতা বিস্তারের প্রমাণ
হিসেবে সারনাথ লিপিকে মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং এই লিপিতে কেবল তাঁর ধর্ম-কর্মের কথা
লিপিবদ্ধ রয়েছে।
দাক্ষিণাত্যের চোলরাজ রাজেন্দ্রচোলের তিরুমুলাই লিপি মহীপালের সমসাময়িক বাংলার ইতিহাসের ওপর
যথেষ্ট আলোকপাত করে। এই লিপিতে রাজেন্দ্রচোল কর্তৃক এক বিজয়াভিযানের কথা উল্লেখ আছে। বলা
হয়েছে তাঁর সেনাপতি বঙ্গের সীমান্তে উপস্থিত হয়ে প্রথমে দন্ডভুক্তিরাজ ধর্মপাল ও পরে দক্ষিণ রাঢ়ের
অধিপতি রণশূরকে পরাজিত করে বঙ্গালদেশে রাজা গোবিন্দ চন্দ্রকে পরাজিত করেন।এরপর শক্তিশালী
প্রথম মহীপালের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয় উত্তর রাঢ়ে এবং মহীপাল ভীত হয়ে রণস্থল ত্যাগ করেন।চোল
সেনাপতি পাল রাজার দুর্দম রণহস্তি, নারীগণ ও ধনরতœ লুণ্ঠনপূর্বক উত্তর রাঢ় অধিকার করে গঙ্গাতীরে
উপনীত হন। এই বর্ণনা হতে বোঝা যায়, মহীপাল উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় রাজত্ব করতেন। দক্ষিণপশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন রাজত্ব বিদ্যমান ছিল।
প্রথম মহীপালের রাজত্বকালে ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে মুসলমানদের আক্রমণ শুরু হয়। গজনীর সুলতানদের
উপর্যুপরি ভারত আক্রমণে পরাক্রান্ত সাহী ও প্রতীহার বংশ ধ্বংস হয়। অন্যান্য রাজবংশ বিপর্যস্ত হয় এবং
একের পর এক প্রসিদ্ধ মন্দির-নগর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই বহি:শত্রুর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে মহীপাল
কোন পদক্ষেপ বা সাহায্য প্রেরণ করেননি। এজন্য কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁকে দোষারোপ করেছেন।
অনেকে মন্তব্য করে বলেন, সম্রাট অশোকের ন্যায় প্রথম মহীপালও উত্তর বাংলা পুনরুদ্ধারের পর সমরযাত্রা
ত্যাগ করে ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু মহীপালের ইতিহাস সম্যক আলোচনা
করলে এ ধরনের অভিযোগকে সমর্থন করা যায় না। পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করে তিনি যথেষ্ট শৌর্যবীর্যের
পরিচয় দেন। এরপর রাজেন্দ্রচোলের অভিযানের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কারণে সুদূর পঞ্চনদ অঞ্চলে সৈন্য
প্রেরণ মহীপালের পক্ষে সম্ভব ছিল না।তাছাড়া মুসলিম আক্রমণ তাঁর রাজ্যসীমায় এসে পৌঁছায়নি। ফলে
তাঁর উদ্বেগের কোন কারণ ছিল না।সে সময় সমগ্র উত্তর ভারত ভিন্ন ভিন্ন রাজবংশের শাসনাধীন থাকায়
সর্বভারতীয় সম্মিলিত প্রতিরোধের কথা কল্পনা করা যায় না।আক্রান্ত রাজ্যসমূহ অবস্থার চাপে পড়ে
সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের প্রতিরোধ করেছিল। ভারতের পূর্ব সীমান্তের পাল রাজ্যের পক্ষে এই প্রচেষ্টায়
যোগ দেয়ার কারণ নেই। সুতরাং এসব দিক দিয়ে বিবেচনা করে প্রথম মহীপালকে ভীরু, কাপুরুষ এবং
দেশের প্রতি কর্তব্য পালনে উদাসীন ইত্যাদি দোষে অভিযুক্ত করা অযৌক্তিক।
প্রথম মহীপালের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল, পাল সাম্রাজ্যকে আসন্ন বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। বিহার,
উত্তর বাংলা ও পশ্চিম বাংলায় সাম্রাজ্য পুন:প্রতিষ্ঠা করে তিনি পাল সাম্রাজ্যকে নবজীবন দান করেন।
রাজত্বের শেষ দিকে তিনি মিথিলা (উত্তর বিহার) অঞ্চলেও আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তবে বারাণসী
পর্যন্ত মহীপালের রাজ্য বিস্তারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
প্রথম মহীপাল পাল রাজ্য সম্প্রসারণ ব্যতিত ধর্মীয় ও জনহিতকর কার্যেও অবদান রাখেন। বাংলার অনেক
দিঘী ও নগরী, যেমনÑ রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ, বগুড়া জেলার মাহীপুর, দিনাজপুর জেলার মাহীসন্তোষ ও
মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল নগরী; দিনাজপুরের মহীপাল দীঘি, মুর্শিদাবাদের মহীপালের সাগরদীঘি ইত্যাদি
সবই মহীপালের স্মৃতি বহন করছে। তাছাড়া অসংখ্য লোকগাঁথায় মহীপালের নাম জড়িত ছিল। বৃন্দাবন
দাসের চৈতন্য ভগবতে উল্লেখ আছে যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহীপালের এসব গীতিকা খুবই জনপ্রিয়
ছিল। দুঃখের বিষয় এসব গীতিকা আজকাল শোনা যায় না। তবে ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত' লৌকিক
প্রবাদের প্রচলন তাঁর জনপ্রিয়তারই পরিচয় বহন করে। সম্ভবত জনহিতকর কার্যাবলীর মাধ্যমে মহীপাল এই
জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
মহীপালের ধর্মীয় কীর্তি সংরক্ষণ ও নির্মাণের বহু প্রমাণ রয়েছে। সারনাথ লিপি বিখ্যাত বৌদ্ধতীর্থে মহীপাল
কর্তৃক বিভিন্ন ধর্মীয় কীর্তি রক্ষণ ও নির্মাণের পরিচয় বহন করে। এছাড়া অগ্নিদাহে বিনষ্ট নালন্দা মহাবিহারে
ও বুদ্ধগয়ায় দুটি মন্দির তাঁর সময়ে নির্মিত হয়। পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ থেকেও মহীপালের সময়ে এই
বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও নির্মাণ কার্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
দেবপালের পর প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে পাল সাম্রাজ্যের যে অবনতি ঘটেছিল তা অব্যাহত থাকলে
পাল রাজবংশের শাসন প্রায় চারশত বছর টিকে থাকা খুবই অসম্ভব ছিল।দক্ষিণ বিহারে সীমাবদ্ধ পাল
সাম্রাজ্য মহীপালের রাজত্বকালে উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই তাঁর সর্বশ্রেষ্ট কৃতিত্ব।
তাছাড়া পাল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে মনোনিবেশের কারণেই মহীপালের
জনপ্রিয়তা বহুকাল পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। তাই বলা যায়, পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার এবং ধর্মীয় ও জনহিতকর
কার্যাবলী প্রথম মহীপালকে পাল রাজবংশের ইতিহাসে চির স্মরণীয় করে রেখেছে।
সারসংক্ষেপ
দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যে সম্ভবত বিভক্তি দেখা দেয়। সাম্প্রতিককালের জ্ঞান থেকে
ঐতিহাসিকদের অনুমান, দেবপালের পুত্র মহারাজাধিরাজ মহেন্দ্রপাল এবং অন্যান্য পাল রাজা
শূরপাল, বিগ্রহপাল প্রমুখ সাম্রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাজত্ব করেন। নারায়ণপালের অধীনে পাল
রাজত্বের দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়। ক্রমেই উপর্যুপরি বিদেশি আক্রমণে পাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল
হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় গোপালের রাজত্বের শেষ দিকে কম্বোজ বংশসম্ভুত পালদের উত্থান ঘটে। প্রথম
মহীপাল এদের কাছ থেকেই সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। মহীপাল উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় রাজত্ব
করেন। তাঁর হাতেই পাল সাম্রাজ্য নবজীবন পায়। সামগ্রিকভাবে প্রথম মহীপাল ছিলেন প্রাচীন
বাংলার একজন জনপ্রিয় রাজা।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। দেবপালের পরবর্তী পাল রাজা ছিলেনÑ
(ক) শূরপাল (খ) মহেন্দ্রপাল
(গ) নারায়ণপাল (ঘ) বিগ্রহপাল।
২। কম্বোজদের রাজত্বের তথ্যপাওয়া যায় কোন তাম্রশাসনে?
(ক) খালিমপুর তাম্রশাসন (খ) মুঙ্গের তাম্রশাসনে
(গ) বাদলশিলালিপিতে (ঘ) ইর্দা তাম্রশাসনে।
৩। কোন তাম্রশাসনে কম্বোজদের অদ্ভূত কার্যের উল্লেখ আছেÑ
(ক) পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে (খ) নিধনপুর তাম্রশাসনে
(গ) ইর্দা তাম্রশাসনে (ঘ) ভাগলপুর তাম্রশাসনে।
৪। প্রথম মহীপালের রাজত্বকালÑ
(ক) ৮৯৫Ñ৯৪৩ খ্রি: পর্যন্ত (খ) ৯৪৩Ñ১০২৫ খ্রি: পর্যন্ত
(গ) ৯৯৫Ñ১০৪৩ খ্রি: পর্যন্ত (ঘ) ১০৪৩Ñ১০৯৫ খ্রি: পর্যন্ত।
৫। সারনাথ লিপি সূত্রে অনুমিত হয়মহীপালের সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিলÑ
(ক) বিহার পর্যন্ত (খ) দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত
(গ) কামরূপ পর্যন্ত (ঘ) বারাণসী পর্যন্ত।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। কম্বোজদের উত্থান ও শাসন সম্পর্কে যা জানেন লিখুন।
২। নারায়ণপালের রাজত্বকাল সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। অবনতিকালে পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করুন।
২। পাল সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারকর্তা হিসেবে প্রথম মহীপালের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
৩। প্রথম মহীপালের রাজ্যসীমা নির্ধারণপূর্বক প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে তাঁর স্থান নিরূপণ করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। অনফঁষ গড়সরহ ঈযড়ফিযঁৎু, উুহধংঃরপ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ.
২। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ইবহমধষ.
৩। আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৪। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১ম খন্ড।