রামপাল ও বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার


রামপাল ও বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার
দ্বিতীয় শূরপালের পর রামপাল পাল বংশের রাজা হন। লিপি প্রমাণে বলা যায় তিনি ৪২ বছর (আনু:
১০৮২-১১২৪ খ্রি:) রাজত্ব করেন। রাজত্বের প্রথম দিকে তাঁর রাজ্য বিহার ও পশ্চিম বাংলার অংশবিশেষে
সীমাবদ্ধ ছিল।বিহারে রামপালের শাসনকালের বহু লিপির প্রমাণ রয়েছে।পশ্চিম বাংলাও যে তাঁর অধিকারে
ছিল সে বিষয়ে পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
রামপাল রাজ্যভার গ্রহণ করেই বরেন্দ্র (উত্তর বাংলা) অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে
কৈবর্ত প্রধান দিব্য তাঁর বিরুদ্ধে সাফল্যজনক আক্রমণ চালিয়েছিলেন। ফলে রামপাল নিজ সামরিক শক্তি
বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেন। সৈন্য সংগ্রহ ও সাহায্যের জন্য তাঁর অধীনস্ত সামন্তদের অর্থ ও সম্পত্তির
প্রলোভন দেখিয়ে তিনি সামন্তদের সাহায্য লাভ করেন। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে রামপাল যেসকল সামন্ত রাজের
সাহায্য নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন অংশে রাজত্ব করতো। পশ্চিম বাংলায় তাঁর
আধিপত্য দুর্বল ছিল বলেই তিনি ঐসব সামন্ত রাজের কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে সাহায্য ভিক্ষা করেছিলেন,
এ থেকে মনে হয় সেসময় কেন্দ্রীয় সরকারের চাইতে সামন্তদেরই দাপট বেশি ছিল।
যেসব সামন্ত রাজারা রামপালকে সাহায্য করেছিলেন রামচরিতে তাঁদের নাম পাওয়া যায়। টীকাকারের
ব্যাখ্যা হতে তাঁদের অনেকের রাজ্যের অবস্থিতি সম্বন্ধেও ধারণা করা যায়। যেমনÑ মগধের অধিপতি
ভীমযশ, কোটাটবীর (বাকুরার অন্তর্গত কোটেশ্বর) বীরগুণ, দন্ডভুক্তির (মেদিনীপুর) রাজা জয়সিংহ,
দেবগ্রামের রাজা বিক্রমরাজ, অরণ্য প্রদেশস্থ অপরমন্দারের (হুগলী জেলার মন্দারণ) ল²ীশূর, কুঞ্জবটির
(সাঁওতাল পরগণা) শূরপাল, তৈলকম্পের রুদ্রশিখর, উচ্ছালের ভাস্কর বা ময়গলসিংহ, চেক্করীরাজ (বর্ধমান)
প্রতাপসিংহ, কযঙ্গল মন্ডলের (কজঙ্গল) নরসিংহার্জুন, সংকট গ্রামের চন্ডার্জুন, নিদ্রাবলীর রাজা বিজয়রাজ,
কৌশাম্বীর দ্বোরপবর্ধন প্রমুখ। এ সকল সামন্তরাজা ছাড়াও রামপালের প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর মাতুল
রাষ্ট্রক‚টকুলতিলক মথন বা মহন। তিনি তাঁর দুই পুত্র কাহণরদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র শিবরাজকে
সঙ্গে নিয়ে রামপালকে সাহায্য করতে এসেছিলেন। রামপালের নির্দেশে প্রথমে শিবরাজ এক সৈন্যদল নিয়ে
সম্ভবত গঙ্গানদীর তীরে ভীমের সীমান্তবর্তী ঘাঁটিসমূহ বিধ্বস্ত করে দেন।রামপালের নেতৃত্বে মূল সৈন্যবাহিনী
দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা হতে বরেন্দ্র আক্রমণ করলে ভীমের সাথে এক তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রামচরিতের নয়টি
শ্লোকে এই যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যুদ্ধে রামপাল ও ভীম উভয়েই বিশেষ পারদর্শিতা দেখালেও হঠাৎ
ভীম বন্দী হন। এতে ভীমের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে হরি নামক ভীমের এক সুহৃদ সৈন্যদলকে পুনরায়
একত্রিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু রামপাল স্বর্ণকলস ভর্তি উপঢৌকনের মাধ্যমে
হরিকে নিজের দলভুক্ত করে ভীমের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন।


পিতৃভ‚মি বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করে রামপাল পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে পাল সাম্রাজ্যের লুপ্ত
গৌরব উদ্ধারের চেষ্টা করেন। রামচরিতে বলা হয়েছে, পূর্বদেশীয় বর্মরাজ উত্তর বাংলায় রামপালের সাফল্যে
ভীত হয়ে পড়েন এবং নিজ রাজ্যকে রামপালের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে উপঢৌকন প্রেরণের
মাধ্যমে পালরাজার তুষ্টি ও বন্ধুত্ব আদায় করেন। বর্মরাজ কর্তৃক তুষ্টিসাধনকে পালরাজার আনুগত্যের
স্বীকৃতি স্বরূপ ধরা যায়।
রামচরিতে রামপালের মিত্ররাজা কর্তৃক পার্শ্ববর্তী রাজ্য কামরূপ জয়ের উল্লেখ রয়েছে। কামরূপ বা কামরূপ
রাজ্যের অংশবিশেষ যে পাল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল তার প্রমাণ বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসনেও রয়েছে।
দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে দক্ষিণ হতে গঙ্গা রাজগণ কর্তৃক উপর্যুপরি উড়িষ্যা আক্রমণের সুযোগে রামপাল
সামন্ত দন্ডভুক্তির অধিপতি জয়সিংহ উৎকলরাজ কর্ণকেশরীকে পরাজিত করেন এবং নিজের মনোনীত
একজনকে উৎকলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। রামচরিত অনুসারে রামপাল উৎকল জয় করে
কলিঙ্গদেশ পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান।
কলচুরিরাজ লক্ষীকর্ণের মৃত্যুর পর ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতীয় গাহড়বাল বংশ বারাণসী ও কান্যকুব্জ
অধিকার করে পাল সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত নিজেদের রাজ্যের প্রসার ঘটান। তাঁদের লিপি হতে জানা যায়,
গাহড়বাল রাজা মদনপালের রাজত্বকালে (১১০৪-১১১১ খ্রি:) তাঁর পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের সাথে রামপালের যুদ্ধ
হয়েছিল। যুদ্ধে গোবিন্দচন্দ্র পাল সাম্রাজ্যের কোন অংশ অধিকার করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোন উল্লেখ
নেই। হয়তো রামপাল স্বরাজ্য সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। গোবিন্দচন্দ্রের স্ত্রী ছিলেন রামপালের মাতুল
মহনের দৌহিত্রী। সম্ভবত এই বৈবাহিক মৈত্রী কিছু সময়ের জন্য দুই বংশের বিরোধিতার অবসান
ঘটিয়েছিল। তবে রামপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের অনেকটুকু গাহড়বাল রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
বরেন্দ্র বহুদিন কৈবর্ত শাসনে থাকার পর সে অঞ্চলে রামপাল পালশাসনের পুন:প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার
শান্তি-শৃ´খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তিনি কৃষির উন্নতি ও করভার লাঘবের প্রয়াস চালান। এরপর
রামপাল রামাবতী (মালদহের নিকটবর্তী) নামক এক নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরবর্তী সময়েও
পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল।
অগ্রজ দুই ভ্রাতার পর রামপাল বেশ প্রৌঢ় অবস্থায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। তথাপি তাঁর রাজত্বকাল
ছিল নিঃসন্দেহে সাফল্যপূর্ণ। শাসনকালের প্রথমদিকে সীমিত সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও পুনরায় উত্তর
বাংলাকে পাল সাম্রাজ্যভুক্ত করে তিনি শৌর্য-বীর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। রামপালের রাজত্বের
শুরুর তুলনায় শেষদিকে পালশক্তির যে উন্নতি লক্ষ করা যায় তা তাঁরই কৃতিত্ব। এই কৃতিত্বের জন্যই তিনি
পাল বংশের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্য শেষবারের মতো
উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।তাঁর মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্য দ্রুত গতিতে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। তাই
রামপালকে পালবংশের শেষ ‘মুকুটমণি' বলা হয়।
প্রথম মহীপালের পরবর্তী প্রায় একশত বছর পাল সাম্রাজ্য বহি:শত্রুর আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগের
ফলে ক্রমশ: দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি ধীরে ধীরে অবনতি ও বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। পরবর্তীকালে
পাল রাজাদের মধ্যে একমাত্র রামপালই কিছু শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দেন এবং পাল বংশের অবনতির গতিকে
ক্ষণকালের জন্য হলেও রোধ করতে সক্ষম হন।কিন্তু রামপালের পর বিলুপ্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের কোন এক সময়ে সুদীর্ঘ চারশত বছরের পাল শাসনের অবসান ঘটে।
মদনপালই সম্ভবত শেষ পাল সম্রাট। তবে বাংলার ভ‚-ভাগ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরও কিছুদিন পাল
রাজ্য বিহারের অংশবিশেষে টিকে ছিল। পলপাল ও গোবিন্দপাল নামক রাজাÑ যাদের লিপি বিহারে পাওয়া
গিয়েছে তাঁরা পাল বংশের কিনা তা সঠিক করে বলা যায় না।


সারসংক্ষেপ
নয়পাল ও বিগ্রহপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় মহীপালের সময়
উত্তর বাংলায় দেখা দেয় সামন্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে বরেন্দ্র অঞ্চলে পাল শাসনের বিলুপ্তি ঘটে।
রামপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে তৎপর হন। তৎকালীন শক্তিশালী সামন্তদের সাহায্য নিয়ে তিনি পালদের
লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। রামাবতী নামক স্থানে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন।
রামপালকে পাল বংশের শেষ ‘মুকুটমণি' বলা হয়। দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে কোন এক সময়ে
সুদীর্ঘ পাল শাসনের অবসান ঘটে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনাÑ
(ক) ভ্রাতৃদ্বন্দ¡ (খ) কম্বোজদের সামরিক বিজয়
(গ) বরেন্দ্র বিদ্রোহ (ঘ) জনহিতকর কার্যাবলী।
২। উত্তর বাংলার বিদ্রোহ দমন করেনÑ
(ক) প্রথম মহীপাল (খ) দ্বিতীয় মহীপাল
(গ) রামপাল (ঘ) শূরপাল।
৩। বরেন্দ্র বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেনÑ
(ক) কলচুরি রাজা কর্ণ (খ) চন্দ্ররাজা গোবিন্দচন্দ্র
(গ) উৎকলরাজ কর্ণকেশরি (ঘ) কৈবর্ত প্রধান দিব্য।
৪। বরেন্দ্র বিদ্রোহের নেতাকে রামচরিত কাব্যে বলা হয়েছেÑ
(ক) উত্তরপথস্বামী (খ) উপধিব্রতী
(গ) সকলোত্তর পথনাথ (ঘ) মুকুটমণি।
৫। পাল বংশের শেষ ‘মুকুটমণি' কে?
(ক) প্রথম মহীপাল (খ) দ্বিতীয় মহীপাল
(গ) রামপাল (ঘ) মদনপাল।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। বৈদেশিক আক্রমণে পাল সাম্রাজ্যের অবনতি সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। দিব্য সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।

রচনামূলক প্রশ্ন ঃ


১। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালেসংঘটিত ‘বরেন্দ্র বিদ্রোহ' সম্পর্কে আলোচনা করুন। এই বিদ্রোহের
উৎপত্তি সম্বন্ধে ‘রামচরিত' কাব্যে কী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়?
২। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে রামপালের ভ‚মিকা মূল্যায়ন করুন।
৩। পাল বংশের শেষ ‘মুকুটমণি' হিসেবে রামপালের কৃতিত্ব আলোচনা করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১ম খন্ড।
২। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ইবহমধষ.
৩। অনফঁষ গড়সরহ ঈযড়ফিযঁৎু, উুহবংঃরপ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ.
৪। আবদুলমমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।

FOR MORE CLICK HERE

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]