সাম্প্রতিককালে প্রাপ্ত বিভিন্ন তাম্রশাসন ও লিপি প্রমাণের ভিত্তিতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠন
সম্ভব। গুপ্ত যুগের পর থেকে সেন বংশের উদ্ভব পর্যন্ত বাংলার এ অঞ্চল যে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল
থেকে পৃথক ছিল তার সাক্ষ্য মেলে এই উপাদানগুলোতে। প্রাপ্ত তথ্যসমূহে সপ্তম শতাব্দী থেকে দক্ষিণ-পূর্ব
বাংলায় কিছু শক্তিশালী রাজবংশের শাসন পরিলক্ষিত হয় যা এ অঞ্চলের একটি পৃথক রাজনৈতিক সত্তার
পরিচয় বহন করে। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ছয়টি তাম্রশাসনে বঙ্গে গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব
নামক তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। খালিমপুর তাম্রশাসন ও আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পের ভিত্তিতে সপ্তম
শতাব্দীর প্রথম ভাগে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ভদ্র রাজবংশের অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এছাড়া
একই শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে সমতট অঞ্চলে শাসনকারী রাজবংশ হিসেবে খড়গদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
খড়গদের পর অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে এ অঞ্চলে শাসন করে দেবরাজবংশ।এছাড়া লিপিমালায় হরিকেল
অঞ্চলে দেব শাসনের পরপরই এক ভিন্ন রাজবংশের কথা জানা যায়।অধুনাপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদানে
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজবংশ হিসেবে প্রমাণ মেলে চন্দ্র রাজবংশের। চন্দ্ররা এ অঞ্চলে
দেড়শ' বছর (দশম শতাব্দীর শুরু থেকে একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত) রাজত্ব করেছিলো বলে জানা
যায়। এ যাবত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে এ ধারণা স্পষ্ট হয় যে, সপ্তম শতাব্দী থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা
বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল হতে পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে বিকাশ লাভ
করেছিল।
‘দেব' রাজবংশ
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় খড়গ রাজবংশের শাসনের পর অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেবরাজবংশের উদ্ভব হয়।
তিনটি তাম্রশাসন ও কিছু মুদ্রা থেকে বাংলার ইতিহাসে দেবরাজবংশের অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া
যায়, পূর্বে যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রাপ্ত তাম্রশাসনগুলোর মধ্যে দুটি এবং কিছু মুদ্রা পাওয়া যায় কুমিল্লার
ময়নামতি-লালমাই অঞ্চলের শালবন বৌদ্ধ বিহারে। ১৯৫১ সালে ডি.সি. সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তৃতীয়
তাম্রশাসনটি ‘কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল'-এ সংরক্ষিত রয়েছে। ময়নামতিতে প্রাপ্ত অপর
একটি তাম্রশাসনে রাজা শ্রী আনন্দদেব কর্তৃক ভ‚মিদান এবং তাঁর পরবর্তী রাজা শ্রীভবদেব কর্তৃক উক্ত
ভ‚মিদান অনুমোদনের প্রমাণও পাওয়া যায়। দেবরাজাদের ভ‚মিদান সংক্রান্ত এসব তাম্রশাসনে এই বংশের
চার পুরুষের নামের উল্লেখ রয়েছে। তাঁরা হলেন শ্রীশান্তিদেব, শ্রীবীরদেব, শ্রী আনন্দদেব ও শ্রীভবদেব।
এরা প্রত্যেকেই পরমসৌগত, পরমভট্টারক, পরমেশ্বর এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করেন। আর এই
উপাধি তাঁদের সার্বভৌমত্বেরই পরিচয় প্রদান করে।
দেব রাজারা দেবপর্বত নামক স্থানে তাঁদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলো।রাজা শ্রীভবদেবের একটি
তাম্রশাসনেও এর উল্লেখ রয়েছে। ভবদেবের তাম্রশাসন, শ্রীধারণ রাটের কৈলান তাম্রশাসন এবং শ্রীচন্দ্রের
সিলেট তাম্রশাসনে দেবপর্বতের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হতে মনে হয় কুমিল্লার লালমাই পাহাড়েই এর
অবস্থান ছিল। শ্রীধারণ রাটের কৈলান তাম্রশাসনের মাধ্যমে জানা যায় দেবপর্বত ‘ক্ষিরোদা' নদীর তীরে
অবস্থিত। আধুনিক কালে এই ‘ক্ষিরোদা' কুমিল্লা শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত গোমতি নদীর শাখা
‘ক্ষীরনাই' নদী হিসেবে চিহ্নিত। এই চিহ্নিতকরণ থেকে বলা যায় যে, দেবপর্বত নগরী কুমিল্লার ময়নামতি
এলাকাতেই অবস্থিত ছিল এবং একে কেন্দ্র করেই দেবরাজারা তাঁদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
দেব রাজাদের রাজ্যসীমা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে উপর্যুক্ত লিপি প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে,
দেবরাজাগণ সমতট অঞ্চলেই তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।অবশ্য এই সমতট অঞ্চল ছিল নোয়াখালীত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত। লিপি প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যায় যে, আনন্দদেব ও ভবদেব উভয়ই পেরানটন বিষয়ে
ভ‚মিদান করেছিলেন।আর এই পেরানটন-এর অবস্থান ছিল কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলে। দেবরাজাদের
রাজ্যসীমা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা না গেলেও এটি প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা প্রভুত্ব স্থাপন করেছিলো
প্রাচীন বাংলার সমতট অঞ্চলে।
দেবরাজাদের রাজত্বকাল সম্পর্কেও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। তবে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম
ভাগে খড়গ রাজবংশের পরই দেবরা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট অঞ্চলে তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় যে সময় পালবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সে সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা
দেবরাজবংশের শাসনাধীন ছিল।দেবরাজাগণ বিভিন্ন সময় ভ‚মিদান সংক্রান্ত তাম্রশাসন উৎকীর্ণ করেন।
ভবদেবের ময়নামতি তাম্রশাসনগুলোর একটি উৎকীর্ণ হয় তাঁর রাজত্বের দ্বাদশ বৎসরে। তাই দেববংশের
চারপুরুষের শাসনের যথাযথ কাল নির্ধারণ করা না গেলেও আনুমানিক তাঁরা একত্রে ৫০-৬০ বৎসর রাজত্ব
করেছিলেন বলে বলা যায়। যেহেতু দেবরা খড়গদের পরবর্তী এবং পাল রাজাদের সমসাময়িক, তাই ৭৫০-
৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সমতটে তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে অনুমান করা যায়।
এছাড়া তাঁদের শাসন ছিল নবম শতাব্দীর হরিকেল রাজাদের পূর্ববর্তী কাল পর্যন্ত। তাই তাম্রশাসন ও
উৎকীর্ণ লিপি বিচারে বলা যায় যে, দেবরাজারা অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সমতট অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।
দেবরাজাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত।ময়নামতিতে প্রাপ্ত লিপিগুলোতে
দেব রাজাদের যে বংশানুক্রম পাওয়া যায় তাতে শ্রী শান্তিদেবকে এই বংশের প্রথম রাজা হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়েছে।কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত তাম্রশাসনের প্রথম লাইনে বীরদেবকে
দেববংশের প্রথম রাজা বলা হয়েছে।এতে শত্রুনিধনে বীরদেবের বিপুল শক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এও
বলা হয় যে, তিনি শত্রুদের সূর্যাস্তের অন্ধকারের ন্যায় ধ্বংস করতেন।এদিক থেকে তিনি বিষ্ণুর সাথে
তুলনীয়।এই লিপিতে তাঁর পুত্র আনন্দদেবকে যুদ্ধক্ষেত্রে পিতার প্রতিকৃতি বলা হয়েছে।দেবরাজাদের
তাম্রশাসনগুলো প্রায় ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় তাঁদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা না গেলেও এগুলোর প্রশস্তিতে
আনন্দদেব ও ভবদেবকে এ রাজবংশের অত্যন্ত পরাক্রমশালী রাজারূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। ময়নামতি
এলাকায় প্রতœ খননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত শালবন বিহার ভবদেবের কীর্তি।আনন্দদেবের কীর্তি আনন্দ
বিহার। অধুনা আবিষ্কৃত ভোজ বিহারও এ বংশের কোন এক রাজারই কীর্তি হবে বলে অনুমান করা হয়।
তাছাড়া ময়নামতি এলাকার অন্যান্য বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনাদি দেব বংশেরই সমৃদ্ধশালী শাসনের পরিচয়
বহন করে। রাজধানী ‘দেবপর্বত'-এর সন্নিকটেই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির
কেন্দ্র। যদিও দেবপর্বতকে সঠিকভাবে এখনও সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই
যে, এইসব পুরাকীর্তির আশেপাশেই ছিল এর অবস্থান।
হরিকেল রাজ্য
নবম শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হরিকেল অঞ্চলে (যা চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকা বলে ধরা হয়)
কয়েকজন স্বাধীন রাজার শাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে প্রাপ্ত শ্রীকান্তিদেবের একটি অসম্পূর্ণ
তাম্রশাসন থেকে রমেশচন্দ্র মজুমদার এই তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে বৌদ্ধ রাজপরিবারের তিন পুরুষের
উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁরা হলেনÑ ভদ্রদত্ত, তাঁর পুত্র ধনদত্ত এবং ধনদত্তের পুত্র কান্তিদেব। এদের মধ্যে
কেবল কান্তিদেব সম্পূর্ণ রাজকীয় উপাধি ধারণ করেন। তিনি রাজত্বের উত্তরাধিকার তাঁর মাতার পিতার
নিকট থেকে পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। কারণ, তাঁর মাতা বিন্দুবতীকে ‘মহারাজার কন্যা' বলা
হয়েছে।নবম শতাব্দীতে বা দেব রাজবংশের পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হরিকেল অঞ্চলে কান্তিদেবের
শাসন বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল।
তথ্যের বিভিন্নতার কারণে এই হরিকেল অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন। পন্ডিতগণ শ্রীহট্ট বা বর্তমান
সিলেটকে এবং সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে হরিকেল-এর অবস্থান বলে মনে করেন। তবে কেউ কেউ
একে বঙ্গের সাথে অভিন্ন বলেও মত প্রকাশ করেন। এমনও হতে পারে যে, হরিকেল রাজ্যের রাজনৈতিক
ক্ষমতা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে রাজ্যের ব্যপ্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজা কান্তিদেবের রাজধানীর নাম ছিল
বর্ধমানপুর। তবে এর অবস্থান সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন।
উল্লেখিত আলোচনার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, হরিকেল এবং বর্ধমানপুরের অবস্থান যেখানেই হোক না
কেন নবম শতাব্দীতে কান্তিদেবসহ কতিপয় রাজা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শাসন করেছিলেন।
চন্দ্ররাজবংশ
বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তাম্রশাসনসমূহ হতে বর্তমানে চন্দ্রবংশের ইতিহাস পুনর্গঠন সম্ভব। ময়নামতিতে প্রাপ্ত
তিনটি, ঢাকায় প্রাপ্ত একটি ও সিলেটের পশ্চিমভাগে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন থেকে এখন এই বংশের শাসন
সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়েছে। পূর্বে বেশ কয়েকটি তাম্রশাসন হতে শ্রীচন্দ্র প্রমুখ কয়েকজন রাজার নাম
জানা গেলেও বিস্তারিত ইতিহাস জানা সম্ভব ছিল না।আর তাই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার এই শক্তিশালী
রাজবংশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় এ অঞ্চলের ইতিহাস উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার ইতিহাসের
সাথে অভিন্ন বলে মনে করে সাধারণভাবে সারা বাংলায় পাল বংশীয় শাসন প্রবর্তিত ছিল বলে মনে করা
হতো। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকাংশে স্পষ্ট।
লিপিমালা ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে চন্দ্ররাজাদের রাজত্বকাল ও বংশানুক্রমিক নির্ণয় করা সম্ভব। তাঁদের
বংশতালিকা ও বিভিন্ন রাজাদের শাসনকালে প্রাপ্ত লিপি হতে তাঁদের রাজত্বের যে ধারাবাহিক কাল নির্ণয়
সম্ভব তা হলোÑ
পূর্ণচন্দ্র
সুবর্ণচন্দ্র
ত্রৈলোক্যচন্দ্রÑ রাজত্বকাল জানা যায়নি
শ্রীচন্দ্রÑ ৪৪ বছর
কল্যাণচন্দ্রÑ ২৪ বছর
লড়হচন্দ্রÑ ১৮ বছর
গোবিন্দচন্দ্রÑ ২৩ বছর
চন্দ্রবংশের উল্লেখিত রাজাদের মধ্যে শেষ চারজন মোটামুটিভাবে ১১০Ñ১১৫ বছরব্যাপী শাসনকার্য
পরিচালনা করেন। কেবলমাত্র রাজা গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বের যথাযথ কাল নির্ণয় করা সম্ভব হয় লিপি
প্রমাণের মাধ্যমে। রাজেন্দ্রচোলের তীরুমুলাই লিপিতে গোবিন্দচন্দ্রকে বঙ্গালদেশের রাজা হিসেবে আখ্যায়িত
করা হয়েছে এবং এতে বলা হয়েছে যেÑ তিনি পাল রাজা প্রথম মহীপালের সমসাময়িক। এই তথ্যের
ভিত্তিতে এবং ‘শব্দপ্রদীপ' নামক চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ থেকে তাঁর রাজত্বের দ্বিতীয়ার্ধ সম্পর্কেও জানা
যায়। এতে করে তাঁর রাজত্বের মোট সময়কাল ধরা যায় ১০২০Ñ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালের
ওপর ভিত্তি করে গোবিন্দচন্দ্রের পূর্বের রাজাদের যে রাজত্বকাল নির্ধারণ করা যায় তা হলোÑ
শ্রীচন্দ্র - ৯৩০Ñ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ
কল্যাণচন্দ্র - ৯৭৫Ñ১০০০ খ্রিস্টাব্দ
লড়হচন্দ্র - ১০০০Ñ১০২০ খ্রিস্টাব্দ
ত্রৈলোক্যচন্দ্রের রাজত্বকালের কোন লিপি প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তিনি স্ব-বংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন বলে জানা যায়। আর তাই তাঁর রাজত্বকাল ৯০০Ñ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল বলে
অনুমেয়। তবে উপরোল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এই কাল নির্ণয় সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল নাও হতে পারে। তথাপি
একথা বলা যায় যে, আনুমানিক দশম শতাব্দীর প্রারম্ভিক কাল হতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
তাম্রশাসনে বিধৃত তথ্যের ভিত্তিতে চন্দ্ররাজাদের ক্ষমতা আরোহণ সম্পর্কিত কিছু আভাষ পাওয়া যায়।
তাম্রশাসনসমূহে এ বংশের প্রথম ভ‚-পতি পূর্ণচন্দ্রকে রোহিতাগিরির ভ‚-স্বামী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর
পুত্র সুবর্ণচন্দ্রও একজন ভ‚-স্বামী ছিলেন বলে মনে করা হয়। পূর্ণচন্দ্র ও সুবর্ণচন্দ্র সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা
যায় না। তবে শ্রীচন্দ্রের ধুল্লা, রামপাল ও মদনপুর তাম্রশাসনে সুবর্ণচন্দ্রকে বৌদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্ভবত তিনিই চন্দ্ররাজাদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তী সব রাজাই ছিলেন বৌদ্ধ।
পন্ডিতগণ ত্রৈলোক্যচন্দ্রকে চন্দ্র বংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হিসেবে মত প্রকাশ করেন। তবে
প্রথমদিকে তিনি রোহিতাগিরির ভ‚-স্বামী বা সামন্তরাজা ছিলেন। তাম্রশাসনে তাঁকে হরিকেল রাজার ক্ষমতার
আধার বা প্রধান অবলম্বন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই অবস্থান থেকে তিনি চন্দ্রদ্বীপের নৃপতি
হয়েছিলেন। এ থেকে বলা যায় যে, ত্রৈলোক্যচন্দ্র প্রথমে হরিকেল রাজার অধীনে সামন্তরাজা ছিলেন এবং
তিনি এতই ক্ষমতাশালী ছিলেন যে, তাঁকে হরিকেল রাজার প্রধান অবলম্বন হিসেবে মনে করা হতো। আর
এ অবস্থা থেকেই তিনি হয়েছিলেন চন্দ্রদ্বীপের নৃপতি, যা ছিল তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রথম
পদক্ষেপ।
চন্দ্রদের আদি অবস্থান রোহিতাগিরির সনাক্তকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ
রোহিতাগিরিকে বিহারের রোহতাসগড় বলে মনে করেন। তবে নলিনীকান্ত ভট্টাশালীর মতবাদ অধিক
যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। তিনি মত পোষণ করেন যে, রোহিতাগিরি কুমিল্লার লালমাই পাহাড়েই অবস্থিত
ছিল। কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলে চন্দ্রবংশীয় রাজারা প্রাথমিক পর্যায়ে হরিকেল রাজাদের অধীনে ভ‚-স্বামী
ছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে। ক্রমে ক্রমে তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয়। তাঁদের মধ্যে ত্রৈলোক্যচন্দ্র
সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন, যা তাঁকে হরিকেল রাজার শক্তির প্রধান অবলম্বন রূপে প্রতিষ্ঠা করে।
একথা মনে করা যেতে পারে যে, কান্তিদেব বা তাঁর পরবর্তী কোন হরিকেল রাজার অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলে
চন্দ্রদের এই উত্থানের সূচনা। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের ক্ষমতা এত বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে এক সময় তিনি
চন্দ্রদ্বীপের নৃপতি হন। ক্রমান¦য়ে তিনি সমতট অঞ্চলে ক্ষমতা বিস্তার করেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় স্ব-
বংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক সমতট জয়ের উল্লেখ
রয়েছে। পূর্ববর্তী দেবরাজাদের শাসনকেন্দ্র দেবপর্বত ছিল তাঁর ক্ষমতার উৎস এবং সে স্থানের সৈন্যদল
নিয়েই তিনি সমতট অধিকার করেছিলেন বলেও মনে করা হয়।লড়হচন্দ্রের ময়নামতি তাম্রশাসনে উল্লেখিত
হয়েছে যে, বঙ্গ ত্রৈলোক্যচন্দ্রের শাসনকালে অভ্যুন্নতিশালী ছিল। সুতরাং বলা যায় হরিকেল রাজার অধীনে
সামন্তরাজার অবস্থান হতে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভের নায়ক ছিলেন ত্রৈলোক্যচন্দ্র।
অন্যদিকে মুদ্রার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে বাংলার এই চন্দ্রবংশীয় রাজারা আরাকানের চন্দ্রবংশীয়
রাজাদের সাথে সম্পর্কিত ছিল। চট্টগ্রাম-কুমিল্লা অঞ্চলে আরাকানের প্রভাবের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই
একথা বলা যায় যে, চন্দ্রবংশীয় কোন এক ব্যক্তি কুমিল্লা অঞ্চলের ভ‚-স্বামী হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে এ
বংশেরই একজন শক্তিশালী শাসক দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চট্টগ্রামে হরিকেল
রাজ্যের অবস্থিতি এ অনুমানের পক্ষে সমর্থন যোগায়। তবে রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের উত্থান যেভাবেই হোক না
কেন তিনিই চন্দ্রবংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
ত্রৈলোক্যচন্দ্র সম্বন্ধে প্রায় সব তাম্রশাসনে সাধারণভাবে প্রশংসা করা হয়েছে।কল্যাণচন্দ্রের ঢাকা তাম্রশাসনে
ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক গৌড়দের পরাস্ত করার উল্লেখ রয়েছে। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের কোন তাম্রশাসন আজ পর্যন্ত
পাওয়া যায়নি। সামন্তরাজা হিসেবে জীবন শুরু করে সমতট ও বঙ্গে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর
সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব।ত্রৈলোক্যচন্দ্র আনুমানিক ৯০০Ñ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় সগৌরবে রাজত্ব
করেন।
শ্রীচন্দ্র
চন্দ্র বংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন শ্রীচন্দ্র। তিনি ছিলেন পিতা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের উত্তরাধিকারী। তাঁর
নিজের এবং উত্তরসুরীদের তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্রকে একজন মহৎ রাজা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর
শাসনামলে চন্দ্রবংশের ক্ষমতা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সমগ্র পৃথিবীকে তাঁর
ছাতার নিচে একীভ‚ত করেছিলেন এবং তাঁর শত্রুদের করেছিলেন বন্দি। তিনি পরমেশ্বর, পরমভট্টারক,
মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করে বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। আনুমানিক ৪৫ বছর তিনি দক্ষিণপূর্ব বাংলায় শৌর্যবীর্যের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন।
শ্রীচন্দ্র উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন দক্ষিণ পূর্ব বাংলার শাসনভার। শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চল তাঁর
শাসনাধীনে ছিল। তাঁর রাজত্বকালের পঞ্চম বৎসরে উৎকীর্ণ পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন সিলেটে তাঁর ভ‚মিদানের
পরিচয় বহন করে। তিনি আরো উত্তরপূর্বে কামরূপ রাজ্যে বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছিলেন বলেও এই
তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য কামরূপ আক্রমণ ছিল তাঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কামরূপ
বিজয়াভিযানে শ্রীচন্দ্রের সৈন্যদল লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করে গৌহাটির অদূরবর্তী পার্বত্যাঞ্চল
পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল বলে প্রশস্তিকার উল্লেখ করেন। এই তথ্যের সত্যতা যাচাই সম্ভব না হলেও বলা যায়
কামরূপরাজ বলবর্মার পরবর্তীকালে রাজ্যে যে দুর্বল শাসন বিদ্যমান ছিল সে সুযোগে শ্রীচন্দ্রের সাফল্যজনক
অভিযান খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে কামরূপ রাজ্যের কোন অংশ বাংলার শাসনাধীনে এসেছিল কিনা তা
বলা কঠিন। তদুপরি এ কথা বলা যায় যে, কামরূপের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক অভিযান শ্রীচন্দ্রের অধীনে
বাংলার শক্তি, শৌর্য ও বীর্যের পরিচয় বাহক।
লড়হচন্দ্রের ময়নামতি তাম্রশাসনে গৌড়ের বিরুদ্ধে শ্রীচন্দ্রের সাফল্যের কথা বলা হয়েছে। গৌড় এসময়
কম্বোজ বংশীয় গৌড়পতিদের অধীন ছিল বলে মনে হয়। দ্বিতীয় গোপালের রাজত্বকালেই উত্তর-পশ্চিম
বাংলা হতে পাল শাসন বিলুপ্ত হয়ে সেখানে কম্বোজবংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।সুতরাং শ্রীচন্দ্রের
গৌড়ের বিরুদ্ধে সাফল্যই কম্বোজদের বিরুদ্ধে সাফল্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।কল্যাণচন্দ্রের তাম্রশাসনে উল্লেখ
করা হয়েছে যে, শ্রীচন্দ্র গোপালকে সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন।শ্রীচন্দ্রের সমসাময়িক
পাল রাজা দ্বিতীয় গোপাল গৌড় হতে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সুতরাং কম্বোজদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য
গোপালের পুন:প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল।তবে কম্বোজদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছিল এমন মনে
করা যায় না। এও হতে পারে যে, কাম্বোজদের উত্থানকালে গোপাল রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং শ্রীচন্দ্র
কম্বোজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে গোপালকে সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন। আর তা
না হলে হয়তো সম্পূর্ণ পাল সাম্রাজ্যই কম্বোজদের হস্তগত হতো বা গোপাল নিজ অস্তিত্বই বজায় রাখতে
ব্যর্থ হতেন। এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে সে, এক বৌদ্ধ রাজবংশ অন্য বৌদ্ধ রাজবংশের দুঃসময়ে
সাহায্য করেছিল।
শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে তাঁর অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাফল্যের উল্লেখ রয়েছে। এ লিপিতে বলা হয়েছে
যে, তিনি যমন বা যবন, হ‚ণ ও উৎকলদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তবে এ উক্তিতে কতখানি
সত্যতা রয়েছে বা উল্লেখিত জনপদগুলোর ওপর শ্রীচন্দ্রের আধিপত্য কতদূর বিস্তার লাভ করেছিল তা
নির্ণয়ের উপায় নেই।
সমরক্ষেত্রে শ্রীচন্দ্রের সাফল্যের যে প্রমাণ আমরা লিপিমালা হতে পাই তা থেকে মনে হয় যে, শ্রীচন্দ্র চন্দ্র
সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কামরূপ ও গৌড়ের বিরুদ্ধে তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় শ্রীচন্দ্রের ভ‚মিকা অনেকাংশে পাল সাম্রাজ্যের ধর্মপালের ভ‚মিকার
অনুরূপ বলে ধারণা করা যায়।
শ্রীচন্দ্রের শাসনকালের মোট ছয়টি তাম্রশাসন এ পর্যন্ত আবিষ্কার করা হয়েছে এবং এগুলো দক্ষিণ-পূর্ব
বাংলায় তাঁর পরাক্রমশালী শাসনের পরিচয় বহন করে। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ছিল তাঁর রাজধানী। ঢাকা
জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা-ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞ্চল ও কুমিল্লা-নোয়াখালীসহ
সমতট অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল একথা বলা যায় লিপি প্রমাণের ভিত্তিতে। সুতরাং প্রায় সমগ্র দক্ষিণপূর্ব বাংলায় চন্দ্র রাজবংশের শাসন এ সময় ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য
সম্প্রসারণ ও দৃঢ়ীকরণে শ্রীচন্দ্রের বলিষ্ঠ ভ‚মিকা সীমিত উপাদানসমূহ হতে পূর্ণাঙ্গ ও স্পষ্টভাবে অনুধাবন
করা সম্ভব না হলেও তিনি যে চন্দ্রবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন তা বিভিন্ন তাম্রশাসনে বিধৃত প্রশস্তিসমূহের
সুর হতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়।
চন্দ্র শাসনের শেষ পর্যায়
শ্রীচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র কল্যাণচন্দ্র সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি প্রায় ২৫ বছর অর্থাৎ আনুমানিক
৯৭৫Ñ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কল্যাণচন্দ্রের শাসনামলেও চন্দ্রদের শৌর্যবীর্য অক্ষুন্ন ছিল বলে
মনে করা হয়। তাঁর রাজত্বকালের একটি মাত্র তাম্রশাসন পাওয়া যায়। তবে এই লিপিতে তাঁর নিজ
রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কল্যাণচন্দ্রের পুত্র এবং পৌত্রের তাম্রশাসনে তাঁর
সম্বন্ধে জানা যায় যে, তিনি কামরূপের ¤েøচ্ছদের এবং গৌড়রাজকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক
গৌড়রাজ কোন এক কাম্বোজ গৌড়পতি হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং এমনও হতে পারে যে, গৌড়রাজের
বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য পরোক্ষভাবে পাল সম্রাট মহীপালকে সাম্রাজ্য পুন:রুদ্ধারকার্যে সাহায্য করেছিল। পিতার
ন্যায় তিনিও হয়তো পালরাজাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এবং কম্বোজ গৌড়পতিদের ক্ষমতা খর্ব
করে মহীপাল কর্তৃক পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করেছিলেন।কল্যাণচন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা না গেলেও
তাঁকে ‘কলানিলয়' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া তাঁকে দানে বলী, সত্যবাদিতায় যুধিষ্ঠিত ও বীরত্বে
অর্জুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
লড়হচন্দ্র ছিলেন কল্যাণচন্দ্রের উত্তরাধিকারী। তিনি ১০০০Ñ১০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন বলে
অনুমান করা হয়। ময়নামতিতে প্রাপ্ত তাঁর দুটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, তিনি বাসুদেব বা বিষ্ণুর
উদ্দেশ্যে ভ‚মিদান করেছিলেন। লড়হচন্দ্র ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাঁর পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের একটি
তাম্রশাসনে তাঁর বিদ্যানদী অতিক্রম, বারাণসীতে ধর্মীয় øান এবং কবিত্ব ও পান্ডিত্যজনিত খ্যাতির উল্লেখ
পাওয়া যায়। বারাণসীতে গঙ্গাøানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ, বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে ভ‚মিদান ইত্যাদি তাঁর অন্য ধর্মের
প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় প্রদান করে। ভারেল্লায় তাঁর শাসনকালে নর্তেশ্বর শিবের যে মূর্তি পাওয়া
গেছে তা হতে প্রমাণিত হয় যে, এই আকৃতিতে শিবের উপাসনা তখন থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল।
স্বাভাবিকভাবে মনে করা হতো এ ধরনের শিব উপাসনা সেন আমলে দাক্ষিণাত্য থেকে এসেছিল। কিন্তু
সেন বংশের প্রায় এক শতাব্দী পূর্বেই এ ধরনের উপাসনার প্রচলন বাংলায় ছিল।
লড়হচন্দ্রের পর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শাসন করেছিলেন চন্দ্ররাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্র।
গোবিন্দচন্দ্রের নাম পূর্বেই দুটি মূর্তিলিপি, তিরুমুলাই লিপি ও শব্দপ্রদীপ গ্রন্থ হতে জানা গিয়েছিল। কিন্তু
ময়নামতিতে প্রাপ্ত গোবিন্দচন্দ্রের তাম্রশাসন তাঁর বংশ পরিচয় ও কালানুক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান
করে। তিনি আনুমানিক ১০২০Ñ১০৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন।
গোবিন্দচন্দ্রের তাম্রশাসনে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ও গুণাবলীর কথা উল্লেখ রয়েছে এবং আশা পোষণ করা
হয়েছে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু তাঁর রাজত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করবে। এ থেকে মনে হয় যে, এই তাম্রশাসন তাঁর রাজত্বের
প্রারম্ভেই উৎকীর্ণ হয়েছিলেন।
সিংহাসনে আরোহণের স্বল্পকালের মধ্যেই তাঁকে দাক্ষিণাত্যের চোলরাজ রাজেন্দ্রচোলের আক্রমণের সম্মুখীন
হতে হয়েছিল। এই আক্রমণ তাঁর শক্তি অনেকাংশে হ্রাস করেছিল। এছাড়া গোবিন্দচন্দ্র কলচুরিরাজ কর্ণ
কর্তৃক আক্রান্ত হন। এই দুই বৈদেশিক আক্রমণ চন্দ্ররাজার ক্ষমতা হ্রাস করে এবং তাঁদের শাসনের অবসান
ঘটায়।
পিতা লড়হচন্দ্রের ন্যায় চন্দ্রবংশের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্রেরও অন্য ধর্মের প্রতি উদার মনোভাবের পরিচয়
মেলে। অনেকে চন্দ্রবংশীয় রাজা গোবিন্দচন্দ্রের সাথে বাংলার বহুল প্রচলিত লোকগাঁথায় গোপীচন্দ্র বা
গোবিন্দচন্দ্রকে অভিন্ন বলে মনে করেন। কিন্তু ‘গোবিন্দচন্দ্রের গান', ‘মানিকচন্দ্রের গান' প্রমুখ লোকগাঁথার
সঠিক কাল নির্ণয় দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়া সিংহাসন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণকারী লোকগাঁথায় গোবিন্দচন্দ্রের
যে পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় তা চন্দ্রবংশীয় রাজার পিতৃপরিচয় হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং কেবলমাত্র নামের
মিলের ওপর নির্ভর করে এ মতবাদ গ্রহণ করা যায় না।
গোবিন্দচন্দ্র ২৫ বছর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেন। একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব
বাংলায় চন্দ্রবংশের শাসনের অবসান হয়। ধারণা করা হয় যে, এ সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পাল শাসন
সম্প্রসারিত হলেও তা এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে উত্তর বাংলায় সামন্ত
বিদ্রোহের সুযোগে এ অঞ্চলে বর্মরাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রায় দেড় শতাব্দীকাল চন্দ্রবংশের শাসন বিরাজমান ছিল। ত্রৈলোক্যচন্দ্র ছিলেন এ
বংশের ক্ষমতায় আরোহণের নায়ক, শ্রীচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁদের ক্ষমতা উন্নতির চরম শিখরে উপনীত
হয়। কল্যাণচন্দ্র ও লড়হচন্দ্রের শাসনকালেও তাঁদের গৌরব বজায় ছিল। কিন্তু গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকালে
বৈদেশিক আক্রমণের ফলে তাঁদের ক্ষমতা হীনবল হয়ে পড়ে এবং তাঁদের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
সারসংক্ষেপ
সপ্তম শতাব্দী থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে বিকাশ লাভ করে।ভদ্র,খড়গ,
দেব, চন্দ্র, বর্মণ ইত্যাদি রাজবংশ ধারাবাহিকভাবে এ অঞ্চলে রাজত্ব করে।দেবপর্বতে দেব রাজাদের
রাজধানী স্থাপিত হয়।শালবন বিহার ভবদেবের কীর্তি আর আনন্দদেবের কীর্তি আনন্দবিহার। ৫০/৬০
বছর দেব রাজারা রাজত্ব করেন।চন্দ্র রাজারা রাজত্ব করেন প্রায় দেড়শ বছর।ত্রৈলোক্যচন্দ্র প্রথম
গুরুত্বপুর্ণ চন্দ্র শাসক।তাঁরই পুত্র শ্রীচন্দ্র যে চন্দ্রবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা তা তাম্রশাসনে বিধৃত
প্রশস্তিসমূহের মুর হতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।কল্যাণচন্দ্র, লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের কালেও চন্দ্রদের
গৌরবময় শাসন অব্যাহত থাকে।শিল্পকলাচর্চার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সাধিত হয়।বৈদেশিক আক্রমণে
চন্দ্রবংশের শক্তিক্ষয় ঘটে এবং রাজ্যটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রথম রাজবংশ কোনটি?
(ক) খড়গ (খ) দেব
(গ) চন্দ্র (ঘ) ভদ্র।
২। কে দেব বংশের রাজা নন?
(ক) সমাচারদেব (খ) শান্তিদেব
(গ) আনন্দদেব (ঘ) ভবদেব।
৩। রোহিতাগিরি কোথায় অবস্থিত?
(ক) বিহারের রোহতাসগড়ে (খ) কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলে
(গ) রাঙ্গামাটিতে (ঘ) রাজবাড়ী ডাঙ্গায়।
৪। শ্রীচন্দ্র রাজত্ব করেন আনুমানিকÑ
(ক) ৪০ বছর (খ) ৩৫ বছর
(গ) ৪৫ বছর (ঘ) ৫০ বছর।
৫। শ্রীচন্দ্রের রাজধানী কোথায়অবস্থিত?
(ক) বিক্রমপুরে (খ) দেবপর্বতে
(গ) কোটালীপাড়ায় (ঘ) চন্দ্রদ্বীপে।
৬। কোন নৃপতিকে ‘কলানিলয়' বলা হয়েছে?
(ক) লড়হচন্দ্রকে (খ) গোবিন্দচন্দ্রকে
(গ) কল্যাণচন্দ্রকে (ঘ) শ্রীচন্দ্রকে।
৭। বাঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায় কোন লিপিতে?
(ক) কৈলান লিপিতে (খ) তিরুমুলাই লিপিতে
(গ) পশ্চিমভাগ লিপিতে (ঘ) ময়নামতি লিপিতে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। ত্রৈলোক্যচন্দ্র সম্পর্কে যা জানেন লিখুন।
২। হরিকেল রাজ্য সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। দেব রাজবংশের ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসসমূহ কি? দেবরাজাদের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
২। চন্দ্রদের আদি বাসভ‚মি কোথায়? ত্রৈলোক্যচন্দ্রকে চন্দ্রবংশের প্রথম স্বাধীন নৃপতি বলা যায় কি?
৩। চন্দ্রবংশের ইতিহাস জানার উপাদানগুলো উল্লেখ করুন।শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্যসীমা চিহ্নিত করুন।
৪। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি হিসেবে শ্রীচন্দ্রের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। অনফঁষ গড়সরহ ঈযড়ফিযঁৎু, উুহধংঃরপ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ.
২। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ইবহমধষ.
৩। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১ম খন্ড।
৪। আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।