বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়


বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য আমরা বাঙালি জাতি।এক ভাষায় কথা বললেও আমাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য কিন্তু এক না।আমরা দেখতে কেউ ফর্সা,কেউ কালো, কেউ লম্বা, কেউ খাটো। আবার চুল,চোখ,নাক অর্থাৎ মুখাবয়বের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
এত পার্থক্য কিন্তু জাপানি,চীনা,স্পেনীয়, ব্রিটিশ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নেই।ওদের দেখলে মনে হয় নিজ নিজ জাতির সবার সাথে সবার দৈহিক বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে।
এ থেকে বোঝা যায় বাঙালিরা একক কোন নৃগােষ্ঠী থেকে আসেনি।বাঙালিরা মিশ্র জাতিগোষ্ঠী। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর(উপজাতি) মানুষ আছে।এই আলোচনায় তারাও অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধারা বা জনগােষ্ঠীর মিশ্রণে আজকের এই বাঙালি জাতি।নৃতাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর প্রধান চারটি নৃগোষ্ঠীর কোন না কোন শাখা এসে মিলেছে এই বাংলা ভূখণ্ডে।
এখন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব----
বাংলায় আগত জনগােষ্ঠীকে সাধারণত দু'ভাগে ভাগ করা যায়। (১) প্রাক আর্য বা অনার্য নৃগোষ্ঠী
এবং
(২) আর্য নৃগোষ্ঠী
(১)প্রাক আর্য বা অনার্য জনগােষ্ঠী
------------------------------------------------
আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে এদেশে বসবাসকারী জনগােষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এরা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে এসেছে। এরাই হচ্ছে বাংলার আদি জনগােষ্ঠী।
অনার্য জনগােষ্ঠী আবার চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। যথা : ক)অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড,
খ) নেগ্রিটো,
গ)দ্রাবিড়

ঘ)মঙ্গোলয়েড।
ক)অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড :
এরা অস্ট্রেলিয়ার কাছের দ্বীপসমূহ থেকে আসা আদিম অধিবাসী। ঐতিহাসিকদের মতে,অস্ট্রিকরাই এদেশের প্রাচীনতম বাসিন্দা। বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে এ নৃগােষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অষ্ট্রিকরা পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন হয়ে আসাম দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। এরা ভেডিডড এবং নিষাদ নামেও পরিচিত।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.এদের গায়ের রং গাঢ় কালাে
২.মাথার গড়ন লম্বা, নাক প্রশস্ত
৩.উচ্চতা বেটে ও মধ্যমাকার।
বাংলাদেশের কোল, ভীম, মুণ্ডা, সাঁওতাল, চণ্ডাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এ পর্যায়ভুক্ত বলা যায়। এ নৃগােষ্ঠীর লােকরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলতাে। বর্তমান মুণ্ড বা মুণ্ডারী ভাষা আদি অস্ট্রিক ভাষার বিবর্তিত রূপ।কুড়ি, পণ, গণ্ডা, চোঙ্গা, ঠেঙ্গা, করাত,দা, কলা প্রভৃতি অস্ট্রিক ভাষার শব্দ।
খ)নেগ্রিটো :
নিগ্রোদের মতাে দেহ গঠনযুক্ত এক আদিম জাতির এ দেশে বসবাসের কথা অনুমান করা হয়। এদের নেগ্রিটো বা নিগ্রোয়েড বলা হয়। এদের আদি নিবাস ছিল আফ্রিকা। বিশেষ করে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে এবং মেলানেশিয়ায় এরা বসবাস করতাে। ঠিক কখন এরা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস শুরু করে তা জানা যায় না। তবে এদেরকে বাংলার জনগােষ্ঠীর প্রথম স্তর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.এদের গায়ের রং কালো।
২.আকার খর্বাকৃতি, ঠোট পুরু ও উল্টানাে।
৩. নাক খুবই চ্যাপ্টা।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় উপদ্বীপে নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর লােক বাস করতাে বলে জানা যায়। বর্তমান সুন্দরবন, যশােরের বাশফোড়, ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিম্নবর্ণের জনগণের মধ্যে এদের প্রভাব দেখা যায়।
গ)দ্রাবিড় :
অস্ট্রিক ধাচের তার একটি গােষ্ঠী হলো দ্রাবিড়রা। অস্ট্রেলিয় আদিম অধিবাসীদের সাথে এদের মিল রয়েছে বলে এদরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। এরা ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল থেকে এদেশে আসে।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.গায়ের রং কালো থেকে বাদামি
২.এদের দেহ মধ্যমাকার
৩.মাথা লম্বা,নাক চওড়া
৪.চুল কালাে ও বাদামি এবং ঢেউ খেলানাে।
এ জনগােষ্ঠী সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। দক্ষিণ ভারতে এ গােষ্ঠীর লোকদের প্রাধান্য দেখা যায়।
ঘ)মঙ্গোলয়েড : পূর্ব এশিয়ায় মঙ্গোলীয় নরগােষ্ঠী বসবাস করে থাকে । এ জনগােষ্ঠী দক্ষিণ ও পশ্চিম চীন থেকে এদশে আগমন করে।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.এদের গায়ের রং পীতাভ থেকে বাদামী।
২.আকৃতিতে বেটে
৩.চুল কালাে ও ঋজু
৪.মাথার আকৃতি গােল, নাক চ্যাপ্টা।
৫.চোখের পাতা সামনের দিকে ঝােলানাে !
বাংলাদেশের চাকমা, গারাে,হাজং, মুরং,খাসিয়া, মগ, ত্রিপুরা, মিজো, মারমা ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীরা এই নরগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
এবার আমরা আলোচনা করব আর্য নরগােষ্ঠী নিয়ে---
২)আর্য নরগােষ্ঠী :
আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগােষ্ঠী। তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে। উত্তর ভারতের গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করে আর্যরা ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদেশে আর্যরা বৈদিক সভ্যতার জন্ম দেয়।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.লম্বা মাথা, সরু ও মাঝারি নাক
২.গায়ের রং ফর্সা
৩. পুরুষদের দাড়ি গােফ বেশি
৪. দেহের গড়ন বলিষ্ঠ
আর্যরা দুটি নরগােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল
যথা- ক)আলপাইন জনগােষ্ঠী
খ)নর্ডিক জনগােষ্ঠী।
নিম্নে এদের সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :
১. আলপাইন জনগােষ্ঠী : নৃতত্ত্ববিদদের মতে পামির মালভূমি হতে এই জনগােষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসবাস শুরু করে । তবে এদেশের আলপাইন আর্যভাষী গােষ্ঠী ছিল ইন্দো-ইরানী গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরা এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূল হয়ে এদেশে প্রবেশ করে।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১.এরা মাঝারি টাইপের দৈহিকগড়নের
২.মাথার খুলি ছােট ও চওড়া
৩.নাক লম্বা, মুখ গােল ও শ্যামলা বর্ণের।
২. নর্ডিক জনগােষ্ঠী :
সুইডেন, নরওয়ে, উত্তর জার্মান,ব্রিটেন ও রাশিয়ার কিছু লােক এ নৃগােষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এদেশে নর্ডিকরা আগমন করে উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চল থেকে।
এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিন্মরূপ:
১)নর্ডিক আর্যরা সাধারণভাবে গৌরবর্ণ
২) লম্বা,উন্নত নাক
৩)কপাল ও ঘাড় লম্বা
৪)দেহ লম্বা ও বলিষ্ঠ।
তাহলে এ আলোচনা থেকে বোঝা গেল অনার্য জনগােষ্ঠীরা এদেশের আদিম জনগােষ্ঠী। আর আর্য জনগােষ্ঠীরা এদের পরে এসেছে।এই দুই জনগােষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত বাঙালির ধমনীতে।
এছাড়া পরবর্তীসময়ে ধর্মপ্রচার ও ব্যবসা বাণিজ্য বা দেশজয়ের জন্য এদেশে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসেছে।এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের আকর্ষণ করেছে বিভিন্ন দেশের মানুষদের। মধ্য এশিয়া, পারস্য, ও তুরস্ক থেকে আসা শক, তুর্কি, পাঠান, মােগল, ইরানি, আবিসিনীয়, আরব জনগােষ্ঠী এদেশে এসে বসবাস করার সুবাদে বাঙালি রক্তের সাথে তাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে। পরে ইংরেজ, পুর্তগিজ এবং ওলন্দাজদের সাথে এই অঞ্চলের মানুষের রক্ত ধারা মিশেছে।এভাবে দেখা যায়, বাঙালি কোন বিশুদ্ধ নৃগােষ্ঠীগত জাতি নয়। বাঙালি জাতি গঠনে নানা ধরনের নরগােষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। অস্ট্রেলীয়রাই (অস্ট্রিক) হচ্ছে এদেশের প্রথম জনগােষ্ঠী। কারাে কারাে মতে, নিগ্রোটোদের হটিয়ে অস্ট্রিকরা এদেশে বসবাস শুরু করে। এরপর দ্রাবিড়রা এদেশে আগমন করে। এদের আধিপত্য শুরু হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকরা মিলে বর্তমান বাঙালি জাতির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। তারপর প্রায় এখন থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে আর্যদের আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়। আর্যরা এদেশের আদিবাসী অনার্যদের পদানত করে এবং এদেশে বর্ণাশ্রম প্রথার সৃষ্টি করে। বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা আর্যগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। মঙ্গোলীয়দের একটি অংশ এদেশে বসবাস করলেও বাঙালি নরগােষ্ঠীর মধ্যে তাদের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। মঙ্গোলীয় জনগােষ্ঠীর পরে আসে শক জাতির লোক পারস্য ও তুর্কিস্থান থেকে। তাদের রক্ত মিশ্রিত হয় এ দেশে বসবাসরত অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-আলপাইনীয় আর্যদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ ছাড়াও এদেশে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক, শাসক ও যাযাবর গােষ্ঠীর আগমন ঘটেছে। তাদেরও রক্ত মিশেছে।
তাই বাঙালি হচ্ছে একটি সংকর জাতি।

FOR MORE CLICK HERE

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]