একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় ‘সেন বংশ' নামক এক নতুন রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। উত্তর বাংলায়
সামন্তচক্রের বিদ্রোহের সময় পাল সাম্রাজ্যে দুর্বলতার সুযোগে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়সেন ধীরে ধীরে
নিজ ক্ষমতা প্রসারিত করেন।পাল সম্রাট মদনপালের রাজত্বকালে সেন রাজবংশ সার্বভৌম ক্ষমতার
অধিকারী হয়। পশ্চিম ও উত্তর বাংলা হতে পাল শাসন এবং দক্ষিণ পূর্ব বাংলা হতে বর্ম শাসনের অবসান
ঘটিয়ে সেনরা প্রায় সমগ্র বাংলায় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। তাঁদের শাসনাধীনেই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলায় একক
স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সেদিক দিয়ে বাংলার ইতিহাসে সেন শাসনের গুরুত্ব রয়েছে।
সেন বংশের আদি পরিচয়
সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত কর্ণাট দেশের (মহারাষ্ট্র ও হায়দ্রাবাদ অঞ্চলের দক্ষিণ ও
মহীশূর রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিম ভাগ) অধিবাসী ছিলেন। সেন রাজাদের লিপি হতে জানা যায়, তাঁরা
চন্দ্রবংশীয় ও ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় ছিলেন। সেনরা কোন সময়ে এবং কিভাবে বাংলায় আগমন করেন সে বিষয়ে
সঠিক কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলেও সেন লিপিমালার ভিত্তিতে কিছুটা ধারণা করা যায়।
সেনদের আগমন কাল সম্বন্ধে বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপি থেকে জানা যায় যে, সামন্ত সেন রামেশ্বর
সেতুবন্ধ পর্যন্ত যুদ্ধাভিযান করে এবং দুর্বৃত্ত কর্ণাটল²ী লুণ্ঠনকারী শত্রুদেরকে ধ্বংস করে শেষ বয়সে
গঙ্গাতটে পূণ্যাশ্রমে জীবনযাপন করেছিলেন।এ থেকে অনুমিত হয় যে, সামন্তসেনই প্রথমে কর্ণাটে বীরত্ব
প্রদর্শন করেছিলেন এবং শেষজীবনে বাংলায় এসে গঙ্গাতীরে বাস করেন। বল্লালসেনের নৈহাটি তাম্রশাসনে
বলা হয়েছে চন্দ্রবংশজাত অনেক রাজপুত্র রাঢ়দেশের অলংকার স্বরূপ ছিলেন এবং তাদের বংশে
সামন্তসেনের জন্ম হয় এবং সামন্তসেনের পূর্বেই কোন এক পূর্বপুরুষ রাঢ়দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
দেওপাড়া লিপি ও নৈহাটি তাম্রশাসনের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করে বলা যায় যে, কর্ণাটের এক সেন বংশ
বহুদিন ধরে রাঢ় অঞ্চলে বাস করেছিল। এই বংশের সামন্তসেন কর্ণাটে বীরত্ব প্রদর্শন করে শেষ বয়সে
রাঢ়ে এসে জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁরই বংশধর বাংলায় রাজক্ষমতা অধিকার করেন।
সেন বংশ কিভাবে সুদূর কর্ণাট হতে এসে বাংলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তার সঠিক জবাব সেন লিপিমালায়
পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়ে আনুমানিক সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা যায়। সেন বংশ সুদূর কর্ণাট হতে এসে
বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে হয় না। বরং এমন মনে করাই স্বাভাবিক যে,
কর্ণাট দেশীয় সেনবংশ কোন এক সময়ে সম্ভবত সামন্তসেনের সময় বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন
এবং ধীরে ধীরে ক্ষমতা অর্জন করে প্রথমে সামন্তরাজা ও পরে সার্বভৌম স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটে সেনবংশের আগমন সম্বন্ধে দুটি গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, পাল
রাজাদের সৈন্যদলে বিভিন্ন অঞ্চলের লোক ছিল। পাল তাম্রশাসনে প্রাপ্ত কর্মচারী তালিকায় নিয়মিতভাবে
‘গৌড়-মালব-খশ-হুন-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট' পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় যে,
কর্ণাটবাসীও পাল সৈন্যদলে ছিল। সৈন্যদলেরই একজন সেনবংশীয় কর্মচারী শক্তি সঞ্চয় করে পশ্চিম
বাংলায় এক রাজ্যাধিপতি হন এবং পরবর্তীতে পাল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে স্বীয় আধিপত্য বিস্তারে
সক্ষম হন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, কর্ণাটের চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ১০৪২ ও ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে
একাধিকবার উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলা আক্রমণ করেন। এ সময় সেন রাজবংশের পূর্বপুরুষ কোন
আক্রমণকারী সৈন্যদলের সাথে দাক্ষিণাত্য হতে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন। পরে এদেরই কেউ
স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বল্লালসেনের সাথে চালুক্য রাজকন্যা রামদেবীর বিবাহ সেনবংশের সাথে
চালুক্যদের সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে। এখানে উল্লেখিত দুটি সম্ভাবনাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। যদিও
সেন লিপিতে এ বিষয়ে কোন আভাস না থাকায় কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়।
সামন্তসেনের পূর্বে সেনবংশের কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। সামন্তসেনই এই বংশের প্রথম ঐতিহাসিক
ব্যক্তিত্ব। তাঁর কর্ণাটদেশে যুদ্ধে যশোলাভ এবং বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাতীরে বাস ব্যতিত আর বিশেষ কিছু জানা
যায় না।
সামন্তসেনের পুত্র হেমন্তসেন। হেমন্তসেনকে বিজয়সেনের লিপিতে ‘মহারাজাধিরাজ' বলে আখ্যায়িত করা
হয়েছে। এই উপাধি হতে ধারণা করা হয়, হেমন্তসেনই সেনবংশের প্রথম রাজা। তবে তিনি সার্বভৌম
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রলিপিতে তাঁকে ‘রাজরক্ষা
সুদক্ষ' বলে উল্লেখ করা হয়। এ থেকে মনে হয় তিনি পাল সাম্রাজ্যের রাঢ় অঞ্চলে সামন্তরাজা ছিলেন এবং
অধিরাজের সাম্রাজ্য রক্ষায় দক্ষতা প্রদর্শন করেন।