বিজয় সেন
হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন সামন্তরাজা হতে নিজেকে স্বাধীন রাজারূপে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং স্ববংশীয়
ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সফল হন।বিজয়সেনের একটি তাম্রশাসন ও একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাম্রশাসনটি
তাঁর ৬২ রাজ্যাঙ্কে লিখিত বলে সাধারণভাবে গৃহীত। সে অনুযায়ী বিজয়সেনের রাজত্বকাল ধরা হয় ১০৯৮
হতে ১১৬০ খ্রি: পর্যন্ত।
পালরাজা রামপালের রাজত্বকালে বিজয়সেন খুব সম্ভবত রাঢ় অঞ্চলে প্রথমে সামন্ত রাজা হয়েছিলেন। পরে
ক্ষুদ্র ভ‚-খন্ডের অধিপতি হন।যে সকল সামন্তরাজা রামপালকে বরেন্দ্র উদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন নিদ্রাবলীর
বিজয়রাজ ছিলেন তাঁদেরই একজন। এই বিজয়রাজই সেনরাজা বিজয়সেন, সে ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে কবি
উমাপতি বিরচিত দেওপাড়া প্রশস্তির ঊনবিংশ শ্লোকে। সেখানে বলা হয়েছে, বিজয়সেন দিব্যভ‚মি বিপক্ষ
দলীয় নরপতিকে দান করেছিলেন এবং প্রতিদানস্বরূপ বিপুল অধিকার লাভ করেছিলেন। শ্লোকে ব্যবহৃত
‘দিব্যভ‚ব' দিব্য কর্তৃক শাসিত ভ‚মি অর্থাৎ বরেন্দ্রকে বোঝাতে পারে।এরূপ অর্থে শ্লোকের ব্যাখ্যা দাঁড়ায় যে,
বরেন্দ্র উদ্ধারে বিজয়সেন পাল রাজাকে সাহায্য করেছিলেন এবং প্রতিদানে তিনি রাঢ়ে স্বাধীন ক্ষমতা লাভ
করেছিলেন।শ্লোকে পাল রাজাকে বিপক্ষ দলীয় বলার কারণ হয়তো এই যে, পরবর্তীকালে তাঁদেরকে পরাস্ত
করে বিজয়সেন গৌড় ও উত্তরবঙ্গ অধিকার করেছিলেন।দেওপাড়া শিলালিপিতে গৌড়ের বিরুদ্ধে
বিজয়সেনের সাফল্যের কথা উল্লেখ আছে। বরেন্দ্র উদ্ধারে রামপালকে সাহায্য করার পরিবর্তে বিজয়সেন
স্বীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এমন মনে করাও অযৌক্তিক নয়। কারণ রামচরিতে উল্লেখ আছে যে,
রামপাল বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও উপঢৌকনের বিনিময়ে সামন্তদের সাহায্য লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। সুতরাং
দেওপাড়া প্রশস্তির শ্লোকের ওপর ভিত্তি করে বিজয়সেনের ক্ষমতা সম্প্রসারণের প্রথম পর্যায় সম্বন্ধে অনুমান
করা যায় যে, তিনি রাঢ়ের সামন্তরাজা ছিলেন, রামপালকে বরেন্দ্র উদ্ধারে সাহায্যের বিনিময়ে তিনি স্বীয়
স্বাধীনতার স্বীকৃতি পান এবং পরবর্তীতে ক্ষমতা সম্প্রসারণ করে সমগ্র বাংলায় স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা
করেন।
বিজয়সেন কর্তৃক স্বীয় ক্ষমতার ক্রমোন্নতির কোন ধারাবাহিক বিবরণ নেই। মনে হয় শূরবংশীয় রাজকন্যা
বিলাসদেবীর সাথে বিয়ে তাঁর ক্ষমতা সম্প্রসারণে সাহায্য করেছিল। এই বিয়ের কথা তাঁর ব্যারাকপুর
তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে। বিজয়সেন উড়িষ্যারাজ অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গেরও সাহায্য লাভ করে থাকতে
পারেন। বল্লাল চরিত গ্রন্থে বিজয়সেনকে ‘চোড়গঙ্গসখা' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
কবি উমাপতিধর রচিত দেওপাড়া শিলিলিপিতে বিজয়সেনের ক্ষমতা সম্প্রসারণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে,
নান্য, বীর, রাঘব ও বর্ধন নামক রাজাগণ তাঁর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন।তিনি কামরূপরাজকে দূরীভ‚ত,
কলিঙ্গরাজকে পরাজিত ও গৌড়রাজকে দ্রুত পলায়নে বাধ্য করেন এবং গঙ্গার স্রোত ধরে এক
‘পাশ্চাত্যচক্রের' বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান প্রেরণ করেন।কিন্তু উমাপতিধর ধারাবাহিকতা বজায় না রাখায় বিভিন্ন
দিকে বিজয়সেনের অভিযান কোনটির পর কোনটি সংঘটিত হয়েছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে সম্ভাব্য
ঘটনাক্রম সম্বন্ধে অনুমান করা যায়।
খুব সম্ভবত নিড়োলে সামন্তরাজা হিসেবে বিজয়সেনের উত্থান শুরু। উত্তর বাংলায় সামন্তবিদ্রোহের সুযোগে
তিনি নিজশক্তি বৃদ্ধি করেন। কৈর্বতদের বিরুদ্ধে রামপালের সাফল্য কিছুদিনের জন্য তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার
অভিযান স্থগিত রাখতে বাধ্য করে এবং তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ইতোমধ্যে শূর পরিবারে তাঁর
বিয়ে রাঢ় অঞ্চলে তাঁর ক্ষমতা দৃঢ় করতে সাহায্য করে। রামপালের দুই দুর্বল উত্তরাধিকারীর রাজত্বকালে
অন্যান্য সামন্তরাজাদের ক্ষমতা খর্ব করে নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। বীর (কোটাটবীর রাজ
বীরগুণ) ও বর্ধন (কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপবর্ধন কিংবা মদনপাল কর্তৃক পরাজিত গোবর্ধন) প্রমুখের বিরুদ্ধে
বিজয়সেনের সাফল্য এই পর্যায়ের।
রাঘব ও কলিঙ্গরাজ সম্ভবত একই ব্যক্তি। রাঘব ছিলেন উড়িষ্যারাজ চোড়গঙ্গের পুত্র। তিনি ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দ
থেকে ১১৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সুতরাং বিজয়সেনের রাজত্বের শেষদিকে রাঘবের সাথে তাঁর
সংঘর্ষ হতে পারে। বিজয়সেন কর্তৃক বাংলায় ক্ষমতা বিস্তারের পর পার্শ্ববর্তী রাজ্য উড়িষ্যার বিরুদ্ধে অভিযান
খুবই স্বাভাবিক।
মিথিলার রাজা নান্যদেবের বিরুদ্ধে বিজয়সেনের যুদ্ধ ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগেই সংঘটিত হয়েছিল। কারণ,
১১৪৭ খ্রি: ছিল নান্যদেবের রাজত্বের শেষ বছর। সুতরাং মনে করা হয়, নান্যদেব ১০৯৭ খ্রি: উত্তর বিহারে
ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে হয়তো বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং বিজয়সেনের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বাঁধে।
প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সাফল্য তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে।
দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিকালে বিজয়সেন প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বর্মরাজ বংশের
ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে তিনি সেখানে সেন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। সম্ভবত একই সময়ে উত্তর বাংলা হতে
পাল শাসনেরও অবসান ঘটে এবং সমগ্র বাংলায় সেন শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজয়সেন যে গৌড়রাজকে দ্রুত
পালাতে বাধ্য করেন তিনি যে পালরাজা মদনপাল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মদনপালের অষ্টম
রাজ্যাঙ্ক পর্যন্ত অর্থাৎ ১১৫২-৫৩ খ্রি: পর্যন্ত উত্তর বাংলায় পাল আধিপত্যের প্রমাণ মনহলি তাম্রশাসন হতে
পাওয়া যায়। সুতরাং এই সময়ের পরেই বিজয়সেন পাল সাম্রাজ্যের ওপর আঘাত হানেন এবং স্বীয় প্রভুত্ব
বিস্তার করেন। রাজশাহীর সাত মাইল পশ্চিমে দেওপাড়া নামক স্থানে বিজয়সেনের প্রাপ্ত লিপি হতে জানা
যায় তিনি ঐ স্থানে প্রদ্যুæেশ্বর শিবের এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সুতরাং এই লিপি প্রমাণ করে
যে, বরেন্দ্রে বিজয়সেনের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।রামচরিত গ্রন্থে মদনপাল কর্তৃক আক্রমণকারী
সৈন্যদলকে কালিন্দী পর্যন্ত হটিয়ে দেবার যে উল্লেখ আছে তাতে সম্ভবত বিজয়সেনের আক্রমণের কথাই
বলা হয়েছে। মদনপাল প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করলেও মদনপালের অষ্টম রাজ্যাঙ্কের পর উত্তর ও
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাল লিপির অনুপস্থিতি বিজয়সেন কর্তৃক এই অঞ্চলে প্রভুত্ব বিস্তারের কথাই প্রমাণ
করে।
পাল শক্তির বিরুদ্ধে সাফল্যের পর বিজয়সেন গঙ্গাস্রোত ধরে কোন এক পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে
বিজয়াভিযান প্রেরণ করা খুব অস্বাভাবিক নয়।সম্ভবত গাহড়বাল রাজই এই পাশ্চাত্য শক্তি। কারণ সে সময়
গাহড়বাল শক্তিই বিহার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তবে এই নৌ-অভিযানে বিজয়সেনের সাফল্য সম্বন্ধে
কোন ধারণা পাওয়া যায় না।
বিক্রমপুর হতে প্রকাশিত বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসন হতে প্রমাণিত হয় যে, চন্দ্র ও বর্মর্ রাজবংশের
রাজধানী বিক্রমপুর সেন রাজ্যের রাজধানী হয়েছিল। একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে দ্বাদশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বর্মরাজাদের শাসন বজায় ছিল।বিজয়সেন বর্মরাজাদের শাসনের
অবসান ঘটিয়ে এই অঞ্চলে সেন প্রভ‚ত্ব বিস্তার করেন।
বিজয়সেন কর্তৃক উল্লেখিত অভিযানসমূহ সেন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতা সম্প্রসারণের চেষ্টারই
অভিব্যক্তি।তাঁর সাফল্যের বিবরণ হতে দেখা যায়, বহুযুদ্ধে তিনি জয়লাভ করে প্রায় সমগ্র বাংলায় এক
অখন্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
বিজয়সেন কর্তৃক পাল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র বাংলায় স্ব-বংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসে
অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।সেন বংশের অধীনেই সর্বপ্রথম বাংলা দীর্ঘকালব্যাপী একাধিপত্যে ছিল। এই
আধিপত্যের ফল বাংলার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, সে কারণেই সেন যুগের এত গুরুত্ব।
বিজয়সেন পরম মহেশ্বর, পরমেশ্বর, পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন এবং “অরিরাজ
বৃষভ শঙ্কর' গৌরবসূচক নামেও পরিচিত ছিলেন। দেওপাড়া প্রশস্তিতে বিজয়সেন কর্তৃক অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞের
উল্লেখ রয়েছে। এসব যাগযজ্ঞ হতে অনুমান করা হয়, বৈদিক ধর্মের প্রতি তিনি বিশেষ শ্রদ্ধাবান ছিলেন।
ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর অনুগ্রহে ব্রাহ্মণগণ বিত্তশালী ও ধনবান হয়ে উঠেছিল। তাই
বিজয়সেন কর্তৃক উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি শ্রী হর্ষ তাঁর বিজয় প্রশস্তি ও গৌড়বীর্শক‚ল-প্রশস্তি রচনা করেছিলেন,
এরূপ মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।সুতরাং একদিকে বিজয়সেন যেমন সমরাঙ্গনে সাফল্য অর্জন করে
সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ধর্মকর্মের দিকেও তিনি যতœবান ছিলেন। তাই
বাংলায় সেন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিজয়সেন স্মরণীয় হয়ে আছেন।