লক্ষণসেন


লক্ষণসেন
বল্লালসেনের পর তাঁর পুত্র লক্ষণসেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। লক্ষণসেনের রাজত্বে প্রকাশিত ৮টি
তাম্রশাসন, তার সভাকবিগণ কর্তৃক রচিত কয়েকটি স্তুতিবাচক শ্লোক, তাঁর পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসন ও
ঐতিহাসিক মিনহাজুদ্দিন বিরচিত “তাবাকাৎ-ই-নাসিরি” নামক গ্রন্থ হতে তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা
যায়।
মাধাইনগর তাম্রশাসন ও ভাওয়াল তাম্রশাসন ব্যতিত অন্য তাম্রশাসনগুলো তাঁর রাজত্বের ৬ষ্ঠ বছরের মধ্যে
উৎকীর্ণ। এগুলোতে লক্ষণসেন সম্বন্ধে সাধারণভাবে প্রশংসাসূচক শ্লোক রয়েছে। তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে সঠিক
বর্ণনা নেই। তবে মাধাইনগর ও ভাওয়াল তাম্রশাসনে তাঁর কৃতিত্বের অতি স্তুতিবাচক বর্ণনা পাওয়া যায়।
এখানে বলা হয়েছে, তিনি কৌমারে উদ্ধত গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ ও যৌবনে কলিঙ্গদেশ অভিযান করেন।
তিনি যুদ্ধে কাশীরাজকে পরাজিত করেন এবং ভীরু প্রাগজ্যোতিষের (কামরূপ ও আসাম) রাজা তাঁর বশ্যতা
স্বীকার করেন। মাধাইনগর তাম্রশাসনে লক্ষণসেনকে অতি উচ্চ সম্মানসূচক উপাধি ‘বীর চক্রবর্তী সার্বভৌম
বিজয়ী' দেয়া হয়েছে। তাঁর পুত্রদের তাম্রশাসনে প্রশংসা করে বলা হয়েছে তিনি পুরী, বারাণসী ও প্রয়াগে


“সমরস্তম্ভ” স্থাপন করেন। এসব শ্লোকের ওপর বিশ্বাস করলে মনে হয় লক্ষণসেন বিজয়াভিযানকালে গৌড়,
কলিঙ্গ,কামরূপ ও কাশীর রাজাদের পরাজিত করেছিলেন। তবে মাধাইনগর ও ভাওয়াল তাম্রশাসনে ব্যবহৃত
‘কৌমারকেলী' পদটি তাৎপর্যপূর্ণ।সুতরাং যেসব বিজয়াভিযানের উল্লেখ রয়েছে সেগুলো লক্ষণসেনের
যৌবনে ঘটেছিল মনে করাই সঙ্গত। সম্ভবত তাঁর পিতামহের রাজত্বকালে যেসব বিজয়াভিযান সংঘটিত
হয়েছিল, লক্ষণসেন সেসব অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মিনহাজের বর্ণনা হতে জানা যায়, বখতিয়ার
খলজীর আক্রমণকালে লক্ষণসেন আশি বছরের বৃদ্ধ ছিলেন। সুতরাং পিতামহের রাজত্বকালে তাঁর
যৌবনকালই চলছিল।
ভাওয়াল তাম্রশাসন লক্ষণসেনের রাজত্বের ২৭ রাজ্যাঙ্কে (সম্ভবত মুসলিম আক্রমণের পর) উৎকীর্ণ
হয়েছিল। মাধাইনগর তাম্রশাসনও কাছাকাছি সময়ে উৎকীর্ণ বলে মনে হয়। কারণ এই তাম্রশাসনে
‘ঐন্দ্রিমহাশক্তি যজ্ঞে'র উল্লেখ আছে। এই যজ্ঞ কোন আগত বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়।
মুসলমান আক্রমণই হয়তো এই আগত বিপদ। সুতরাং ভাওয়াল ও মাধাইনগর তাম্রশাসন দুটি লক্ষণসেনের
রাজত্বের শেষ দিকের এবং এ সময় সেনরাজ্য হয় মুসলমান আক্রমণের অপেক্ষা করছিল নাহয় আক্রমনের
ফলে সাম্রাজ্যের কিছু অংশ ইতোমধ্যেই হারিয়েছিলেন। এমন এক বিপদের সময় বিগত গৌরব ও কৃতিত্বের
কথা উচ্চারণ করার প্রয়োজনের তাগিদেই প্রশস্তিকার লক্ষণসেনের যৌবনকালের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ
করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকের তাম্রশাসনে এসব কৃতিত্বের উল্লেখ একেবারেই
অনুপস্থিত। কিন্তু পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসনে এসব কৃতিত্বকে আরো গৌরবময় করতে লক্ষণসেন কর্তৃক
বিভিন্নভাবে ‘সমরজয় স্তম্ভ' স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া সমসাময়িক গাহড়বালরাজ জয়চন্দ্রের
(১১৭৩-১২১৯ খ্রি:) রাজত্বকালে উত্তর বিহার ও মগধের পশ্চিমাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। কাশী ও
প্রয়াগও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। সুতরাং তাঁকে পরাজিত করে কাশী ও প্রয়াগে লক্ষণসেন জয়স্তম্ভ স্থাপন
করেছিলেন বলে মনে হয় না।
ভাওয়াল ও মাধাইনগর তাম্রশাসনে লক্ষণসেন ‘গৌড়েশ্বর' উপাধি গ্রহণ করেন।কিন্তু বিজয়সেন ও
বল্লালসেন এই উপাধি ব্যবহার করেননি।এমনকি লক্ষণসেনের রাজত্বের প্রথম দিকে উৎকীর্ণ
তাম্রশাসনসমূহেও এই উপাধির ব্যবহার দেখা যায় না। সুতরাং বিজয়সেন ও বল্লালসেনের তাম্রশাসনে
‘গৌড়েশ্বর' উপাধির অনুপস্থিতি এবং লক্ষণসেনের তাম্রশাসনে এই উপাধির প্রথম ব্যবহার হতে অনেক
অনুমান করেন যে, গৌড় লক্ষণসেনের শাসনকালেই পুরোপুরিভাবে সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ গৌড়
বিজয় অসমাপ্ত ছিল এবং লক্ষণসেন এই বিজয় সম্পন্ন করে ‘গৌড়েশ্বর' উপাধি ধারণ করেন। তবে এই
অনুমান তেমন যুক্তিসঙ্গত নয়। মদনপালের পর বাংলার কোন অংশে পাল শাসনের কোন নিদর্শন আজ
পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাছাড়া গৌড় অঞ্চলে লক্ষণসেনের প্রভুত্ব তাঁর রাজত্বকালের প্রথম বছর হতেই ছিল
বলে প্রমাণ আছে। তাঁর দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্কে গোবিন্দপুর তাম্রশাসনের মাধ্যমে তাঁর অভিষেক উপলক্ষে গৌড়
অঞ্চলে ভ‚মিদান করা হয়। তাঁর ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্কে শক্তিপুর তাম্রশাসনের মাধ্যমেও গৌড় অঞ্চলে ভ‚মিদান করা
হয়। সুতরাং লক্ষণসেন কর্তৃক গৌড় বিজয় সম্পন্ন করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই।‘গৌড়েশ্বর' উপাধি গ্রহণের
তাৎপর্য অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কেবলমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রাজত্বরত বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন
কর্তৃক ‘গৌড়েশ্বর' উপাধি গ্রহণ বা তাঁদের তাম্রশাসনে সকল সেন রাজার প্রতি এই উপাধির ব্যবহার
একথাই প্রমাণ করে যে, মুসলিম আক্রমণের ফলে গৌড় অঞ্চল হাতছাড়া হওয়ার পর পূর্ব গৌরব বজায়
রাখা ও তা ঘোষণা করার প্রয়োজনে এই উপাধি ব্যবহার করা হয়েছে। মগধের অংশবিশেষের পাল রাজা
গোবিন্দপাল ও পলপাল কর্তৃক ‘গৌড়েশ্বর' উপাধি গ্রহণ এই প্রবণতারই ফল।
লক্ষণসেন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সমরক্ষেত্রে কোন সাফল্য অর্জন করেছিলেন কিনা তা স্পষ্ট জানা
যায় না। ‘প্রবন্ধকোষ' ও ‘পুরাতন প্রবন্ধ সংগ্রহ' নামক জৈন গ্রন্থদুটি হতে অনুমান করা হয়, লক্ষণসেন তাঁর
মন্ত্রী কুমারদেবের বুদ্ধি ও কৌশলের দরুন গাহাড়বাল রাজাদের আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন।
লক্ষণসেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক নামহীন রাজার বিজয় কাহিনী
বর্ণিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে, সেই রাজা প্রাগ্জ্যোতিষ, গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি অঞ্চল জয়


করেন এবং চেদি (রতনপুরের কলচুরি বংশ) ও ¤েøচ্ছ রাজকে পরাজিত করেন। চেদি ও ¤েøচ্ছরাজ ব্যতিত
অন্যান্য বিজয়গুলো লক্ষণসেন সম্বন্ধে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। শ্লোকগুলো লক্ষণসেনের উদ্দেশ্যেই
রচিত। মধ্যপ্রদেশের একটি লিপিতে আছে যে, চেদিদের সামন্ত বল্লভরাজ গৌড়রাজকে পরাজিত করেন।
সুতরাং লক্ষণসেনের সাথে চেদিরাজদের সংঘর্ষ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যদিও এর ফলাফল সম্বন্ধে সঠিক
তথ্য জানা যায় না। লক্ষণসেনের সভাকবি শরণ লক্ষণসেন কর্তৃক এক ¤েøচ্ছরাজার পরাজয়ের কথা উল্লেখ
করেন। নিহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, বখতিয়ার কর্তৃক নদীয়া জয়ের পূর্বে বা পরে লক্ষণসেন তাঁর
বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করেছিলেন। এবং শরণ এরই উল্লেখ করেন। তবে অনেকে অনুমান করেন, ¤েøচ্ছ
বলতে আরাকানের মগ বুঝিয়েছেন, যারা হয়ত বাংলায় আগমন করেছিল এবং লক্ষণসেন তাদের পরাজিত
করেছিলেন।
লক্ষণসেনের রাজত্বের শেষদিকে বার্ধ্যক্যের কারণে তিনি দূর্বল হয়ে পড়েন।এ সময় সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ
বিপ্লবের চিহ্ন লক্ষ করা যায়। সুন্দরবন এলাকায় ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে ডোম্মনপাল নামক এক স্বাধীন রাজার
অস্তিত্ব সেন শাসনের দুর্বলতারই পরিচয় বহন করে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতে মুসলিম শক্তির
আবির্ভাব ঘটে এবং ক্রমশ সেন সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা পর্যন্ত মুসলিম শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
সম্ভবত ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খলজী নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সময় বৃদ্ধ
লক্ষণসেন নদীয়ায় অবস্থান করেছিলেন। বখতিয়ার নদীয়া আক্রমণ করলে তিনি প্রতিরোধ না করে নদীপথে
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান। ফলে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় অবস্থান করে লক্ষণসেন আরো দুই-এক বছর রাজত্ব করেন। অবশেষে আনুমানিক
১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
লক্ষণসেনের রাজত্বকালে (১১৭৮-১২০৫ খ্রি:) সেন শাসন চরম উন্নতি এবং চরম অবনতি উভয়পথেই
ধাবিত হয়।রাজত্বের প্রথম দিকে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি লক্ষণসেন শান্তিকালীন বিভিন্ন কার্যে মনোযোগ
দেন। রাজত্বের শেষদিকে উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়
সীমাবদ্ধ রাজ্যের অধিপতিতে পরিণত হন।
লক্ষণসেন নিজে ছিলেন সুপন্ডিত এবং সুকবি। পিতার অসমাপ্ত গ্রন্থ ‘অদ্ভূতসাগর' তিনি সমাপ্ত করেন।
এছাড়া তাঁর রচিত কয়েকটি শ্লোক পাওয়া গেছে। লক্ষণসেনের রাজসভা সেই যুগের জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিবর্গ
দ্বারা অলংকৃত ছিল। সভায় ধোয়ী, শরণ, জয়দেব, গোবর্ধন, উমাপতিধর প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিগণের সমাবেশ
ঘটেছিল। ভারত প্রসিদ্ধ পন্ডিত হলায়ূধ তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও ধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। হলায়ূধ ব্রাহ্মণসর্বস্ব এবং
মৎস্যসূক্ত ভিন্ন মীমাংসাসর্বস্ব, বৈষ্ণবসর্বস্ব ও পন্ডিত সর্বস্ব রচনা করেন। হলায়ূধের সমসাময়িক অন্যান্য
পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন পুরুষোত্তম, পশুপতি ও ঈশান। কবিদের মধ্যে গোবর্ধন ‘আর্যসপ্তশতী', জয়দেব
‘গীতগোবিন্দ' এবং কবীন্দ্র ধোয়ী ‘পবনদূত' রচনা করে অমরত্ব লাভ করেন।এ সময়ে সাহিত্যের পাশাপাশি
শিল্পক্ষেত্রেও বাংলা উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছিল।
লক্ষণসেন পিতা ও পিতামহের শৈবধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি পিতা ও পিতামহের
‘পরম মহেশ্বর' উপাধি ত্যাগ করে ‘পরমবৈষ্ণব' উপাধি ধারণ করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ লক্ষণসেনের
দানশীলতা ও ঔদার্যের সুখ্যাতি এবং শাসনরীতির প্রশংসা করে তাঁকে হিন্দুস্তানের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক
খলিফা স্থানীয় বলে বর্ণনা করে। সে যুগের হাতেম কুতুবুদ্দিনের সাথে তুলনা করেন এবং আল্লাহ্র কাছে
প্রার্থনা করেন যেন লক্ষণসেনের পরলোকে শাস্তি লাঘব করেন।
সেন শাসনের শেষ পর্যায়
লক্ষণসেনের পর তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই দুই ভ্রাতার
মোট রাজত্বকাল প্রায় ২৫ বছর (আনুমানিক ১২০৫-১২৩০ খ্রি:) ছিল বলে অনুমান করা হয়। দুই রাজারই
তাম্রশাসন পাওয়া গেছে এবং উভয়েই ছিলেন সূর্যের উপাসক।
বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের রাজত্বকালের বিস্তৃত বিবরণ নেই। তাঁদের তাম্রশাসন বিক্রমপুর ও বঙ্গ অঞ্চলে
ভ‚মিদান করেছিল। সুতরাং তাঁদের রাজ্য সীমা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়।নদী
বিধৌত এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে আরো প্রায় এক শতাব্দী সময় লাগে। তাম্রশাসনে
বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন উভয়েই ‘যবনাম্বয়-প্রলয়-কালরুদ্র' বলে অভিহিত হন। সুতরাং ধারনা করা হয়,
তাঁরা মুসলিম আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা কেবল প্রশস্তিকারের স্তুতিবাক্যই নয়,
মিনহাজউদ্দিনের ইতিহাস হতেও প্রমাণিত হয় যে, তুর্কিগণ উত্তরবঙ্গ সমগ্র বা অধিকাংশ অধিকার করলেও
বহুদিন পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ অধিকার করতে পারেন নাই।
বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে কুমার সূর্যসেন ও পুরুষোত্তমসেনের নাম পাওয়া যায়। এদের কেউ রাজত্ব
করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। তবে মিনহাজ যে সময়ে (আনু: ১২৪৪-৪৫ খ্রি:) লক্ষণাবতীতে এসে
বাংলার ঐতিহাসিক বিবরণ সংগ্রহ করেন তখনও লক্ষণসেনের বংশধর বঙ্গে রাজত্ব করছিলেন বলে মিনহাজ
তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেন। সুতরাং কেশবসেনের পরেও একাধিক সেন রাজা বঙ্গে রাজত্ব করতেন বলে
মনে হয়। তবে তাঁদের বিস্তারিত ইতিহাস জানা যায়নি।
বিক্রমপুরে প্রকাশিত আদাবাড়ি তাম্রশাসন হতে ‘দশরথদেব' নামক এক রাজার নাম পাওয়া যায়। তিনি
পরমেশ্বর, পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ অধিরাজ দনুজমাধব উপাধি ধারন করেন। সম্ভবত দিল্লির সুলতান
গিয়াসউদ্দিন বলবন বাংলা অভিযানের সময় ‘রায় দনুজ' নামক যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজার সাথে সন্ধি
করেন তিনিই সেই দশরথদেব।ত্রয়োদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কোন সময়ে বিক্রমপুরে সেন শাসনের
অবসান ঘটে এবং ‘দেব' নামক এক রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।এ অঞ্চলে এটিই শেষ হিন্দু
রাজবংশ। কেননা, এরপর (ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে ও চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে) এ অঞ্চলে মুসলিম
আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
সারসংক্ষেপ
সেনদের শাসনাধীনে বাংলা সর্বপ্রথম একক স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিজয়সেন হলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। উমাপতি ধরের দেওপাড়া প্রশস্তির
আলোকে বিজয়সেনের গৌরবগাঁথা বিস্তারিত জানা যায়। বিজয়সেনের পর বল্লালসেন ও লক্ষণসেন
রাজত্ব করেন। বল্লালসেনকে কুলীন প্রথার প্রবর্তক মনে করা হয়, যদিও এর কোন যুক্তিযুক্ত ভিত্তি
নেই। তিনি একজন পন্ডিত হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লক্ষণসেনের আমলে মুসলিম
আক্রমণে সেন শাসনের অবসান ঘটে। ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণেও সেনদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে
পড়ে।বখতিয়ার খলজীর নদীয়া আক্রমণের পর লক্ষণসেন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান।
সুপন্ডিত এবং কবি হিসেবে লক্ষণসেন বিখ্যাত ছিলেন।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। ‘মহারাজাধিরাজ' উপাধিকারী প্রথম সেন শাসকের নাম কী?
(ক) বিজয়সেন (খ) হেমন্তসেন
(গ) সামন্তসেন (ঘ) বীরসেন।
২। সেনদের আদি নিবাস কোথায়?
(ক) উত্তরবঙ্গে (খ) পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে
(গ) দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট দেশে (ঘ) উত্তর ভারতের কান্যকুব্জে।
৩। দেওপাড়া প্রশস্তির রচয়িতা কে?
(ক) সন্ধ্যাকর নন্দী (খ) শ্রীধর দাস
(গ) হরিষেণ (ঘ) উমাপতিধর।
৪। নান্যদেব কোন্ অঞ্চলের রাজা?
(ক) মিথিলা (খ) উড়িষ্যা
(গ) কোটাটবীর (ঘ) কলিঙ্গ।
৫। ‘বিদ্বানমন্ডলীর চক্রবর্তী' কে ছিলেন?
(ক) বল্লালসেন (খ) লক্ষণসেন
(গ) বিজয়সেন (ঘ) হেমন্তসেন।
৬। ‘ঐন্দ্রিমহাশান্তিযজ্ঞ' অর্থ কী?
(ক) সুখ-শান্তির নিমিত্তে যজ্ঞ (খ) আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তির জন্য যজ্ঞ
(গ) রাজার দীর্ঘায়ু কামনার জন্য যজ্ঞ (ঘ) রাজ্যের সীমানা নির্ধারণের জন্য যজ্ঞ।
৭। লক্ষণসেনের প্রধানমন্ত্রী ও ধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন কোন্ পন্ডিত?
(ক) জয়দেব (খ) শরণ
(গ) উমাপতিধর (ঘ) হলায়ূধ।
৮। ‘আর্যসপ্তশতী' রচয়িতা কে?
(ক) গোবর্ধন (খ) ধোয়ী
(গ) শরণ (ঘ) শ্রীধরদাস।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সেন বংশের পরিচয় দিন।
২। বিজয়সেন কে ছিলেন?
৩। ‘গৌড়েশ্বর' কাকে ও কেন বলা হয়?
৪। ‘যবনান¦য়-প্রলয়-কালরুদ্র' কাকে, কেন বলা হয়?


রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। সেনদের আদি পরিচয় দিন। সেন ইতিহাসের উৎস কি কি? সেন শাসকদের বংশতালিকা প্রণয়ন
করুন।
২। দেওপাড়া প্রশস্তির আলোকে বিজয়সেনের কৃতিত্ব নিরূপণ করুন। কেন তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ সেন শাসক
বলা হয়?
৩। বল্লালসেন ও লক্ষণসেনের আমলে বাংলার সেন বংশের ইতিহাস মূল্যায়ন করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। জ.ঈ. গধলঁসফধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ইবহমধষ.
২। অ.গ. ঈযড়ফিযঁৎু, উুহধংঃরপ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ.
৩। আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৪। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ।
৫। নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব।

FOR MORE CLICK HERE

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]