প্রাচীন বাংলার শাসন-ব্যবস্থা
গুপ্ত শাসনের পূর্বে প্রাচীন বাংলার রাজ্যশাসন পদ্ধতি সম্বন্ধে সঠিক কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। প্রাচীন বাংলার শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দিতে গেলে সবার আগে কৌম সমাজের কথা মনে পড়ে। এদেশে গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই কৌম সমাজই ছিল সর্বেসর্বা। তখন রাজা ছিল না, রাজত্ব ছিল না। তবু শাসন-পদ্ধতি সামান্য মাত্রায় ছিল। তখন মানুষ একসাথে বসবাস করত। কোমদের মধ্যে পঞ্চায়েতী প্রথায় পঞ্চায়েত দ্বারা নির্বাচিত দলনেতা স্থানীয় কৌম শাসনব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিতেন। বাংলার এ কৌম ব্যবস্থা চিরস্থায়ী হয়নি। খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকের পূর্বেই বাংলায় কৌমতন্ত্র ভেঙ্গে গিয়ে রাজতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল।
গুপ্তদের সময় বাংলার শাসন-পদ্ধতির পরিষ্কার বিবরণ পাওয়া যায়। আনুমানিক দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে উত্তরবঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বাংলায় মৌর্য শাসনের কেন্দ্র ছিল পুন্ড্রনগর-বর্তমান বগুড়ার পাঁচ মাইল দূরে মহাস্থানগড়ে। মনে হয় ‘মহামাত্র’ নামক একজন রাজ প্রতিনিধির মাধ্যমে তখন বাংলায় মৌর্য শাসনকার্য পরিচালিত হতো। বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও সমগ্র বাংলা গুপ্ত সম্রাটদের সরাসরি শাসনে ছিল না। বাংলার যে অংশ গুপ্ত সম্রাটদের সরাসরি শাসনে ছিল না তা ‘মহারাজা’ উপাধিধারী মহাসামন্তগণ প্রায় স্বাধীন ও আলাদাভাবে শাসন করতেন। এ সমস্ত সামন্ত রাজারা সব সময় গুপ্ত সম্রাটের কর্তৃত্বকে মেনে চলতেন। ধীরে ধীরে বাংলার সর্বত্র গুপ্ত সম্রাটদের শাসন চালু হয়। এ মহাসামন্তদের অধীনে বহু কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন।
বাংলাদেশের যে অংশ সরাসরি গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে ছিল তা কয়েকটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিভাগের নাম ছিল ‘ভুক্তি’। প্রত্যেক ‘ভুক্তি’ আবার কয়েকটি বিষয়ে, প্রত্যেক বিষয় কয়েকটি মণ্ডলে, প্রত্যেক মণ্ডল কয়েকটি বীথিতে এবং প্রত্যেকটি বীথি কয়েকটি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রামই ছিল সবচেয়ে ছোট শাসন বিভাগ।
গুপ্ত সম্রাট নিজে ভুক্তির শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন। কোনো কোনো সময় রাজকুমার বা রাজপরিবার থেকেও ভুক্তির শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হতো। ভুক্তিপতিকে বলা হত ‘উপরিক’। পরবর্তী সময়ে শাসকগণ ‘উপরিক মহারাজ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। সাধারণত ‘উপরিক মহারাজ’-ই তাঁর বিষয়গুলোর শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন। কিন্তু কোনো কোনো সময়ে সম্রাট নিজে তাদের নিয়োগ করতেন। গুপ্তযুগের ভুক্তি ও বিষয়গুলোকে বর্তমান সময়ের ন্যায় বিভাগ ও জেলার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। গুপ্তদের সময় বাংলার বেসামরিক শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সামান্য তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সামরিক শাসন সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। তেমনিভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানও খুবই কম। এ ব্যাপারে মাত্র কয়েকজন কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। এ হতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, গুপ্তদের সময়ে মোটামুটি একটি সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
ছয় শতকে উত্তর-পশ্চিম বাংলায় গুপ্তবংশের শাসন শেষ হয়ে যায়। বঙ্গ স্বাধীন ও আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন বঙ্গে যে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা মূলত গুপ্ত আমলের প্রাদেশিক শাসনের মতোই ছিল। গুপ্তদের সময়ে রাজতন্ত্র ছিল সামন্ত নির্ভর। এ আমলে তার পরিবর্তন হয়নি। বরং সামন্ততন্ত্রই আরও প্রসার লাভ করেছে। গুপ্ত রাজাদের মতো বাংলার সামন্ত রাজাগণও ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করতেন। এঁরাও বিভিন্ন শ্রেণির বহুসংখ্যক রাজকর্মচারী নিয়োগ করতেন।
আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাল বংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গের নতুন যুগের শুরু হয়। পাল বংশের চার শতাব্দীর রাজত্বকালে বঙ্গে তাদের শাসন-ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্বের মতো পাল যুগেও শাসন-ব্যবস্থার মূল কথা হলো রাজতন্ত্র। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ ছিলেন রাজা স্বয়ং। পরাক্রান্ত পাল রাজারা প্রাচীন বাংলার ‘মহারাজ’ বা পরবর্তীকালের ‘মহারাজাধিরাজ’ পদবীতে সন্তুষ্ট থাকেননি। গুপ্ত সম্রাটগণের মতো তাঁরাও ‘পরমেশ্বর’, ‘পরমভট্টারক’, ‘মহারাজাধিরাজ’ প্রভৃতি গৌরবময় উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। রাজার পুত্র রাজা হতেন। এ নিয়ম থাকা সত্ত্বেও ভ্রাতা ও রাজ পরিবারের অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরোধ ও সংঘর্ষ হতো। এ সময় হতে সর্বপ্রথম একজন প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সচিবের উলে- পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সর্বপ্রধান রাজ কর্মচারী।
রাজ্যের সকল প্রকার শাসনকার্যের জন্য কতকগুলো নির্দিষ্ট শাসন-বিভাগ ছিল। এর প্রতিটি বিভাগের জন্য একজন অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকতেন। রাজা মন্ত্রী ও আমাত্যগণের সাহায্যে কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনা করতেন। পিতা জীবিত থাকলেও অনেক সময় যুবরাজ শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের বিভিন্ন উৎস ছিল। এর মধ্যে নানা প্রকার কর ছিল প্রধান। বিভিন্ন রকমের রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। রাজস্ব আয়-ব্যয়ের হিসাব ও দলিল বিভাগ দেখাশুনা করার ব্যবস্থা ছিল। ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ঠিক করার জন্য জমি জরিপের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। মুদ্রা এবং শস্যের আকারে রাজস্ব আদায় হতো। পাল রাজাদের সময়ে শান্তি রক্ষার জন্য সুন্দর বিচার ও পুলিশ বিভাগ ছিল। এ সময়ে গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর বাহিনী ছিল। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তী ও রণতরী- এ কটি বিভাগে সামরিক বাহিনী বিভক্ত ছিল।
গুপ্তদের মতো পালদের সময়েও সামন্ত রাজাদের উলে- পাওয়া যায়। এঁদের নানা উপাধি ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনের শৌর্যখ ও বীর্য সামন্তদের অধীনতায় থাকতে বাধ্য করত। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে এঁরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। পাল শাসকদের শক্তি অনেকাংশে এরূপ সামন্তরাজদের সাহায্য ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করত।
পাল রাজ্যে যে শাসন-পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছিল তা পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ ও সেন রাজত্বকালে রাষ্ট্র শাসনের আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত লাভ করে। অবশ্য কোনো কোনো বিষয়ে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। সেন বংশীয় রাজারা পাল রাজাদের রাজ-উপাধি ছাড়াও নানাবিধ উপাধি ধারণ করতেন। এ সময়ে রানীকে রাজকীয় মর্যাদা দেয়া হয়েছে। শাসনকার্যে যুবরাজদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। জ্যৈষ্ঠ রাজকুমার যুবরাজ হতেন। পূর্বের মতো সেনদের সময়েও অনেক সামন্ত শাসক ছিলেন। তাঁদের শক্তি ও প্রভাব খুব প্রবল ছিল। এ সকল সামন্তরা প্রকৃতপক্ষে নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীন রাজার মতোই চলতেন।
মোটামুটিভাবে এই ছিল প্রাচীন বাংলার শাসন-পদ্ধতি। এ শাসন ব্যবস্থায় বিদেশিদের প্রভাব কি পরিমাণ ছিল তা বলা যায় না। পণ্ডিতদের মতে, শাসন পদ্ধতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সে সময়ে ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় মোটেই পিছিয়ে ছিল না