আমেরিকার স্বাধীনতা সগ্রামের পটভূমি ও কারণ।

আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম
কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কার, আমেরিকায় ইংল্যান্ডের উপনিবেশ স্থাপন এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি প্রতিটি ঘটনাই ইতিহাসের খুব আকর্ষণীয় অধ্যায়। স্পেনীয় রাজদম্পতি ফাডিল্যান্ড ও ইসাবেলার একান্ত উৎসাহ অনুপ্রেরণা ও সহযােগিতায় দুঃসাহসী ইতালীয় নাবিক কলম্বাস দূরপ্রাচ্যের জলপথ আবিষ্কারের জন্য বের হয়ে ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর আমেরিকার সানসালভেদরে এসে পৌছান এবং আবিষ্কার করেন এক বিপুল সমৃদ্ধশালী ও প্রাচুর্যময় মহাদেশ যার নাম আমেরিকা। পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরােপীয় শক্তি নতুন এ অঞ্চলে অভিযান চালালেও বসতি স্থাপনের মাধ্যমে সেখানকার সম্পদ আহরণ করে দেশকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে নৌবলে দক্ষ ইংল্যান্ডই সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দেয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইংল্যান্ডের রাজা ৩য় জর্জের ঘটনাবহুল রাজত্বকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আজকের যে যুক্তরাষ্ট্র তা ছিল মূলত তৎকালীন ব্রিটেনের ১৩টি উপনিবেশ। ব্রিটেনের রাজা ৩য় জর্জ, প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল এবং লর্ড নর্থের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও জন আকাক্ষা বিরােধী রীতিনীতি প্রবর্তনের কারণে এসব উপনিবেশসমূহে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এ পূঞ্জীভূত ক্ষোভের বহি প্রকাশই হচ্ছে ১৭৭৬ খ্রি. সংঘটিত আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ । ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ যুদ্ধে ইংল্যান্ড পরাজিত হয় এবং জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ। ইংরেজগণ প্রথম সফল ও স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত ভার্জিনিয়া জেমসটাউনে ১৬০৭ সালে। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জেমসের নিকট হতে সনদপ্রাপ্ত হয়ে ভার্জিনিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন জন স্মিথ এ
আমেরিকার স্বাধীনতা সগ্রামের পটভূমি ও কারণ।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আঠার শতকের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘােষণা করে।
স্ত এ স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপট ছিল সুদীর্ঘ। মূলত ইংল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের অধীন আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ এর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক বিরােধ এবং উভয়ের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যই তৈরি করেছিল এ যুদ্ধের পটভূমি। আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন এ্যাডামসের মতে, স্বাধীনতার স্পৃহা ও বীজ ছিল আমেরিকার প্রতিটি মানুষের অন্তরে । আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ করে ১৭৪০ -১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও লেখনিতে ব্রিটেনের সঙ্গে আমেরিকানদের চিন্তাধারা ও আদর্শের পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে থাকে এসব পত্র-পত্রিকায় মধ্যযুগীয় সামত্ম প্রথার দোষ-ত্রুটি, ধর্ম প্রতিষ্ঠান তথা চার্চের দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে সমালােচনা এবং নিজেদের ভবিষ্যত
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম। নিজেদের অর্থনৈতিক শােষণকে নিরাপদ রাখতে আরও সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে উপনিবেশসমূহে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমশ জোড়ালাে হয়ে ওঠে । এসময় অনেকেই নিজেদেরকে মেধা ও যােগ্যতায় ইংল্যান্ডবাসীর সমকক্ষ মনে করতে থাকে এবং আত্মনিয়ন্ত্রিত সরকার গঠনের কথা বলতে থাকে। তারা অন্যায়ভাবে সুবিধাভােগী। সরকারের অনুগতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায় । উপনিবেশবাসীর দাবি ও মনােভাবকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের শােষণ ধারা যেমন অব্যাহত রাখে তেমনি তাদের অনুগতদের সুযাগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও উদারতার পরিচয় দিতে থাকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এসময় একের পর এক উপনিবেশের স্বার্থ বিরােধী বিভিন্ন আইন পাশ হতে থাকে। এমতাবস্থায় নিজেদের স্বার্থে উপনিবেশের প্রধানত ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতি শ্রেণী একদিকে যেমন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এসব আইনের বিরােধিতা করতে থাকে অন্যদিকে ব্রিটিশদের অনুগত শ্রেণীর সুবিধা ভােগের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের এ আন্দোলন ক্রমশ স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনের রূপান্তরিত হয়। অবশেষে ১৭৭৬ খ্রি. আমেরিকা স্বাধীনতা ঘােষণা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণসমূহকে একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ আমেরিকার এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ভৌগােলিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসহ বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গী জড়িত রয়েছে। সুতরাং আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণসমূহকে আলােচনার সুবিধার্থে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক, ভৌগােলিক এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক এ ৩টি প্রধানভাবে বিভক্ত করে আলােচনা করা যেতে পারে।
ক। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণ : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রশাসনিক দূর্বলতা ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা যথা ১) রাজপ্রতিনিধি ও স্থানীয় পরিষদের দ্বন্দ্ব: আমেরিকাস্থ ইংল্যান্ডের ১৩টি উপনিবেশের প্রতিটিতে ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী কর্তৃক একজন করে গভর্নর বা শাসনকর্তা নিযুক্ত হতেন। তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন নির্বাচিত একটি স্থানীয় পরিষদের সাহায্যে। কিন্তু গভর্নর ইংল্যান্ডের অধিবাসী হওয়ায় উপনিবেশের স্বার্থরক্ষার চেয়ে ব্রিটেনের স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়নে এবং ব্রিটিশ সরকারের আদেশ নির্দেশে শাসনকার্য পরিচালনাতেই তিনি অধিক মনােযােগী হতেন। যা ছিল। উপনিবেশবাসীর আকাক্সক্ষা বিরােধী। তাই এ নিয়ে স্থানীয় পরিষদের সাথে গভর্নরের প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। কারণ স্থানীয় পরিষদ অনেক সময়ই ব্রিটিশ সরকারের আদেশ নির্দেশ মানতে রাজী হতাে না।
২) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপনিবেশের প্রতিনিধি না থাকা : ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে তৎকালে উপনিবেশ হতে কোনাে প্রতিনিধি থাকার সুযােগ ছিল না। তাই উপনিবেশ সমূহের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল উপনিবেশসমূহের পক্ষে কথা বলার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপনিবেশসমূহ হতে প্রতিনিধি গ্রহণ করা হােক। কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উপনিবেশবাসীর এ দাবির প্রতি কোনাে কর্ণপাত না করায় ইংল্যান্ড ও আমেরিকাস্থ উপনিবেশসমূহের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।।
৩) উপনিবেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তা বােধের উনােষ : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল উপনিবেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবােধের উন্মেষ । উপনিবেশের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল ইংরেজদের বংশধর। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক পদে নিয়ােগ লাভ এবং বসতি স্থাপন ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে তার উপনিবেশের অধিবাসীতে পরিণত হয়েছিল। আর এ কারণে তারা ছিল ইংরেজদের মতই উদ্যমী, নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। এমনকি আমেরিকায় যেসব ওলন্দাজ, জার্মান, ইরিশ ও সুইডিশ বসতি স্থাপন করেছিল তারাও ধীরে ধীরে ইংরােজ ভাষা ও রীতিনীতি গ্রহণ করে এক মিশ্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল- যেখানে প্রথম থেকেই ব্যক্তি স্বাধীনতা, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এবং ধর্মীয় উদারতার নীতি প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগণ উপনিবেশের অধিবাসীদেরকে তাদের অধস্তন জাতি হিসেবে বিবেচনা করে শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করলে ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আমেরিকার অধিবাসীরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
৪) ব্রিটিশ সরকারের অদূরদর্শী শাসন ব্যবস্থা : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের অদুরদর্শিতা ও ভ্রান্ত নীতি বিশেষ ভাবে দায়ী। বিশেষ করে রাজা তৃতীয় জর্জ এবং প্রধানমন্ত্রী জর্জ গ্রেনভিলের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীকে এ ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়ে থাকে । ক) তৃতীয় জর্জের স্বেচ্ছাচারিতা : রাজা তৃতীয় জর্জের সিংহাসন আরােহণের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ দিন যাবৎ কমন্স সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই প্রধানতঃ শাসনকার্য পরিচালনার সুযােগ পেত । কিন্তু ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় জর্জ সিংহাসনের আরােহণ করার পর থেকেই ব্যক্তিগত উচ্চাশা চরিতার্থ করতে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হুইগ দলকে ধীরে ধীরে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করে অনুগত টোরি দলকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে সহায়তা করেন এবং পরবর্তী বারাে বছর ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উপনিবেশ সমূহের শাসন ব্যবস্থার উপরও রাজ শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি করতে সমর্থ হন। এর ফলে উপনিবেশের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে রাজশক্তি ও ব্রিটেনের প্রতি প্রবল ঘূণার সৃষ্টি হতে থাকে যা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল । আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম
অন্যদিকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের (১৭৫৬-১৭৬৩ খি শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশের বাণিজ্যতরী ও গুদামঘর তল্লাশী করার জন ইংরেজ কর্মচারীদেরকে ক্ষমতা প্রদান করে এই অভিযােগে যে, উপনিবেশে ব্যবসায়ীরা গােপনে শত্রু পক্ষের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের এই নীতি আমেরিকার সর্বত্র প্রচণ্ড অসন্তোষ সৃষ্টি করে। খ) গ্রেনভিলের ভ্রান্ত নীতি : আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী জজ। গ্রেনভিলের ভ্রান্তনীতি বিশেষ ভাবে দায়ী । ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে গ্রেনভিল উপনিবেশ সমূহের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা উপনিবেশবাসীকে ক্ষিপ্ত করে তােলে। গৃহীত পদক্ষেপ গুলাে নিম্নরুপ:
i) এ্যাডমিরাল কোর্ট গঠন : উপনিবেশের জনগণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত এ অভিযােগে চোরাকারবার বন্ধ করে উপকূল রক্ষণাবেক্ষণে বােস্টনে নৌবাহিনী নিযুক্ত করেন। এছাড়া চোরাচালানীদের বিচারের জন্য তিনি একটি এ্যাডমিরাল কোর্ট গঠন করে চোরাকারবারীদের কঠোর শাস্তির বিধান করেন । গ্রেনভিলের এ পদক্ষেপের ফলে উপনিবেশ সমূহে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ii) রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য ভূমি রিজার্ভ ঘােষণা করা : সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমাঞ্চল হতে ফরাসীদের বিতাড়নের পর এ এলাকার স্থানীয় অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ী ও বসতি স্থাপনকারীদের বিরােধ এড়াতে ১৭৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য কিছু ভূমি রিজার্ভ ঘােষণা করে একটি আদেশ জারি করেন এবং এ্যাপেলেচিয়ান জলবিভাজিকার পশ্চিম দিকের ভূ-খণ্ডে শ্বেতাঙ্গদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। এতে করে পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীগণ দারুণভাবে রুষ্ট হন ।।
iii) সুগার এ্যাক্ট (Sugar Act, 1764) : ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে ব্রিটিশ সরকারের যেসব পদক্ষেপকে বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয় তারমধ্যে অন্যমত হচ্ছে সুগার এ্যাক্ট । উপনিবেশ সমূহে গুড় বা চিনির চাহিদা ছিল। ব্যাপক। এই চাহিদা মেটাতে উপনিবেশের ব্যবসায়ীগণ ফ্রান্স এবং স্পেন অধিকৃত ওয়েস্ট ইন্ডিজ হতে সস্তা দরে ও লাভজনকভাবে চিনি বা গুড় আমদানি করত। কিন্তু। একমাত্র ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের নিকট হতে আমেরিকার ব্যবসায়ীরা যাতে এই গুড় বা চিনি ক্রয় করে সেজন্য ব্রিটিশমন্ত্রী ওয়ালপােল ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে মােলাসেস এ্যাক্ট (Molasses Act, 1733) প্রবর্তন করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হতে আমদানিকৃত গুড়ের উপর শুল্ক ধার্য করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল কর আদায় বৃদ্ধির জন্য প্রতি গ্যালন গুড়ের উপর ট্যাক্স কমিয়ে ৬ সেন্ট এর পরিবর্তে ৩ সেন্ট পুন:নির্ধারণ করেন এবং এই আইনটি কঠোরভাবে কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে Sugar Act নামক একটি আইন পাস করে তিনি ইংল্যান্ড ছাড়া ফ্রান্স ও স্পেন অধিকৃত অঞ্চল থেকে আমেরিকায় গুড় ও চিনি আমদানি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন । অথচ এসব স্থান হতে গুড়, চিনি ইত্যাদি আমদানি করা ছিল বেশ লাভজনক ও সাশ্রয়ী। গ্রেনভিল ধারণা করেছিলেন যে, এই খাত হতে ৪৫,০০০ পাউন্ড আয় হবে কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ফ্রান্স অধিকৃত অঞ্চল হতে সস্তা দরে গুড় আমদানি করতে না পারায় আমেরিকায় নিউ ইংল্যান্ডের মদের কারখানাগুলাে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ব্যবসায়ীসহ উপনিবেশের জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব তীব্র হয়ে ওঠে।
iv) কারেন্সি এ্যাক্ট (Curreney Act, 174)) : প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল ১৭৬৪ সালে কারেন্সি এ্যাক্ট প্রবর্তন করে উপনিবেশ সমহে কাগজের নােট ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয় এবং উপনিবেশবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। v) কোয়াটারিং এ্যাক্ট : উপনিবেশ সমূহের নিরাপত্তার জন্য সেখানে ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী মােতায়ন করা হয়েছিল । মােতায়েনকৃত এ সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোয়াটারিং এ্যাক্ট পাস করেন। এ আইনে উল্লেখ করা হয় যে, উপনিবেশ সমূহে মােতায়নকৃত সেনাবাহিনীর ব্যয় উপনিবেশবাসীকেই বহন করতে হবে। এ আইনের বিরুদ্ধে উপনিবেশবাসীরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এটাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উপনিবেশবাসীর প্রথম বড় রকমের প্রতিবাদ। এসময় জেমস ওটিসসহ কয়েকজন ব্যক্তি জনগণের পক্ষে যুক্তি দেখান যে, জনগণের সম্পত্তি ছাড়া তাদের নিকট হতে অর্থ আদায় করা সংবিধান পরিপন্থী। জনগণ ওটিসের বক্তব্যে দারুণভাবে সাড়া দেয়।। এছাড়া তিনি Sugar Act প্রবর্তন করেন যা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান কারণ বলে স্বীকৃত । এ বিষয়টি অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। সুতারাং দেখা যায় যে, রাজা তৃতীয় জর্জ ও প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিলসহ ব্রিটিশ সরকারের অপরিণামদর্শী শাসনব্যবস্থা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ।
৫) পশ্চিমের নতুন অঞ্চল নিয়ে কর্তৃত্বের বিরােধ : ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর (১৭৫৬-১৭৬৩) ব্রিটিশ পালামেন্ট ফ্রান্সের নিকট হতে। দখলকৃত মিসিসিপি নদীর পূর্ব দিকস্থ অঞ্চল অর্থাৎ এ্যাপেলেচিয়ান অঞ্চলের বিরাট ভূ খণ্ডকে খাস জমিতে পরিণত করে সেখানে ইংল্যান্ড হতে সরাসরি শাসন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের বণিক গােষ্ঠী এ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে। অন্যদিকে ভার্জিনিয়াসহ আমেরিকার আধকাংশ উপনিবেশ দখলকৃত এ ভূ-খণ্ডকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি দাবি করে এর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। এছাড়া এ্যাপেলেচিয়ান অঞ্চলের আe অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরাও ছিল ব্রিটিশদের প্রতি ক্ষুব্ধ এবং কিছুদিন পূর্বেও তা পন্টিয়াক বিদ্রোহে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ অনুগত স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে বিব্রত কতে তুলেছিল (উল্লেখ্য, রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি গৃহীত ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিশােধ গ্রহণ এবং ফরাসীদের শাসন পুনঃ প্রতিষ্ঠায় আশায় রেড ইন্ডিয়ানদের নেতা পন্টিয়াক এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন)। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার এ্যাপেলেচিয়ান অঞ্চলের জলসীমা পর্যন্ত উপনিবেশ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু উপনিবেশবাসীরা ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং এ সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘােষণা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকার ও উপনিবেশসমূহের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ৬) সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যপী যুদ্ধের প্রভাব ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমেরিকার পাশেই কানাডা ও লুইজিয়ানায় ছিল শক্তিশালী ফরাসি উপনিবেশ। ফ্রান্স চাচ্ছিল আমেরিকায় অবস্থিত ১৩টি ইংরেজ উপনিবেশ,- দখল করতে। তাই আমেরিকানদের ভয়ছিল এই যে, তারা যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য আন্দোলন করে। তাহলে এ সুযােগে ফ্রান্স, আমেরিকাস্থ ১৩ টি উপনিবেশ বা এর কোনােটি দখল করলে তাদের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। অর্থাৎ উপনিবেশগুলাে ইংল্যান্ডের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এবং তাদের মধ্যে স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্সের ভয়ে তারা এতদিন ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল। কিন্তু সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬-৬৩) ব্রিটেনের নিকট ফ্রান্স পরাজিত হলে উত্তর আমেরিকায় ফরাসি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় পথ রুদ্ধ হয় এবং কানাডা ও লুইজিয়ানা ফ্রান্সের হাত ছাড়া হয়। এর ফলে উপনিবেশবাসীর মন হতে ফরাসি ভীতি দূর হয়। এ অবস্থায় উপনিবেশবাসীরা ইংল্যান্ড হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা পায় এবং উৎসাহী হয়ে ওঠে। খ। ভৌগােলিক কারণ : ব্রিটেন হতে আমেরিকার ভৌগােলিক দূরত্ব ছিল প্রায় ৩ হাজার মাইল। ভৌগােলিক এই বিরাট দূরত্ব ইংল্যান্ডের সঙ্গে উপনিবেশবাসীর মনেরও দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। একটি ভিন্ন ভৌগােলিক এলাকা হতে আমেরিকার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমেরিকার অধিকার সচেতন জনগণ সহজে মেনে নিতে পারছিল না। এমনকি উপনিবেশ সমূহে বসবাসকারী ইংরেজদের বংশধরগণও গভীর জাতীয়তাবােধে আবদ্ধ হয়ে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য ইংরেজদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। গ। বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কারণ : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের মতে অর্থনৈতিক কারণই ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারণ। এগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হল:
১) ইংরেজদের আগ্রাসী বাণিজ্যনীতি : ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড উপনিবেশ সমূহকে তার সম্পদের উৎস বলে মনে করতেন। তাই শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে যে সব কলকারখানা গড়ে উঠেছিল সেসব কারখানার জন্য প্রয়ােজনীয় সকল কাঁচামাল উপনিবেশ হতে নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করা হতাে। অন্যদিকে এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে যেসব শিল্প দ্রব্য উৎপন্ন হতাে সেসব আবার উপনিবেশ গুলিতেই বিক্রয় করা হতাে চড়া মূল্যে। এর ফলে উপনিবেশসমূহ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতাে। এছাড়াও উপনিবেশের বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার কয়েকটি বিধি নিষেধ জারি করে কঠোরতা অবলম্বন করেছিলেন, যেমন (ক) ইউরােপের বাজারে যে সমত্ম পণ্যের চাহিদা বেশি কেবল সেগুলিই উপনিবেশ সমূহঅধিকহারে উৎপন্ন করতে পারত। নিজেদের প্রয়ােজন অনুযায়ী তারা দ্রব্যাদি তৈরি করতে পারত না। (খ) স্টিল ও লােহার যন্ত্রপাতি এবং উলের জিনিসপত্র উপনিবেশগুলিতে তৈরি করা যেত না। ব্রিটিশ বণিজ্যের স্বার্থে এগুলাে তৈরি করত ইংল্যান্ড নিজে। (গ) উপনিরেশগুলি সরাসরি অন্য কোনাে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারতাে না। উপনিবেশের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে তামাক ও তুলা কেবলমাত্র ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা যেত। কারণ ইংল্যান্ডে এগুলাের চাহিদা বেশি ছিল। সুতরাং দেখা যায় যে, উপনিবেশগুলির স্বার্থকে তােয়াক্কা না করে কেবল ইংল্যান্ডের সার্বিক স্বার্থেই এই উপনিবেশ বাণিজ্য নীতি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেনের এই উপনিবেশিক বাণিজ্যনীতি উপনিবেশবাসীর মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তবে যখনই এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়েছে তখনই ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ উপনিবেশিক উৎপন্ন দ্রব্যের উপর বাউন্টি (Bounty) দিয়ে বাণিজ্য বিধির কঠোরতাকে শিথিল করার চেষ্টা করেছেন। বস্তুত এই ব্রিটিশ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাই ছিল ইংল্যান্ড ও তার উপনিবেশ গুলির মধ্যে বিবাদ ও দূরত্ব সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ২) স্ট্যাম্প এ্যাক্ট (Stamp Act) : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের আর একটি কারণ ছিল Stamp Act নামক আইন পাশ করা। সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬-১৭৬৩) ফ্রান্সকে পরাজিত করতে ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। আর এই অর্থ ঘাটতি পূরণ করা, ফরাসীদের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা এবং রেড ইন্ডিয়ানদের সন্ত্রাস দমনে উপনিবেশগুলিতে স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠনের তাগিদে উত্তর আমেরিকায় ১০ হাজার সৈন্য মােতায়ন করা হয়। নােভা, স্কোটিয়া, কানাডা ও নিউইয়র্কে সৈন্যদের জন্য নতুন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়, সিদ্ধান্ত হয় যে উপনিবেশ সমূহে নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত এ সেনাবাহিনীর ব্যয় উপনিবেশগুলােকেই বহন করতে হবে। এমতাবস্থায় ১৭৬৫ সালে ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ (প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল) Stamp Act নামক একটি সংক্রান্ত আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম আইন পাশ করেন। এ আইনে স্থির হয় যে, সাংবাদপত্রসহ আইন ও বাণিজ্য সস সকল প্রকার দলিল ও মামলা মােকদ্দমার কাগজপত্রে স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে ১৮ প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল ধারণা করেছিলেন যে, এই কর ধার্যের ফলে আমেরিকায় অবসি ইংরেজ সৈন্যদের মােট ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ এই কর থেকে আদায় হবে। কি নিজেদের প্রতিনিধি বিহীন পালমেন্ট এই Stamp Act পাশ হওয়ায় উপনিবেশ সমূহের জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার আগে কিছু কর আদায় করলেও এবারই প্রথম উপনিবেশবাসীর উপর প্রত্যক্ষ কর ধার্য হলাে। তাই প্রত্যক্ষ এই কর ধার্যকে উপনিবেশবাসী মৌলিক আইন ও স্বাভাবিক অধিকারের পরিপন্থী বলে গণ্য করে বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন শুরু করে। তারা এ আইন প্রতিহত করার ঘােষণা দেয়। ব্যপক প্রতিবাদের মুখে শুল্ক বিভাগের কর্মচারি, স্ট্যাম্প এজেন্ট প্রমুখের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এমনকি স্থানীয় বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি টমাস হাটচিনসন এর আবাসস্থল জনতার আক্রমণে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। প্রধানত আন্দোলনকারীরা নিজেদেরকে স্বাধীনতার সন্তান (Son of liberty) বলেও পরিচয় দিতে থাকে। স্ট্যাম্প এ্যাক্ট এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে উপনিবেশের জনগণ ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ব্রিটিশ ব্যবসা ও শিল্প কারখানা ব্যাপক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে স্ট্যাম্প এ্যাক্ট বাতিলের জন্য বিটিশ ব্যবসায়ীরাও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ইতােমধ্যে গ্রেনভিল মন্ত্রিসভার পতন হলে বাকিংহামের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। এ মন্ত্রিসভা ১৭৬৬ খ্রি. স্ট্যাম্প এ্যাক্ট বাতিল ঘােষণা করে। কিন্তু ততদিনে উপনিবেশবাসীর মধ্যে ব্রিটিশ বিরােধী যে মনােভাব সৃষ্টি হয় তা তাদেরকে ক্রমেই স্বাধীনতা অর্জনের দিকে ধাবিত করতে থাকে। বস্তুত Stamp Act কে কেন্দ্র করেই আমেরিকা বিপ্লবের প্রকাশ্য সূচনা ঘটে।
৩) টাউনসেন্ড এ্যাক্ট ও বােস্টন হত্যাকাণ্ড : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম। গুরুত্বপর্ণ কারণ হচ্ছে ব্রিটিশ রাজস্ব মন্ত্রী চার্লস টাউনসেভ (Charls Townshend) কর্তৃক প্রবর্তিত টাউনসেন্ড এ্যাক্ট। পূর্ববর্তী বাকিংহাম মন্ত্রিসভা Stamp Act বাতিল করলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উপনিবেশগুলাের উপর কর ধার্য করতে পারবে মর্মে “ডিক্লারেটরি এ্যাক্ট” নামে একটি আইন পাশ করেছিল। এই আইন বলে টাউনসেভ পার্লামেন্টে টাউনসেন্ড এ্যাক্ট পাশ করা হয়। উল্লেখ্য বাকিংহাম মন্ত্রিসভার পতনের পর ব্রিটেনে নতুন মন্ত্রিসভা রাজস্ব মন্ত্রী আর্ল অব চ্যাথাম। টাউনসেন্ড ছিলেন এই মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রী । বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য টাউনসেন্ড উপনিবেশ সমূহের উপর বাড়তি কর ধার্য করার সিদ্ধাত্ম গ্রহণ করেন এবং উপনিবেশ সমূহের জন্য আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করে পার্লামেন্টে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের জুন আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম বােস্টন হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ বিরােধী বিক্ষোভ গড়ে তুলতে সব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন ম্যাসাচুসেটস এর স্যামুয়েল এ্যাডামস (Samu.. Adams)। জনগণকে উপনিবেশসমূহের অভাব অভিযােগ সম্পর্কে অবহিত করতে এবং অন্যান্য উপনিবেশের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে তিনি ১৭৭২ সালে এক পত্রযােগাযােগ কমিটি গঠন করেছিলেন। এভাবে উপনিবেশসমূহ ক্রমেই সংঘটিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, টাউনসেন্ডের ধার্যকৃত কর তিন বছর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল । ৪) চা আইন ও এর প্রতিক্রিয়া : বােস্টন হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব যখন তীব্র ঠিক সে সময় ব্রিটিশ সরকার চা আইন (Tea Act 1773) নামে একটি নতুন আইন পাশ করেন যা উপনিবেশবাসীকে প্রচণ্ড ভাবে বিক্ষুব্ধ করে । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুদামে ১৭৭৩ সালে প্রচুর পরিমাণে চা মজুদ ছিল । ইংল্যান্ডে এই বােস্টন টি পার্টি চা সময়মত বিক্রি না হওয়ায় কোম্পানি আর্থিক দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ অবস্থায় কোম্পানিকে রক্ষা করার জন্য লর্ড নর্থের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকার ১৭৭৩ সালে সংসদে চা আইন পাশ করেন। উপনিবেশে ব্যবসা করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক এতদিন যাবৎ নিয়মিত কর পরিশােধ করতে হতাে। কিন্তু এ আইনের ফলে কোম্পানি কোনরূপ শুল্ক পরিশােধ না করেই উপনিবেশে সরাসরি চা রপ্তানির সুযােগ লাভ করে। ফলে উপনিবেশের আমেরিকান ব্যবসায়ীগণের পক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিযােগিতায় টিকতে না পারায় এবং অর্থনৈতিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রত্ম হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় উপনিবেশবাসীরা কোম্পানি।
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস। কর্তক আমদানিকৃত চা বর্জন করতে শুরু করে। নারী শ্রমিকেরা এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের আমদানিকৃত চা রাতে জাহাজ থেকে উপনিবেশের বন্দরে নামাতে না পারে সেজন্য উপনিবেশের। আমেরিকান ব্যবসায়ীদের একাংশ তৎপর হয়। তারা ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্ক বন্দরে কোম্পানির জাহাজ থেকে চা খালাস বন্ধ রাখে। তবে বােস্টনে নােঙ্গরকৃত তিনটি জাহাজকে পােতাশ্রয় হতে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে একদল উপনিবেশবাসী ১৭৭৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর রেড- ইন্ডিয়ানদের ছদ্মবেশে জাহাজে উঠে জাহাজের চায়ের পেটিগুলাে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। আমেরিকার ইতিহাসে এই ঘটনা ‘বােস্টন টি পাটি' নামে পরিচিত। এ ঘটনা নিজেস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থে আমেরিকান ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিহিংসামূলক কাজ বলেই স্বীকৃত । অন্যান্য বন্দরেও প্রায় একই ঘটনা ঘটতে থাকে। সমুদ্রের পানিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা ফেলে দেওয়ার উপযুক্ত ঘটনাকে ব্রিটিশ সরকার দস্যুতা হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং উপনিবেশসমূহকে শায়েস্তা করতে ১৭৭৪ সালে Intolerable Act নামে একটি দমন আইন পাশ করে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যথা ১) বােস্টন বন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। ২) ম্যাসাচুসেটস এর স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ক্ষমতা ছাঁটাই করা হয়। ৩) অভিযুক্ত ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের ইংল্যান্ড কিংবা অন্য কোনাে উপনিবেশে বিচার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ৪) বােস্টন বন্দরে ৪ (চার) রেজিমেন্ট সৈন্য মােতায়েনসহ উপনিবেশসমূহে ব্রিটিশ সৈন্য মােতায়েন করার উদ্যেগ নেয়া হয়। Intolerable Act এর অধীনে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি উপনিবেশবাসীরা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
৫) কুইবেক এ্যাক্ট ১৭৭৪ : চা আইন এবং তৎপরবর্তী দমন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে উপনিবেশ বা কলােনীর অধিবাসীরা যখন চরম বিক্ষুব্ধ ঠিক তখনই ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় কুইবেক এ্যাক্ট । এই আইনে ওহাইয়াে ও মিসিসিপি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের এলাকাগুলাে (প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশভুক্ত) কুইবেক এর অধীনে এনে কুইবেক প্রদেশের সম্প্রসারণ ঘটানাে হয়। কিন্তু কুইবেকের এ সম্প্রসারণের ফলে আমেরিকানদের মধ্যে আশংকা জন্মে যে, এর ফলে তাদের পশ্চিমমুখী অভিযান ব্যাহত হবে। এছাড়া কুইবেক এ্যাক্টে রােমান ক্যাথলিকদের রাজনৈতিক চার্চগুলাে বৈধতার স্বীকৃতি পায়। এতে আমেরিকানদের মধ্যে এই ভীতি কাজ করে যে, তাদেরকে হয়তাে পােপের কর্তৃত্বাধীন করার ষড়যন্ত্র চলছে।

FOR MORE CLICK HERE