স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল
বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমেরিকা মহাদেশে ইউরােপীয় শক্তিসমূহের চূড়ান্ত পতনের
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস পাশাপাশি আমেরিকা একটি নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভত হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটেনের ছিল বিশ্বের অন্যতম সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ও সুবৃহৎ নৌবাহিনী । অর্থ সম্পদেও তারা ছিল বলীয়ান। সে তুলনায়। সবদিক দিয়ে আমেরিকা ছিল অনেক দুর্বল । তাদের না ছিল শক্তিশালী সরকার, না ছিল সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী । কারণ ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে তারা কেবল তখন সরকার গঠন পর্যায়ে ছিল । তাছাড়া এক উপনিবেশের সৈন্যরা অন্য উপনিবেশের সেনাপতির নির্দেশও অনেক সময় মানতে চাইত না। তারপরও আমেরিকা ইংল্যান্ডকে এ যুদ্ধে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের ফলাফল নিম্নরূপ :
ক) আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ফল
১. স্বাধীন সার্বভৌম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ; দীর্ঘ ৮ বছর লড়াই সংগ্রামের পর ব্রিটেনের ১৩টি উপনিবেশ কর্তৃক বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেনকে পরাজিত করা মধ্য দিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নামে বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. প্রত্যেক রাজ্যে নিজস্ব সংবিধান : ১৩টি রাজ্য নিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেশন গঠিত হলেও স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের মতাে প্রতিটি রাজ্য তাদের নিজস্ব সংবিধান রচনা করে। রাজকীয় সরকার পদ্ধতি বাতিল করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
৩, এ্যাংলিকান চার্চ নিষিদ্ধ : চার্চ এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করে রাখার জন্য চার্চসমূহ বিশেষ করে জনগণের অর্থে পরিচালিত এ্যাংলিকান চার্চসমূহ আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয় । কোনাে কোনাে চার্চ ইউরােপের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে। এর ফলে স্বাধীন আমেরিকায় ধর্ম থেকে রাজনীতি পৃথক হয় ।
৪. ভূমি ব্যবস্থায় পরিবর্তন : স্বাধীন আমেরিকায় ভূমি ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। অনেক স্থানে বিশেষ করে উত্তরে বৃহৎ জমিদারি এস্টেটকে ভেঙ্গে ছােট ছােট এস্টেটে রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে ভূমি ব্যবস্থায় অধিক জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়- যা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভবহয়। খ) ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি ও শাসনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল যথা
১. ক্ষমতার পরিবর্তন : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ডের পরাজয়ের কারণে লর্ড নর্থের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে এবং হুইগ দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জেরও পতন ঘটে। তৃতীয় জর্জ ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারী ও কুশাসনের প্রতিভূ। তৃতীয় জর্জের পতন ঘটায় ইংল্যান্ড একটি অনিবার্য বিপ্লব ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষা পায় এবং সেখানে শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম
২. সহিষ্ণু উপনিবেশিক নীতি গ্রহণ :
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাবে ইংলা সহিষ্ণ উপনিবেশিক নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান শক্তি ছিল তার উপনিবেশ। কিন্তু আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ব্রিটেনের ব্যবসা-বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৩টি উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য উপনিবেশগুলাে ইংল্যান্ডের একতরফা বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। তাছাড়া যুদ্ধকালীন সফল কূটনীতির অভাবে আত র্জাতিক অঙ্গনেও ইংল্যান্ডের অনেক শক্র সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় উপনিবেশগুলাের উপর ইংল্যান্ড তার মার্কেন্টাইল নীতির প্রয়ােগের ভুল বুঝতে পারে এবং উপনিবেশগুলোর প্রতি অধিকতর সহিষ্ণু নীতি গ্রহণ করে।
গ) ফ্রান্সের উপর প্রভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের পাশাপাশি ফ্রান্সকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বলা যায় যে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ফরাসি বিপ্লবকে তুরান্বিত করেছিল। নানা অনিয়ম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, রাজা ষােড়শ লুই এর স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি ফ্রান্সে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল নাজুক। কিন্তু ইংল্যান্ডকে দুর্বল করার মানসে ফ্রান্স আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থ ও সৈন্যদিয়ে সরাসরি যােগদান করায় ফ্রান্সের অর্থনীতি আরও ভঙ্গুর হয়ে যায়। জনগণ প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এ অবস্থায় লাফায়েত সহ যেসব ফরাসি বিপ্লবী আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি যােগদান করে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল এবং আমেরিকার গণতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তারা জনগণকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন – যা ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
ঘ) অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ স্পেন, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতাকামী জনতাকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে আয়ারল্যান্ডবাসী আন্দোলন করে বেশ কিছু সুযােগ সুবিধা আদায় করে। অন্যদিকে স্পেনের অধিকাংশ উপনিবেশই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন হয়ে যায় ।