আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয়ের কারণ
১) আমেরিকার সঙ্গে ইংল্যান্ডের দূরত্ব : ইংল্যান্ড হতে আমেরিকার দূরত্ব ছিল প্রায় ৩ হাজার মাইল আর এই দূরত্ব ইংল্যান্ডের জন্য ছিল যুদ্ধ জয়ে একটি বিরাট বাধা। কারণ ৩ হাজার মাইল দূর থেকে উপনিবেশগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং সময়মত সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র ইত্যাদি প্রেরণ করা ইংরেজদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ দূরবর্তী দেশে তখন খাদ্যসহ রসদ পত্র, সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণের প্রধান মাধ্যম ছিল পাল চালিত জাহাজ - যা ছিল খুব ধীর গতির।
2) শত্রু ভূমিতে যুদ্ধ :
উপনিবেশগুলি যুদ্ধ করেছে তাদের নিজস্ব বাসভূমিতে যেখানে সব কিছুই ছিল তাদের চেনা জানা। অপর দিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও ঘন জঙ্গলে আবত স্থানে যুদ্ধ করতে এসে ইংরেজগণ মােটেই সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি উপনিবেশগুলির গেরিলা আক্রমণে তারা দিশেহারা যায়।
৩) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাহায্য দান : ইউরােপের রাজনীতিতে তখন ইংল্যান্ড ও আম ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেরিকা স্বাধীনতা ঘােষণা করলে ফ্রান্স ও তার দীর্ঘ দিনের মিত্র স্পেন উপনিবেশগুলিকে সাহায্য প্রদান করে - যা ইংল্যান্ডের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। উল্লেখ্য, আমেরিকা ও ভারতবর্ষ উভয়স্থানেই তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে চলছিল বাণিজ্যিক ও উপনিবেশিক স্বার্থের দ্বন্দ । আমেরিকায় ছিল ইংল্যান্ডের ১৩টি উপনিবেশ। অন্যদিকে এ উপনিবেশগুলাের উত্তরে কানাডা ও দক্ষিণ পশ্চিমে লুইজিয়ানা ছিল ফরাসি উপনিবেশ। ইংল্যান্ড যেন পশ্চিম দিকে আর কোনাে উপনিবেশ স্থাপন করতে না পারে সেজন্য ফরাসিগণ ইংরেজ উপনিবেশগুলাের পশ্চাৎবর্তী ও পশ্চিম অঞ্চলগুলাে দখল করে কানাডা ও লুইজিয়ানাকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ অবস্থায় ইংল্যান্ড প্রধানত তার বাণিজ্যিক ও উপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । ফ্রান্স সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের নিকট পরাজিত হয়েছিল । একই সময়ে ইংল্যান্ড ভারতস্থ। ফরাসি নৌঘাঁটিগুলাে দখল করে নেয়। আর এ পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে ফ্রান্স সৈন্য। ও অস্ত্র দিয়ে উপনিবেশবাসীকে সাহায্য করেছিল ।
৪) পর্যাপ্ত দক্ষ সৈন্য ও অর্থের অভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ডের পরাজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে যুদ্ধের জন্য ইংল্যান্ডের পর্যাপ্ত দক্ষ সৈন্য ও অর্থের অভাব। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় । ফলে ইংল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ যুদ্ধ পরিচালনা করার মত অর্থনৈতিক সামর্থ ইংল্যান্ডের ছিলনা। অন্যদিকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়ােজনীয় সৈন্য ও প্রস্তুতি ছাড়াই আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ভিন্ন ও অচেনা পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য প্রযােজন যােগ্য নেতৃত্ব, দক্ষ সেনাবাহিনী ও প্রয়ােজনীয় রসদপত্র। প্রায় ৩ হাজার মাইল দূর হতে এগুলাে প্রয়ােজন অনুসারে আমেরিকায় পাঠানাে ইংল্যান্ডের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ ছিলেন জার্মানির হ্যানােভার বংশের আত্মীয় (পিতা প্রথম জর্জ জার্মানীর হ্যানােভার বংশ হতে বৈবাহিক সূত্রের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন)। তাই তিনি তৎকালীন যুদ্ধ মন্ত্রী লর্ড নর্থকে না জানিয়েই জার্মানী হতে সৈন্য ভাড়া করে আমেরিকায় যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করেন, যা ছিল অদরদশী সিদ্ধান্ত। এছাড়া সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারত ও আমেরিকার রাজভক্তদের সৈন্য হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। তাই ইংল্যান্ডের সৈন্য সংখ্যা বেশী হলেও তাদের মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তাবােধের অভাব ছিল ।
৫) নিরপেক্ষ দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি : আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যেন বাইরের কোনাে দেশ হতে আমেরিকায় যেন কোনাে অর্থ ও অস্ত্র সাহা পৌছাতে না পারে সে জন্য শত্রু জাহাজ তল্লাশীর পাশাপাশি ইংল্যান্ড নৌপথে নিরপেক্ষ দেশসমূহের জাহাজও তল্লাশী করতে থাকে। সমুদ্র পথে ইংরেজদের এই কার্যক্রমে রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি নিরপেক্ষ দেশগুলাে প্রচণ্ডভাবে অসন্তুষ্ট হয় এবং এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ প্রতিহত করতে রাশিয়ার নেতৃত্বে তারা নিজেদের মধ্যে আর্মড নিউট্রালিটি অব দ্যা নর্থ' নামে একটি ঐক্যজোট গড়ে তুলে, এক পর্যায়ে নেদারল্যান্ডের সঙ্গে নৌপথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধও সংঘটিত হয় - যা ইংল্যান্ডের নৌশক্তির প্রাধান্য ক্ষুন্ন করে। ইংল্যান্ডের এ পদক্ষেপ নিরপেক্ষ দেশগুলাের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবং সমুদ্রের উপর ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব হ্রাস পায় - যা ছিল যুদ্ধ জয়ে আমেরিকার সহায়ক।
৬) জর্জ ওয়াশিংটনের যােগ্য নেতৃত্ব :
দুর্জয় সাহসী জর্জ ওয়াশিংটনের যােগ্য নেতৃত্ব, তাঁর গভীর দেশাতুবােধ, অক্লান্ত কর্ম ক্ষমতা, উদ্যম ইত্যাদি উপনিবেশবাসীর মনে গভীর আত্মবিশ্বাস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। যা উপনিবেশবাসীর নিকট ইংরেজদেরকে পরাজিত হতে বাধ্য করেছিল। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল আমেরিকানদের জন্য অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। অন্যদিকে ইংল্যান্ড তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা টিকিয়ে রাখার জন্যই এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু আমেরিকানদের জাতীয়তাবােধের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে। এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে এ যুদ্ধের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কারণ এ যুদ্ধের ফলে একটি নতুন, স্বাধীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার জন্ম হয়, সমৃদ্ধশালী উপনিবেশগুলি ব্রিটেনের হাত ছাড়া হয় এবং সাম্রাজ্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে ব্রিটেনের বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। তাই বলা যায় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত।