আর্টিকলস অব কনফেডারেশনের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণ
আমেরিকা কনফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর আর্টিকলস অব কনফেডারেশনের মাধ্যমে তা পরিচালনা করার যে স্বপ্ন আমেরিকার নেতৃবৃন্দ দেখেছিলেন তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। কনফেডারেশনের বিধানাবলীর মধ্যে বিশেষ দুর্বলতা থাকায় তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিম্নে আর্টিকলস অব কনফেডারেশনের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণসমূহ উল্লেখ করা হল:
১. অর্থনৈতিক কার্যক্রমে কংগ্রেসের দুর্বল ভূমিকা: কনফেডারেশনের বিধানাবলীর ত্রুটি সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল বাণিজ্যিক ও কর স্থাপনের উপর কংগ্রেসের কোনো ক্ষমতা না থাকা। অন্যদিকে আমেরিকার রাজ্যসমূহের কোষাগারে খুব সামান্য পরিমাণ রাজস্ব জমা হওয়ায় রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে প্রশাসন জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ে। এর ফলস্বরূপ রাজস্বমন্ত্রী রবার্ট মরিস ১৭৮৩ সালে পদত্যাগ করেন। তাছাড়া বাঁধাধরা সুনিশ্চিত কোনো আয় কংগ্রেসের ছিল না। রাজ্যগুলির কাছ থেকে চাঁদার আকারে অর্থ সংগ্রহের একটা ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু কেউ তা না দিতে চাইলে জোর করে তা আদায়ের কোনো পথ ছিল না। আবার আর্টিকলসের রাজস্ব সম্পর্কিত সংশোধনগুলিকে কংগ্রেসের আইনে পরিণত করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। আবার যুদ্ধ শেষে দেশের সর্বত্র অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একদিকে যুদ্ধের সময়কার গৃহীত ঋণ এবং অন্যদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাতির অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো আমেরিকার নেতৃবর্গের নিকট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ দেখা দেয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ঋণপত্রের উপর প্রদেয় সুদ যথাসময়ে পরিশোধ করতে না পারার ফলে তার অঙ্ক ক্রমশ স্ফীত হতে থাকে। ফলে কংগ্রেস সুষ্ঠুভাবে কনফেডারেশন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়।
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
কেন্দ্রীয় সরকারের সীমিত ক্ষমতা: আর্টিকলস অব কনফেডারেশনের একটি প্রধান দুর্বলতা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনতান্ত্রিক ও বিচার বিভাগীয় যথাযোগ্য অধিকারের অভাব । এ সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকান কনফেডারেশন ছিল একটি মিত্র সংঘ। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কোনো ক্ষমতা না রেখে রাজ্যগুলির হাতেই সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। ফলে রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারকে তোয়াক্কা না করার এক সময় তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি করতে থাকে। কনফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসমূহের ঐক্যবদ্ধ মনোভাবের বিকাশ ঘটাতে না পারায় রাজ্যসমূহের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয় । ৩. শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও কৌশলী পররাষ্ট্রনীতির অভাব: কনফেডারেশনের সময়কালে আমেরিকার সরকার একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। এ সময় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিতে এবং আমেরিকার চতুর্দিকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণের বিশেষ প্রভাব থাকায় কনফেডারেট সরকার ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে কোনো প্রকার যুদ্ধে না জড়িয়ে বৈদেশিক ক্ষেত্রে আপোস নীতি গ্রহণ করে। ইংল্যান্ড ও স্পেন আমেরিকার পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণকে সমর্থন না করায় কনফেডারেশন সরকার বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে মিসিসিপি অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ নীতি পরিহার করে। এর ফলে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং পশ্চিমাঞ্চলের অনেক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রীয় সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিউ অরলিন্স থেকে স্পেনকে বিতাড়িত করতে বা স্পেনের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে চুক্তি করতে প্রস্তুত হয়। এমনকি কয়েকটি রাষ্ট্র গোপনে স্পেনের সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে এবং স্পেন সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। এভাবে দেখা যায় কনফেডারেশন আমলে সুষ্ঠু বৈদেশিক নীতি গৃহীত না হওয়ার ফলে জাতীয় ঐক্য হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পরেছিল ।
৪. ত্রুটিপূর্ণ বাণিজ্য নীতি: বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার নতুনভাবে বিকাশের প্রয়োজন ছিল । বিপ্লবের আগে নিউ ইংল্যান্ড ও মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির রপ্তানি পণ্যের সর্বোত্তম বাজার ছিল পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। আমেরিকান ভূ-খণ্ডে বিট্রিশদের দখলে ছিল ছয়টি ঘাঁটি এবং ব্রিটিশদের উপেক্ষা করে আমেরিকানদের পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের কোনো উপায় ছিল না। অধিকন্তু ১৭৯১ সালের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দূত পাঠাতেও তারা অস্বীকৃতি জানায়। ১৭৮৯ সালের প্যারিস সন্ধিতে ব্রিটিশরা পশ্চিমাঞ্চলীয় ঘাঁটিগুলি থেকে তাদের লোক লস্কর অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সন্ধি ভঙ্গ করেছে এ যুক্তিতে তারা সেখানে কর্তৃত্ব বজায় রাখে। এভাবেই বিপ্লবের পর ব্রিটেন, আমেরিকানদের বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ বণিকরা আমেরিকায় তাদের পণ্য এনে স্তুপীকৃত
করলেও আমেরিকানরা ব্রিটিশদের কাছে শুধু সে সব পণ্য বিক্রি
করতে পারত যা ইংরেজরা অন্য কোথাও পেত না। অন্যদিকে ফ্রান্স আমেরিকার ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ সুযোগ সুবিধা এবং আমেরিকান ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে না পারায় বৈদেশিক বাণিজ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ধ্বস নামে। এরকম ত্রুটিপূর্ণ বাণিজ্যনীতি আমেরিকা কনফেডারেশনকে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত করে
৫. মুদ্রা ব্যবস্থার উপর কেন্দ্রীয় সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ না থাকা: অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কনফেডারেট সরকার ব্যবস্থায় মুদ্রা সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা অঙ্গরাজ্যসমূহকে দেওয়া হলে বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভুল মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ম্যাসাচুসেটস। সেখানে মুদ্রাস্ফীতির কারণে ঋণের বোঝা অসহনীয় আকার ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ ফেরত এক প্রাক্তন সৈনিক, ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েল শেইজের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়। যদিও এ অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল তথাপি আমেরিকা কনফেডারেশন তখন চরম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীন ও বেদেশিক উভয় ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এ অবস্থা কনফেডারেশন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ ।
৬. ব্রিটেন ও স্পেনের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা :
আমেরিকা কনফেডারেশন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আরেকটি সমস্যা ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণের ভীতি কানাডা ছিল গ্রেট ব্রিটেনের অধীন আর ফ্লোরিডা ও লুইজিয়ানা ছিল স্পেনের অধীন ইংল্যান্ড ও স্পেন এ দুটি শক্তিই ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমদিকে সম্প্রসারণের নীতির বিরোধী। ইংরেজরা প্রকৃতপক্ষে রেড ইন্ডিয়ানদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলি ছাড়াও লাভজনক পশমের ব্যবহারের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। স্পেনের পক্ষ থেকেও অনুরূপভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে মিসিসিপি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে যখন ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তখন আমেরিকার অভ্যন্তরে পশ্চিমাঞ্চলের দিকে সম্প্রসারণ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। তাছাড়া সমুদ্রের তীরবর্তী অনেক রাষ্ট্রই পশ্চিমদিকে সম্প্রসারণ নীতির বিরোধী ছিল কারণ তাদের ধারণা ছিল এর ফলে গণতান্ত্রিক মতবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং পূর্বাঞ্চলের জন্য শ্রমিক সংগ্রহের ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি করবে। ফলে দেখা যায় ব্রিটেন এবং স্পেনের সম্প্রসারণবাদী চেতনার কাছে আমেরিকার কনফেডারেশন সরকার নিজ কর্তৃত্ব যথাযথভাবে বহাল রাখতে সক্ষম হয়নি, যা এর দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।
এভাবে দেখা যায় যে, আর্টিকলস অব কনফেডারেশন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংহতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা কনফেডারেশনের নেতৃবর্গকে কনফেডারেশন সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে । যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং অখণ্ডতা বজায় রাখার লক্ষ্যে নেতৃবর্গ আর্টিকলস অব কনফেডারেশন সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময় তাদের এ পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতেই আমেরিকার বর্তমান সংবিধান রচনা করা হয়েছিল।