আমেরিকার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন
শাসনতন্ত্র বা সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি অধ্যায়। সুতরাং সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা যে কোনো স্বাধীন দেশের জন্যই একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই আমেরিকার শাসনতন্ত্র প্রণয়নও একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। তবে এ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া, অনুমোদনের জটিলতা ও এর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য এ শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আমেরিকা ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠন করে। ১৭৭৬ সালের ২০মে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজ নিজ সরকার গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কনফেডারেশন এবং এসব অঙ্গরাজ্য পরিচালিত হতো ১৭৭৭ সালে কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত আর্টিকলের অব কনফেডারেশন বা কনফেডারেশনের বিধানাবলীর মাধ্যমে। কিন্তু রাজ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রে সংবিধানের কিছু নীতির সংস্কার অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। তাই আর্টিকলস অব কনফেডারেশন সংস্কারের জন্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরামর্শ অনুযায়ী ১৭৮৭ সালে সকল রাজ্যের অংশগ্রহণমূলক একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। অবশেষে ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে মার্কিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। আমেরিকার প্রথম প্রধান বিচারপতি জেমস মেডিসন সংবিধান প্রণয়নে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তাকে আমেরিকার সংবিধানের জনক (Father of the Constitutions) বলা হয় । ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন ১৭৮৭
আমেরিকার শানসতান্ত্রিক ইতিহাসে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । এ সম্মেলনেই মার্কিন শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায়
শেষে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, "There are several parts of this Constitution which I do not at present approve. but I am not sure I shall never approve them. ...I doubt too whether any other Convention we can obtain, may be able to make a better Constitution. ... It therefore astonishes me. Sir. to find this system approaching so near to perfection as it does, and I think it will astonish our enemies..." এরপর সংবিধান কার্যকর করার জন্য ৯ টি রাষ্ট্রের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। তাই সম্মেলন শেষে প্রতিনিধিবর্গ সংবিধান অনুমোদনের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন। ১৭৮৭ সালের ২১ জুন নিউ হ্যাম্পশায়ার নবম রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধান অনুমোদন করে। অবশেষে ১৭৮৯ সালের ৪ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কার্যকর হয়।
আমেরিকার সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
আমেরিকার সংবিধান একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান। এ সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র কর্তৃক সম্পাদিত প্রত্যেকটি চুক্তি অঙ্গরাষ্ট্রগুলো মেনে চলতে বাধ্য থাকবে : নিজস্ব কর্মকর্তা ও আদালতের মাধ্যমে সরকার সে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আছে । মার্কিন সংবিধান মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সেগুলো হলো: শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ ।
এই সংবিধানের অন্যান্য প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. লিখিত সংবিধান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান আধুনিক বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান। এতে শাসন পরিচালনার মৌলিক বিধি, পদ্ধতি, কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে মার্কিন সংবিধানের প্রায় দু'শ বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারায় অনেক অলিখিত বিধানও শাসনব্যবস্থায় অত্মর্ভুক্ত হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের অলিখিত বা প্রথাগত ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভা, রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও প্রভাব, প্রকৃতি বিচারে রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ২. সংক্ষিপ্ত সংবিধান: বর্তমানে সংবিধানগুলোর তুলনায় মার্কিন সংবিধান অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারের । মার্কিন সংবিধানে কেবল শাসনব্যবস্থার মূলনীতিগুলিরই উল্লেখ আছে, কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। ১৭৮৯ সালের মূল সংবিধানে ১টি প্রস্তাবনাসহ ৭টি ধারা ছিল। মার্কিন সংবিধানের শব্দসংখ্যা এখনও ছ'হাজার অতিক্রম করেনি। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা মুদ্রিত অবস্থায় ১৫-১৬ এর বেশি হবে না
ভাষা ও বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট: মার্কিন সংবিধান সংক্ষিপ্ত হলেও সংবিধানের বিষয়বস্তু খুব স্পষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত সংবিধানের ভাষাও সহজবোধ্য। এতে অপ্রয়োজনীয়, জটিল ও দ্ব্যার্থবোধক কোনো শব্দ স্থান পায়নি ।
সংবিধানে প্রস্তাবনা সংযুক্ত: ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে রচিত ও গৃহীত মার্কিন সংবিধানেই সর্বপ্রথম একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত করা হয়। এর আগে সংবিধানে প্রস্তাবনা সংযোজনের কোনো নজির নেই । এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পথ-প্রদর্শক। মার্কিন সংবিধানের প্রস্তাবনাটি ছিল নিম্নরূপ- "We the People of the United States, in Order to form a more perfect Union. establish Justice, insure domestic Tranquility. provide for the common defence, promote the general Welfare, and secure the Blessings of Liberty to ourselves and our Posterity. do ordain and establish this Constitution for the United States of America." ৫. সংবিধানের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য: মার্কিন সংবিধানে সংবিধানের
সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৬নং ধারায় সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন' হিসেবে ঘোষিত হয়েছে- যা জাতীয় সরকার, স্থানীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের উপর সমভাবে প্রযোজ্য হবে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, "This Constitution, and the Laws of the United States which shall be made in Pursuance thereof; and all Treaties made, or which shall be made, under the Authority of the United States, shall be the supreme Law of the Land: and the Judges in every State shall be bound thereby, any Thing in the to the Contrary Constitution or Laws of any State notwithstanding.
জনগণের সার্বভৌমত্ব: জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি মার্কিন সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মার্কিন সংবিধান শুরু হয়েছে 'We the people of the United States' বাক্যটি দিয়ে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই রকম উল্লেখ সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট স্বীকৃতির পরিচায়ক। লর্ড ব্রাইসের মতানুসারে মার্কিন সংবিধানে উল্লেখিত জনগণের সার্বভৌমত্বই হলো গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূলমন্ত্র স্বরূপ। প্রস্তাবনা থেকেই প্রতিপন্ন হয় যে, মার্কিন সংবিধানের উৎস এবং আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি হল সে দেশের জনসাধারণ।
৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা: মার্কিন সংবিধান একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বলতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্য উভয় সরকারের হাতে ক্ষমতার বণ্টন, লিখিত ও ন্যস্ত থাকবে। উভয় সরকারের মধ্যে দূস্পরিবর্তনীয় সংবিধান এবং তার প্রাধান্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের কর্তৃত্ব
এবং দ্বৈত নাগরিকতা মূলত এই চারটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত শাসনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা। মার্কিন সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ যথাযথভাবে উপস্থিত।
৮. সমঝোতা নীতি: মার্কিন সংবিধান সমঝোতা নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। বৃহৎ ও ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে সমঝোতার মাধ্যমে নিরসন হবে। সমঝোতার জন্য কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের দুজন প্রতিনিধি এবং নিম্নকক্ষে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংরক্ষিত থাকবে ।
৯. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি
শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকে। তিনি একাধারে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। তিনি চার বছর মেয়াদে নির্বাচিত হন। সংবিধানের ২নং ধারার ২নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “The President shall be Commander in Chief of the Army and Navy of the United States. and of the Militia of the several States, ...and he shall have Power to grant Reprieves and Pardons for Offences against the United States, except in Cases of Impeachment. He shall have Power, by and with the Advice and Consent of the Senate, to make Treaties, provided two thirds of the Senators present concur; and he shall nominate, and by and with the Advice and Consent of the Senate. shall appoint Ambassadors, other public Ministers and Consuls. Judges of the supreme Court, and all other Officers of the United States, whose Appointments are not herein otherwise provided for. and which shall be established by Law; but the Congress may by Law vest the Appointment of such inferior Officers, as they think proper, in the President alone, in the Courts of Law, or in the Heads of Departments."
১০. প্রজাতান্ত্রিক প্রকৃতি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা প্রজাতান্ত্রিক। মার্কিন
রাষ্ট্রপতি চার বছরের জন্য একটি নির্বাচন সংস্থা (ইলেকটোরাল কলেজ) কর্তৃক নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের দুটি কক্ষ সিনেট ও প্রতিনিধি সভার সদস্যগণ ও নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। মার্কিন অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকারও প্রজাতান্ত্রিক। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
১১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: মার্কিন সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ । মার্কিন শাসনতন্ত্রের রচয়িতাগণ ঔপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষা কবজ হিসেবে গণ্য করে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে, শাসন ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে এবং বিচার ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্ট ও অন্যান্য আদালতের হাতে ন্যস্ত থাকে ।
১২. বিচার বিভাগের প্রাধান্য: সংবিধানে বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে।
সংবিধানের সঙ্গে কোনো বিষয়ে সরকারের বিরোধ দেখা দিলে সুপ্রীম কোর্ট সরকারের যে কোন কার্যকলাপের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করতে পারে। অর্থাৎ মার্কিন আদালত সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে।
-
১৩. ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্রের কোনো বিভাগই যেন এককভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে সেজন্য মার্কিন সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ও পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রপতির হাতে শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। যেমন হলেও কার্যকালের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতিকে কংগ্রেস পদচ্যুত করতে পারে। কংগ্রেস প্রণীত কোনো আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী হলে সুপ্রীম কোর্ট তা বাতিল করতে পারে। আবার সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে উইলসন সুপ্রীমকোর্টকে A Kind of থাকেন। কারণে উড্রো উইলসন
Constitutional Convention in Continuous Session' নামে অভিহিত
করেছেন।
১৪. সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: মার্কিন সংবিধানে সরকারের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধান রচয়িতারা সীমাবদ্ধ সরকারের ধারণাকে স্বীকার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল সংবিধানেই কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির উপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।
১৫. দ্বৈত নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার দ্বৈত নাগরিকতার নীতি স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক একই সঙ্গে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং নিজ অঙ্গরাজ্যের নাগরিক।
| ১৬. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সর্বপ্রথম নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিখিতভাবে স্বীকার করা হয়েছে। প্রথমদিকে মার্কিন সংবিধানে এ নীতিসমূহ না থাকায় রাজ্যসমূহে অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিয়েছিল। পরে ১৭৯১ সালে মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব মৌলিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি। মার্কিন নাগরিকদের এ সকল অধিকারকে অধিকারের আইন (Bill of Rights) বলা হয়।
১৭. সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এর সংশোধনী পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল । অর্থাৎ সংবিধান হচ্ছে দুষ্পরিবর্তনীয়। এটা সংশোধনে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার উভয় কক্ষের (উচ্চ কক্ষ, নিম্ন কক্ষ) দুই তৃতীয়াংশের অনুমোদনের পর কংগ্রেস সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে । তারপর সংশোধনী প্রস্তাব কার্যকর করতে তিন চতুর্থাংশ অঙ্গরাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন হয় ।
১৮. উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শনের প্রভাব: মার্কিন সংবিধানের প্রণেতাগণ এক্ষেত্রে জন
লক, টমাস পেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এজন্য মার্কিন শাসনব্যবস্থায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্তমান
১৯. কর্তৃত্ববিহীন ক্যাবিনেট ব্যবস্থা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৃটেনের মত একটি ক্যাবিনেট আছে। তবে মার্কিন ক্যাবিনেটের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নেই। মার্কিন ক্যাবিনেটের সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারি হিসেবে বিবেচিত হন মাত্র ।
২০. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। এর উচ্চকক্ষের নাম সিনেট এবং নিম্ন কক্ষের নাম প্রতিনিধিসভা। নিম্ন কক্ষের প্রতিনিধিগণ রাজ্যের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং সিনেট সদস্যগণ অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
২১. সরকারি উপাধি বর্জন: মার্কিন সংবিধানে কোনো প্রকার সরকারি উপাধি গ্রহণ
সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । বলা হয়ে থাকে যে, মার্কিন নাগরিকদের সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রকে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
২২. সরকারি দলের অনুগতদের উচ্চপদে নিযুক্তির সুযোগ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে রাষ্ট্রপতির দলের সমর্থকগণকেই নিযুক্ত করা হয়। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির আমলে কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করতে হয়। সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির এ ধরনের ব্যবস্থাকে 'Spoil System বলা হয়। সরকারি চাকরি ছাড়াও কন্ট্রাক্ট দেওয়া এবং কর প্রদানে ছাড় প্রভৃতি ক্ষেত্রেও এ স্পয়েল সিস্টেম প্রয়োগ করা হয়। তবে বর্তমানে এ ব্যবস্থার প্রয়োগ যথেষ্ট সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ মার্কিন সংবিধানের মানদণ্ড হিসাবে কাজ করে ও অন্যান্য সংবিধান হতে পৃথক করে। আর সংবিধানের প্রগতিশীলতার বৈশিষ্ট্য একে দীর্ঘস্থায়ী করে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তার কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে মার্কিন সংবিধানে গতিশীলতা আনয়ন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মনরো তাই বলেছেন, “মার্কিন শাসনতন্ত্র স্থিতিশীল নয় গতিশীল, নিউটোনিয়ান নয় ডারউইনিয়ান” ।
সংবিধান অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতা
ডাকা হলেও
১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন শেষে গৃহীত সংবিধান রাজ্যগুলো দ্বারা অনুমোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বলা হয় প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণ ভোটদানের মাধ্যমে এ সংবিধান অনুমোদন করবে। কিন্তু সংবিধান রচনার পর থেকেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এর বিপক্ষে তীব্র সমালোচনা করা হয়। আর্টিকলস অব কনফেডারেশন সংশোধনের উদ্দেশ্যে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন প্রতিনিধিবৃন্দ তা বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করায় এ সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেন। সংবিধান অনুমোদনের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভার্জিনিয়ার রিচার্ড হেনরি লি ও প্যাট্রিক হেনরি, নিউইয়র্কের জর্জ ক্লিনটন এবং ম্যাসাচুসেটস এর স্যামুয়েল এডমন্ড ও জন হ্যাঙ্কক। অন্যদিকে উদ্যমী তরুণরা ছিলেন শাসনতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। ফেডারেলিস্ট বিরোধীরা মূলত সংবিধান অনুমোদন না করার প্রচেষ্টায় সোচ্চার হয়ে উঠে। মার্কিন সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা ছিল বিল অব রাইটস অন্তর্ভুক্ত না করা। এর ফলে ফেডারেলিস্ট বিরোধী বক্তব্য আরো জোড়ালো হয়ে উঠে। ম্যারিল্যান্ডের লুথার মার্টিনের তিন ঘণ্টা দীর্ঘ বক্তব্যের পর ম্যারিল্যান্ড কনভেনশনে বিল অব রাইটস এর সংশোধনী প্রস্তাব এনে ২৮ এপ্রিল ১৭৮৮ সালে শাসনতন্ত্র অনুমোদন করে। সেই সঙ্গে এ সংশোধনী সকল রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। তবে বৃহৎ রাজ্যগুলোতে সংবিধান অনুমোদনের জটিলতা বেশি ছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভার্জিনিয়া।