আমেরিকার শাসনতন্ত্র প্রণয়নঃ-
শাসনতন্ত্র বা সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি অধ্যায় । সুতরাং সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা যে কোনো স্বাধীন দেশের জন্যই একটি স্বাভাবিক ঘটনা । তাই আমেরিকার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি । তবে এ সাধারণতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া, অনুমোদনের জটিলতাও এর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে ।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আমেরিকা ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে অঙ্গরাজ্য নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠন করে। ১৭৭৬ সালের ২০ মে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজ নিজ সরকার গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয় । কনফেডারেশন এবং এসব অঙ্গরাজ্য পরিচালিত হতো । ১৭৭৭ সালে কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত আর্টিকেলস অব কনফেডারেশন বা কনফেডারেশনের বিধানাবলীর মাধ্যমে । কিন্তু রাজ্য গুলোর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রে সংবিধানের কিছু নীতির সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে । তাই আর্টিকেলস অব কনফেডারেশন সংস্কারের জন্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরামর্শ অনুযায়ী ১৭৮৭ সালে সকল রাজ্যের অংশগ্রহণমূলক একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয় । অবশেষে ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে মার্কিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় । আমেরিকার প্রথম প্রধান বিচারপতি জেমস মেডিসন সংবিধান প্রণয়নের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তাকে আমেরিকার সংবিধানের জনক ( Father of the Constitutions ) বলা হয় ।
ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন ১৭৮৭ :আমেরিকার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । এ সম্মেলনে মার্কিন শাসনতন্ত্র প্রণীত হয় । পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮৭ সালের মে থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর । সম্মেলনে সংবিধান রচনা কমিটির প্রধান ছিলেন ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি জর্জ ওয়াশিংটন । যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ টি অঙ্গরাজ্যের মধ্য থেকে ১২ টি অঙ্গ রাজ্যের মোট ৫৫ জন প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন । শুধু রোডস আইল্যান্ড তাদের কোনো প্রতিনিধি সম্মেলনে পাঠাইনি । দীর্ঘ ৫ মাস পরিশ্রম করে বহু বাক-বিতন্ডার পর ১৭ সেপ্টেম্বর শাসনতন্ত্রের কাজ সম্পন্ন করা হয় ।
সম্মেলনের প্রেক্ষাপট :ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর আমেরিকা ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের মাধ্যমেই অঙ্গরাজ্য গুলি শাসিত হতো । কিন্তু একপর্যায়ে বৈদেশিক বাণিজ্য, পশ্চিম অঞ্চলের উন্নয়ন, টেক্স, অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ, মুদ্রা ইত্যাদি প্রশ্নে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দেয় । ফলে এসব সমস্যা প্রচলিত আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের মাধ্যমে সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে । জর্জ ওয়াশিংটন , জন এডামস প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উপলব্ধি করেছিলেন যে , একটা বড় রকমের পরিবর্তন ছাড়া অঙ্গরাজ্য সমূহের ঐক্যের স্থায়িত্ব বিধান করা যাবে না । কারণ শাসনতান্ত্রিক সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের খাজনা আদায়ের সীমিত ক্ষমতা প্রদানের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয় । এছাড়া বৈদেশিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা এককভাবে কোন রাষ্ট্রের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না । তাই কনফেডারেশনের কিছু নীতি সংস্কারের প্রয়োজনে অঙ্গরাজ্যগুলোর নেতৃবর্গ এগিয়ে আসেন । এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১৭৮৫ সালে ম্যারিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ মাউন্ট ভার্নন কনফারেন্সের আয়োজন করেন । কনফারেন্সের মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের সংস্কারের প্রশ্নে অঙ্গরাজ্যগুলোকে একত্র করা । এই কনফারেন্সের ধারাবাহিকতায় ১৭৮৬ সালে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য এনাপোলিনে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ভার্জিনিয়া , পেনসিলভানিয়া , ডেলওয়ার , নিউজার্সি এবং নিউইর্ক এ ৫টি রাজ্যের ১২ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন । নিউইয়র্কের প্রতিনিধি আলেকজান্ডার হ্যামিলটন সম্মেলনে লিখিত রিপোর্ট পেশ করেন এবং আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের সংস্কারের জন্য একটি ফেডারেল সম্মেলন আয়োজনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান । ২১ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৭ সালে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অঙ্গরাজ্যসমূহকে মে মাসের ফিলাডেলফিয়ার অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠানোর আমন্ত্রণ জানানো হয় । সম্মেলনে জর্জ ওয়াশিংটনকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সংবিধান রচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় । তাদের মধ্যে ৩২ জন ছিলেন আইনজীবী, ১১ জন বণিক, ৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব , ২জন সামরিক ব্যক্তিত্ব , ২ জন চিকিৎসক , ২জন শিক্ষক , ১ জন আবিষ্কারক এবং ১জন কৃষক । তবে সম্মেলনে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব টমাস জেফারসন , জন এডামস এবং পেট্রিক হেনরি অনুপস্থিত ছিলেন । রাষ্ট্রীয় কাজে তারা তখন দেশের বাইরে অবস্থান করেছিলেন ।
সম্মেলনে উত্থাপিত পরিকল্পনা সমূহ :১৭৮৭ সালের ২৫ মে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলন আর্টিকেলস অব কনফেডারেশনের সংস্কারের উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হলেও জাতীয়তাবাদী নেতারা নতুনভাবে জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা সম্মেলনে উত্থাপিত হয় । পরিকল্পনা সমূহ ছিল নিম্নরূপ :
ভার্জিনিয়া পরিকল্পনা :২৯ মে ১৭৮৭ সালে এডমান্ড র্যানডল্ফ ভার্জিনিয়া পরিকল্পনা সম্মেলনে উত্থাপিত করেন ।এ পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন জেমস মেডিসন । যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়গুলো উল্লেখ ছিল সেগুলো হলো:
১) দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকবে ।
২) উভয় কক্ষের প্রতিনিধি জনসংখ্যা অনুপাতে নির্বাচিত হবে ।
৩) নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ।
৪) উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন নিম্নকক্ষ দ্বারা ।
৫) উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আইনসভা থাকবে ।
৬) পৃথকভাবে অঙ্গরাজ্যের যে সকল বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকার নেই , কেন্দ্রীয় আইন সভায় সেই সকল বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকার থাকবে ।
৭) বিচার বিভাগের গঠন প্রক্রিয়া এবং
৮) ফেডারেল সরকারের বিধানসমূহ মেনে চলতে অঙ্গরাজ্যগুলোকে বাধ্য করার প্রক্রিয়া ইত্যাদি ।
নিউজার্সি পরিকল্পনা :১৫ জুন ১৭৮৭ সালে উইলিয়াম প্যাটারসন নিউজার্সি পরিকল্পনা সম্মেলনে উত্থাপিত করেন । এ প্রস্তাবটি ছিল মূলত ভার্জিনিয়া প্রস্তাবের পাল্টা প্রস্তাব । তার মতে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা হলে তারা ছোট রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করবে । এ পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল-
১) এক কক্ষ বিশিষ্ট কংগ্রেস নির্বাচন হবে এবং এটি প্রতিটি রাজ্যের একটি করে ভোট থাকবে ।
২) বর্তমান কংগ্রেস বহাল থাকবে এবং কংগ্রেসকে আরও ক্ষমতা প্রদান করা হবে । যেমন : কংগ্রেস ট্যাক্স বসানো এবং তা সংগ্রহের জন্য চাপ দিতে পারবে।
৩) যুক্তরাষ্ট্রের আইন সঙ্গত অধিকারের স্বাক্ষরিত এবং অনুমোদিত সমূহ নিজ নিজ রাজ্যের চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে ।
৪) কোন রাজ্যের আইনে যদি অসঙ্গতি বা বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় তাহলে ওই রাজ্যের বিচারকগণ পূর্বোক্ত আইন মানতে বাধ্য থাকবেন ।
৫) শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রের চূড়ান্ত বিধান , এর বিপরীতে সব আইন অচল এবং একমাত্র আদালতে হচ্ছে একে কার্যকর করার যথাযোগ্য প্রতিনিধি ।
হ্যামিল্টন পরিকল্পনা :১৮ জুন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিজ মতামত প্রকাশ করেন । হ্যামিল্টন তার দীর্ঘ বক্তব্য প্রেসিডেন্ট এবং সিনেট নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা বলেন । সেই সঙ্গে তিনি হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ৩ বছরের জন্য সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন । তিনি মূলত এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিলেন । হ্যামিলটনের এই পরিকল্পনায় ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল । তবে হ্যামিলটনের এ পরিকল্পনা সম্মেলনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়নি । তাই তিনি সম্মেলন ছেড়ে চলে যান । তবে সম্মেলনের শেষের দিকে শাসনতন্ত্রের স্বাক্ষর করার জন্য তিনি এসেছিলেন ।
এছাড়া জন ডিকিনসন এবং রজার শ্যরমান তাদের পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন । তবে জন ডিকিনসন আনুষ্ঠানিকভাবে তার মতামত উপস্থাপন করেননি । ডিকিনসন হ্যামিল্টনের পরিকল্পনার বিপরীতে মত প্রকাশ করেছিলেন । অন্যদিকে রজার শ্যরমান ১১ জুন তাঁর পরিকল্পনা উত্থাপিত করেন । শ্যরমানের পরিকল্পনা দ্যা গ্রেট কমপ্রোমাইজ নামে পরিচিত । তার পরিকল্পনা অনুসারে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এবং সিনেটে প্রতিটি রাষ্ট্রের সমান সদস্য থাকবে । সেই সঙ্গে তিনি দাসদের বাদ দিয়ে শুধু মুক্ত জনগণকে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন করার যোগ্য বলে মত প্রকাশ করেন । কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলো এর বিরোধিতা করলে জেমস উইলসন এর মত অনুযায়ী স্থির হয় যে, দাসদের তিন-পঞ্চমাংশ এবং স্বাধীন মানুষের সংখ্যা সহ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধিত্ব নির্দেশ করবে ।
শাসনতন্ত্র প্রণয়ন :ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে উত্থাপিত পরিকল্পনা সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে সম্মেলনে নেতৃবর্গ প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের দিক-নির্দেশনার ব্যাপারে একমত হতে পারছিল না । তাই প্রতিনিধিত্বের বিতর্কিত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রত্যেক রাজ্য থেকে একজন সদস্য নিয়ে একটি বড় কমিটি গঠন করা হয় । ১৬ জুলাই কমিটি কর্তৃক গৃহীত এক গুরুত্বপূর্ণ মীমাংসা ছোট বড় সকল রাজ্য সিনেটে এক ভোটের অধিকার লাভ করবে । তবে প্রতিনিধি পরিষদে রাজ্যসমূহের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন করা হয় জেমস উইলসনের মতামত অনুযায়ী । তার মতে দাসদের তিন- পঞ্চমাংশ ও স্বাধীন মানুষের সংখ্যা সহ মোট তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধিত্ব নির্দেশ করবে । যেহেতু তাদের মধ্যে থেকে তিন- পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা হিসেব করা হয় এজন্য এ পদক্ষেপকে তিন- পঞ্চমাংশ ( Three-Fifth Compromise ) সমঝোতা বলা হয় । একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে , সকল অর্থসংক্রান্ত বিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদ থেকেই উত্থাপিত হবে । প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ও অন্যান্য বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় । উত্তর দিকের শিল্প প্রদান এবং দক্ষিণে কৃষিপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ব্যাপারে সংঘর্ষ দেখা দেয় । উত্তর দিকে রাষ্ট্রগুলো সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিল কিন্তু দক্ষিণ দিকে রাষ্ট্রগুলো আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের উপর সরকারের অতিরক্ত কৃতিত্ব স্থাপনে বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করতে থাকে । শেষ পর্যন্ত স্থির হয় কৃষি পণ্য রপ্তানি এবং আগামী বিশ বছর পর্যন্ত ক্রীতদাস আমদানির ব্যাপারে সরকার কোন কঠোর নীতি গ্রহণ করবে না । একইভাবে দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোকে সন্তুষ্ট করার পর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের নতুন Navigation Act পাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতির আশঙ্কা দূর করে । এছাড়া সম্মেলনের প্রতিনিধিদের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়ক একটা নির্দিষ্ট ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়েছিল । চার্লস পিস্কনির মন্তব্য অনুযায়ী আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পাঁচটি বাণিজ্যিক স্বার্থ ছিল নিম্নরূপ :
১) নিউ ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রসমূহের আওতাধীন ছিল মৎস্য এবং পশ্চিম ভারতীয় বাণিজ্য ।
২) নিউইয়র্কের প্রধান স্বার্থ ছিল বৈদেশিক বাণিজ্য
৩) নিউজার্সি ও পেনসিলভানিয়ার প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল গম ও ময়দা
৪) ম্যারিল্যান্ড ভার্জিনিয়া ও উত্তর ক্যারোলাইনার অংশবিশেষে উৎপাদিত হতো তামাক ।
৫) দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়ার প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল চাল ও নীল ।
Three-Fifth Compromise এবং Navigation Act এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতভেদ ছাড়াও ছোটখাট ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে নানা প্রকার মতপার্থক্য দেখা যায় । শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের দ্বারা সংবিধান তৈরি বাধাগুলো দূর করা হয় । ফলে ১৭৮৭ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে সম্মেলনে গৃহীত সংবিধানেই নীতি সমূহের খসড়া তৈরি করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় । পরবর্তী একমাস কমিটি খসড়া তৈরির জন্য নিরলস পরিশ্রম করে । এরপর দ্বিতীয় কমিটি গঠন করা হয় চূড়ান্ত সংবিধান তৈরি করার জন্য । এই কমিটিতে ছিলেন হ্যামিল্টন , উইলিয়াম স্যামুয়েল জনসন , রূফুম কিং , ম্যাডিসন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । শুভারনিয়াস মরিস ছিলেন কমিটির প্রধান । কমিটি ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত সংবিধান সম্মেলনে পেশ করেন । দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান রচিত হলেও প্রতিনিধিদের মধ্যে একজনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়নি । সকলে আমেরিকার উন্নতি এবং অঙ্গরাজ্যগুলোর ঐক্যবদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য আপস-রফার মাধ্যমে সংবিধান তৈরি করেন । তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই চলে যান এবং তিনজন সংবিধানে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায় । তারা হলেন ভার্জিনিয়ার এডমান্ড রেনডল্ফ ও জর্জ মেসন এবং ম্যাসাচুসেটস এর এলব্রিজ গেরি । শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের মধ্যে ৩৯ জন প্রতিনিধি সংবিধানে স্বাক্ষর করেন । স্বাক্ষর শেষে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন , “ There are several parts of this Constitution which I do not at present approve, but I am not sure I shall never approve them . ….I doubt too whether any other Convention we can obtain, may be able to make a better Constitution, …. It therefore astonishes me, to find this system approaching so near to perfection as it does; and I think it will astonish our enemies……” এরপর সংবিধান কার্যকর করার জন্য ৯টি রাষ্ট্রের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল তাই সম্মেলন শেষে প্রতিনিধিবর্গ সংবিধান অনুমোদন প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন । ১৭৮৭ সালের ২১ জুন নিউ হ্যাম্পশায়ার নবম রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধান অনুমোদন করে । অবশেষে ১৭৮৯ সালের ৪ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কার্যকর হয় ।