মুখ্য শব্দ গণআন্দোলন, আইনগত কাঠামো, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সামরিক শাসন, প্রাথমিক
রিপোর্ট, ষড়যন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ
১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ সালের উপর্যুপরি আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের অবস্থা ক্রমশ নাজুক হতে থাকে।
১৯৬৯ এর ফেব্রæয়ারিতে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান।
তিনিও সামরিক শাসন জারি করেন। একই সাথে ঘোষণা করেন, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর সার্বজনীন ভোটাধিকারের
ভিত্তিতে সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বাচন সংক্রান্ত
আইনবিধি ‘আইনগত কাঠামো আদেশ’ বা এলএফও ঘোষণা করেন। আইনগত কাঠামো আদেশ অনুযায়ী জাতীয়
পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয় ৫ অক্টোবর। আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ২২ অক্টোবর স্থির হয়।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন যথাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান উপকূলবর্তী
জেলাগুলোতে প্রবল ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস আঘাত হানে। জলোচ্ছ¡াস প্লাবিত এলাকাগুলোতে ১৯৭১ সালের ১৭ জনুয়ারি
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইনগত কাঠামো আদেশ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩ নির্ধারণ করা হয়। এর
মধ্যে সাধারণ আসন সংখ্যা ৩০০ এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৩।
নির্বাচনের ফলাফল
৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২ টি আসনের ১৬০ টিতে
বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ । বাকি দুটির একটিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নূরুল আমিন এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র
প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। আওয়ামী লীগের এই ১৬০ টি আসনের সাথে যুক্ত হয় সংরক্ষিত ৭টি মহিলা
আসন। ফলে আওয়ামী লীগের মোট আসন দাঁড়ায় ১৬৭; অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ
কোন প্রার্থী দেয়নি। অন্যদিকে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানেই প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে জুলফিকার আলী ভূট্টোর পাকিস্তান পিপলস
পার্টি (পিপিপি)। এ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে
কোন আসন পায়নি, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দল পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসন লাভ করেনি। ১৯৭০ সালের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ¡াসের সংবাদ সর্বপ্রথম ১৪ তারিখে খবরের
কাগজে আসে। দিনে-দিনে এর ভয়াবহতা উন্মোচিত হতে থাকে। যা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সারা বিশ্ব। পশ্চিমা
বিশ্ব থেকে ছুটে আসতে থাকে ত্রাণ কর্মীরা। কিন্তু আসে না শুধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। ত্রাণ সাহায্য দূরের কথা
সরকারের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতেও কেউ আসে নি। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতারাও এলেন না,
মাত্র একজন ছাড়া। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী) প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান। কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম
পাকিস্তানি নেতাদের এই হৃদয়হীন আচরণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের মনে চরম বিতৃষ্ণার জন্ম
দেয়। বিতৃষ্ণা ঘৃণায় পরিণত হল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে জীবনহানি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে।
ওই রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ বলা হল। গভর্নর এস এম আহসানের সংবাদ সম্মেলন বাঙালি মানসে তীব্র
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনার জন্য তিনি হেলিকপ্টার চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু তাঁকে বিমুখ করা হয়। ১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর গভর্নর হাউসে (স্বাধীনতার পর
বঙ্গভবন) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, হেলিকপ্টার চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায় নি।
কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের এই আচরণে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর
রহমান। শেখ মুজিব ঘূর্ণিদূর্গত এলাকা সফর শেষে এক বিবৃতিতে জানান, সরকার প্রতিটি পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ
হয়েছে। আবহাওয়া উপগ্রহ মারফত আগাম তথ্য পাওয়া সত্তে¡ও ঘূর্ণিঝড় কবলিত উপকূলীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করা ও
উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পর মৃতের সংখ্যা অথবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণেরও কোন ব্যবস্থা নেয়া
হয়নি।
নির্বাচন পরবর্তী ষড়যন্ত্র
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাতে এভাবে ভরাডুবি ভাবতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। এমতাবস্থায়, ক্ষমতা হস্তান্তর না
করার লক্ষ্যে শুরু হয়ে যায় ষড়যন্ত্র। পরবর্তীকালে অনেক পাকিস্তানী এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ
সৃষ্টির দুই দশকের মাথায় পাকিস্তানি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই ভাঙন নিয়ে একটি সম্পাদকীয়
প্রকাশ করে। এতে বলা হয় নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার মুহূর্ত থেকে আওয়ামী লীগকে তার অর্জিত বিজয়ের সুফল
ভোগ করা থেকে বঞ্চিত করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। নির্বাচন পরবর্তী ষড়যন্ত্র শুরু হয় আওয়ামী লীগের বিজয় নিয়ে
অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে। জামায়াতে ইসলামি এক্ষেত্রে বিশেষ ভ‚মিকা নেয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত এ দলের
একটি পত্রিকা ঢাকা থেকে পাঠানো এক রিপোর্টে লেখে, ‘শেখ মুজিবের জয়লাভে হিন্দু নর-নারীরা উল্লাসে নেচেছে, গান
করেছে।’ অপপ্রচার এখানেই থেমে থাকেনি। এক পর্যায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগের লোকেরা মুসলমান নয়। ইসলামের
চেয়ে হিন্দুদের প্রতি আওয়ামী লীগের টান বেশি।
নির্বাচনী ফলাফল সেনাবাহিনীর মতোই পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও বিপর্যস্ত করে দেয়। ভুট্টো ধরেই
নিয়েছিলেন তার পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে । তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। এই আকাক্সক্ষা ভেঙ্গে দিল
একজন বাঙালি যার নাম শেখ মুজিব! বাঙালি মুজিবের নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে বিরোধীদলের নেতার আসনে তিনি বসেন
কী করে? সুতরাং তিনি নেমে পড়লেন ষড়যন্ত্রে। আর তাঁর সাথে হাত মেলালো সামরিক শক্তি। এহেন বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের
দ্বারা বাতিল করা হল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। ক্ষমতা হস্তান্তর করা হল না বাঙালির হাতে। বরং আলোচনার নামে
প্রহসন চালিয়ে ২৫ মার্চের রাত্রে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে অসংখ্য নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়।
নির্বাচনের গুরুত্ব ও প্রভাব
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এটাই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনটি ছিল
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। পক্ষান্তরে, ১৯৭০ এর নির্বাচন ছিল একই সাথে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন।
কেন্দ্র ও প্রদেশে সরকার গঠনের জন্য এ নির্বাচন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা শাসকদের বৈষম্য-নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করার মাধ্যমে জনগণ প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগের ছয়
দফার দাবি সঠিক ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আর একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা হচ্ছে পাকিস্তান নামেই কেবল
একটি অখন্ড রাষ্ট্র। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কোন ঐক্য সংহতি বা মতের মিল কিছুই নেই। ১৯৭০ এর
নির্বাচনে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগকে একচেটিয়াভাবে ভোটদানের মাধ্যমে ক্ষমতার
দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে জনগণ প্রমাণ করে যে তারা একতাবদ্ধ। জনগণ জানিয়ে দেয় যে, তারা সকল রকম বঞ্চনা আর
শোষণের অবসান চায়। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনের পর নানামুখি ষড়যন্ত্র,
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও পাকিস্তানিরা টিকে থাকতে পারেনি। বাঙালির আতœপ্রত্যয় আর দেশপ্রেমের কাছে হার
মেনে আতœসমর্পণ করে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
সারসংক্ষেপ
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৪ বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এ
নির্বাচনে বাঙালির বিপুল বিজয় তাদের ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে এনে দেয়। কিন্তু পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা বাঙালিদের
হাতে আসেনি। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলন শেষাবধি স্বাধীনতার
ঘোষণার মধ্য দিযে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-২.১০
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কত আসন লাভ করে ?
(ক) ১৫৫ (খ) ১৬০
(গ) ১৭০ (ঘ) ১৪০
২। ১৯৭০ সালে পিপিপির নেতা কে ছিলেন?
(ক) জুলফিকার আলী ভূট্টো (খ) আইয়ুব খান
(গ) নুরুল আমিন (ঘ) খাজা নাজিমউদ্দিন
নিচের উদ্দীপকটি পড়ুন এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দিন।
নির্বাচনের ফলাফল
রাজনৈতিক দল- প্রাপ্ত আসন
আওয়ামী লীগ- ১৬৭
পিপলস পার্টি- ৮৮
অন্যান্য- ৫৮
সর্বমোট- ৩১৩
৩। উদ্দীপকে কত সালের নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ?
(ক) ১৯৩৭ (খ) ১৯৪৬
(গ) ১৯৫৪ (ঘ) ১৯৭০
৪। উক্ত নির্বাচনের ফলে-
র. বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়
রর. পাকিস্তানের ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হয়
ররর. মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়
নিচের কোনটি সঠিক?
(ক) র (খ) র ও ররর (গ) রর ও ররর (ঘ) র, রর ও ররর
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র