জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার দিক থেকে বাবর ছিলেন বিখ্যাত
তুর্কি তৈমুর লং-এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ এবং মায়ের দিক থেকে তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিখ্যাত মোঙ্গল নেতা
চেঙ্গিস খান। উপমহাদেশে বাবরের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মোগল বংশ নামে পরিচিত হয়েছে মোঙ্গলদের সাথে তাঁর সম্পর্ক
থাকার কারণেই। বাবর ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার ফারগানায় জš§গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ওমর মির্জা ফারগনার
শাসনকর্তা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর বাবর বার বছর বয়সে ফারগানার অধিপতি হন। তিনি তাঁর বিখ্যাত পূর্বপুরুষ
তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ একাধিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে দখল করেন। কিন্তু অচিরেই বাবরের নিকট আত্মীয় পরিজন,
রাজন্যবর্গ এবং উজবেক নেতা সাইবানি খানের বিরুদ্ধাচারণের ফলে ফারগানা ও সমরখন্দ তাঁর হাত ছাড়া হয়ে যায়। তিনি
রাজ্য হারা হয়ে ভাগ্যান্বেষণে বের হন। এভাবেই এক সময় হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন তিনি। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে উজবেক
শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথম বারের মতো বাবর কাবুল জয় করেন। কাবুল বিজয়ের পরও বাবর পিতৃসিংহাসন পুনরুদ্ধার ও
রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ভারতবর্ষের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করেন।
বাবরের ভারত অভিযান
বাবরের ভারত অভিযান আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। ঐতিহাসিকদের মতে মধ্য এশিয়ায় বাবরের যে ভাগ্য বিপর্যয়
ঘটেছিল তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যই তিনি ভারত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ভৌগোলিকভাবে
হিন্দুস্তানের অবস্থান ছিল কাবুলের পাশেই। অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভারতীয় কোনো কোনো
শাসকের আমন্ত্রণ বাবরকে ভারত আক্রমণে উৎসাহ যুগিয়েছিল। দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে পানিপথের যুদ্ধের
পূর্বেও বাবর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এসব অভিযানকে প্রাথমিক অভিযান বলা হয়ে থাকে। ১৫১৯ থেকে
১৫২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাবর ভারতে তিনটি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে তিনি সিন্ধুনদ অতিক্রম করে অতি
সহজেই বজৌর দুর্গ, ভীরা, কুশব ও চেনাব নদীর অববাহিকা অঞ্চল দখল করেন। ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা
দৌলত খান লোদী ও কয়েকজন আফগান অমাত্য বিশেষ করে আলম খানের আমন্ত্রণ জানালে বাবর তাঁর সৈন্যবাহিনীসহ
পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন এবং লাহোর, দিপালপুর ও অন্যান্য স্থান অধিকার করেন। এ বিজয়ের পর বাবর পাঞ্জাবকে
কয়েকভাগে ভাগ করেন এবং দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার খান, ইব্রাহিম লোদীর চাচা আলম খান এবং মোগল
আমীরদেরকে প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়ে কাবুলে ফিরে যান। বাবরের অনুপস্থিতিতে দৌলত খান পাঞ্জাব পুনরুদ্ধার করেন
এবং আলম খান ও দিলওয়ার খানকে বিতাড়িত করেন। আলম খান বাধ্য হয়ে কাবুলে আশ্রয় নেন এবং বাবরের সাহায্য
প্রার্থনা করেন। ফলে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে বাবর পাঞ্জাব অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি সহজে পাঞ্জাব জয় করেন এবং দিল্লির
দিকে এগিয়ে যান। ইব্রাহিম লোদী বাবরকে পানিপথ প্রান্তরে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাঁধা দেন। এই বিখ্যাত পানিপথ প্রান্তরের
যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদী পরাজিত হলে প্রাথমিকভাবে বাবরের ভারত বিজয় সম্পন্ন হয়।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
বাবর বুঝেছিলেন পানিপথের প্রান্তরের যুদ্ধে জয় লাভ করলে তাঁর দিল্লির সিংহাসনে বসার পথ সহজ হয়ে যাবে। তাই তিনি
দিল্লির নিকটবর্তী পানিপথ প্রান্তরে দিল্লির লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন। তারিখটি
ছিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ১২ এপ্রিল। বাবরের আত্মজীবনী তুযুক-ই-বাবরী থেকে জানা যায়, এ সময়ে তাঁর সাথে বার হাজার
সৈন্য ছিল। তাছাড়া পাঞ্জাব জয়ের পর কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্যও তাঁর সাথে যোগদান করে। তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র হুমায়ুনও
তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য সংখ্যা ছিল এক লক্ষ। পানিপথ প্রান্তরে বাবর ভিন্ন রকম
যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিরক্ষা হিসেবে পরিখা খনন করেন। আর ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো কামান ও
গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত ও নিহত হন।
যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের কারণ
প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের মূল কারণগুলো নি¤œরুপ:
১. বাবরের সৈন্য ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য অপেক্ষা অধিক সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত ছিল।
২. ইব্রাহিম লোদীর অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষা বাবরের অস্ত্রশস্ত্র ছিল অধিক উন্নতমানের।
৩. বাবর ছিলেন একজন দক্ষ সেনানায়ক। তিনি ইব্রাহিম লোদীর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষতার সাথে এবং উন্নত যুদ্ধ
কৌশল গ্রহণ করে জয় লাভ করেন। তাছাড়া যুদ্ধ পরিচালনায় ইব্রাহিম লোদী অপেক্ষা বাবর অধিক অভিজ্ঞ ছিলেন।
৪. ইব্রাহিম লোদীর আত্মীয় স্বজনের ষড়যন্ত্র তাঁকে যেমন দুর্বল ও শক্তিহীন করে ফেলেছিল বিপরীত দিকে এই পরিস্থিতি
বাবরকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।
৫. বাবর প্রথম ভারতবর্ষে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র কামান ব্যবহার করেন। তাঁর গোলন্দাজ বাহিনী সুশৃঙ্খল ও দক্ষ ছিল।
৬. বাবর উজবেগী ও তুর্কীদের নিকট থেকে নতুন রণকৌশল শিখেছিলেন। এ কৌশলকে বলা হত ‘তুলঘুমা’ যুদ্ধরীতি। এ
রীতি মোতাবেক তিনি যুদ্ধে পরিখা খনন, সৈন্যদের মাঝে ব্যুহ রচনা, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও অশ্বারোহী দ্বারা আক্রমণ
পরিচালনা করেন।
পানিপথের যুদ্ধের ফলাফল
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের ফলে ভারতের তুর্কী আফগান
দীর্ঘ শাসনের (১২০৩-১৫২৬ খ্রি.) অবসান ঘটে। এ যুদ্ধের ফলে বাবর দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে লোদী সাম্রাজ্যের
পতন ঘটিয়ে মোগল বংশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পানিপথের যুদ্ধের ফল হিসেবে ভারতের প্রভুত্ব সম্পূর্ণরূপে না
হলেও আংশিকভাবে বাবরের হাতে চলে যায়। পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর বাবর মোগল বাহিনীর অঙ্গ হিসাবে
ভারতবর্ষে গোলন্দাজ বাহিনী প্রবর্তন করেন। এ যুদ্ধে বাবরের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। রাশব্রæক
উইলিয়ামস বলেছেন যে, “পানিপথের জয় দ্বারা সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ ঘটে; তখনও আফগান উপজাতিসমূহের
বিরোধিতা ছিল প্রধান বাধা”। পানিপথের যুদ্ধ জয়ের পর বাবর দিল্লি ও আগ্রায় বহু ধনরতœ হস্তগত করেন এবং এ সম্পদ
বিতরণ করে তিনি সহযোগীদের সমর্থন আদায় করেন। তাছাড়া পানিপথের জয়ের পর বাবর ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে রাজত্ব
প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে জয়ের ফলে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বাবরের অধিকারে আসে। বহু আফগান
সর্দার তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন।
সুতরাং বলা যায় পানিপথের এই যুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী মোগল সা¤্রাজ্যের সূচনা পর্ব শুরু হলো।
খানুয়ার যুদ্ধ, ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ
ভারতের অন্যান্য শক্তির মধ্যে রাজপুত শক্তি ছিল অন্যতম। রাজপুতানার মেবারের অধিপতি ছিলেন রানা সংগ্রাম সিংহ।
সংগ্রাম সিংহ আশা করেছিলেন যে বাবর তাঁর পূর্বপুরুষের ন্যায় দিল্লি লুট করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। তখন তিনি ইব্রাহিম
লোদীর রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করে মুসলিম শাসনের ধ্বংসস্ত‚পের উপর এক স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা
করবেন। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধে জয় লাভের পর বাবরের ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্পের কথা জেনে
সংগ্রাম সিংহ একটি শক্তিশালী রাজপুত সৈন্য বাহিনী গঠন করেন। বিভিন্ন রাজ্যের নেতৃবর্গ, আজমীর, মারওয়াড়, আম্বর ও
চান্দেরীর রাজপুতগণ এবং মেওয়াটের হাসান খান তাঁর দলে যোগদান করেন। প্রতিপক্ষের যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে বাবরের
সৈন্যগণ আতংকিত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ না করে কাবুলে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। সেনাদলের মনোবল বৃদ্ধির
জন্য বাবর দু’টি কাজ করেন। তিনি নিজের পানপাত্র ভেঙ্গে ফেলেন এবং তাঁর সোনার ও রূপার পানপাত্রগুলো বিতরণ করে
দেন। বাবর সৈন্যদেরকে উদ্দীপ্ত করে মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেন। এভাবে তিনি রাজপুতদের মোকাবেলা করার জন্য
আগ্রার পশ্চিমে খানুয়ার প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ করেন।
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে রানা সংগ্রাম সিংহ এবং বাবরের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রায় ১০ ঘন্টার
যুদ্ধে রাজপুত বাহিনী অসাধারণ বিক্রম দেখালেও বাবরের রণকৌশল শেষ পর্যন্ত রাজপুতদেরকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।
বাবর এ যুদ্ধেও তুলঘুমা যুদ্ধ রীতি এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা রাজপুত শক্তিকে ধ্বংস করেন। সংগ্রাম সিংহ আহত
অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর সহযোগীরা তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।
খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব
খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। খানুয়ার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সংগ্রাম সিংহের ভারতে রাজপুত প্রাধান্য স্থাপনের
স্বপ্ন চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায়। শক্তিশালী মোগলদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য আর কোনো শক্তি রইল না। রাজপুত
শক্তি পতনের ফলে আফগানরাও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কারণ রাজপুতদের সাথে যোগ দিয়ে জোট গড়ার সম্ভাবনাও বিলীন
হয়ে যায়। এ যুদ্ধে জয়ের ফলে ভারতে মোগল শক্তির ভিত্তি দৃঢ় হয় এবং বাবর কাবুল থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর
করেন। অতঃপর তিনি সহজে মালবের মেদিনী রায়কে পরাস্ত করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক খানুয়ার যুদ্ধকে বক্সারের
যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ ভারতে বৃটিশ শক্তির প্রাধান্য স্থাপনে বক্সার যেমন একটি নিষ্পত্তিকারী যুদ্ধ, ভারতে
মোগল শক্তির উত্থানে খানুয়ার যুদ্ধও ছিল তদরূপ।
ফলাফল
১. খানুয়ার যুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষে মোগল শক্তি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
২. বাবরের ভারতবর্ষ আক্রমণকালীন সময়ে এদেশে দুইটি পরাক্রমশালী শক্তি ছিল। তাঁরা হলো আফগান ও রাজপুত।
পরপর দু’টি যুদ্ধে বিজয়ের ফলে উভয় শক্তি বিনষ্ট হয়। ফলে ভারতবর্ষে মোগল শক্তির উত্থানের পথ খুলে যায়।
৩. খানুয়ার প্রান্তরে জয়লাভের পর মোগলদের কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুল থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।
৪. খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পর বাবর অন্যান্য রাজপুতদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
গোগরার যুদ্ধ, ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ
ভারতবর্ষের দু’টি বৃহৎ শক্তি ইব্রাহিম লোদী ও রানা সংগ্রাম সিংহ বাবরের নিকট পরাজিত হলেও পূর্ব ভারতের আফগানগণ
তাঁকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেন নি। বাংলার সুলতান নুসরত শাহের আশ্রয়ে আফগান সর্দারগণ পুনরায় শক্তি সঞ্চয়
করতে থাকেন। বিহারের শের খান, জৌনপুরের মুহম্মদ লোদী এবং নুসরৎ শাহ একযোগে দিল্লি আক্রমণের পরিকল্পনা
করেন। বাবরের বাহিনী দ্রæত কনৌজ, বারাণসী, এলাহাবাদ দখল করে বিহার সীমান্তে গোগরা নদীর তীরে উপনীত হলে
মুহম্মদ লোদী ও শের খান বাধা দেন। কিন্তু সুশিক্ষিত মোগল বাহিনীর নিকট আফগান বাহিনী পরাজিত হয়। ১৫২৯
খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ লোদী বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বাবরের সঙ্গে নুসরত শাহের এক
সন্ধি হয়। এর ফলে বাংলার সুলতান মোগল আফগান যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রæতি দেন। বিনিময়ে বাবর নুসরত
শাহের রাজ্য সীমা মেনে নেন এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করেন। এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে
ভারতবর্ষে বাবরের বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়। বাবর আমুদরিয়া থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত
বিস্তীর্ণ ভ‚ভাগের অধিপতি হন। এভাবে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জহির উদ্দিন বাবর আগ্রায়
ইন্তেকাল করেন।
বাবরের চরিত্র
তুর্কী ভাষায় ‘বাবর’ শব্দের অর্থ ‘সিংহ’। বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি ও দৃঢ়তার জন্য তাঁর এ নামকরণ যথার্থ বলে অনেকে
অভিমত প্রকাশ করেছেন। মধ্য এশিয়ার দুই প্রধান বিজেতা তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের রক্ত তাঁর দেহে প্রবহমান ছিল।
বাবরের চরিত্রে উভয় নেতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন যাযাবর
যোদ্ধা। যোদ্ধা জাতিসুলভ স্বভাব নিয়ে সমরখন্দ, আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষে ভাগ্যান্বেষণ করেন। মধ্য এশিয়ার জন্য তাঁর
ভালবাসা ছিল আন্তরিক। মধ্য এশিয়ার লোকদের স্বভাব অনুযায়ী বাবর যুদ্ধকে জীবনের এক স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে মনে করতেন।
জয় বা পরাজয়ে তিনি ছিলেন অবিচলিত। যুদ্ধের প্রয়োজনে চরম নিষ্ঠুরতা দেখালেও তিনি স্বভাব-নিষ্ঠুর ছিলেন না। যুদ্ধের
মধ্যেও তিনি উদ্যান রচনা ও কবিতা রচনার কথা ভাবতেন। বস্তুত বাবরের হৃদয় ছিল কোমল। তিনি তাঁর পরিবারের
লোকজনদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন সাহসী, উচ্চাকাক্সক্ষী ও আত্মবিশ্বাসী, বিপদে তিনি ধৈর্য হারাতেন না।
তীক্ষè বুদ্ধি দিয়ে তিনি শত্রæপক্ষের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতেন। সঙ্গীত, কাব্য, সাহিত্যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে বাবর ছিলেন ফরাসি বীর নেপোলিয়নের মতো আত্মনির্ভরশীল এবং ধৈর্যশীল।
ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “যোদ্ধা, শাসক ও পÐিত ব্যক্তি হিসেবে বাবর মধ্যযুগের একজন আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্ব
সম্পন্ন নরপতি ছিলেন।” বাবর ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু। রাজ্যহারা হয়ে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করেছেন। তবুও
তিনি হতোদ্যম হন নি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন ¯েœহবৎসল পিতা।
শাসক হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তিনি যদি মোগল শক্তিকে ভারতমুখী না
করতেন তাহলে মধ্য এশিয়ায় হয়ত উজবেগ জাতির সাথে সংঘর্ষে তারা ধ্বংস হয়ে যেত। তিনি উত্তর ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
রাজ্য ধ্বংস করে একক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজপুত এবং আফগান শক্তিকে দুর্বল করে দিয়ে পরবর্তীকালে
আকবরের সাম্রাজ্য গড়ার কাজ সহজ করেছিলেন। তিনি ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ এবং সিংহাসনের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা
করেন। বাবরের সাম্রাজ্য পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে চান্দেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তিনি মাত্র চার বছর (১৫২৬-১৫৩০ খ্রি.) রাজত্ব করেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে শাসন কাঠামোর কোনো উল্লেখযোগ্য
পরিবর্তন সাধন করতে পারেন নি। তবে তিনি বাদশাহ ও সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য
একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা, দিওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা), শিকদার ও কোতোয়াল বা
নগরাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। তবে তিনি সামন্ত ও জায়গীরদারদের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করেন।
শিল্প ও সাহিত্যানুরাগী হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব
বাবর শুধু একজন শাসক ও যোদ্ধাই ছিলেন না, শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিও তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তাঁর রচিত তুযুক-ইবাবরী বা বাবরের আত্মজীবনী তুর্কী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বাবর দিল্লি ও আগ্রায় বেশ কয়েকটি অট্টালিকা, উদ্যান
এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য পাকা নর্দমা নির্মাণ করেছিলেন।
বাবর পরাজিত আফগান ও রাজপুতদের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে মৈত্রী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বাবর ছিলেন মধ্যযুগের
একজন আকর্ষণীয় এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নরপতি।
জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবর পিতৃরাজ্য ফারগানা হারিয়ে অনেক চড়াই
উৎরাই অতিক্রম করে কাবুলের সিংহাসন দখল করেন। কাবুল থেকে বাবর ভারতবর্ষে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং
ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁকে এদেশ বিজয়ে উৎসাহিত করে। বাবরের এদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল
আক্রমণের প্রাথমিক সাফল্য এবং পরবর্তীকালে পানিপথ, খানুয়া ও গোগরার যুদ্ধের বিজয়ের মধ্যদিয়ে এদেশে মোগল
শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। সম্রাট বাবর কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
ক) তাসখন্দ খ) ফারগানা
গ) বোখারা ঘ) সমরখন্দ
২। কত খ্রিস্টাব্দে পানি পথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়?
ক) ১৫২৪ খ) ১৫২৫
গ) ১৫২৬ ঘ) ১৫২৭
৩। লোদী বংশের শেষ সুলতান কে?
ক) ইব্রাহিম লোদী খ) বাহলুল লোদী
গ) দৌলত খান লোদী ঘ) সিকান্দার লোদী
৪। কত খ্রিস্টাব্দে বাবর মৃত্যুবরণ করেন?
ক) ১৫২৬ খ) ১৫২৭
গ) ১৫২৯ ঘ) ১৫৩০
৫। পানি পথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের কারণÑ
র. বাবরের সৈন্য সুশৃংখল ও সুশিক্ষিত ছিল
রর. বাবরের অস্ত্র-শস্ত্র অধিক উন্নতমানের ছিল
ররর. এ যুদ্ধে বাবর কামান ব্যবহার করেন
নিচের কোনটি সঠিক?
ক) র ও রর খ) র ও ররর
গ) রর ও ররর ঘ) র, রর ও ররর
সৃজনশীল প্রশ্ন
জাফরের পিতা চন্দ্রদ্বীপ নামক নগর রাষ্ট্রের রাজা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই জাফরকে রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ
করতে হয়। কিন্তু অচিরেই তার নিকটাত্মীয় পরিজন, সভাসদ, আমীর ওমরাদের বিরুদ্ধাচারণের ফলে তার রাজ্য হাত ছাড়া
হয়ে যায়। অনেক বার চেষ্টা করেও রাজ্য পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে পাশ্ববর্তী রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে তা দখল
করে শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
ক. তুযুক-ই-বাবরী গ্রন্থের রচয়িতা কে? ১
খ. ‘ভারত বর্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল’Ñ ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. উদ্দীপকের জাফরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে পাঠ্য পুস্তকের কোন শাসকের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাদৃশ্য আছে? ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. উক্ত শাসকের সমর কৌশল বিশ্লেষণ করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র