মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্য শিল্প

মধ্যযুগ পর্বে বাংলার স্থাপত্য শিল্পে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছিল। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রাচীন বাংলার
স্থাপত্যের অধিকাংশই যেমন আমরা খুঁজে পাই না, মধ্যযুগের ক্ষেত্রে তেমনটি হয় নি। এযুগের স্থাপত্যকলায়
গুণগত যে পরিবর্তন এসেছিল তাতে প্রতিক‚ল প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেশকিছু সংখ্যক স্থাপত্য টিকে আছে। প্রয়োজনীয়
সংস্কার সংরক্ষণের মধ্যদিয়েও টিকিয়ে রাখা গিয়েছে কিছু সংখ্যক স্থাপত্য।
সুলতানি যুগের প্রতিনিধিত্বশীল স্থাপত্যগুলোর প্রধান উপকরণ ছিল ইট। ইট তৈরির উপযোগী কাদামাটি ছিল এদেশে।
ইমারত তৈরির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পাথরের যোগান কোথাও ছিল না। মালদহ জেলার রাজমহল পাহাড়ে কালো ব্যাসল্ট
পাথর পাওয়া গেলেও তা দিয়ে সমগ্র দেশের স্থাপত্য নির্মাণের চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া এই পাথর
পরিবহনের সহজ সুযোগও ছিল না। কচিৎ কখনো বিহার থেকে বেলেপাথর ও গ্রানাইট পাথর আমদানি করা হতো। তাই
বাংলার ইমারতে এ ধরনের নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার ছিল সীমিত। ইটের ইমারতে পিলার, সিঁড়ি, মসজিদের মিম্বর,
মিহরাব প্রভৃতিতে কখনো কালো ব্যাসল্ট বা বেলেপাথর ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে।
সুলতানি যুগের ইমারতে ইটের গাঁথুনিতে চুন সুরকির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গিয়েছে। মুসলিম যুগের স্থাপত্যের বিশেষ
দিক ছিল যে, এসময় ছাদ-গম্বুজ প্রভৃতির পলেস্তরা দেয়ার জন্য চুনের বিশেষ ব্যবহার ছিল। তবে দেয়াল পলেস্তরা দিয়ে
ঢেকে দেয়ার পদ্ধতি মোগল যুগের পূর্বে দেখা যায় নি। পনের শতক থেকে বাংলার স্থাপত্যে উজ্জ্বল টালির ব্যবহার বিশেষ
মাত্রা যুক্ত করেছিল।
মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যে ইটের ব্যবহার বাংলার স্থাপত্যকলার মৌলিক ও সর্বজনীন রূপ নয়। প্রধানত শহরাঞ্চলেই ইটের
ব্যবহার দৃশ্যমান ছিল। বাংলার অধিকাংশ মানুষের বাস ছিল বাঁশ আর খড়ের তৈরি ঘরে। বাঁশ ও কাঠের তৈরি ঘরে
অপেক্ষাকৃত উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা বাস করত। বাংলায় দীর্ঘ দিনের প্রচলিত বাঁশের ঘরের গঠন রীতি ইটের তৈরি স্থাপত্য
রীতিকে প্রভাবিত করেছিল। এভাবে বহিরাগত মুসলমানদের স্থাপত্যরীতির নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে স্থানীয় নির্মাণ শৈলীর
মিশ্রণ ঘটে। যে কারণে ইটের তৈরি ইমারতে গ্রাম বাংলার প্রচলিত দোচালা বা চারচালা ঘরের আদল লক্ষ করা যায়।
সুলতানি যুগের স্থাপত্য নির্মাণে নির্মাতাগণ স্থানীয় নির্মাণ শিল্পীদেরও নিয়োগ করতেন। ফলে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার
কারণে মুসলিম স্থাপত্যে বাঙালির স্থাপত্য শৈলীর ধারণা সহজেই প্রবেশ করেছিল। তাই এ যুগের ইটের তৈরি ইমারতে
চৌচালার মতো ঢালু ও বাঁকা আকৃতির ছাদ নির্মিত হয়। এ ধারার প্রাচীনতম নিদর্শন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বাগেরহাটের
ষাট গম্বুজ মসজিদ। চৌচালা আকৃতির ছাদ নির্মাণের উদাহরণ এখানে দেখা যায়। এর প্রায় দুশো বৎসর পর মোগল যুগে
গৌড়ে নির্মিত হয়েছিল ফতেহ খানের সমাধি। এই সমাধি গৃহের ছাদটি ছিল দোচালা আকৃতির।
মুসলমান বসতির আবশ্যিক অঙ্গ ছিল মসজিদ, কারণ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুসলমানদের বাধ্যতামূলক ধর্মীয়
বিধান। মসজিদ ছিল মুসলমানদের নামাজ বা প্রার্থনা গৃহ। একারণেই মধ্যযুগের সূচনা থেকে মুসলিম স্থাপত্য বিশেষ গুরুত্ব
পেতে থাকে। মসজিদের পরই মুসলমানদের দ্বিতীয় আবশ্যিক স্থাপনা হচ্ছে মাদ্রাসা। মুসলিম সাধক ও শাসকদের সমাধিও
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত।
সুলতানি যুগের ইমারতে মুসলমানদের নির্মাণ শৈলীর বিশেষত্ব লক্ষ করা যায়। এগুলো হচ্ছে খিলান, মিনার ও মিহরাব।
স্থাপত্য নির্মাণে এদেশের জলবায়ুর ওপর দৃষ্টি রাখা হয়েছে। আর্দ্র জলবায়ুর দেশ বলে মসজিদের ভেতর প্রশস্ত নামাজ
কক্ষে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের প্রয়োজন ছিল। তাই কিবলা বা পশ্চিম দিক ছাড়া অন্য তিন দিকের দেয়ালে পর্যাপ্ত দরজা ও
জানালা কাটা হতো। বৃষ্টির পানি যাতে সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে তাই দরজাগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট করে
বানানো হতো। মসজিদে বড় আকৃতির প্রবেশ দ্বার নির্মিত হয় মোগল আমলে।
সুলতানি যুগের মসজিদে গম্বুজ ও খিলান ব্যবহারে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন কোথাও দেখা যায় এক গম্বুজ বিশিষ্ট
ক্ষুদ্রাকৃতি মসজিদ, কোথাও এক গম্বুজ মসজিদের সামনে বারান্দা বা বহু গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। সমাধিগুলো সাধারণত এক
গম্বুজ রীতিতে তৈরি হতো। পাÐুয়ায় অবস্থিত সুলতান সিকান্দার শাহের (১৩৫৭-১৩৮৯ খ্রি.) সমাধি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ত্রিবেণীর সাতগাঁও ও হুগলী জেলার ছোট পাÐুয়াতে এ ধরণের অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। চমৎকার খিলানে শোভিত
এ সকল মসজিদে একাধিক গম্বুজ থাকতো। পোড়ামাটির অলংকরণ শোভিত ছিল মিহরাবগুলো, পাÐুয়ার আদিনা মসজিদ
এ রীতির সর্বোত্তম উদাহরণ। এটি মধ্যযুগে বাংলার সর্ববৃহৎ মসজিদ স্থাপত্য। ইটের পাশাপাশি এখানে পাথরেরও ব্যবহার
লক্ষণীয় ছিল।
ষোল শতকের প্রথমার্ধে বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসনের অবসান ঘটলে স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন
আসে। মোগল যুগে বাংলা দিল্লির একটি প্রদেশ বা সুবায় পরিণত হয়। দিল্লির মোগল সম্রাট এবং তাদের নিয়োজিত
সুবাদার ও আমীর ওমরাহদের তত্ত¡াবধানে এ সময় ইমারত নির্মিত হতে থাকে। ফলে এই নির্মাতাদের উপর স্থানীয় রীতি
তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। দিল্লির আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে যে ধারায় মোগল স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে তারই
অনুকৃতি দেখা যেতে থাকে বাংলার মোগল স্থাপত্যে। শুধু ব্যতিক্রম র্ছিল উত্তর ভারতের স্থাপত্যে ব্যবহৃত মর্মরপাথর ও
লাল বেলেপাথরের বদলে ইটের ব্যবহার। সুলতানি যুগে দেয়ালকে আবৃত করতে পোড়ামাটির অলংকরণ বা টেরাকোটার
যথেচ্ছ ব্যবহার ছিল। কিন্তু টেরাকোটা বিলুপ্ত হয়ে যায় মোগল যুগে। কারণ এ সময়ে চুন-সুরকিতে প্লাস্টার করার পদ্ধতি
আয়ত্ব করে ফেলে নির্মাণ শিল্পীরা। খিলানগুলো এসময় নানা বর্ণের চিত্র ও কারুকার্যে সজ্জিত করা হতে থাকে। মোগল
যুগের ইমারতগুলোর প্রবেশ মুখে বিশাল ও জমকালো তোরণ নির্মিত হতে থাকে। মোগল যুগের মসজিদের খিলান ও
গম্বুজে আসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যা দেখে সুলতানি যুগের মসজিদ থেকে সহজেই একে আলাদা করা যায়। ঢাকায় নির্মিত
বাংলা একাডেমির কাছে হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ, লালবাগ দুর্গের ভেতর ফররুখশিয়ার মসজিদ (লালবাগ শাহী
মসজিদ) মোগল মসজিদের উদাহরণ।
ধর্মীয় ইমারতের বাইরেও মোগল যুগে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাধারণ ইমারত তৈরি হতে থাকে। এর মধ্যে কাটরা এর অন্যতম
উদাহরণ। মোগল যুগের বাংলায় প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে এবং বিশেষ করে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত
করার জন্য কয়েকটি জলদুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গ, নারায়ণগঞ্জের হাজিগঞ্জ ও
সোনকান্দা দুর্গ। লালবাগ প্রাসাদ দুর্গও মোগল বাংলার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। মোগল যুগে বিশেষ করে নবাবী আমলে
বেশ কয়েকটি প্রাসাদও নির্মিত হয়েছিল। এরমধ্যে মুর্শিদাবাদে নবাবদের ইমারতসমূহ বিশেষ স্থাপত্য সৌকর্যের প্রমাণ বহন
করছে। এসব ছাড়াও মোগল যুগে অনেক সেতু, খানকাহ ও ইমামবাড়া তৈরি হয়েছে।
মোগল শাসনযুগের শেষ দিকে হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে মন্দির নির্মিত হতে থাকে।
মন্দিরগুলোতে ধর্মীয় কাহিনী উপজীব্য করে নানা অলঙ্করণে শোভিত করা হতো। দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির ও পুঠিয়ায়
নির্মিত কয়েকটি মন্দিরের অলংকরণে কৃষ্ণ কাহিনীর নানা চিত্র এবং পৌরাণিক ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের
অন্যত্র এ ধারার অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
মধ্যযুগের বাংলার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে এসময়ের নানা স্থাপত্য কলার বিকাশ। সুলতানি ও মোগল পর্বে নির্মিত
স্থাপত্য কলায় অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল। সুলতানি যুগের স্থাপত্যসমূহের বড় জায়গা জুড়ে আছে মসজিদ স্থাপত্য। এ
পর্বে পলেস্তারা করার ধারণা না থাকায় দেয়ালের গায়ে কারুকার্য খচিত পোড়ামাটির ফলক ব্যবহার করা হতো। সুলতানি
যুগের ইমারত-শৈলীতে দেশীয় রীতির প্রভাব স্পষ্ট ছিল। মোগল পর্বে ধর্মীয় ইমারতের পাশাপাশি নানা লৌকিক
ইমারতও নির্মিত হয়। উত্তর ভারতের নির্মাণ শৈলীর প্রভাব এসব স্থাপত্যে লক্ষ করা যায়।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি কোথায় অবস্থিত?
ক) সোনারগাঁও খ) পাÐুয়া
গ) গৌড় ঘ) বাগেরহাট
২। সুলতানি স্থাপত্য নির্মাণের প্রধান উপকরণ কী ছিল?
ক) কাঠ খ) পাথর
গ) ইট ঘ) সুড়কি
৩। মধ্যযুগে বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শনÑ
র. লালবাগ প্রাসাদ দুর্গ মোগল বাংলার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন
রর. মোগল যুগে অনেক সেতু, খানকাহ ও ইমামবাড়া তৈরি হয়েছে
ররর. পাÐুয়ার আদিনা মসজিদ মধ্যযুগে বাংলার সর্ববৃহৎ মসজিদ স্থাপত্য
নিচের কোনটি সঠিক?
ক) র ও রর খ) র ও ররর
গ) রর ও ররর ঘ) র, রর ও ররর
সৃজনশীল প্রশ্ন
ক একটি জনপদের শাসক। তার প্রতিনিধি খ তার অধীনে অন্য একটি জনপদের দায়িত্ব লাভ করেছে। সেখানকার
অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল দেখে হঠাৎ খ বিদ্রোহ করে বসে। তারপর অনেকটা স্বাধীন দেশ হিসেবে সে স্বাধীন করতে থাকে।
তার দীর্ঘদিনের শাসনে সেখানে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়। উদ্দীপকের এ অংশের আলোকে উত্তর দিনÑ
ক. সুলতানি আমলে বাংলায় কী ধরণের স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল? ১
খ. সুলতানি ও মোগল আমলে নির্মিত মসজিদগুলোর মূল নির্মাণ উপকরণ কী ছিল? ২
গ. সুলতানি ও মোগল আমলে নির্মিত মসজিদগুলোর কোনো পার্থক্য আছে কী? ৩
ঘ. ধর্মীয় স্থাপত্যের বাইরে মোগল আমলে আর কী কী তৈরি হয়েছিল? ৪

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]