পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীরকাশিম পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজদের
গতিরোধ করার মতো শক্তি ও সাহস এদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর তখন থেকেই বাংলার
শাসন ব্যবস্থায় ইংরেজরা সরাসরি হস্তক্ষেপ শুরু করে এবং বাংলার ভাগ্যবিধাতা হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে কিভাবে ইংরেজগণ এই সরাসরি হস্তক্ষেপের ক্ষমতা লাভ করে? এ প্রসংগে বলা দরকার যে, মুগল
শাসনতন্ত্রে প্রদেশ শাসনের জন্য দু’টি সমপর্যায়ের পদের বিধান ছিল। একটি সুবাদারী, আরেকটি দিউয়ানি। সুবাদার ও
দিউয়ান উভয় ব্যক্তিই সরাসরি দিল্লির সম্রাটের নিকট ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন। তাঁরা একে অপরকে
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতেন, কিন্তু একে অন্যকে তাঁর অধীন করতে পারতেন না। সুবাদারের দায়িত্ব ছিল বিচার,
প্রতিরক্ষা ও সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা, আর দিউয়ানের দায়িত্ব ছিল মূলত রাজস্ব (খাজনা) শাসন। তাই দিওয়ানী লাভের
অর্থ রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব লাভ করা। কোনো প্রাদেশিক শাসনকর্তা যেন স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীনতাকামী হয়ে না পড়ে সে
উদ্দেশ্যেই এ ক্ষমতা বিভাজনের ব্যবস্থা ছিল। প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জনও ছিল এই ব্যবস্থার আর এক লক্ষ্য।
মুর্শিদকুলী খানের (১৭১৭ খ্রি.) সুবাদারী লাভ পর্যন্ত সুবাদারী ও দিউয়ানের পদ পৃথক পৃথক ব্যক্তির উপর ন্যস্ত ছিল।
মুর্শিদকুলী খানই প্রথম যিনি মুগল শাসনতান্ত্রিক প্রথা ভঙ্গ করে দিউয়ানের পদটিও নিজে দখল করে নেন। কিন্তু পরবর্তী
সময়ে কেন্দ্রের দুর্বলতার সুযোগে মুর্শিদকুলি খানের পরবর্তী সব সুবাদারগণই সুবাদারী ও দিউয়ানীর পদ একত্রীভ‚ত
রাখেন। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সুবে বাংলা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসিত হতে থাকে।
মারাঠা উৎপাতের কারণে আলীবর্দ্দী খান কেন্দ্রকে রাজস্ব পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দেন। সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফরের
আমলে কেন্দ্রকে রাজস্ব দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পলাশীর যুদ্ধের পর হতে কোম্পানি ছিল দেশের হর্তাকর্তা। কেন্দ্রীয়
রাজনীতি তথা সমগ্র উপমহাদেশের রাজনীতি এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল যে, সুবে বাংলা আবার আগের মতো বেশি করে
রাজস্ব কেন্দ্রে (দিল্লিতে) পাঠাবে এমন আশা সম্রাট শাহ আলম ছেড়েই দিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে সম্রাট কয়েকবার
কোম্পানিকে বাৎসরিক কিছু উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিউয়ানি গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে কোম্পানি
তা প্রত্যাখ্যান করে।
এদিকে বক্সার যুদ্ধের পর কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা চরমে উঠলে এবং বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ
খারাপ হলে, ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে পড়লেন। ফলে ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ কোম্পানির দুর্নীতি দমন ও স্বার্থ বৃদ্ধির জন্য
পুনরায় ক্লাইভকে লর্ড উপাধি দান করে বাংলায় দ্বিতীয়বার প্রেরণ করেন (১৭৬৫-১৭৬৭ খ্রি.)। এদেশে এসেই তিনি মীর
কাশিমের মিত্রশক্তি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রতি নজর দেন। বক্সার যুদ্ধের
ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ জেলা দু’টি পেয়ে অযোধ্যার নবাবের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন।
তারপর তিনি দিল্লির দুর্বল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। ক্লাইভ কারা ও এলাহাবাদ জেলা দু’টি ও
বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে সম্রাটের নিকট হতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিউয়ানি লাভ করলেন
(১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিউয়ানি সনদ লাভ করে)।
ফলাফল ও গুরুত্ব
কোম্পানির দিক থেকে বাংলার দিউয়ানি লাভ ছিল এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রথমত: দিউয়ানি লাভ ছিল কোম্পানির জন্য একটি বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। এর ফলে সম্রাট ও নবাব একেবারে
ক্ষমতাহীন হয়ে ইংরেজদের হাতের পুতুল বনে যায়। নবাবের না ছিল রাজস্ব আদায়ের অধিকার, না ছিল সেনাদল রাখার
মতো অর্থবল। নবাবকে নামমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা অধিকার করে নেয়। ফলে বাংলায়
আইনত ও কার্যত ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয়ত: কোম্পানির দিউয়ানি লাভ ছিল কোম্পানির জন্য আরও একটি বিরাট অর্থনৈতিক বিজয়। এর ফলে কোম্পানি
নিজের দেউলিয়া অবস্থা হতে রক্ষা পায়। দিউয়ানি লাভের সুযোগ সুবিধা ঈড়ঁৎঃ ড়ভ উরৎবপঃড়ৎং-কে অবহিত করতে গিয়ে
লর্ড ক্লাইভ বলেন যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যাবে তা এত বেশি যে, সম্রাট ও নবাবের নির্ধারিত
ভাতা ও অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক খাতে সমস্ত ব্যায় বাদ দিলেও কোম্পানির হাতে নেট আয় থাকবে ১২ কোটি
টাকারও উপর (১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দের রাজস্ব হিসেব থেকে)।
তৃতীয়ত: লর্ড ক্লাইভ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ উরৎবপঃড়ৎং-কে আরও জানান যে, ঐ উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানির গোটা বাণিজ্য বিনিয়োগের
জন্য যথেষ্ট। ফলে দিউয়ানি লাভের আগে এ দেশে বাণিজ্য করার জন্য ইউরোপ হতে কোম্পানি যে বিপুল পুঁজি নিয়ে
আসতো তা দিউয়ানি লাভের পর বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যবসার সমস্ত পুঁজি প্রদেশের রাজস্ব হতেই সংগ্রহ করা হয়।
চতুর্থত: দিউয়ানি লাভের ফলে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলায় শুল্কহীন অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পায়। এতে কোম্পানির
কর্মচারীদের অর্থের লোভ দিন দিন বাড়তে থাকে। অসুদুপায়ে রাজস্ব আদায় ও আত্মসাৎ করলেও কোম্পানির কর্তারা
কোনো পদক্ষেপ নিতেন না। এভাবে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে এদেশের মানুষের মেরুদÐ ভেঙ্গে যায়।
পঞ্চমত: দিউয়ানি লাভের পর বাংলা থেকে ব্যাপকভাবে অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে। তাই ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে
বাংলার দিউয়ানি প্রকৃত অর্থে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র রচনা করে।
বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলা তথা উপমহাদেশে ইংরেজদের দিউয়ানি লাভ ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপনের ইতিহাসে একটি গুরুত্ব
ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মীর কাশিমের নবাবী লাভের আগেই ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কিন্তু ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এদেশে
কোম্পানির দুর্নীতি দমনের ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য আবার তাঁকে লর্ড উপাধিতে ভ‚ষিত করে দ্বিতীয় বার এদেশে
প্রেরণ করে। ক্লাইভ বাংলায় এসে দেখেন যে বক্সারের যুদ্ধে ত্রি-পক্ষীয় শক্তিকে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত করার ফলে
কোম্পানির একশ্রেণীর কর্মকর্তারা বাংলা ছাড়া অযোধ্যা ও দিল্লিতে আধিপত্য স্থাপনের কথা ভাবছে। ক্লাইভ অত্যন্ত
বাস্তববোধ সম্পন্ন বিচক্ষণ লোক ছিলেন। অবশেষে তিনি দিউয়ানি লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তিকে এদেশে প্রতিষ্ঠিত
করেন। ইংরেজদের এই দিউয়ানি লাভ করাকে বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং এর সূত্র ধরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
‘হস্তক্ষেপের সনদ’ বলা যেতে পারে। ইংরেজরা উপমহাদেশ প্রায় দু’শো বছর শাসন করে। অনেক ঐতিহাসিক তাই,
ইংরেজদের এই দিউয়ানি লাভ করাকে ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৫.৫
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। কত খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার দিউয়ানি লাভ করে?
ক) ১৭৬৪ খ) ১৭৬৫ গ) ১৭৬৬ ঘ) ১৭৬৭
২। বাৎসরিক কত টাকার বিনিময়ে কোম্পানী দিউয়ানি লাভ করে?
ক) ২৪ লক্ষ খ) ২৫ লক্ষ গ) ২৬ লক্ষ ঘ) ২৭ লক্ষ
৩। কোন নবাবের সময় থেকে দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানো প্রায় বন্ধ হয়ে যায়?
ক) আলীবদ্দী খাঁ খ) সিরাজদ্দৌলা গ) মীর জাফর ঘ) মীর কাশিম
৪। মোগল শাসনতান্ত্রিক প্রথা ভঙ্গ করে কে প্রথম দিউয়ানির পদটিও নিজে দখল করেন?
ক) আলীবর্দ্দী খাঁ খ) সিরাজউদ্দৌলা গ) মীর জাফর ঘ) মুর্শিদকুলী খাঁন
৫। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দিউয়ানি লাভের ফলেÑ
র. বাংলায় আইনত ও কার্যত ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়
রর. ব্যবসার সমস্ত পুঁজি প্রদেশের রাজস্ব থেকেই সংগ্রহ করা হয়
ররর. ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়
নিচের কোনটি সঠিক?
ক) র ও রর খ) র ও ররর গ) রর ও ররর ঘ) র, রর ও ররর
সৃজনশীল প্রশ্ন
মামুন একজন প্রাদেশিক সুবাদার। মোগল শাসনতন্ত্রে প্রদেশ প্রশাসনে দুটি সমপর্যায়ের পদ ছিল। একটি সুবাদার অন্যটি
দিউয়ান। সুবাদার ও দিউয়ান উভয়ই সরাসরি সম্রাটের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতেন। তারা একে অন্যকে
সাহায্য করতে পারতেন; কিন্তু একে অন্যকে তার অধীন করতে পারতেন না। সুবাদারের দায়িত্ব ছিল বিচার প্রতিরক্ষা ও
সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা, অন্যদিকে দিউয়ানের দায়িত্ব ছিল রাজস্ব প্রশাসন। দিউয়ানের অর্থই হলোÑ রাজত্ব আদায়ের
কর্তৃত্ব লাভ করা। কোনো প্রাদেশিক শাসনকর্তা যেন সেচ্ছাচারী ও স্বাধীন হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই ক্ষমতা বিভাজনের
এই ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু মামুনই প্রথম সুবাদার যিনি মোগল শাসনতান্ত্রিক এই প্রথা ভঙ্গ করে দিউয়ানের পদটিও নিজে
দখল করেন।
ক. ক্লাইভকে কখন লর্ড উপাধী প্রদান করা হয়? ১
খ. “হয় খ্রিস্টাধর্ম গ্রহণ কর অথবা মৃত্যুবরণ কর”Ñ ব্যাখ্যা কর। ২
গ. উদ্দীপকের মামুনের সাথে পাঠ্য পুস্তকের যে সুবাদারের সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তার শাসন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. “ইংরেজদের দিউয়ানি লাভ ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা”Ñ বিশ্লেষন করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র