ভারতবর্ষে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকালের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৮৫৭ সালের
মহাবিদ্রোহ বা বিপ্লব। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীর দেশীয় সিপাহীদের অসন্তোষ ও বিক্ষোভের কারণে সৃষ্ট বিদ্রোহ
পরবর্তী সময়ে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই গণবিদ্রোহ বৃটিশ শাসনকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে
এই গণবিদ্রোহ শুধু যে সিপাহীদের অসন্তোষের ফল তা নয়। এর মূলে ছিল কোম্পানির অনুসৃত নীতি ও বিদেশি শাসনের
বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভ‚ত ক্ষোভ ও হতাশা। ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মধ্যে বিক্ষোভ দানা
বেঁধে উঠে এবং তা থেকেই বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে।
কোনো একটি বিদ্রোহ বা বিপ্লব একদিনে বা একটি কারণে সংঘটিত হয় না। এর পেছনে থাকে নানাবিধ কারণ। ১৮৫৭
খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পেছনেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভৃতি কারণ ছিল। এছাড়াও কোনো কারণকে
প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
রাজনৈতিক কারণ
লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ দ্বারা তিনি
সাঁতারা, ঝাঁসি, সম্বলপুর ও নাগপুর রাজ্য দখল করেন। তাঞ্জোর ও কর্নাটকের নবাবের বৃত্তি এবং পেশোয়া দ্বিতীয়
বাজীয়াও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ করে দেন। অযোধ্যা রাজ্যটি কুশাসনের অভিযোগে গ্রাস করা হয় এবং
অমানুষিক অত্যাচার ও বর্বরতার সাথে দখলকৃত অযোধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করা হয়। এর ফলে নানা সাহেব
ও ঝাঁসির রাণি বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা পালন করেন এবং সাঁতারা ও নাগপুরের রাজপরিবারগুলো বিদ্রোহী ভাবাপন্ন হয়ে
উঠে। ডালহৌসি মোগল সম্রাটের উপাধি পর্যন্ত কেড়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা মুসলমান সম্প্রদায়ের
মধ্যে অসন্তোষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তা ছাড়া ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচার ও কুশাসনের কারণে ভারতীয়দের মধ্যে
বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
অর্থনৈতিক কারণ
ইংরেজ কোম্পানি শাসনে ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। পলাশীর পর থেকে
প্রায় একশ বছর ধরে ইংরেজরা ভারত থেকে সোনা, রূপা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু ও অপরিসীম ধনসম্পদ নিজেদের দেশে
পাচার করে। ভারতবর্ষকে বিলাতী পণ্যের বাজার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। অবাধভাবে বৃটিশ পণ্য আমদানির ফলে আস্তে
আস্তে দেশীয় ক্ষুদ্র শিল্পসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে বহু লোক বেকার হয়ে পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ নতুন ভ‚মি
ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর অসম্ভব করের বোঝা চাপান হয়। বহু লাখেরাজ সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ইংরেজ কর্তৃক
অযোধ্যা দখলের পর সেখানকার বহু তালুকদার জমির মালিকানা হারান। এভাবে ইংরেজদের শোষণ নীতির কারণে
জনগণের দুর্দশা ও দুরবস্থা চরমে উঠলে তারা বিদেশি শাসন বিরোধী হয়ে উঠে।
সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ
বিজিত ভারতবাসী এবং বিজেতা ইংরেজদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব থাকায় উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি
হয়। সে কারণে সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ, বিধবা বিবাহ আইন, শিশু হত্যা নিবারণ, নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি সংস্কারমূলক
পদক্ষেপ সনাতনপন্থী হিন্দুদের মনে সন্দেহ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার, জেলখানার
কয়েদীদের কাছে পাদরীদের যাতায়াত এবং অসহায় ও গরীবদের শিক্ষা-দীক্ষায় আর্থিক সহায়তা দান হিন্দু ও মুসলিম
সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন আশংকার সৃষ্টি করে যে, ইংরেজদের উদ্দেশ্য হলো ভারতবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা।
রেলপথ বিস্তার ও টেলিগ্রাফের প্রবর্তন একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে তারা সন্দেহ পোষণ করে।
সামরিক কারণ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল সিপাহীদের অসন্তোষ। যে সিপাহীরা ছিল বৃটিশ রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ,
নানাবিধ কারণে তারাও বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয় সৈনিকদের বেতন ছিল খুবই কম। পদোন্নতির
ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হতো। সামরিক কারণে দূরদেশে অবস্থান কালে ইংরেজ সৈনিকরা ভাতা পেত। কিন্তু
ভারতীয় সিপাহীরা তা থেকে বঞ্চিত ছিল। বৃটিশ অফিসারদের দুর্ব্যবহার, উদ্ধত ও অপামানজনক আচরণে দেশীয়
সৈনিকদের মধ্যে ইংরেজ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়। সিপাহীদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারে উৎসাহ দেয়া, কপালে তিলক
লেপন, দাঁড়ি রাখা ও পাগড়ী পরা নিষিদ্ধ করা, কালাপানি অর্থাৎ সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধ্য করা ইত্যাদির কারণে তাদের ধর্ম
বিশ্বাসেও আঘাত লাগে এবং তারা ক্রমশ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে।
প্রত্যক্ষ কারণ
বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ হল চর্বি মিশ্রিত কার্তুজের প্রবর্তন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক
ধরনের বন্দুকের ব্যবহার শুরু হয়। ব্যবহারের পূর্বে এর কার্তুজ দাঁত দিয়ে কাটতে হতো। গুজব রটে যে, উক্ত রাইফেলে
গরু ও শুকরের চর্র্বি মিশ্রিত কার্তুজের প্রচলন করে বৃটিশ সরকার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্ম নাশ করার ষড়যন্ত্র
করছে। ফলে দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুর সেনানিবাসে মঙ্গল
পান্ডে নামে এক সিপাহী প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহ করে। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ মঙ্গল পাÐে এবং তার একজন সমর্থককে প্রাণদÐে
দÐিত করে বিদ্রোহের আগুন নেভাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর মে মাসে বড় আকারের বিদ্রোহ দেখা দেয় মীরাটের
সেনা ছাউনিতে। সিপাহীরা সরকারী নির্দেশ অমান্য করে এবং কর্নেল ফিনিসকে গুলি করে হত্যা করার পর প্রকৃত বিদ্রোহের
সূত্রপাত ঘটে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব শুধু যে সিপাহীদের অসন্তোষের ফল তা নয়। এর পেছনে ছিল ঔপনিবেশিক সরকারের গৃহীত
ব্যবস্থা ও অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ ও ক্ষোভ। বিপ্লবের কারণসমূহকে
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় ও সামাজিক এবং প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিদেশী শাসন
শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ এ বিপ্লবের মাধ্যমেই ঘটেছিল।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন কে?
ক) লর্ড কানিং খ) লর্ড ডালহৌসী গ) লর্ড ওয়েলেসলি ঘ) উইলিয়াম বেন্টিংক
২। স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রয়োগ করেন কে?
ক) ওয়ারেন হেন্টিংস খ) লর্ড কর্নওয়ালিস গ) উইলিয়াম বেন্টিংক ঘ) লর্ড ডালহৌসি
৩। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ ছিলÑ
ক) সামাজিক খ) এনফিল্ড রাইফেল প্রবর্তন গ) সামরিক ঘ) রাজনৈতিক
৪। সিপাহীর গুলিতে নিহত হনÑ
ক) লর্ড ক্যানিং খ) কর্ণেল ফিনিস গ) লর্ড ডালহৌসি ঘ) উইলিয়াম বেন্টিংক
৫। ব্যারাকপুরে প্রথম প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেন কে?
ক) মঙ্গল পান্ডে খ) বাজীয়াও গ) নানা সাহেব ঘ) ল²ী বাঈ
সৃজনশীল প্রশ্ন
অরবিন্দ ঢালী, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে কর্মরত। তিনি লক্ষ্য করেছেন দেশীয় সৈন্যদের থেকে বিদেশি
সৈন্যদের বেশি বেতন দেয়া হয়। ভিন্ন দেশে কর্মরত থাকলেও দেশীয় সৈন্যদের ভাতা দেয়া হয় না ভাতা দেয়া হয় বিদেশি
সৈন্যদের। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার। এছাড়া ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, উদ্ধত ও অপমানজনক
ব্যবহার তাদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তৈরি করে। কপালে তিলক লেপন, দাড়ি রাখা, পাগড়ীপরা ও জোর করে
সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধ্য করায় ক্রমশ দেশীয় সৈন্যরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।
ক. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী? ১
খ. প্রকৃত বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে কখন? ২
গ. উদ্দীপকের সাথে পাঠ্য পুস্তকের যে বিদ্রোহের সাদৃশ্য আছে, তার সামরিক কারণ ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. “উক্ত বিদ্রোহের ফলে কোম্পানি শাসকের অবসান ঘটে।” বিশ্লেষণ করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র