১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের (বাংলা বিভাগ) পটভ‚মি ও কারণসমূহ, প্রতিক্রিয়া

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ বা বঙ্গ-বিভক্তি ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জনের শাসনামলের একটি প্রশাসনিক
সংস্কার। ঐ সময় সমগ্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল বঙ্গ প্রদেশ
বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। উপমহাদেশের এক তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস ছিল এ অঞ্চলে। কার্জন এত বড় এলাকাকে একটি
মাত্র প্রশাসনিক ইউনিটের অধীনে রাখা যুক্তিযুক্ত মনে করেন নি। রাজধানী কলকাতা থেকে সুদূর পূর্বাঞ্চলের আইন শৃংখলা
রক্ষা ও শাসনকার্য সুচারুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনিক কারণে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল
প্রেসিডেন্সিকে দু’ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা করেন। পূর্ব ও উত্তর বঙ্গকে আসামের সাথে সংযুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম
নামে একটা নতুন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে। কিন্তু কার্জনের উক্ত সিদ্ধান্ত প্রবল
প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও বাংলার বর্ণ হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন গড়ে তোলে।
বাংলা প্রেসিডেন্সির সীমানা রদবদলের প্রয়োজনীয়তা অনেক পূর্ব থেকেই সরকারী মহলের বিবেচনায় স্থান লাভ করে।
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে চার্লস গ্রান্ট বাংলা প্রদেশকে দু’ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। পরের বছর লর্ড ডালহৌসীও একই মন্তব্য
করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের সময় বাংলার সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ভারত সচিব লর্ড
নর্থকোট যে কমিটি নিয়োগ করেন তার প্রতিবেদনেও বাংলা প্রদেশকে ভাগ করার সুপারিশ করা হয়। এসব বিবেচনা করে
সরকার ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে আসামকে বাংলা থেকে পৃথক করে চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত করে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে
আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দেন।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ হওয়ায় প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। ভাইসরয় নিযুক্তির অল্পদিনের মধ্যেই কার্জন ভারতের
প্রদেশগুলোর সীমারেখা পুননির্ধারণের পূর্বের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর
মাসে ভারত সরকার বাংলার সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারগুলোর মতামত জানতে চাইলে তারা পূর্ব পরিকল্পনা
অনুযায়ী চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার সামান্য রদবদল
করে পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি প্রবল গণ-অসন্তোষের সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরুদ্ধে সরকারের
কাছে স্মারকলিপি পাঠান হয়। মুসলমানদের পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ আসে। এমতবস্থায় লর্ড কার্জন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের
ফেব্রæয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গ সফরে যান। তিনি সর্বত্রই বঙ্গবিভক্তি বিরোধী উত্তেজনা লক্ষ করেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে
প্রদত্ত ভাষণে তিনি প্রস্তাবিত পুনর্বিন্যাসে আরও কিছু এলাকা এর সঙ্গে যুক্ত করার ইঙ্গিত দেন, যার ফলে একজন
লেফটেন্যান্ট গভর্নর, একটি আইন পরিষদ ও পৃথক রাজস্ব বোর্ড নতুন প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে থাকবে। তিনি আরও
বলেন যে, প্রস্তাবিত প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকায় এবং এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা নতুন প্রদেশে বেশি সুযোগ
সুবিধা ভোগ করবে। ফিরে গিয়ে কার্জন প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি পুনরায় পর্যালোচনা করেন এবং কিছু সংযোজনসহ ১৯০৫
খ্রিস্টাব্দের ফেব্রæয়ারি মাসে অনুমোদনের জন্য ভারত সচিবের নিকট প্রেরণ করেন। নতুন বিন্যাসে আসামের সঙ্গে পূর্ব
বাংলার চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগ যুক্ত হয়। তাছাড়া দার্জিলিং বাদ দিয়ে জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা ও মালদহ
এর অন্তর্ভুক্ত হয়। তিন কোটি দশ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী নির্বাচিত হয় ঢাকা।
বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর কার্যকরী হয়।
বঙ্গবিভাগ ও নতুন প্রদেশ গঠনের পেছনে প্রশাসনিক সুবিধা ও দক্ষতা বৃদ্ধিই ছিল কার্জনের মূল উদ্দেশ্য। ইংরেজ শাসনের
শুরু থেকেই সমগ্র বাংলার শাসন ব্যবস্থা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। এর ফলে পূর্ব বাংলা সব সময়েই ছিল অবহেলিত ও
অনুন্নত। কার্জন ভেবেছিলেন যে, নতুন প্রদেশ করা হলে এ অঞ্চলের শিক্ষা, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে
এবং পূর্ববঙ্গ বাংলার অন্য অংশের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। কিন্তু কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও সমকালীন রাজনৈতিক
ব্যক্তিবর্গের অনেকে তাঁর এ পরিকল্পনাকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির একটি রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে
করেন। তাঁদের ধারণা কার্জন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইংরেজ বিরোধী ভ‚মিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তিনি বাঙালীর
নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক শক্তিকে খর্ব করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য প্রধানত রাজনৈতিক কারণে তিনি কংগ্রেসের প্রভাব
প্রতিপত্তি ও নতুন জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে মনস্থ করেন।
উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লা এবং নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে
স্বাগত জানায়। মুসলিম পত্র-পত্রিকাগুলো নতুন প্রদেশ গঠনে সন্তোষ প্রকাশ করে। যেহেতু পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ ছিল
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা নানারকম সুযোগ সুবিধার আশায়
বঙ্গবিভাগকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করে।
কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটে বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে। তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে ভারতীয় জাতীয়
কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে জমিদার, পুঁজিপতি,
ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে এ আন্দোলনে যোগ দেয়। কলকাতা কেন্দ্রিক ভ‚স্বামী ও
পেশাজীবীরা নতুন প্রদেশে নানাবিধ সমস্যা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবার আশংকায় বঙ্গভঙ্গ রদের
আন্দোলনকে শক্তিশালী ও ব্যাপক করে তোলে। সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনী কুমার দত্ত,
বাল গঙ্গাধর তিলক এমন কি গোখলের মতো উদারপন্থী নেতাও এ আন্দোলনে অংশ নেয়। বঙ্গ-বিভক্তি প্রতিরোধ সংগ্রাম
পরে স্বদেশী আন্দোলনকে বেগবান করে। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শক্তি প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করায় সন্ত্রাসবাদী
কার্যকলাপও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বৃটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে
বঙ্গভঙ্গ রহিত করে। রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লী দরবারে এ ঘোষণা দেন।
বঙ্গভঙ্গ বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন অনেক বড় হওয়ায় ১৮৫৩
থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর সীমানা পুনর্বিন্যাসের জন্য বৃটিশ সরকারী মহলে অনেক প্রস্তাব আসে। শেষ পর্যন্ত মূলত
প্রশাসনিক কারণে লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন একটা প্রদেশ সৃষ্টি করেন। এ
প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা এতে খুশী হলেও বাংলার বর্ণ হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন
গড়ে তোলে। তাদের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৯.৪
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানিয়েছিলেন কে?
র. স্যার সৈয়দ আহমদ খান
রর. নবার স্যার খাজা সলিমুল্লা
ররর. নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী
নিচের কোনটি সঠিক?
ক) র ও রর খ) র ও ররর গ) রর ও ররর ঘ) র, রর ও ররর
২। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় কত খ্রিস্টাব্দে?
ক) ১৯০৩ খ) ১৯০৫ গ) ১৯০৯ ঘ) ১৯১১
৩। বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন রাজধানী স্থাপিত হয় কোথায়?
ক) কলকাতা খ) আসাম গ) ঢাকা ঘ) দিল্লী
সৃজনশীল প্রশ্ন
প্রশাসনিক ও মহানগরীর বাসিন্দাদের সার্বিক সুবিধা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ঢাকা উত্তর সিটি
করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নামে বিভক্ত করা হয়। দু’জন মেয়রের হাতে এর দায়িত্বভার ন্যাস্ত করা
হয়। এ ঘোষণায় নামমাত্র বিক্ষোভ হলেও ঢাকাবাসী সাদরে এ বিভক্তি সমর্থন করে সরকারকে ধন্যবাদ জানায়।
ক. বর্ণিত অঞ্চল বিভাজন আপনার পাঠ্য বইয়ের কোন বিভাজনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করুন। ১
খ. উক্ত বিভক্তি বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায় কীভাবে গ্রহণ করেছিল? এই বিষয়ে আপনার মতামত যুক্তিসহ
লিখুন। ২

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]