ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন দু’টি ছিল প্রথম ব্যাপক ও জাতীয় ভিত্তিক গণআন্দোলন।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা এ আন্দোলন বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভীতকে কাঁপিয়ে
তোলে। এ দুটি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল না হলেও ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট
সাহায্য করে।
মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক তুরস্কের খলিফার প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য ও সম্মানবোধ অনেক দিন থেকেই
ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক বৃটিশের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে এবং জার্মানির পক্ষে অবতীর্ণ হওয়ায় ভারতীয়
মুসলমানদের মনে দ্বৈত আনুগত্যের প্রশ্ন দেখা দেয়। মহাযুদ্ধের সময় ভারতের মুসলমানগণ বৃটিশ সরকারকে এ শর্তে
সমর্থন দেয় যে বৃটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে তুরস্কের খলিফার কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু যুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর
বৃটিশরা তাদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে। মিত্রপক্ষ ‘প্যারিস চুক্তির’ মাধ্যমে তুর্কী সাম্রাজ্যের ব্যবচ্ছেদ এবং খলিফাকে অর্মযাদা
করা হয়। ফলে বিক্ষুব্ধ ভারতীয় মুসলমানরা খলিফার মর্যাদা ও তুরস্কের অখÐতা রক্ষার উদ্দেশ্যে এক আন্দোলন গড়ে
তোলে। এই আন্দোলন ইতিহাসে ‘খিলাফত আন্দোলন’ নামে পরিচিত। মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত
আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতাদের নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মিত্রপক্ষ
তুরস্কের উপর ‘সেভার্স চুক্তি’ চাপিয়ে দিয়ে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে চ‚ড়ান্তভাবে খÐ বিখÐ করার এবং তুরস্কের সার্বভৌমত্ব
বিলুপ্তির উদ্যোগ নিলে খিলাফত আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে লক্ষেèৗতে ভারতীয় মুসলমানদের একটি বৈঠকে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়।
বোম্বেকে কেন্দ্র করে সব প্রদেশে কমিটির শাখা প্রশাখা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। পরের মাসে এ. কে ফজলুল হকের
সভাপতিত্বে দিল্লীতে খিলাফত কমিটির প্রথম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, বৃটিশ সরকার তুরস্কের খলিফার মর্যাদা রক্ষার
কোনো প্রতিশ্রæতি না দিলে মুসলমানরা সরকারের সঙ্গে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করবে। প্রয়োজনে তারা বৃটিশ পণ্যও
বর্জন করবে। মহাত্মা গান্ধী যিনি এ সময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ার লক্ষ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন
তিনি কয়েকজন কংগ্রেস নেতাসহ উক্ত খিলাফত সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি খেলাফতের বিষয়ে কংগ্রেসের পূর্ণ
সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাওলানা মোহম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি
ডেপুটেশন খিলাফতের ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য লন্ডন ও প্যারিস সফর করেন। কিন্তু বৃটেন অথবা মিত্রপক্ষের কেউই এ
ডেপুটেশনকে কোনো বিশেষ গুরুত্ব দেয় নি। ফলে প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে আসলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন
আরও তীব্র এবং জোরদার হয়। ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ সারা ভারতে খিলাফতের দাবিতে হরতাল পালিত হয়। মে মাসে
বোম্বেতে খেলাফত কমিটির সভায় বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। জুন মাসে এলাহাবাদে
খিলাফত কমিটির আহবানে হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের এক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি চ‚ড়ান্ত করার জন্য একটি
কমিটি গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে খিলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি আরেকটি আন্দোলন কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে গড়ে তোলার
প্রস্তুতি চলে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বৃটিশ সরকার চরমপন্থী বিপ্লবী আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে নিবর্তনমূলক
রাওলাট আইন পাশ করে এবং বিনা বিচারে শত শত লোককে কারাবন্দী করে। উক্ত আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ
ও প্রতিবাদ আন্দোলনের পটভ‚মিতে সংঘটিত হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাÐ। বৃটিশ
জেনারেল ডায়ার নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়ে প্রায় ৪০০ লোককে হত্যা করে। এতে ইংরেজ বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা
হয়ে উঠে। মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের সহযোগিতা লাভের জন্য ইতিপূর্বে সৃষ্ট খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। তিনি
বৃটিশদের দেয়া ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট সেভার্স চুক্তির পর এর প্রতিবাদে মুসলমানগণ ৩১ আগস্ট খিলাফত দিবস পালন
করে। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি
গৃহীত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের এবং পূর্ণ
স্বরাজের দাবির ঘোষণা দেয়া হয়। জাতীয় কংগ্রেস অসহযোগের কর্মসূচি হিসেবে সরকারী চাকুরী ও পদবী ত্যাগ, সরকারী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আদালত ও আইন ব্যবসা বর্জন, বিলাতী দ্রব্য পরিহার ইত্যাদি প্রস্তাব গ্রহণ করে। একই সময়ে নাগপুরে
খিলাফত কমিটি ও মুসলিম লীগ অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তারিত কর্মসূচি অনুমোদন করে এবং স্বরাজ উভয়ের মূল লক্ষ্য
বলে ঘোষণা দেয়। ফলে খিলাফত ও অসহযোগ হিন্দু মুসলমানের যৌথ আন্দোলনে পরিণত হয়।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে উভয় আন্দোলন তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং এক চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়। ছাত্রছাত্রীরা সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে, শ্রমিকরা কারখানা ত্যাগ করে, সরকারী চাকুরীতে ভারতীয়রা ইস্তফা দেয় এবং
আইনজীবীরা আদালত ছেড়ে চলে যায়। আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠন গড়া রাজনৈতিক
কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। দমন নীতির অংশরূপে বৃটিশ সরকার হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার করে। অনেকে আবার
স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। মুসলমানরা বৃটিশ সেনাবাহিনী ত্যাগের হুমকি দেয়।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আহমেদাবাদে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং সর্বত্র
অচলাবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকারকে কর ও খাজনা প্রদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আন্দোলনের সে চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে
অহিংসার স্থলে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে মালাবারে মোপলা কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করে এবং দাঙ্গা হাঙ্গামার আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রæয়ারিতে উত্তর প্রদেশের চৌরিচোরা নামক
স্থানে একদল বিক্ষুদ্ধ জনতা থানা আক্রমণ করে ২১ জন সিপাহী ও একজন দারোগাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
গান্ধী তাঁর অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন এভাবে সহিংসায় পরিণত হতে দেখে মর্মাহত হন। কংগ্রেসের বারদালি
সম্মেলনে তিনি হঠাৎ সমগ্র আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এতে সারাদেশে হতাশার সৃষ্টি হয়। সরকার শীঘ্রই গান্ধীকে
গ্রেফতার করে। অসহযোগ আন্দোলনের অবসানে খিলাফত আন্দোলনও দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে কামাল
আতাতুর্ক খিলাফত উচ্ছেদ করার পর এ আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন সফল না
হলেও সে গণজাগরণ ছিল অভ‚তপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে আন্দোলন দুটির
অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম।
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত ঔপনিবেশিক শাসনের
বিরুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম জাতীয় ভিত্তিক গণআন্দোলন। তুরস্কের খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার জন্য ভারতের মুসলমানগণ
খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়। অন্যদিকে অসহযোগের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জন্য স্বরাজ অর্জন। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের
ভিন্নতা থাকা সত্তে¡ও আন্দোলন দুটি একই সঙ্গে ও যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। কিন্তু অহিংস পন্থায় আন্দোলন
চালানো সম্ভব হচ্ছে না দেখে হঠাৎ গান্ধী আন্দোলন বন্ধ ঘোষণা করেন। এর ফলে খিলাফত আন্দোলনও শক্তি হারিয়ে
ফেলে এবং তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক খিলাফত প্রতিষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করায় ভারতবর্ষে এ আন্দোলন অকেজো হয়ে পড়ে।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। কোন দেশের ঘটনায় খিলাফত আন্দোলনের সূচনা হয়?
ক) বাংলা খ) ভারত গ) ব্রিটেন ঘ) তুরস্ক
২। ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ কার উপাধি?
ক) এ কে ফজলুল হক খ) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গ) মহাত্মা গান্ধী ঘ) মতিলাল নেহেরু
৩। খিলাফত আন্দোলন চুড়ান্তভাবে বন্ধ হওয়ার কারণ কী?
ক) অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত হলে খ) তুরস্কে কামাল আতার্তুক ক্ষমতায় এলে
গ) সরকারের দমন অভিযান শুরু হলে ঘ) খিলাফত নেতাদের বন্দী করলে
৪। অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোন পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছিল?
ক) অহিংস পদ্ধতিতে খ) হিংসাত্মক কার্যক্রমের মাধ্যমে
গ) গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে ঘ) আইন অমান্য পদ্ধতিতে
সৃজনশীল প্রশ্ন
শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনমূলক আইন এবং একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে একটি অঞ্চলের দুটি সম্প্রদায়ের
নেতৃবৃন্দ দুটি পৃথক আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক
ঐক্যের মাধ্যমে একত্রিত হয়। এতে উভয় আন্দোলন শাসকগোষ্ঠীকে প্রায় কোনঠাসা করে ফেলে। এক পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন
কারণে আন্দোলন দুটি থেমে গেলেও এর ব্যাপক প্রভাব শাসকগোষ্ঠীর অবস্থাকে সংকটাপন্ন করেছিল।
ক. ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে কারা পৃথক নির্বাচনের অধিকার লাভ করে? ১
খ. “১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ছিল এক রকম দ্বৈত শাসন।” উক্তিটি ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. বর্ণিত আন্দোলন দুটি ব্রিটিশ শাসনাধীনে কোন কোন ভারতীয় আন্দোলনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. উক্ত আন্দোলনের দুটির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র