মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ
আইয়ুব খানের নিকট থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা
হস্তান্তরের প্রতিশ্রæতি দেন। ২৮ নভেম্বর তিনি এক ভাষণে দেশে পুনরায় সর্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে
সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একাধিক রাজনৈতিক দল
নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফল ছিল ছয়
দফাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা
হস্তান্তরে গড়িমসি করেন।
অসহযোগ আন্দোলন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পাকিস্তানের
রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বের
আসনে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি সামরিক শাসক স্বাভাবিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আন্দোলনের
মাধ্যমে তা আদায় করে নিতে হবে। তাই তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে ১৯৭১ সালের ২ ও ৩ মার্চ হরতাল এবং ৭ মার্চ
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যথাসময়ে হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশের পর আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে ডাকসু নেতৃবৃন্দ কলাভবনে প্রথম
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিনে হরতাল চলাকালে মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে পূর্ব বাংলার মানুষ
বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। পরিস্থিতির দ্রæত অবনতি ঘটতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। তিনি
অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করে। সভা থেকে বঙ্গবন্ধু ২-৬ মার্চ প্রতিদিন ভোর ৫-২টা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা
করেন। এই অবস্থাকে সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার তারিখ নির্ধারণ করেন। এই
সময় লেফটেন্যন্টি জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু- ইয়াহিয়া খান আলোচনা
বঙ্গবন্ধুর আদেশ জারির পর থেকে শুধু সেনাবাহিনী ছাড়া সর্বত্র আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবস্থার গভীরতা
উপলদ্ধি করে ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব
দেন। বঙ্গবন্ধু আলোচনায় রাজি হলেও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নি। ১৬ মার্চ থেকে মুজিব-ইয়াহিয়া
আলোচনা শুরু হয়। একদিকে আলোচনা শুরু হয় অন্যদিকে ১৭ মার্চ টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চ
লাইট’ বা বাঙালির ওপর নৃশংস হত্যাকাÐ পরিচালনার নীলনকশা তৈরি করে। ১৯ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা জয়দেবপুরে
নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়। এরপর ২২ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন এবং আলোচনায় অংশ
নেন। ভুট্টো ছয় দফার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা জটিল করে তোলেন। আসলে এভাবে তারা সময় ক্ষেপন করছিলেন। আর
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আর রসদ আনা হচ্ছিল এ দেশে। স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমে তীব্র হতে থাকে।
চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে শ্রমিকরা অস্বীকার করে। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। এদিন পূর্ব
পাকিস্তানের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের শেষ
চেষ্টা করেন। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চের গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক
নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে
একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। পাকিস্তানি
সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র, নিরীহ,
স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের উপর হামলা করে
নির্বিচারে হত্যাকাÐ চালায়। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের
হত্যার এই অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চ
লাইট’। ২৫ মার্চ রাতে এই অভিযান পরিচালনা করলেও
মূলত মার্চের প্রথম থেকেই তারা এর পরিকল্পনা করে।
১৯ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের
বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়। ২০ মার্চ সরকার
অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করে। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম.ভি সোয়াত থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস শুরু হয়। সব
প্রস্তুতি শেষে ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য বেছে নেয়া হয় এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহরের মূল
দায়িত্ব দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। যাবার আগে
সেনাবাহিনীকে পূর্বপাকিস্তানিদের উপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে
যান। ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ মোতাবেক গভর্নর টিক্কা খানের
ঘাতক সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার তাÐবলীলা চালায়।
এই গণহত্যা চলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, পুরনো ঢাকায়,
কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে, রায়ের বাজার, ধানমন্ডি, কলাবাগান,
কাঁঠালবাগানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায়
গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন
এবং তা ওয়্যারলেসযোগে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা
বাণী শোনামাত্রই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ গড়ে
তোলা হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর ঘাটি
এবং রাজনৈতিক দলের কার্যালয়সমূহে আক্রমণ পরিচালনা করা
হয়। নৃশংস গণহত্যার সংবাদ যাতে বিদেশে ছড়িয়ে না পড়ে সে
জন্য ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ২৫ জন বিদেশি
সাংবাদিককে আটক করা হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে
বাঙালি পুলিশ, আনসার ও সাধারণ মানুষের এক অসম লড়াই যা
বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের মাইলফলক ও প্রেরণার উৎস। বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তি
কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হলেও এর বিষয়বস্তু ও নির্দেশনা ছিল একই। এই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব
স্বীকৃত হয়েছে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা
গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
তিনি এ ঘোষণা ওয়্যারলেসযোগে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। এজন্যই ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। মূল
ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে। এর বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে নিম্নরূপ:
‘ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহŸান জানাইতেছি যে,
যে যেখানে আছে, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো।
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না
করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। (বাংলাদেশ গেজেট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, ৩ জুলাই ২০১১)
স্বাধীনতার এ ঘোষণা বাংলাদেশের সকল স্থানে তদানীন্তন ইপিআর এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে
প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান চট্টগ্রামের
বেতার কেন্দ্র থেকে একবার এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার প্রচার করেন। ২৭ মার্চ কালুরঘাটে
স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এর প্রতি
বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমর্থন ও অংশগ্রহণের খবরে স্বাধীনতাকামী জনগণ উজ্জীবিত হয়।
এরপর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে
জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার আহŸান জানানো হয়। এ ঘোষণায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে স্বাধীনতা ঘোষণা
কার্যকর বলে গণ্য করা হয়। স্বাধীনতার পর সংবিধানে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে একে প্রতিষ্ঠানিক রূপ
প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে প্রাথমিকভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা
ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ও
গণহত্যা শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান হতে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ সদস্য প্রতিবেশি দেশ ভারতে
আশ্রয় নেন। তারা একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের
একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। ১৩ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের এক সভায় সরকার
গঠন অনুমোদন করা হয়। ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের সদস্যগণ মেহেরপুর বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহণ করেন।
সরকারের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম অনুসারে বৈদ্যনাথ তলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর
এবং দেশে-বিদেশে সরকার পরিচিত হয় মুজিবনগর সরকার নামে।
আওয়ামী লীগের চীপ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অস্থায়ী সরকারের (মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত) সদস্যদের শপথ
পাঠ করান। শপথ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। এ সরকার গঠনের মাত্র দুই ঘন্টা
পর পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান মুজিবনগরে বোমাবর্ষণ করে এবং মেহেরপুর দখল করে নেয়। ফলে মুজিবনগর সরকারের
সদর দপ্তর কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়।
মুজিবনগর সরকার: সালাম গ্রহণ গার্ড অব অর্নার
মুজিবনগর সরকার
নাম দপ্তর
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ
পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় খন্দকার মোশতাক আহমেদ
অর্থমন্ত্রণালয় এম.মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এ এইচ এম কামরুজ্জামান
প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এম. এ. জি. ওসমানী
উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকায় উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। সরকারকে নীতি নির্ধারণী পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য ৯ সদস্যের একটি উপদেষ্টা
কাউন্সিল গঠন করা হয়। মাওলানা ভাসানী ছিলেন কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ১২টি
মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। এসব বিভাগের মাধ্যমে যুদ্ধকালে সামরিক ও বেসামরিক যাবতীয় প্রশাসন পরিচালিত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয়
দোসররা নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে। তাদের প্রধান লক্ষ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এদেশের
ছাত্রসমাজ, অসা¤প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু হিন্দু স¤প্রদায়। পাকিস্তানিরা বিশ্বাস
করত পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন সংগ্রামের পেছনে ভারতের ইন্ধনে হিন্দুরা কাজ করছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী পৌঁছে যায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের
এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। সরকারি হিসেবে আড়াই লাখের অধিক মা-বোন পাকিস্তানিদের
পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী বরেণ্য
সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনীকে নির্যাতন,
হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি
কমিটি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী এদেশিয় দোসররা এককথায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত।
প্রধানত জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের সমর্থকরা
মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশ এই দলগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা
করেছে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দানের আহŸান
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহির্বিশ্বের সমর্থন
আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত
হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা
পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নতুন রাষ্ট্র
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহŸান জানান। শত্রæর মোকাবেলা
করে দেশকে মুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতিও আহŸান জানানো হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল
ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভের
ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এ
সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা। বাঙালি কর্মকর্তাদের
নিয়ে সরকার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন। এতে মোট ১২টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা
ও সমর্থন আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন
করে। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক, বেসামরিক জনগণকে নিয়ে একটি
মুক্তিযোদ্ধাবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে প্রথমে ১০ এপ্রিল ৪টি এবং
পরবর্তীকালে ১১ এপ্রিল ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি সেক্টরেই নিয়মিত সেনা, গেরিলা ও সাধারণ যোদ্ধা ছিল
যারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিফৌজ নামে পরিচিত ছিল। এসব বাহিনীতে দেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক, নারী, রাজনৈতিক দলের
কর্মী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সরকারের অধীন বিভিন্ন বাহিনী ছাড়াও বেশ
কয়েকটি স্থানীয় বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এই বাহিনীগুলোও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দেশিয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এসব বাহিনী সরকারের আওতার বাইরে নিজস্ব পদ্ধতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর
বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। মুজিবনগর সরকার আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত
করে। তিনি মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করেন। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বাঙালি সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সৈন্য
ব্যাটেলিয়ান ই পি আর পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মুক্তি বাহিনীর নিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে দীর্ঘ দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান করে।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও পিকিং পন্থী হিসেবে পরিচিত একটি অংশ বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী
ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এই দলগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে অত্যাচার,
নির্যাতন ও গণহত্যায় সহযোগিতা করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সমমনা বাম রাজনৈতিক দলসমূহ
নিয়ে আওয়ামী লীগ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল
হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ-ভাসানী), মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল
কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ (ন্যাপ-মুজাফফর)। আওয়ামী লীগ থেকে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশিয় দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন,
হত্যা, ধর্ষণ এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক,
চিকিৎসক, শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ শামিল হয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটি, রাজাকার ও অন্যান্য বাহিনী গঠন
মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট ইয়াহিয়া খান গভর্নর টিক্কা খানের স্থলে ডা.
আব্দুল মালিককে গভর্নর নিযুক্ত করেন। ডা. মালিকের তত্ত¡াবধানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি
বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়। পাকিস্তান সমর্থক রাজনীতিবিদদের ও ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে
ইসলামী, পিডিপি, মুসলিম লীগের সমন্বয়ে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। দেশব্যাপী এর শাখা কমিটি গঠিত হয়।
অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় এই সংগঠন দখলদার বাহিনীর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে কাজ করে। পকিস্তানি হানাদার
বাহিনীর সহযোগি সংগঠন হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দিতো
পাকিস্তানি বাহিনী এবং প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহ। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের
সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় আলবদর বাহিনী। এই বাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান দায়িত্ব পালন করে।
অন্যান্য ইসলামি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় আল-শামস বাহিনী। এই বাহিনী গণহত্যায় সহযোগিতার
পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্প ও ব্রিজ পাহারা দিতো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সব সম্পদ-প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে
দিতে চেয়েছে। তাদের লক্ষ ছিল এই ভূখÐের মানুষদের হত্যা করে ভূমি দখল করে নেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনীর এই সকল
মানবতাবিরোধী অপরাধে সহায়তা করেছে এই দেশীয় বাহিনীগুলো।
পূর্ব পাকিস্তানের কিছু লোক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মানবতাবিরোধী অপরাধ গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে
সহযোগিতা করে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে জামায়াত ইসলামীর নেতা গোলাম আযম,
আব্বাস আলী খান, আব্দুল খালেক, মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ, পিডিপি নেতা নূরুল আমীন, মাহমুদ আলী, ফরিদ
আহমদ, ইউসুফ আলী চৌধুরি, আবদুল জব্বার খান, মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান, কাজী কাদের, ফজলুল কাদের চৌধুরী,
আবদুল মতিন, আ.ন.ম. ইউসুফ, খাজা খয়েরুদ্দীন, আবুল কাশেম, কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা মোহাম্মদ সোলায়মান,
জাতীয় লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আবদুল কাদের মোল্লা,
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ অন্যতম। এই দেশদ্রোহীরা প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এ সময় অবরুদ্ধ
বাংলাদেশে দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সমগ্র বাংলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে।
মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের সমর্থন ও সাহায্য
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় তাÐব বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। বিভিন্ন দেশ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশি দেশ ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব
ইউরোপের দেশসমূহের সরকার ও জনগণ সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিল। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায়
এককোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশি শরণার্থীদের ভরণ পোষণের দায়িত্বপালনসহ
সবধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদীআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের
সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। ঐসব দেশের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল গভীর সহানুভূতি ও
সমর্থন। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও যশোরের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয়।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ৪ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইন্দিরা গান্ধী
সরকার ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য ভারত
সরকার মিত্র বাহিনী পাঠায়। মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী একত্রে যৌথ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচÐ
আক্রমণ শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে যশোর সেনানিবাস, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, ভৈরব, কুষ্টিয়া,
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল মুক্ত করে যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে চলে আসে।
বুদ্ধিজীবী হত্যা
যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে আগমন ও ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঢাকা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর
মালিকের নেতৃত্বাধীন সরকার পদত্যাগ করে। এ সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও
আল শামস এর সহযোগিতায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, চিকিৎসক
ও সাংবাদিকসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। হত্যাকাÐের শিকার
বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য সহযোগিতা করে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী
ও ভারতীয় বাহিনী মিলে ‘যৌথ কমান্ড’ গঠন করে। ৬-১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতের সেনা, নৌ,
বিমানবাহিনীও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। যৌথ বাহিনীর দুর্বার আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনী অবশেষে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ৯৩ হাজার
সৈন্যসহ যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তানের পক্ষে নিয়াজী এবং যৌথ বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ
দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এতে অস্থায়ী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের
মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সম্পন্ন হয়। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার। পাকিস্তানি শাসনযন্ত্রের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানিরা
কোনোরূপ সহানুভূতি লাভ করতে পারে নি; বরং পেয়েছে বঞ্চনা আর নির্যাতন। স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া ছাড়া তখন
তাদের আর করণীয় কিছু ছিল না। ফলে বাংলাদেশিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধে বিপর্যস্ত করে ফেলে
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের মিত্র বাহিনী সাহায্যের হাত বাড়ায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের
শক্তি অনেক বেড়ে যায়। এরই পরিণতিতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের
মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কতটি?
ক) ৬ খ) ১১
গ) ১২ ঘ) ১৭
২। অপারেশন সার্চ লাইট বলতে বুঝায়Ñ
ক) রোগীর অপারেশন করা খ) মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ পরিকল্পনা
গ) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান ঘ) সাধারণ মানুষকে হত্যা করা
নিচের উদ্দীপকটি পড়–ন এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দিন।
রেসকোর্স ময়দানÑ উর্দু > না না না
রেসকোর্স ময়দানÑ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম
রেসকোর্স ময়দানÑ ?
৩। প্রশ্নবোধক (?) স্থানে কি বসবে?
ক) গোলটেবিল বৈঠক খ) পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ
গ) ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ঘ) স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
৪। উক্ত ঘটনায় কতজন অংশ নেয়?
ক) ১০ হাজার খ) ৯৩ হাজার
গ) ১০ লক্ষ ঘ) ৩০ লক্ষ
সৃজনশীল প্রশ্ন
একটি ভাষণের অংশ বিশেষ নিম্নরূপ:
“Ñআর যদি একটি গুলি চলে, তা হলে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলÑ যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা
করতে হবে।”
“মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন-শা-আল্লাহ।”
ক. মুজিব নগর সরকারকে শপথ পাঠ করান কে? ১
খ. মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. প্রদত্ত ভাষনের অংশটি কার উদাত্ত আহŸান? ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. “উক্ত নেতা বাঙ্গালি জাতির প্রতীক।” উক্তিটি বিশ্লেষণ করুন। ৪

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]