সামরিক বেসামরিক মিলে প্রায় দেড় কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। প্রায় ৯০ লাখ সামরিক ও ৭০ লাখ
বেসামরিক মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিল। রুশ গৃহযুদ্ধ এবং আর্মেনীয় গণহত্যার কাহিনীকে বাদ দিলেও এ যুদ্ধে
হতাহতের সংখ্যায় তেমন কোনো হেরফের হয় না। বলতে গেলে ১৯১৪ সালের ২১ আগস্ট ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি
ফোর্সের চতুর্থ ড্রাগন গার্ডসের ১২০ জন অশ্বারোহী সৈন্য গিয়ে অবস্থান নেয় বেলজিয়ামের চ্যাস্টাউ গ্রামে। সেখানে জার্মান
সৈন্যদের জোরদার অবস্থান দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি ১৬ বছর বয়স্ক কিশোর ব্রিটিশ সৈন্য বেন ক্লাউটিং। ২২
আগস্ট তাঁর ছোড়া গুলির মধ্য দিয়েই মূলত হয়ে শুরু যায় এ যুদ্ধ। তারপর এগিয়েছে নানা সংঘাত আর ঘটনার ঘনঘটায়,
সেগুলোর মধ্যে থেকে কিছু অংশ এখানে বর্ণনা করা হলÑ
রণাঙ্গনে প্রথম লড়াই
১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সীমান্ত লংঘনের অভিযোগ এনে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় জার্মানির পক্ষ
থেকেই। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মান ও ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্য সমাবেশ যেকোনো মুহূর্তে প্রলয়ঙ্করী সংঘাত বাধার কথা
জানান দেয়। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়নি জার্মানরা। তারা একইসাথে বেলজিয়ামেও
সৈন্য প্রেরণ করে। ৪ আগস্ট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও শুরুতেই তারা শান্তি আলোচনার প্রস্তাব
দিয়েছিল। তাদের শান্তি আলোচনার প্রস্তাব আমলে না দিয়ে দুর্নিবার আক্রমণ চালিয়ে মাত্র ৩ দিনের মাথায় লাইজি দখল
করে বেলজিয়ামের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। পুরো বেলজিয়াম দখলে নিতে জার্মানির ১৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এর মাত্র দুদিন পর জার্মান বাহিনীর আক্রমণ লোরেন থেকে ফরাসিদের পিছু হটতে বাধ্য করে। ২২-২৫ আগস্ট পাল্টা
হামলার চেষ্টা করেও নিউচাটাও ও লংওয়ের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত হয় ফরাসিরা।
ব্রিটিশ-জার্মান মুখোমুখি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম লড়াই শুরু হয় ব্্িরটিশ ও জার্মান সৈন্যদের পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
বেলজিয়ামের পশ্চিম রণাঙ্গনে ব্রিটিশ ও জার্মান সৈন্যরা সমবেত হয়। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্সের সৈন্যরা ৭০
হাজারের একটি দল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় ১৪ আগস্ট। এরপর তাদের সাথে গিয়ে যোগদান করে ফরাসি জেনারেল
লানরেজাসের নেতৃত্বাধীন ফিফথ আর্মি। এসময় ফিল্ড মার্শাল ফ্রেঞ্চ জেনারেল স্মিথ ডোরেন ও হেইগের নেতৃত্বে পশ্চিমের
প্রায় ৪০ কিলোমিটার রণাঙ্গনে সমবেত হতে থাকে সৈন্যরা। আর তাদের প্রতিরোধে উপস্থিত হয় জেনারেল ফন ক্লার্কের
নেতৃত্বাধীন চৌকস জার্মান সৈন্যের একটি দল। তিনি শুরুতে ব্রিটিশ সৈন্যদের ধাওয়া করেন। পরে আক্রমণ বন্ধ করে সংখ্যা
পূরণ করার চেষ্টা করেন।
সার্বিয়া অভিমুখে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাহিনী
গ্রিস, সার্বিয়া ও আলবেনিয়ার সংঘাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে অন্যতম। সার্বিয়ার অস্ট্রোহাঙ্গোরির আক্রমণ বলতে গেলে এ সময়ে যুদ্ধের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯১৪ সালের আগস্টে যুদ্ধ শুরু হলে
এর শেষ তথা ১৯১৮ সাল নাগাদ চলতে থাকে এ দু’পক্ষের লড়াই। মার্শাল রাদোমিক পুতনিকের নেতৃত্বাধীন সার্বিয়ার
সৈন্যদের সাথে যুক্ত হয়েছিল মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। এদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গোরির পাশাপাশি বেলজিয়ামের সৈন্যরা সেখানে প্রথম
অভিযান চালায় জেনারেল অস্কার পোটিওরেকের নেতৃত্বে। যুদ্ধে শুরুতে জেনারেল রামোমির পুতনিকের নেতৃত্বাধীন সার্বিয়ার
সৈন্যসংখ্যা মাত্র ২ লাখ ছিল। তখন অস্ট্রিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করে অস্ট্রীয় বাহিনী।
তবে তাঁকে চিনতে না পেরে চরম বোকামির পরিচয় দিয়ে একটি ট্রেনে করে সার্বিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়। তারপর
সার্বিয়ায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরির আক্রমণ হলে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ভয়ানক অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সার্বিয়ার সৈন্যবাহিনীকে পরিচালনা করেন মার্শাল রাদোমির পুতনিক। ২১ আগস্ট দ্রিনা নদী
অতিক্রমের পর শুরু হয় মরণপণ লড়াই। তখন একজন অসুস্থ সেনানায়ক পুতনিক জেনারেল অস্কার পোটিওরেকের চৌকস
বাহিনীকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেন প্রতিরোধ লড়াই কাকে বলে। পুতনিকের যোগ্য নেতৃত্ব এবং অসুস্থ অবস্থায়ও দেশের
প্রতি সীমাহীন আন্তরিকতা সার্বিয়ার বাহিনীকে পথ দেখায়। তারা প্রতিপক্ষের দ্রিনা ও সাভা নদী পার হওয়ার সব ধরনের
চেষ্টা নস্যাৎ করে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়।
পূর্ব রণাঙ্গনের লড়াই
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দিকে বিস্তৃত পূর্ব রণাঙ্গন পশ্চিম থেকে আলাদা ছিল। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান যুদ্ধ এগিয়ে
নেয়ার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনের লড়াইয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে পরিখার লড়াই বললেও বাড়িয়ে বলা হবে
না। তবে পূর্ব রণাঙ্গনের দীর্ঘ বিস্তৃত ও এবড়ো থেবড়ো ভূ-প্রকৃতির কারণে এখানে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা গড়ে ওঠেনি।
পাশাপাশি এখানকার দীর্ঘ বিস্তৃতি হেতু প্রতিরক্ষা রেখা বরাবর সৈন্য মোতায়েনের ঘনত্বও ছিল বেশ কম। এক্ষেত্রে একবার
কোনোক্রমে প্রতিরক্ষাব্যুহে ফাটল দেখা দিলে তা পুষিয়ে নেয়া বেশ কঠিন ছিল। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন
সুগঠিত না হওয়ায় একবার সৈন্যবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন করে সৈন্য এনে ক্ষতিপূরণ করটাও ছিল বেশ কঠিন একটা
কাজ। এখানে প্রতিরোধ লড়াই যতটা সহজ ছিল বাইরে থেকে আক্রমণ করে সুবিধা অর্জন ছিল ঠিক ততটাই কঠিন।
বলতে গেলে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত এখানে জার্মান বাহিনীই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। রুশ সেনাবাহিনী প্রথম পূর্ব রণাঙ্গনের
যুদ্ধ করে। তারা প্রæশিয়ার একটি প্রদেশ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরির গ্যালিসিয়া প্রদেশে হামলা করার চেষ্টা চালালে পূর্ব
রণাঙ্গনের যুদ্ধ বাধে। তবে ১৯১৪ সালের আগস্টে টানেনবার্গের লড়াইয়ে তাদের বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে। একই বছরের
শরৎ আসতে না আসতেই তারা হানা দেয় গ্যালিসিয়ায়। এক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় অভিযানকে অনেকাংশেই সফল বলা
যেতে পারে। তারপর সেপ্টেম্বরে লাম্বার্গ যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্রাকো ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সীমান্ত দুর্গ পারমিজাইলে অবরোধ শুরু
করে।
টানেনবার্গের সংঘাত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একেবারে সূচনাপর্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা টানেনবার্গের যুদ্ধ। জার্মানির টানেনবার্গে অনুষ্ঠিত এ লড়াইয়ে
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রুশরা। রাশিয়ার পক্ষে আলেকজান্ডার সামসোনভ তার ১ লক্ষ ৫০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর
নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে জেনারেল পল ফন হিন্দেনবার্গের ২ লাখ ১০ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য রুশ বাহিনীকে ছত্রখান করে
দেয়। জার্মান পক্ষে ২০ হাজার নিহত হলেও তারা ৩০ হাজার রুশ সৈন্যকে হত্যার পাশাপাশি ৯৫ হাজার সৈন্যকে বন্দি
করে। রুশ সাম্রাজ্য ও জার্মান রাইখের এ লড়াই অনেকাংশে যুদ্ধে জার্মানদের আরো অনুপ্রাণিত করেছিল। এখানে অষ্টম
জার্মান আর্মির সঙ্গে রুশদের ফার্স্ট ও সেকেন্ড আর্মির সংঘাত বাধলে রুশ সেকেন্ড আর্মি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসে। ১৯১৫
সালের বসন্তকাল আসা পর্যন্ত এ লড়াইয়ে রুশরা আর কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে যুদ্ধ শুরুর আগে
থেকেই জার্মানরা রাশিয়াকে তাদের জন্য হুমকি মনে করত। এ লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা রণাঙ্গনে তাদের প্রথম শত্রæকে
চাপে রাখতে চেয়েছিল। আর যুদ্ধের প্রাথমিক ফলাফল হিসাব করা হলে এ এক্ষেত্রে জার্মানিকেই পুরোপুরি সফল বলাটা
কোনোদিক থেকেই দোষের হবে না।
পারমিজাইল দুর্গ অবরোধ :
১৯১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে পারমিজাইল দুর্গ অবরোধ শুরু করে রুশ বাহিনী। এ অবরোধে রুশদের পক্ষে নেতৃত্ব
দেন তৃতীয় আর্মির কমান্ডার জেনারেল রাডকো দিমিত্রভ। অবরোধের শুরুতে পর্যাপ্ত সংখ্যক কামান না থাকায় তিনি একদফা
হোঁচট খান। ১১ অক্টোবর পাল্টা হামলা চালিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাহিনী। এদিকে নতুন করে
শক্তি সঞ্চয় করে ৯ নভেম্বর থেকে দুর্গ অবরোধ শুরু করে রুশরা। তখন দিমিত্রভের বাহিনীর কাছে পর্যান্ত কামান এসে না
পৌঁছলেও তিনি বাহিনীকে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এদিকে পারমিজাইল দুর্গে রুশ অবরোধ দেখে
জার্মানরাও থেমে থাকেনি। এসময় জেনারেল ফন ফন হিন্দেনবার্গ উত্তর দিকে ওয়ারশতে হামলা চালান। আর এর সাথে
মিল রেখে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির জেনারেল বারোয়িভিক ফন বোজনা দুর্গকে সহায়তা করতে পারমিজাইলের দিকে অগ্রসর হন।
মূলত তিনি এগিয়ে আসাতেই দিমিত্রভ অবরোধ প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সমর নেতা জেনারেল কাউন্ট
ফন কনরাড ভেবেছিলেন ফন বোজনার আক্রমণেই কুপোকাত হয়ে যাবে রুশ বাহিনী। তবে ৩১ অক্টোবরে ভিশ্চুলা নদীতীরের
লড়াইয়ে রুশ বাহিনী হিন্দেনবার্গের চৌকস সেনাদলকে একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ে। এতে ফন কডরাডের সব চিন্তা
ধূলিসাত হয়ে যায়। তবে দুই পক্ষ থেকে তেমন কোনো ছাড় দেয়ার মানসিকতা লক্ষ করা যায়নি। তাই ১৯১৫ সালের ২২
মার্চ দুর্গ পতন পর্যন্ত প্রায় ১৯৪ দিনের লড়াই চলে দু’পক্ষে।
ব্রাসিলভের লড়াই
১৯১৬ সালের গ্রীষ্মকাল মিত্রবাহিনীর জন্য এক নাজুক সময়। তখন পশ্চিম রণাঙ্গনে ব্রিটিশ হামলার ধার অনেকটাই কমে
যায়। বিশেষ করে জার্মান বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে ছত্রখান হওয়ার দশা হয় তাদের। এসময় উপায় না দেখে রুশদের কাছে
সাহায্য প্রার্থনা করে মিত্রবাহিনী। বিশেষ করে ভার্দুনে অবস্থানরত ফরাসি বাহিনী জার্মান আক্রমণে প্রায় দিশেহারা অবস্থায়
পড়ে। তারা মনে করে এসময় রুশরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলে অন্তত এ যাত্রা রক্ষা পাবে তারা। এ ধরনের নানা অবস্থা
পর্যবেক্ষণ করে রুশ জেনারেল অ্যালেক্সি ব্রাসিলভের নেতৃত্বে পূর্ব রণাঙ্গনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে শুরু হয় রুশ অভিযান।
ব্রাসিলভের নামানুসারে এ অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘ব্রাসিলভ অফেনসিভ’। রুশ জেনারেল স্টাফ স্টাভকার সামনে ব্রাসিলভ
একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। সেখানে তার অভিযানের লক্ষ ছিল ফ্রান্সে ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনীর পাশাপাশি আইসনজো
ফ্রন্টে ইতালীয় বাহিনীর ওপর থেকে চাপ কমিয়ে আনা। অন্যদিকে যেভাবেই হোক অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে
দেয়া। এক্ষেত্রে জার্মানরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পূর্ব রণাঙ্গনেও সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। এ হামলায় রুশদের পক্ষে প্রচুর
হতাহত হলেও ফলাফল মিত্রবাহিনীর পক্ষে নিয়ে আসে। বিশেষ করে এ হামলার মধ্য দিয়েই টনক নড়ে জার্মানদের, তারা
পশ্চিম রণাঙ্গনে সব সৈন্যের সমাবেশ না করে তাদের অনেকগুলো ইউনিটকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করে পূর্ব রণাঙ্গনেও।
এতে আর যাই হোক তাদের হামলার ধার কমে যায় অনেকাংশে।
ভয়াবহ পশ্চিম রণাঙ্গন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ লড়াইগুলো হয়েছিল পশ্চিমের রণাঙ্গনেই। এক্ষেত্রে উত্তর সাগর থেকে শুরু করে ফ্রান্সের
সীমান্তঘেঁষে সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এ রণাঙ্গন। প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী কিংবা মিত্রবাহিনী কারো
দিক থেকেই কোনো ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করা যায়নি। দুপক্ষেই প্রচুর হতাহত হলেও শেষ পর্যন্ত নতুন সৈন্য এনে
ক্ষতিপূরণের চেষ্টা লক্ষ করা গেছে তাদের মধ্যে। ব্রিটেনের নেতৃত্বে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এখানে মার্শাল ফার্দিনান্দ
ফচের নেতৃত্বে মোকাবেলা করে জার্মানদের। এদিকে কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই ফ্রন্টের
লড়াইয়ে। শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে ৪৮ লাখ হতাহতের কথা বলা হলেও জার্মান বাহিনী তাদের ক্ষয়ক্ষতি ও
প্রাণহানির উপযুক্ত সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত
বেলজিয়ামের বেশিরভাগ এলাকা, লুক্সেমবার্গ ও ফ্রান্সের শিল্পাঞ্চলগুলো ছিল জার্মানির দখলেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গের পর ফ্রান্সে নিজেদের অগ্রযাত্রাকে
ধারাবাহিক করে জার্মান বাহিনী। তবে ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল নাগাদ এ ফ্রন্টে পরপর কয়েকটি প্রাণঘাতী লড়াই হয়।
দলবদ্ধ পদাতিক বাহিনীর হামলার পাশাপাশি ব্যাপক কামানের গোলাবর্ষণ করা হয় দুই বাহিনীর পক্ষ থেকেই। কাঁটাতারের
শক্ত বেষ্টনীর পাশাপাশি পরিখা খনন করে আগে থেকেই উপযুক্ত অবস্থান নিয়ে বসে থাকে জার্মান বাহিনী। পাশাপাশি
পথগুলো আরো নিরাপদ করতে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাইন পুঁতে রাখে জার্মানরা। তাই অনবরত মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে
থাকলেও শেষ পর্যন্ত জার্মানদের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি মিত্রবাহিনী। পশ্চিম রণাঙ্গনের এ অচলাবস্থা কাটাতে
মরিয়ে হয়ে ওঠে মিত্রবাহিনী। তারা শেষ পর্যন্ত এখানে বিষাক্ত গ্যাসবোমা হামলা করে। পাশাপাশি জঙ্গবিমান থেকে চলতে
থাকে লাগাতার বোমাবর্ষণ।
আটলান্টিকের ত্রাস জার্মান ইউবোট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে ইউরোপের প্রতিটি দেশ সমীহ করে চলতে। কিন্তু প্রথম
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। ১৯১৪ সালের দিকে উদ্ভাবিত জার্মান ইউবোট এক্ষেত্রে হঠাৎ করেই
আটলান্টিকের অতলে ত্রাস সৃষ্টি করে। জার্মান শব্দ ‘আন্ডারসিবোটভাভি’ থেকেই এ ইউবোটের নামকরণ যা পানির তলদেশ
দিয়ে আক্রমণ চালাতে অনেক কার্যকর একটি
জার্মান ইউবোট
সাবমেরিন। ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ঠিক দুদিন পর তৎপরতা শুরু করে এ ইউবোট। ১৯১৪ সালের ৬
আগস্ট হোলিগোল্যান্ডে অবস্থিত নৌঘাঁটি থেকে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ওপর আক্রমণ শানাতে যাত্রা করে ১০টি জার্মান ইউ
বোট। ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাবমেরিন টহল শুরু হলে মাইনের আঘাতে কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ১৯১৪ সালের
৫ সেপ্টেম্বর থেকে সফলতার মুখ দেখে ইউবোটগুলো। লেফটেন্যান্ট অটো হার্সিং ইউ-২১ থেকে টর্পেডো নিক্ষেপ করে
ব্রিটিশ ক্রুজার পাথফাইন্ডারকে ডুবিয়ে দেয়। এতে ২৫৯ জন ক্রুর কেউই প্রাণরক্ষা করতে পারেনি। এদিকে ২২ সেপ্টেম্বর
লেফটেন্যান্ট অটো ওয়েডিগেন ইউ-৯ তিনটি ব্রিটিশ ক্রুজারে প্রাণঘাতী হামলা চালান। এতে তিনটি ব্রিটিশ ক্রুজার
আবুকির, ক্রেসি ও হগ পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। মাত্র আধঘণ্টার এ লড়াইয়ে প্রায় ১ হাজার ৪৬০ জন ব্রিটিশ নাবিক
প্রাণ হারায়। এরপর আরো কয়েকটি হামলা চালিয়ে এককথায় আটলান্টিকের ত্রাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জার্মান
ইউবোট।
অন্তরীক্ষেও দুর্নিবার যুদ্ধ
প্রথম দিকে পদাতিক বাহিনী যুদ্ধ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিমান বাহিনী এর শৈশব অতিক্রম করছে মাত্র। প্রথম দিকে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যাম্বিস ও কাঠের
তৈরি বিমানগুলোকে ব্যবহার করা হয়। খুবই ধীরগতির কিছু জেপেলিন ও বেলুন এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।
প্রথম দিকে শুধুমাত্র শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে সংবাদ বিনিময় শুরু হলেও পরের দিকে ইট থেকে শুরু করে গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু
হয় বিমান থেকে। প্রথম দিকে দুর্বল শক্তির মরিস ফারম্যান, শর্টহর্ন, লংহর্ন, ডিএফডবিøউবি-১, র্যামপ্লার টাউব, বিই-২-এ,
এইজি সেকেন্ড, বেøরিয়ট ইলেভেন প্রভৃতি বিমান ব্যবহার করা হয়। ধীরে যুদ্ধ এগিয়ে যাওয়া অবস্থায় বিমানের গঠন
কাঠামোতে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়। বিশেষ করে ১৯১৫ সালে জার্মানির উদ্ভাবিত ফকার বিমান মিত্রবাহিনীর ব্যাপক
ক্ষতিসাধন করে। প্রায় ১১০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম এই বিমান বলতে গেলে
মিত্রবাহিনীর জন্য মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। ১৯১৭ সালের দিকে বিমান হামলা ভয়াবহরূপ লাভ করলে ব্রিটিশ
বাহিনী তাদের ২৪৫টি বিমান হারায়। এক্ষেত্রে জার্মান বাহিনীর ক্ষতি হয় ৬৬টির মত বিমান। সবমিলিয়ে আকাশপথেও
চলতে থাকে ভয়াবহ যুদ্ধ।
ট্যাংকের লড়াই
পশ্চিম রণাঙ্গনের ব্যর্থতা ব্রিটিশদের উন্নততর প্রযুক্তির সামরিক যান ও কৌশলগত অবস্থান গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।
উপনিবেশ স্থাপন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পেছনের দরজা যে ব্রিটিশদের প্রথম পছন্দ এবারেও তারা তেমন
কোনো পদ্ধতি খুঁজতে চেষ্টা করে। তারা একইসাথে কাঁটাতারের বেড়া ধ্বংসের পাশাপাশি মেশিনগানের গুলি থেকে বেঁচে
পরিখা অতিক্রমে সক্ষম যানবাহন তৈরি করে। এক্ষেত্রে কর্নেল আর্নেস্ট সুইনটনের নির্দেশনায় কাজে নেমে পড়ে ল্যান্ডশিপস
কমিটি। তাদের দীর্ঘদিনের চেষ্টায় নির্মিত হয় লিটল উইলি নামক ট্যাংক। এক্ষেত্রে ব্রিটিশরা দুই মেইল ও ফিমেইল নামে দুই
ধরনের ট্যাংক উদ্ভাবন করে। তারা দুইটি সিক্স পাউন্ডার গানের পাশাপাশি ৪টি মেশিনগান সজ্জিত ট্যাংকের নাম দেয় মেইল।
অন্যদিকে সিক্স পাউন্ডারের পাশাপাশি ভাইকার্স মেশিনগান যুক্ত ট্যাংকে ফিমেইল নাম দেয়। বলতে গেলে পশ্চিম রণাঙ্গনের
ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনীর হাজার হাজার ট্যাংক এক্ষেত্রে অনেক কার্যকর হয়ে ওঠে। বলতে গেলে শুরুতে এ ট্যাংকের
লড়াইতেই তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি শক্তিমান জার্মান বাহিনী। তবে পরিখা সুবিধা কাজে লাগিয়ে গতি শ্লথ করে
দেয়ার পাশাপাশি জার্মানরাও বসে থাকেনি। তারা আবিষ্কার করে বসে ট্যাংক বিধ্বংসী নানা অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত জার্মানরা তৈরি
করে প্যাক ৪০-৭৫এমএম গান। বিশাল ক্যালিবারের এ গোলা যেকোনো ট্যাংকর ধ্বংস করে দিত।
অনৈতিক রাসায়নিক অস্ত্র
পশ্চিম রণাঙ্গনের দখল নিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর অনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। পরিখা তৈরি করে বছরের পর বছর
নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে জার্মান বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তাদের পিছু হটাতে জঘন্য রকমের গন্ধযুক্ত ক্লোরিন গ্যাসবোমা
নিক্ষেপ করা হয়েছে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে চোখ জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি সৈন্যদের আরো নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
উপযুক্ত জবাব দিতে জার্মানিও চালায় মাস্টার্ড গ্যাসবোমা হামলা। চামড়ায় যন্ত্রণাদায়ক দহন ও কাপড়চোপড় ভেদ করে
ভেতরে গিয়ে যন্ত্রণার কারণ হয়ে দেখা এই গ্যাস। সবমিলিয়ে এই গ্যাসবোমার হামলা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও মানবতা
বিবর্জিত হলেও তা শাপে বর হয়ে দেখা দেয় মিত্রবাহিনীর জন্য। বিশেষ করে বেশিরভাগ গ্যাস ছিল বাতাসের চেয়ে ভারী।
এগুলো গিয়ে বিভিন্ন জার্মান বাংকারে জমা হয়। সেখানে শুধুমাত্র যন্ত্রণাদায়ক গ্যাসের জন্য অনেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়
জার্মান বাহিনী। অন্যদিকে কিছু বিষাক্ত গ্যাস পানিতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেক প্রাণি মারা যাওয়ার পাশাপাশি
পানযোগ্য পানির অভাবেও ধুঁকতে থাকে শক্তিশালী জার্মান বাহিনী। অন্যদিকে গ্যাসবোমায় আক্রান্ত হয়ে মিত্রবাহিনীরও
ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। অসেক ক্ষেত্রে গ্যাসবোমার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা নির্ভর করত বায়ুপ্রবাহের ওপর। বিশেষ করে
বাতাসের উল্টোদিকে গ্যাসবোমা নিক্ষিপ্ত হলে তার থেকে নিজেদের রক্ষা করা অনেক কঠিন হয়ে যেত। পক্ষান্তরে দূর
থেকে কুÐলি পাকানো গ্যাসের মেঘ থেকে শত্রæ পক্ষ সাবধান হয়ে যায়। তবে পরবর্তীকালে ফরাসিরা কামানের গোলায়
ভরে ফসজেন গ্যাস নিক্ষেপ করা শুরু করে। এতে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
ইপ্রেঁর যুদ্ধ
অন্যতম আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্র ইপ্রেঁতে পরপর তিনটি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোকে ইপ্রেঁর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুদ্ধ
হিসেবে ইতিহাসে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। মহাযুদ্ধের প্রথম বছরের দীর্ঘতম এবং ভয়াবহ লড়াই হিসেবে ইপ্রেঁর প্রথম
যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে যা ব্যাটল অব ফ্লান্ডার্স নামেও পরিচিত। এক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর বিজয় হলেও দু’পক্ষে অনেক
ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯১৪ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেন জন
ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ফচ। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স মিলিয়ে মিত্রবাহিনীর লক্ষাধিক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে এরিক ফন
ফাকেনহায়েনের নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীর বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের চতুর্থ ও ষষ্ঠ আর্মি থেকে সবমিলিয়ে ১ লাখ ৩০
হাজার সৈন্যের প্রাণহানি হয়। এদিকে ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিল আবার লড়াই বাধে বেলজিয়ামের ইপ্রেঁ যুদ্ধক্ষেত্রে যা ২৫
মে পর্যন্ত স্থায়ী হয়। হোরেস স্মিথ ডোরেনের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর ৮টি পদাতিক ডিভিশন এতে অংশ নেয় যাদের ৭০
হাজার হতাহত কিংবা নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে জার্মানির পক্ষে ৭টি পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অলব্রেচট অব
ওয়ার্টেম্বার্গ যার থেকে ৩৫ হাজার সৈন্য হতাহত কিংবা নিখোঁজ হলেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থাকে অমীমাংসিত। এদিকে ১৯১৭
সালের ৩১ জুলাই বেলজিয়ামের পশ্চিম ফ্লান্ডার্সে নতুন করে শুরু হয় ইপ্রেঁর তৃতীয় লড়াই। এতে বিশালাকার মিত্রবাহিনীর
নেতৃত্বে ছিলেন চারজন কুশলী সেনানায়ক জেনারেল ডগলাস হেইস, জেনারেল হুবার্ট গাফ, জেনারেল হার্বার্ট প্লামার ও
জেনারেল আর্থার কুরি। অন্যদিকে জেনারেল ম্যাক্স ফন গ্যালউইজ ও জেনারেল এরিক লুডেনডর্ফের নেতৃত্বে অংশ নেয়
শক্তিশালী জার্মান বাহিনী। শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর ৪ লাখ ৪৮ হাজার এবং জার্মানদের ২ লাখ ৬০ হাজার হতাহত হলেও
যুদ্ধের ফলাফল ছিল অমীমাংসিত।
মারনির সংঘাত
ভয়াবহ পশ্চিম রণাঙ্গনের একক বৃহত্তম যুদ্ধ হিসেবে মারনির সংঘাতের কথা বলা যেতে পারে। এই লড়াইয়ে মিত্রবাহিনীর
জয়ের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে অনেক দিক থেকে যুদ্ধে স্থবিরতা লক্ষ করা গেছে। এতে দ্রæত জয়লাভের আশা বাদ দিয়ে
জার্মান বাহিনী দুই রণাঙ্গনে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। রুশ জেনারেল সিলাইফেনের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে
শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে জার্মান বাহিনী তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর
দায়িত্বে ছিলেন দুজন কুশলী সেনানায়ক ফিল্ড মার্শাল স্যার জন ফ্রেঞ্চ ও জেনারেল জোসেফ জোফরে। তাঁদের নেতৃত্বে
প্যারিসের মারনি নদীর তীরে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার সৈন্য সমাবেশ করে মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনীকে উপযুক্ত জবাব
দিতে তিনজন জার্মান সমরনায়ক জেনারেল হেলমুট ফন মোল্টকি, জেনারেল কার্ল ফন বুলো, জেনারেল আক্সান্ডার ফন
ক্লাকের প্রায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার সৈন্য এতে জড়ো করে জার্মান বাহিনী। এতে মিত্রবাহিনীর ৩ লাখ ৬৩ হাজার সৈন্যের
পাশাপাশি জার্মান পক্ষে হতাহত হয় প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য।
গ্যালিপলির যুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত শুরু হয় তুরস্কের গ্যালিপলি উপত্যকায়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স,
ব্রিটিশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের মিলিত বাহিনীর প্রায় ১৪টি ডিভিশন সৈন্য এসে জড়ো হয়
স্যার আয়ান হ্যামিল্টনের নেতৃত্বে। এদিকে তাদের প্রতিরোধ করতে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে জমায়েত করা হয়
ঠিক ১৪ ডিভিশন সৈন্য যার নেতৃত্বের পুরোভাগে লক্ষ করা যায় মোস্তফা কামাল ও অটো লিমান ফন স্যান্ডার্সের মত দক্ষ
সেনানায়ককে। ১৯১৫ সালের ১৯ ফ্রেব্রæয়ারি শুরু হয়ে ১৯১৬ সালের ৯ জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার এ দীর্ঘ সংঘাতে
মিত্রবাহিনীর ২ লাখ ৫২ হাজার সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে অটোমান তুর্কিরা জয়ী হলেও জীবন দিতে হয় ২ লাখ ৫৩
হাজার সৈন্যকে। বিশেষ করে ২৭ এপ্রিল তুর্কি সেনানায়ক কামাল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মিলিত বাহিনী তথা
আনজাক সৈন্যদের উপকূলের দিকে তাড়িয়ে দিতে সমন্বিত হামলা চালান।
কিংবদন্তী তুর্কি সেনানায়ক মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে রাতভর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে তুর্কিরা। অন্যদিকে ১৯ মে
তে ৪২ হাজার তুর্কি সৈন্য আনজাকের ১০ হাজার অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডের বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। টর্পেডো
হামলা চালিয়ে পর পর বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে তুর্কিরা যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য দেখায়। তবে ক্রিমিয়ার
দখল বুঝে নিতে মিত্রবাহিনী একের পর এক হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষের অনেক সৈন্য হতাহত
হলেও যুদ্ধের ফলাফল অপরিবর্তিত থাকে। এদিকে উপর্যুপরি ব্যর্থতার দায়ভার গিয়ে বর্তায় জেনারেল হ্যামিল্টনের ওপর।
তাকে পরিকল্পনার ত্রæটির জন্য দোষারোপ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে জেনারেল হ্যামিল্টনকে
বরখাস্ত করে ব্রিটিশরা সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
দার্দানেলিসের লড়াই
গ্যালিপলির পর তুরস্কের দার্দানেলিস প্রণালির দখল নিয়ে শুরু হয় এক মরণপণ লড়াই। ১৯১৫ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি
থেকে ১৯১৬ সালেল ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এ ভয়াবহ সংঘাত অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত তুর্কি বাহিনী জয়লাভ করলেও শেষ
পর্যন্ত দু’পক্ষেই হতাহত হয় অসংখ্য। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্যাকভাইল কার্ডেন ও জন ডি
রোবেক। প্রায় ৩১টি যুদ্ধজাহাজ, ৩টি ব্যাটল ক্রুজার, ২৪টি ক্রুজার, ২৫টি ডেসট্রয়ার, ৪টি মনিটর ও ২৫টি সাবমেরিন
নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে মিত্রবাহিনী। তবে প্রবল ক্ষমতাধর মিত্রবাহিনী তুর্কিদের কৌশলের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে। বিশেষ
করে সাবমেরিন হামলায় তুর্কিদের একের পর এক সাফল্য মিত্রবাহিনীকে কোণঠাসা করে দেয়।
ভার্দুনের সংঘাত
১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানরা দ্রæত জয়লাভের চেষ্টা করে নানা দিক থেকে ব্যর্থ হতে থাকে। তবে তাদের তীব্র
প্রতিরোধের মুখে মিত্রবাহিনীও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধের মূল যুদ্ধ যখন পরিখার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে ঠিক
তখনি ফ্রান্সের ভার্দুনে সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। ১৯১৬ সালের ২১ ফ্রেব্রæয়ারি থেকে ১৯
ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ মাস ধরে চলা এ সংঘাতে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় ফরাসি বাহিনী। মার্শাল ফিলিপ পেঁতা ও জেনারেল
রবার্ট নিভেলির নেতৃত্বে জার্মানদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ফরাসি সৈন্যরা। জেনারেল এরিক ফন ফাকেন হায়েন প্রায় দেড়
লাখ জার্মান সৈন্য নিয়ে তাদের বাধা দিতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত লক্ষাধিক জার্মান সেনার প্রাণহানি ঘটে এ
সংঘাতে। পাশাপাশি আহত ও নিখোঁজ হয় আরো অনেকে।
নিভেলি অফেন্সিভ
ফরাসি সেনানায়ক জোসেফ জোফরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ফরাসি জেনারেল রবার্ট নেভেলি ঘোষণা করেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়
জার্মানদের বিধ্বস্ত করা হবে। তাঁর নামানুসারে এ লড়াইকে নিভেলি অফেন্সিভ বলা হয়। ফ্রান্সের পক্ষে তিনিসহ নেতৃত্বে
ছিলেন জেনারেল চার্লস মানগিন, জেনারেল ফ্রাঁসোয়া অ্যান্থনি ও জেনারেল মাজেন। ১২ লাখ ৭ হাজার সৈন্যের বিশাল
বাহিনী নিয়ে হামলা চালিয়ে সেখান থেকে ১ লাখ ৮৭ হাজার সৈন্য হারায় ফ্রান্স। অন্যদিকে জার্মান পক্ষে জেনারেল ফন
বোহেন ও জেনারেল ফ্রিটজ ফন বুলোর নেতৃত্বাধীন ১০ লক্ষ সৈন্যের বাহিনী থেকে নিহত হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার। আইসনি
নদী উপত্যকায় চলা এ সংঘাতে জেনারেল নিভেলি শেষ পর্যন্ত তার কথা রাখতে পারেননি। ফলে এ যুদ্ধে জার্মানদের
কৌশলগত বিজয়ের কথা ধরে নেয়া যেতেই পারে। ফরাসি যুদ্ধমন্ত্রী হুবার্ট লাইটি, চিফ অব স্টাফ জেনারেল হেনরি ফিলিপ
পেঁতা এবং ব্রিটিশ কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ডগলাস হেইগ নিভেলির এ পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শুরু
থেকেই। তাদের আপত্তি সত্তে¡ও ফরাসি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিস্টাইড ব্রায়ান্ড এ পরিকল্পনা অনুমোদন করলে ক্ষোভে পদত্যাগ
করেন যুদ্ধমন্ত্রী হুবার্ট লাইটি।
ব্যাটল অব সোম
ফ্রান্সের পিকার্ডির সোম অঞ্চলে ১৯১৬ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয় এক প্রাণঘাতী সংঘাত যা ১৯১৭ সালের ১৮ জুলাই
পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত থাকলেও দু’পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয়। ম্যাক্স ফন
গ্যালউইজ ও ফ্রিটজ ফন বুলোর নেতৃত্বাধীন জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। এক্ষেত্রে
মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স ও নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সৈন্যরা জড়ো
হয় ডগলাস হেউগ ও ফার্দিন্যান্দ ফচের নেতৃত্বে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫০ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে লড়তে থাকা জার্মানদের পক্ষে এ
যুদ্ধে মারা যায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার সৈন্য। অন্যদিকে ৫১ ডিভিশন মিত্রবাহিনীর সৈন্য থেকে হতাহত হয় সাড়ে ছয় লাখের
মত। মিত্রবাহিনীর অনেকগুলো বিমান ও শক্তিশালী ট্যাংকও ধ্বংস হয় এ যুদ্ধে।
ভিমি রিজের লড়াই
ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ভিমি ছিল পশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যতম সুরক্ষিত স্থান। এটাকে অনেকটা দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে মনে
করা হত। ১৯১৭ সালের ৯ থেকে ১২ এপ্রিল এ তিন দিন এখানে চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ। জার্মান বাহিনীর পক্ষ থেকেও
এখানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেখা যায়। তারা সুড়ঙ্গ, কাঁটাতারের বেড়া, তিন স্তরের পরিখা, প্রচুর
কামানের প্রহরার পাশাপাশি অগণিত মেশিনগান পয়েন্ট স্থাপন করে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করেছিল। এর আগে
পাহাড়টির দখল নিতে গিয়ে ব্রিটিশরা হাজার হাজার সৈন্য খুইয়েছিল। ১৯১৫ সালের লড়াইয়ে সেখানে ফরাসি সৈন্যরাই
মারা যায় দেড় লাখের মত। এবার কানাডা ও যুক্তরাজ্যের বাহিনী সম্মিলিতভাবে জেনারেল জুলিয়ান বায়ানগ ও জেনারেল
আর্থার কুরির নেতৃত্বে আক্রমণ চলায়। তাদের ৩০ হাজার সৈন্য থেকে ৩৫৮৯ জন নিহত হলেও যুদ্ধের ফলাফল তাদের
পক্ষেই যায়। জার্মানি প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
এক্ষেত্রে কানাডার ৯টি প্রদেশের প্রত্যেকটি স্থান থেকে সৈন্যরা দিয়ে ভিমি রিজের দখলযুদ্ধে অংশ নেয়।
জুটল্যান্ড রণাঙ্গন
উত্তর সাগরের জুটল্যান্ড রণাঙ্গনে জার্মান বাহিনীর মুখোমুখি হয় ব্রিটিশ-আইরিশ যৌথ বাহিনীর একটি দল। ১৯১৬ সালের
৩১ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত চলতে থাকা এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কৌশলগত বিজয় লক্ষ করা যায় জার্মান বাহিনীর। স্যার জন
জোলিকোয়ি ও স্যার ডেভিড বিটির নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী নিয়ে সমবেত হয় ইঙ্গো-আইরিশ সেনারা। তাদের সাথে ২৮টি
যুদ্ধজাহাজ, ৮ টি ব্যাটল ক্রুজার, ৮টি সাঁজোয়া ক্রুজার, ২৬টি হালকা ক্রুজার ও ৭৮টি ডেস্ট্রয়ার ছিল। এদিকে ১৬টি
যুদ্ধজাহাজ, ৫টি ব্যাটল ক্রুজার ড্রিডনট, ১১টি হালকা ক্রুজার ও ৬১টির মত টর্পোডো বোট নিয়ে রেইনহার্ড শীয়ার ও ফ্রাঞ্চ
ফন হিপারের নেতৃত্বে প্রতিরোধ য্দ্ধু শুরু করে জার্মানরা। তবে এবারের যুদ্ধে জার্মান ইউবোটকে অকার্যকর রাখাটাই ছিল
ব্রিটিশ বাহিনীর বড় কৃতিত্ব।
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র