দুই ফিল্ড মার্শালের দ্বৈরথ নাকি ব্রিটিশ-জার্মান সংঘাত কি বলে বিবরণ দিলে সবচেয়ে উপযুক্ত উপমার ব্যবহার নিশ্চিত করা
যাবে তা বলা কঠিন। মিসরের এখনকার রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় দেড়শ মাইল পশ্চিমে আল আমিন রণাঙ্গনে প্রথমে
ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ফিল্ড মার্শাল অচিনলেক। দুর্ধর্ষ জার্মান সেনানায়ক মরু শেয়ালখ্যাত ফিল্ড মার্শাল রোমেলের
সামনে একের পর এক নাকানিচুবানি খেতে থাকা অচিনলেককে সরিয়ে নেয় ব্রিটিশরা। এরপর কুশলী সমরনায়ক
মন্টেগোমারি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এবার দুর্দিন দেখতে শুরু করে জার্মানরাও। ১৯৪৩ সালের মে
মাসে আল আমিন রণাঙ্গনের লড়াইয়ে মিত্রবাহিনীর বিজয় ঘটলে জার্মানরা তাদের আফ্রিকা কোর সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৪২ সালের দিকে অনেকগুলো রণাঙ্গনে জার্মানির সাফল্য মিত্র বাহিনীকে হতাশ করে। বিশেষ করে ব্রিটেনের সবচেয়ে
বড় শক্তি নৌবাহিনী বলতে গেলে জার্মান ইউবোটের আক্রমণে নাকাল হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মরুভূমিতে চলতে থাকা
ব্যাটল অব আল আমিন তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে ফিল্ড মার্শাল রোমেল যেভাবে আফ্রিকা কোরকে
সাজিয়ে নিয়ে যুদ্ধ জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাহলে পুরো সুয়েজ খাল জার্মানদের দখলে চলে যেত। অন্যদিকে এ
লড়াইয়ে জিততে পারলে জার্মানরা নজর দিত তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে যা আস্তে আস্তে পুরো বিশ্বের মানচিত্রই বদলে দিতে
পারতো। আর এসব কারণেই ব্যাটল অব আল আমিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এতটা গুরুত্ব পেয়েছে।
ফ্রান্স দখলের ৪৪ দিন
জার্মানির জাতশত্রæ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্থানীয় পরিসরে তাদের ক্ষোভটা ফ্রান্সের উপরেই বেশি ছিল। অ্যাডলফ হিটলার
ক্ষমতায় বসার সাথে সাথে ভার্সাই চুক্তির ন্যক্কারজনক শর্তগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যেকোনো মূল্যে
ফ্রান্সকে শায়েস্তা করা হবে। এদিকে ফরাসিরা তখনকার দিনে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলে
ম্যাজিনো লাইন। তারা মনে করত আর যাই হোক বিশ্বের কোনো সেনা বাহিনীর পক্ষে এই ম্যাজিনো লাইন অতিক্রম করা
সম্ভব হবে না। এদিকে সে অসম্ভবকে সম্ভব করে বসে জার্মানির দুর্জয় পাঞ্জার ডিভিশন। তারা সুকৌশলে এই ম্যাজিনো
লাইন অতিক্রম করে সরাসরি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে উপস্থিত হলে মাত্র চুয়াল্লিশ দিনের মাথায় পতন ঘটে
ফ্রান্সের। নরওয়ে অভিযানের ব্যর্থতায় নেভিল চেম্বারলিনকে তুলোধুনো করে ছাড়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আর সে সুযোগটাই
নিয়েছিলো হিটলারের বাহিনী। জার্মানরা যে বিদ্যুৎগতির বিøৎসক্লিগ অপারেশন চালিয়ে একের পর এক পোল্যান্ড, নরওয়ে
ও ডেনমার্ক দখল করেছিল ফ্রান্সের ক্ষেত্রে সে অভিযানে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছিল শক্তিশালী ম্যাজিনো লাইন।
এক্ষেত্রে জার্মান পাঞ্জার ডিভিশনগুলো ম্যাজিনো লাইন এড়িয়ে বেলজিয়ামের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করে প্যারিস
দখলের চেষ্টা করে সফলতার মুখ দেখে। এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলো বিখ্যাত ‘ম্যানস্টেইন পরিকল্পনা’।
ফ্রান্সের ত্রাণকর্তা শার্লে দ্য গল
ম্যাজিনো লাইন অতিক্রম করে জার্মান পাঞ্জার ডিভিশনের অবিশ্বাস্য সফলতা দুর্ভাগ্যের দিন ডেকে আনে ফরাসিদের। এ
সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হন শার্লে দ্য গল। তিনি ১৯৪১ সালের দিকে সুয়েজ খাল অঞ্চলে প্রথম জার্মান বাহিনীর
বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। এরপর যখন যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তখন
পুরো জাতির হাল ধরেন তিনিই। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অপেক্ষাকৃত বৈজ্ঞানিক চিন্তার অধিকারী জার্মান বাহিনীর সামনে
যত শক্তিশালীই হোক না কেন সব ধরনের পদাতিক বাহিনী ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। তিনি যখন ফরাসিদের উদ্ধার অভিযানে
নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অনেকগুলো ফরাসি উপনিবেশ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দ্য গলের
চরম বৈরি হলেও ১৯৪২ সালের ২২ জুলাই তিনি সাক্ষাৎ করেন জেনারেল আইসেনহাওয়ারের সাথে। এমনি পরিস্থিতিতে
১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ পতনের দিনে গল ফ্রান্সবাসীকে মাঠে না নামার অনুপ্রেরণা যোগাতে মার্কিন সহায়তা
প্রার্থনা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হন। এর ফলে ফ্রান্স একেবারে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন ভাবে স্বপ্ন
দেখতে শুরু করে জার্মানির পরাজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন ফ্রান্স গড়ে তোলার জন্য।
ম্যাজিনো লাইনের লড়াই
ফ্রান্স বুঝতে পেরেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সম্পাদিত জার্মানির জন্য অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি কোনো যুদ্ধবিরতি নয়,
বরং আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ শুরুর অপেক্ষামাত্র। তারা প্রথম মহাযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু চোখের সামনে প্রত্যক্ষ
করেছিল। ১৯১৯ সালে সম্পাদিত ভার্সাই চুক্তি তাই জার্মানিকে সামরিক-রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিলেও ফরাসিদের
স্বস্তি আনতে পারেনি। পল রেনোঁ এবং শার্লে দ্য গলের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে তখন তৈরি করা দুর্ভেদ্য ম্যাজিনো লাইন।
মার্শাল জোফরের পরামর্শে নির্মিত এই লাইন বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন হিসেবে খ্যাত। এক্ষেত্রে
ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আঁদ্রে ম্যাজিনো সরকারকে এ প্রকল্পে রাজি করিয়ে নিজ নামে লাইনটি নির্মাণ করেছিলেন। ম্যাজিনো
লাইনে যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি পদে পদে বাধা সম্মুখীন হয়। কিন্তু তাদের দুর্ধর্ষ পাঞ্জার ডিভিশন এক্ষেত্রে তাদের লড়াইয়ের
দক্ষতা প্রমাণ করে। তারা ম্যাজিনো লাইন তছনছ করে উপস্থিত হয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। এর মাধ্যমে পুরো বিশ্ব
জেনে যায় ময়দানের লড়াইয়ে কতটা শক্তিশালী এবং অপ্রতিদ্ব›দ্বী অবস্থানে গিয়ে উপনীত হয়েছে জার্মানি।
ব্যাটল অব ব্রিটেন
প্রচÐ রকমের জাতীয়তাবাদী নেতা হিটলার শুরু থেকেই অপমানজনক ভার্সাই চুক্তির সবগুলো নীতিকে ভেঙে ফেলার জন্য
উঠেপড়ে লেগে যান। ভার্সাই চুক্তি জার্মানির বিমান বাহিনী ধ্বংস করে তাদের ট্যাংক মোতায়েনের ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে
নিয়েছিল। জার্মানি গোপনে তাদের বাহিনী শক্তিশালী করে তোলে। তারা কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আগে স্পেনের
গৃহযুদ্ধে তাদের বিমান বাহিনীকে প্রথম কাজে লাগায়। তারা এর থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা পরে ব্যবহার করে। ১৯৩৯ সালে
জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডে তাদের বিদ্যুৎগতির বিøৎসক্লিগ চালানোর থেকে ব্রিটেনের সাথে যাদের যুদ্ধ আসন্ন মনে করা হয়।
ব্রিটিশ সরকার জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে মানুষজন তাদের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে আঁচ করতে পারে।
বহু নারী-পুরুষ শিশু লন্ডন শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে যায়। অনেক মানুষ জীবন রক্ষার্থে তাদের বাগানে বাংকার তৈরি
করে। এ অবস্থায় ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঝাঁকে ঝাঁকে জার্মান বিমান এসে হাজির হয়। এগুলো বিভিন্ন বিমান বাহিনীর
ঘাঁটি থেকে শুরু করে শিল্পাঞ্চলে হামলা করতে থাকে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ দিন রাত সমানে হামলা চলে। এতে ব্রিটেনের
সড়ক, রেলপথ, ডকইয়ার্ড থেকে শুরু করে পয়ঃনিষ্কাশন, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এভাবে হামলা
চলে প্রায় ৫৭ দিন ধরে। যে হামলায় অংশ নেয় ৩৪৮টি জার্মান বোমারু বিমানের পাশাপাশি ৬১৭টি জঙ্গি বিমান। হামলায়
বার্মিংহাম প্যালেস থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট হাউজ, ওয়েস্ট মিনস্টার হল, সেন্ট জেমস প্রাসাদ, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট
এক মূর্তিমান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
অপারেশন ড্রামবিট
ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে করা হলেও জার্মান পাঞ্জার ডিভিশন স্থলপথে তাদের নামের
প্রতি সুবিচার করে। এদিকে জার্মানির সুগঠিত বিমান বাহিনীও অন্য সব দেশের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়। এ অবস্থায়
জার্মানরা ঘাতক ইউবোটের মাধ্যমে নৌপথেও তাদের শক্তিশালী অবস্থান জানান দেয়। ১২ ডিসেম্বরের দিকে আটলান্টিক
পাড়ি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জলসীমায় ঢুকে পড়ে জার্মান ইউবোটগুলো। অ্যাডমিরাল ডেয়েনিটস মনে করতেন এই
ইউবোটগুলো নির্বিঘেœ নিউইয়র্ক গিয়ে পুরো ডকইয়ার্ডকে তছনছ করে আসতে পারবে। এ সময় সাহসে বলীয়ান হয়ে ইউ১২৩-এর ক্যাপ্টেন হার্ডেগানের ক্রুরা হামলা করে নোভা স্কটিয়ায় সলিল সমাধি ঘটায় ‘সফোক্লেস’-এর। এরপর ১৮
ডিসেম্বর তারা লং আইল্যান্ডের মোন্টাউক পয়েন্ট থেকে মাত্র ৬০ মাইলের মধ্যে আঘাত হানে। এবার ডুবিয়ে দেয়
‘নোরনেস’কে। প্রথম দিকে কোনো সুনির্দিষ্ট মানচিত্র না থাকলেও ক্যাপ্টেন হার্ডেগান এভাবে হামলা করতে করতে
একেবারে ৩৩০ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব থেকে নিউইয়র্কের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে জ্যাকব রিস
সৈকতের পাহারায় থাকা মার্কিন রক্ষীরা শুরু থেকে শেষ অবধি অপারেশন ড্রামবিট চালাতে অগ্রসর হার্ডেগানের ইউ১২৩কে দেখতেই পায়নি।
জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ
যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বিমান ও নৌঘাঁটি হিসেবে বিখ্যাত পার্ল হারবার। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত সামরিক অভিযান হিসেবে বলা পেতে পারে জাপান সাম্রাজ্যের বাহিনীর পার্ল হারবার আক্রমণ।
একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও নৌঘাঁটিতে চালানো আক্রমণের মুহূর্তে ছত্রখান হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী। জাপান
সাম্রাজ্যের জেনারেল হেডকোয়ার্টারের অপারেশন জেড পরিকল্পনায় একে পরিচালনা করা হয়েছিলে হাওয়াই অপারেশন
হিসেবে। ওয়াহো দিনে তখন ছুটির দিন। মার্কিন নৌবাহিনীর প্যাসিফিক ফ্লিটকে নিয়ে আসা হয় জাপানের ওপর অবরোধ
আরোপের জন্য। প্রতিশোধ নিতে ৬টি বিমানবাহী জাহাজের সহায়তায় ৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধবিমান এবং অগণিত টর্পেডো
একযোগে আক্রমণ করে বসে। তারা পার্ল হারবারের হিকাম সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে এ দ্বীপে নোঙর করা মার্কিন
জাহাজগুলোর ওপর বৃষ্টির মত বোমাবর্ষণ করে।
জাপানি হামলায় সেখানে থাকা সবকটি মার্কিন জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়। মাত্র কয়েকটি সেখান থেকে উড়ে পালাতে সক্ষম
হয়। বিশেষ করে তাদের ১২টি যুদ্ধজাহাজের একটিও অক্ষত ছিল না। অসমর্থিত তথ্যে তাদের প্রায় ১৮৮টি জঙ্গিবিমান
ধ্বংসের পাশাপাশি প্রাণ যায় ২৪০৩ জন মার্কিনর। বিস্ফোরিত হয়ে মার্কিন রণতরী ইউএসএস অ্যারিজোনা ডুবে গিয়ে
প্রাণনাশ হয় ১১০০ মার্কিন নৌসেনার। এখনও স্মৃতি হিসেবে এই ইউএসএস অ্যারিজোনার খোল দর্শনার্থীদের জন্য
সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাপানিরা মূলত প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিনদের দাপট সাময়িকভাবে হলেও কমিয়ে দিতে এ হামলা
চালায়। পার্ল হারবারে জাপানি হামলা প্রাথমিকভাবে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল ছিল অনেক ভয়াবহ।
দ্বিতীয়বারের মত মার্কিন ভূখÐে বহিঃশক্তির সরাসরি বিমান হামলা হিসেবে ঘটনাটি অনেক গুরুত্ব পেয়েছে মার্কিন
ইতিহাসে।
মার্কিন-জার্মান দ্বৈরথ
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির দ্রæত পরাজয়ের মূল কারণ মার্কিনদের অংশগ্রহণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের নেশায় উন্মাদ
হিটলার ইউরোপের কয়েকটি দেশকে হারিয়েই শান্ত হতে পারেননি। তিনি শুরু থেকেই চেয়েছিলেন তাদের পুরনো শত্রæ
মার্কিনদের শায়েস্তা করতে। তাই ইউরোপের রণাঙ্গন ছাড়িয়ে এবারের যুদ্ধ পা বাড়ায় আটলান্টিকের দিকে। হিটলার প্রস্তুতি
সম্পন্ন মনে করে ১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। একই দিনে এর পাল্টা জবাব দিতে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বলতে গেলে হাওয়াইয়ের পার্ল হারবারে
জাপানি হামলার ঠিক চারদিনের মাথায় শুরু হয় জার্মান-মার্কিন সংঘাত। বাইরের ভূখÐে মরণপণ লড়াই চললেই জার্মান
সৈন্যরা মার্কিন ভূখÐে অবতরণ করতে পারেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিটলারের
অনেকগুলো বড় ভুলের একটি।
রাশিয়া অভিমুখে জার্মান বাহিনী
দুই রণাঙ্গনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দুর্বল দিকগুলো বুঝতে পেরে জার্মানরা ১৯৩৯ সালের আগস্টে রাশিয়ার সাথে একটা
১০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে। এক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রের ভূমি জবরদখল থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক আরো নানা কারণ নিয়ে
চুক্তি হয় রুশ-জার্মান বাহিনীর মধ্যে। তাদের সমঝোতা অনুযায়ীই ১৯৩৯ সালের দিকে রুশরা আক্রমণ করে দখল করে
নেয় পোল্যান্ড। এই বছরের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড দখল করলে তাঁর বিরুদ্ধে একইসাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন
ও ফ্রান্স। ১৯৪১ থেকে শুরু হওয়া পূর্ব রণাঙ্গনের ভয়াবহ লড়াইয়ে রুশরা একইসাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে
নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয় যা নিঃসন্দেহে নাৎসি জার্মানির মাথাব্যথার হেতুতে পরিণত হয়। তাদের দমন করতে
এবার সরাসরি রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন হিটলার। নির্দেশ পাওয়ামাত্র ১৯৪১ সালের ২২ জুন ভোরে ৪০
লাখের মত জার্মান, ইতালীয় ও রুমানিয়ার সৈন্য রাশিয়ায় প্রবেশ করে। এক্ষেত্রেও জার্মান পাঞ্জার ডিভিশন তাদের
অপ্রতিরোধ্য ইমেজ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তারা তিনদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করে রুশদের একেবারে বন্দি করে
ফেলে। এভাবে একমাস ধরে লড়াই করে জার্মান সৈন্যরা অপ্রতিরোধ্যভাবে লেনিনগ্রাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে
প্রচÐ বৃষ্টিপাত, তুষারঝড় এবং শীতল আবহাওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত জার্মান বাহিনীর এই অগ্রযাত্রা টিকে থাকেনি। আর
ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে রুশ প্রকৃতি এবারেও তাদের প্রধান প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে।
অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদ
জার্মান পাঞ্জার ডিভিশনের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে নেহাত ঠুনকো মনে হয় রুশ বাহিনীকে। প্রকৃতি তাদের সহায় না
হলে শেষ পর্যন্ত জার্মান বাহিনী তাদের একেবারে কচুকাটা করে ছাড়তো। তবে তাদের চৌকস নৈপুণ্যে সব ধরনের সমস্যা
উত্তরণ করে জার্মানরা। বলতে গেলে ১৯৪১ সালে ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯০০ দিন
অবরুদ্ধ ছিল এ অঞ্চল। দীর্ঘদিনের অবরোধে প্রাণ যায় প্রায় ৬ লাখ ৩২ হাজার মানুষের। ১৯৪১ সালের বড়দিনে সেখানে
অনাহারেই মারা যায় ৪০০০-এর বেশি মানুষ। এই লেনিনগ্রাদ অবরোধ ছিল রাশিয়ায় জার্মানির সর্বাত্মক অভিযানের
অংশ। প্রায় ৪০ লাখ সৈন্য নিয়ে বিশাল এ ফ্রন্টে লড়াই শুরু করে শুধুমাত্র জ্বালানি সংকটের কারণে মস্কো অধিকার করতে
পারেনি জার্মানরা। রাশিয়ার ভূখÐ জার্মান ট্যাংক চলার উপযোগী না হলেও সেখানে তাদের বিজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু
বছরের শুরুতে অহেতুক গ্রিসে অভিযান চালিয়ে জার্মানরা তাদের শক্তি অপচয় করে বসে। এক্ষেত্রে তারা যদি জনবল
অপচয় না করতো, তাহলে এ সময়ে নিশ্চিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটত বলে মনে করেন অনেকেই।
স্ট্যালিনগ্রাড অবরোধ
৪০ লক্ষ জার্মান বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে প্রায় ৩০ লক্ষের মত রুশ সৈন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা প্রথম
দিকে ভালো রকম মার খেলেও শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে জার্মানদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বিরুদ্ধ রাশিয়ার
প্রকৃতি যেখানে জার্মানির জন্য বড় বিপদের কারণ সেখানে রুশ বাহিনী নতুন করে সক্রিয় হয়। তাই বেশিরভাগ
ইতিহাসবিদ মনে করেন স্ট্যালিনগ্রাড অবরোধ হিটলারের অনেকগুলো ভয়ানক ভুলের একটি। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজেই
নিজের ভয়াবহ পরাজয় ডেকে এনেছিলেন জার্মান নেতা হিটলার। জার্মান বাহিনী একাধারে পশ্চিম রণাঙ্গনে ইউরোপের
লড়ছিল অন্যদিকে পূর্ব রণাঙ্গনের লড়াইও থেমে ছিলো না। এ অবস্থায় স্ট্যালিনগ্রাড অবরোধের সিদ্ধান্ত হিটলারের জন্য
নিঃসন্দেহে হঠকারী হয়ে দেখা দেয়। অন্তত একসাথে এতোগুলো ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতা তখন জার্মান
বাহিনীর ছিল না।
জার্মান পাঞ্জার ডিভিশন নিঃসন্দেহে দ্রæত আক্রমণ করে যেকোনো অঞ্চলে দখলে নিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারত। তবে
রাশিয়ার বিরুদ্ধ শীতল প্রকৃতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা বিশ্বের কোনো বাহিনীরই ছিল না। তা জার্মান বাহিনীর স্ট্যালিনগ্রাড
অবরোধের ব্যর্থতায় আরেকবার প্রমাণ হয়ে যায়। স্ট্যালিনগ্রাডে প্রায় ২০০ দিনের অবরোধ চলে প্রথমে জার্মানরা সেখানে
অবরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া সেখানে আরো শক্তিশালী অবরোধ গড়ে তোলে। আক্রমণের ভয়াবহতা আঁচ করে
সেখানে আক্রমণের দায়িত্বে থাকা পাউলাসকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন হিটলার। এর আগে কোনো জার্মান ফিল্ড
মার্শাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেননি। তবে পাউলাস তার বিধ্বস্ত হেডকোয়ার্টার্সের কাছে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করতে
বাধ্য হন। ১৯৪৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রায় ৯১ হাজার জার্মান সৈন্য আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধের অবরোধকালে মারা
যায় লক্ষাধিক জার্মান, তাদের সাথে ছিল প্রায় ৮৭ হাজার ইতালীয় ও লক্ষাধিক রুমানিয়ার সেনা। তবে স্ট্যালিনগ্রাডে রুশ
অবরোধের সময় মারা যায় আরো লাখ তিনেক জার্মান সৈন্য। দুর্ধর্ষ ষষ্ঠ জার্মান পাঞ্জার ডিভিশনকে উদ্ধার করতে গিয়েও
শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয় আরো কয়েক হাজার জার্মান সৈন্য। বলতে গেলে স্ট্যালিনগ্রাড অভিযান এক রক্তগঙ্গা
বইয়ে দেয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা।
নরম্যান্ডির ডি ডে ল্যান্ডিং
জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সের ভূখÐে দুর্দান্ত হামলা চালিয়ে হিটলারের বাহিনীকে অনেকটাই নাজেহাল করে ছাড়ে মিত্রবাহিনী।
১৯৪৪ সালে নরম্যান্ডি উপকূলে হওয়া এ হামলা ধীরে ধীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশু পরিণতি কি তা জানান দিতে শুরু
করে। তুমুল লড়াইয়ে জার্মানরা ফ্রান্সের ওই অঞ্চল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। মিত্রবাহিনী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে এসে
সরাসরি এখানে হামলা চালায় যাকে ইতিহাসে ডি ডে ল্যান্ডিং তথা অপারেশন ওভারলোড নামে স্থান দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে প্রায় ১২টি দেশের ৩০ লাখ সৈন্য গিয়ে হামলা চালায় নরম্যান্ডিতে। অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা,
চেকোশ্লোভাকিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এই ১২ দেশের
সৈন্যরা একসাথে হামলা চালায় ৬ জুন। সেদিন রাতের বেলা ছত্রীসেনা অবতরণ, গøাইডার অবতরণ থেকে শুরু করে জঙ্গি
ও বোমারু বিমানের পাশাপাশি যুদ্ধজাহাজ থেকে বোমা ও গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। মিত্র বাহিনীর ৩৭ হাজার
নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয় দেড় লক্ষাধিক। অন্যদিকে জার্মানদের ২ লক্ষ সৈন্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি ২ লাখ
আত্মসমর্পণ করে। তবে ফিল্ড মার্শাল রোমেলের ৩৫২ তম ডিভিশন এখানে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে মিত্রবাহিনীর
বিরুদ্ধে। প্রচÐ প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে জার্মানদের পরাজয় আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য অনেকটা এখানেই
নির্ধারণ করে দেয়।
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র