মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের নাম বর্ণবাদ। বিশেষ করে বিশ্বের নানা দেশে মানুষের অধিকার হরণের
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই বর্ণবাদ। তবে হিসেব করে দেখা গেছে আফ্রিকায় ইউরোপের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার
পর থেকে আফ্রিকার কালো বর্ণের মানুষরা সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হয়েছিল। এদিক থেকে চিন্তা করে বর্ণবাদের
একটি সহজ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে মনে করা হয়, কালো চামড়ার মানুষদের উপর সাদা চামড়ার মানুষগুলো
যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে সেটাই বর্ণবাদ। এক্ষেত্রে তারা খেয়াল করে না যে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের একটি হচ্ছে ত্বক যা
যে কারো যে কোনো বর্ণের হতেই পারে। চামড়ায় মেলানিন নামক পদার্থের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি কিংবা পরিমাণগত
ভিন্নতায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে মানুষ হিসেবে কারও কোনো হাত থাকে না। ফলে গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে মানুষের
শ্রেণিকরণ একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোর উপর ইউরোপ থেকে যাওয়া সাদা চামড়ার মানুষের
বৈষম্যের প্রতিবাদে প্রথম সোচ্চার হতে দেখা যায় সেখানকার মানুষকে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মানুষও বর্ণবাদ বিরোধী
আন্দোলন শুরু করে। এক্ষেত্রে মার্টিন লুথার কিং, ফ্রেডারিখ উইলিয়াম দ্য ক্লার্ক, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা
ডেসমন্ড টুটুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে অনেকে অন্যায় আচরণ শুরু
করেছিলেন যাদের মধ্যে জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে কিংবা উগান্ডার ইদি আমিনের নাম বলা যেতে পারে।
বর্ণবাদের ধারণা
কোনো নরগোষ্ঠীর প্রতি ভিন্ন গাত্রবর্ণের অন্য নরগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর গাত্রবর্ণের বিভিন্নতাজনিত যে বৈষম্যমূলক আচরণ
তাকে সাধারণ অর্থে বর্ণবাদ বলা হয়ে থাকে। বর্ধিত পরিসরে বলতে গেলে গাত্রবর্ণের ভিন্নতার কারণে রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে কোনো জাতিকে বিপন্ন করা হলে তা বর্ণবাদের আওতায় পড়ে। ইংরেজি রেস
থেকে রেসিজম তথা বর্ণবাদ কথাটির উদ্ভব। এক্ষেত্রে মানুষের গাত্রবর্ণ, সামাজিক শ্রেণি, বংশ পরিচয় ও জন্মস্থানের উপর
ভিত্তি করে মানুষকে বিভক্ত করে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করলে তাকে বর্ণবাদ বলে।
এক্ষেত্রে মানুষকে শ্রেণিকরণের মাধ্যমে আলাদা করে সুযোগ সুবিধা বণ্টনের তারতম্য করার চেষ্টা চলে। ফলে নির্দিষ্ট
জাতিগোষ্ঠী তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে। অন্যদিকে অনেক জাতিগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে
বঞ্চিত হয়।
অ্যাপারথেইড (অঢ়ধহঃযবরফ) তথা আলাদাকরণের যে নীতি, তার উপর ভিত্তি করে নিগ্রহের এক নতুন ধারা জন্ম
নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে সংখ্যলঘু শেতাঙ্গরা দেশ শাসন করতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো চামড়ার মানুষকে
নিগ্রহের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার যে নীতি গ্রহণ করে তা ছিল
বিপত্তিকর। এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্ণবাদে বিশ্বাসী নৃ-বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও ধারণা থেকে। তারা বিশ্বের
মানুষকে বিভিন্ন নরগোষ্ঠী যেমন ককেশয়েড, অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রয়েড প্রভৃতি বর্ণ তথা রেসে ইড (ৎধপব) বিভক্ত
করেছিলেন। তাদের ধারণায় একটি বিশেষ জৈব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ অপেক্ষাকৃত কম বা বেশি কর্মক্ষম কিংবা
অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল। তারা প্রচারের চেষ্টা করেন যে এই জৈবিক বৈশিষ্ট্যের বলেই মানুষ তাদের শিক্ষা-দীক্ষা,
জ্ঞানচর্চা কিংবা সংশ্লিষ্ট নানা ক্ষেত্রে উন্নতির শিখরে আরোহন করেছিল। অন্যদিকে পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ তাদের
গাত্রবর্ণ তথা জৈবিক কারণজাত বর্ণভেদের কারণেই অকর্মা, অপদার্থ, অলস, অসভ্য, অমার্জিত এবং দাসবৃত্তির যোগ্য বলে
মনে করতেন তারা।
নরগোষ্ঠীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এমন ধারণার উপর ভিত্তি করে নরগোষ্ঠীর বিশুদ্ধতা রক্ষার একটা প্রচেষ্টা চলে। তখন
মনে করা হত নি¤œবর্ণের মানুষের দূষিত রক্তের সঙ্গে উন্নত বর্গের মানুষের রক্তের মিশ্রণ সম্ভব নয়। তাদের এই অন্ধ
বিশ্বাসের বলি হতে হয়েছিল অনেক দেশের মানুষকে। তারা শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন মানুষকে তার
দেশছাড়া করেছিল। যেমন সাদাদের দেশ থেকে কালোদের বের করে দেয়া হয়েছিল শুধুমাত্র তাদের রক্ত বিশুদ্ধ রাখার নষ্ট
অভিপ্রায়েই। একইভাবে অনেক দেশে বসবাসরত মানুষকে গণহারে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি মায়ানমারে আদিবাসী
রোহিঙ্গাদের উপর চলমান গণহত্যা এই ধরণের বর্ণবাদ প্রতিষ্ঠার একটি ধিকৃত অপপ্রয়াস। শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের ভিন্নতার
পাশাপাশি ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে আদিবাসী রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। তারা রোহিঙ্গাদের
জন্মভূমি থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে সবাইকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে নিজ থেকে
বিতাড়িত এসব মানুষ প্রাণরক্ষার দায় নিয়ে এসে অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদের যে বিস্তার তার পেছনে মূল প্রণোদনা সৃষ্টি করেছিলেন বর্ণবাদী নৃ-বিজ্ঞানীরা। তাদের
পাশাপাশি ঐ দেশের প্রতœতাত্তি¡ক গবেষক এবং ইতিহাসবিদরা ইন্ধন যুগিয়েছেন। সেখানে বর্ণবাদী নৃ-বিজ্ঞানীরা একবার
বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটি বর্ণনা প্রচারের চেষ্টা চালিয়েছেন। পরে প্রতœতাত্তি¡ক গবেষক ও
ইতিহাসবিদরা তাদের অতীত সম্পর্কে পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরণের মন্তব্য দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়েছেন। বিশেষ করে
একটি দেশের প্রভাবশালী নৃ-বিজ্ঞানীরা যখন কোনো জাতিগোষ্ঠীকে ছোট প্রমাণের চেষ্টা করেছেন সেখানে তাদের পাশে
এসে দাঁড়াতে দেখা গেছে ইতিহাসবিদ ও প্রতœতাত্তি¡ক গবেষকদের। তারা এই জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে নানা নেতিবাচক
মন্তব্য তৈরি করেছেন। পাশাপাশি প্রতœতাত্তি¡ক গবেষণার নামে ঐ নির্দিষ্ট জাতির অতীত সম্পর্কিত নানা নেতিবাচক বস্তুগত
প্রমাণ দাঁড় করানোর চেষ্টাও চলেছে।
এক পর্যায়ে এসে দেখা গেছে নৃ-বিজ্ঞানী, প্রতœতাত্তি¡ক ও ইতিহাসবিদ মিলে অতীতের উপর ভিত্তি করে একটি জাতির
ভবিষ্যত নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টা যখন উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট প্রমাণের মানদÐ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন উক্ত জাতির
বিশ্বাস, আদর্শ ও অধিকারের বিষয়টি হয়ে গেছে প্রশ্নবিদ্ধ। কবির কবিতার বিখ্যাত চরণ ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভেতরে সবার সমান রাঙা’। যে ধারণা মানুষের ভেদাভেদ দূর করে সব মানুষকে সমান বানিয়েছে তা আদতে কতটা
বিদ্যমান সেটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বার বার।
বর্ণবাদ শব্দটি দ্বারা মূলত শরীরের রং দ্বারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে এমন নয়। চামড়ার বর্ণবৈচিত্র্য থেকে
বর্ণবাদ সবার অস্তিমজ্জায় গেঁথে আছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মানুষ বর্ণবাদের বিষয়টি পুরোপুরি দূর করতে চায় না।
সাদা চামড়া কালো চামড়া নিয়ে সারা পৃথিবীতে এক অদ্ভুত বৈষম্য চালু ছিল একসময়। কালো চামড়ার লোকদের দাস
হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রভু আর ভৃত্যের সম্পর্ক ছিল কেবল গায়ের রংয়ের ওপর ভিত্তি করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র
করে রচিত হয়েছে উপন্যাস, সিনেমা। যেই মাদিবা তথা নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি আজ সবার কাছে পরিচিত। তিনি
আজীবন সংগ্রাম করেছেন এই বর্ণবাদো বিরুদ্ধে। তার জন্য তাকে কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। অদ্ভুত সব বৈষম্যে ভরা
এই সমাজটা। এখানে চামড়ার রঙে বৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, গোত্রে গোত্রে বৈষম্য, আকারে বৈষম্য, আর্থিক
ক্ষমতায় বৈষম্য এরকম আরও বহু বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
তবে উইকিপিডিয়া বর্ণবাদের যে সংজ্ঞা দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ‘বর্ণবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ
যেখানে বিশ^াস করা হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একইসাথে বিশ^াস করা হয় কোন
কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী
অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য’। তবে বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী
ধারনাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বর্ণবাদ কখনো গায়ের রং, কখোনো আঞ্চলিকতা আবার কখোনো গোত্র নিয়ে বোঝানো
হতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাগজে কলমে কিংবা বক্তৃতার কথামালায় দেখা যায় মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ
নেই। সবাই মুখে মুখে বর্ণ বৈষম্য নেই বলে নিজেদের আধুনিক দাবি করে। তারপরেও প্রায় প্রতিটি দেশের সমাজে এত
ভেদাভেদ আর গোত্রে গোত্রে যে হানাহানি তার মূলে রয়েছে বর্ণবাদ। সংবিধান কিংবা সমাজের মানুষের স্বাভাবিক
দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণবাদ নেই, গায়ের রং দিয়ে কাউকে ছোট বা বড় করার সুযোগ নেই। তবুও বর্ণবাদের দীর্ঘ কালো ছায়া
আরও দীর্ঘতর হয়ে আছে বিভিন্ন পরিবারের চিন্তায়, সমাজের সিদ্ধান্ত কিংবা টিভির বিজ্ঞাপনে।
ভদ্রলোকের খেলা বলে পরিচিত ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার হাশিম আমলা বারংবার হিং¯্র কথার মুখে পড়েছেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের অনেকেই কটুক্তি করছে কালোবর্ণের কারণে। ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে বর্ণবাদী আক্রমণের
শিকার হয়েছেন আমাদের দেশের ক্রিকেটাররাও। ভারতের বিখ্যাত স্পিনার হরভজন সিং একবার শাস্তির মুখে পড়েছিলেন
অস্ট্রেলিয়ার এক খেলোয়াড় অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে বানর বলার কারণে। পাশাপাশি টিভিতে সারাদিন রং ফর্সা করার ক্রিমের
বিজ্ঞাপন প্রচার হতে দেখলে বোঝা যায় বর্ণবাদ কিভাবে টিকে আছে বিশ্বের নানা দেশে। প্রতিটি দেশে সাদা কালো কোন
বিভেদ নই থাকলে ত্বকের রং ফর্সা হওয়ার ক্রিমের এত মূল্য থাকত না। মুখে যে যাই বলুক মেয়েকে ফর্সা বানানোর
প্রাণান্ত চেষ্টায় থাকেন প্রত্যেক মা বাবা। অনেক ক্ষেত্রে চিন্তাগত দুর্বলতায় মেয়েকে শিক্ষিত করে বড় করে তোলার চেয়ে
ফর্সা করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের কাছে।
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র