ফরাসি বিপ্লবের কারণ

একটি বা কিছু বিচ্ছিন্ন কয়েকটি কারণে ফরাসি বিপ্লবের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়নি। এর পেছনে
যুগপৎ অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। আলোকময়তা পরবর্তীকালের আধুনিক ইউরোপের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি
প্রায় প্রতিটি দেশেই উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল দুটি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিলো। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পীঠস্থানখ্যাত ফ্রান্সে এই দুটি
শ্রেণির অস্তিত্ব আরো স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এখানে সংস্কারপন্থীগোষ্ঠী বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রাচীন
রীতিনীতিকে ঝেড়ে ফেলতে আগ্রহী হয়। অন্যদিকে প্রাচীন রক্ষণশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা, কুসংস্কার ও গোঁড়া
বিশ্বাসকে আগলে রেখে মানুষের উপর চড়াও হয়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক দৈন্যের শিকার নিম্নশ্রেণি এই সময় তাদের
অধিকার নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। ফলে সর্বত্র একটি যুদ্ধংদেহি মনোভাব স্পষ্টত দৃশ্যমান হয়েছিলো। এই অবস্থার মধ্যে
অনেকগুলো কারণে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। নিচে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণগুলো তুলে ধরা হলোÑ
রাজনৈতিক কারণ
ফরাসি বিপ্লবের পেছনে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অনিয়ম ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন অনেকাংশে দায়ী ছিলো। বিশেষ করে বুরবোঁ
রাজবংশের কুকীর্তি, শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা, রাজতন্ত্রের সীমাহীন ক্ষমতা, সামন্তবাদী শাসন, রাণীদের জবরদস্তিমূলক
কর্মকাÐ, আইনগত অসমতা, নাগরিক অধিকার না থাকা, ধর্মীয় মুক্তচিন্তার সুযোগ না থাকার পাশাপাশি চিন্তাজাগতিক
ক্ষেত্রে রাজ্যের হস্তক্ষেপ ফরাসি বিপ্লবের পথ করে দিয়েছিলো। এসব রাজনৈতিক কারণে এখানে বিশ্লেষণ করা হলোÑ
১. বুরবোঁ রাজবংশের দুঃশাসন: ক্ষমতা দেশ শাসনে বুরবোঁ রাজাদের নানা কুকীর্তি ফরাসিদের বিক্ষোভে ফেটে
পড়তে বাধ্য করেছিলো। ১৮ শতকের ইউরোপে অন্য দেশের রাজতন্ত্র যেখানে আস্তে আস্তে মানুষের জন্য
কল্যাণকামী হয়ে উঠছে তখন বুরবোঁদের স্বেচ্ছাচারীতা মাত্রা ছাড়িয়েছিলো। চতুর্দশ লুই যেভাবে ‘আমিই রাষ্ট্র’
এই ধরনের ধারণা প্রচলন করেছিলেন এই যুগের রাজাদের মধ্যেও তার রেশ ছিলো। রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতার
অনর্থক প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে শাসনক্ষেত্রের অবস্থা ছিলো শোচনীয়। রাজ্যের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে
আইন, বিচার ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজা ছিলেন সর্বেসর্বা। এই সময় রাজার ক্ষমতাকে চূড়ান্ত প্রমাণ করতে
সবগুলো প্রতিনিধিত্বমুলক প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেয়া হয়। ষোড়শ লুই বেশ দম্ভের সাথে ঘোষণা করেন
‘ফরাসিদের সার্বভৌম ক্ষমতা কেবলমাত্র তার উপর ন্যস্ত তাই আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতাও তাঁর’। আর
তাঁর ইচ্ছার উপর ভিত্তি করেই স্ট্রেটস-জেনারেল নামক আইনসভা পর্যন্ত ভেঙে দেয়া হয়েছিলো। লুইয়ের
স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করলে তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করে নির্যতন
চালানো এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হতো। লেটা দ্য ক্যাস্তে (খবঃঃৎব ফব ঈধপযবঃ) নামে পরিচিত নিকৃষ্টতম এক
আইনে প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সে অনেক মানুষকে গ্রেপ্তার-নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছিলো।
২. শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা: রাজার সর্বময় ক্ষমতার প্রদীপের নিচের অন্ধকার হিসেবে ফ্রান্সে বিদ্যমান ৪০ টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
রাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। রাজা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকার হিসেবে
নিজেকে ঘোষণা দিয়ে নানামুখী প্রভাব খাটালেও মূল ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছিলো স্থানীয় সরকারের প্রশাসকদের
হাতে। এই সমস্ত স্থানীয় সরকারের প্রধান ইনটেনডেন্ট ও তার কর্মচারীরা জনগণের উপর নানামুখী অত্যাচার
চালাতো। রাজার নির্যাতনের সাথে তাদের নির্যাতন একীভূত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয় সাধারণ
মানুষের জীবনে। এইক্ষেত্রে বেশিরভাগ রাজকর্মচারী ছিলেন বুর্জোয়াশ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী, যারা জনগণের
কল্যাণের থেকে নিজেদের অবস্থা উন্নয়নে অধিক সচেষ্ট ছিলেন। ফলে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের
দীর্ঘসূত্রিতা, অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপের আধিক্য থেকে শুরু করে নানা অনাচার দেখা দেয়।
৩. রাজতন্ত্রের সীমাহীন ক্ষমতা: ফরাসি রাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে সর্বময় করতে অন্যসব ক্যাথলিক প্রধান দেশগুলোর
মতো ফ্রান্সেও দৈব রাজতন্ত্রের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত করানোর
একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। উপযুক্ত দক্ষিণার বিনিময়ে রাজার অপকর্মে বৈধতা দিয়ে সহায়তা করেন
পোপ। দৈব রাজতন্ত্রে সর্বময় ক্ষমতা রাজার হাতে ন্যস্ত হওয়ার ফলে প্রশাসক হিসেবে যতটা ব্যর্থই হন রাজা
হয়ে ওঠেন অত্যাচারের প্রতীক। পোপ সমর্থিত দৈব ক্ষমতার বলে রাজ্যশাসনের নামে স্বেচ্ছাচারিতামূলক
একনায়কতন্ত্রকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলা হয় যা ছিলো মানবতা পরিপন্থি। পোপের মাধ্যমে ক্ষমতার
সর্বজনীন অবস্থান লাভ করে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রাজা যেখানে কৃতকর্মের জন্য তিনি পার্লামেন্ট বা
জনগণ কারো কাছে দায়ী ছিলেন না। আইন প্রণয়ন, কর প্রবর্তন, কোনো রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, চুক্তি
সম্পাদন থেকে শুরু করে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ছিলো একমাত্র রাজার।
৪. সামন্তবাদী শাসন: নামেমাত্র আধুনিক যুগের প্রত্যাবর্তন করলেও মধ্যযুগীয় বর্বর সামন্তপ্রথা ফ্রান্সের মাটি থেকে
তখনো চিরতরে বিলুপ্ত হয়নি। সামন্তপ্রভুদের নারকীয় অত্যাচার নির্যাতন আর অনৈতিক কর্মকাÐ মানুষকে জীবন
মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মানবেতর অবস্থানে এনে দাঁড় করায়। শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রের প্রভাবে রাজার সকল নির্দেশ
মানতে জনগণের গলদঘর্ম হতে হতো। সেই সাথে সামন্ত প্রভুর শোষণ আর নারকীয় নির্যাতন অনেকটাই মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দেয়। সামন্তবাদী অর্থনীতিতে কৃষক তার ভূমির মালিকানা লাভ করেনি। তবে
প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রম দেয়া থেকে শুরু করে সবকিছু তাকেই করতে হতো। পাশাপাশি সামন্ত প্রভুরা নিজেদের
অবস্থান সমুন্নত করতে পোপদের সাথে সম্পর্ক সবসময় ভালো রাখতে চাইতো। তাই তাদের খুশি করতে মানুষ
সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে গির্জার জমিতে বেগার শ্রম দিতো যার বিনিময়ে খাদ্য বা পারিশ্রমিক কিছুই মিলতো না।
রাজা ও পোপের প্রিয়পাত্র ভূ-স্বামী তথা সামন্তপ্রভুরা কৃষকদের অর্জিত সম্পদে বিলাসব্যসনে দিনাতিপাত করতেন
অন্যদিকে কৃষকদের অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকে। সময়ের দাবি মেটাতে তাদের সামনে বিপ্লবী হয়ে ওঠা
বাদে দাবি আদায়ের আর কোনো বিকল্প পথ ছিলো না।
৫. রাণীদের জবরদস্তিমূলক কর্মকাÐ: ফরাসি রাজতন্ত্রের দুর্বলতম দিক হচ্ছে ফরাসি রাজ দরবার থেকে শুরু করে
যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাণীদের অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ। অনেক যোগ্য প্রজাহিতৈষি মন্ত্রী রাণীদের প্রিয়পাত্র না
হওয়াতে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। পশ্চদশ ও ষোড়শ লুইয়ের দরবারে তাদের রাণীর প্রভাব ছিলো চোখে পড়ার
মতো। এক কথায় বললে ষোড়শ লুইয়ের রাণী অ্যান্টয়নেট হয়ে ওঠেন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যমণি। তাইতো
তুর্গোর মতো একজন বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অর্থনীতিবিদকে মন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ করতে বাধ্য
হয়েছিলেন ষোড়শ লুই। দুর্বলচিত্ত ষোড়শ লুই রাণী ও দরবারের স্বার্থন্বেষী চক্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এভাবে রাণীদের অযৌক্তিক শক্তি প্রয়োগ আর অনাকাঙ্খিত ভূমিকা ফরাসি রাজতন্ত্রের ভিত্তিমূলকে আঘাত করে
আস্তে আস্তে দুর্বল করতে থাকে ক্ষমতা কাঠামো।
৬. আইনগত অসমতা: ফরাসি সামন্ততন্ত্রে একই আইন প্রায়োগিক দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক লাভ করেছিলো।
বলতে গেলে আইন প্রয়োগের এই অসম অবস্থানই প্রশাসনযন্ত্রকে নামান্তরে একটি নিয়মতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে রূপ
দিয়েছিলো। যেখানে মানুষের অধিকারের কথা বলাটা ছিলো উপহাসের সমতূল্য। বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সের সর্বত্র একটি
নির্দিষ্ট আইনের বদলে রাজ্যভিত্তিক আইন প্রচলিত ছিলো। এক্ষেত্রে রোমান আইনে পরিচালিত দক্ষিণ ফ্রান্সের
সাথে উত্তর ও মধ্য ফ্রান্সের আইনের পার্থক্য থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা স্থান বদল করতো। এভাবে দোষী
ব্যক্তিরা খুব সহজেই উপযুক্ত শাস্তি থেকে বেঁচে যেতো। জানা যায় পুরো ফ্রান্স জুড়ে প্রায় ৪০০ টির মতো ভিন্ন
ভিন্ন আইন প্রচলিত হয়েছিলো যেগুলোর অধিকাংশ ল্যাটিন ভাষায় হওয়াতে সর্বসাধারণের বোধগম্য হতো না।
তখনো হেবিয়াস-কর্পাস প্রবর্তন হয়নি। এর বদলে প্রচলিত কঠোর আইনে মামুলি অপরাধেও মানুষের অঙ্গচ্ছেদ
করার পর্যন্ত বিধান রাখা হয়েছিলো।
৭. নাগরিক অধিকার না থাকা: নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে সবার আগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কথাটি বলতে হয় যা তখনকার
ফ্রান্সে এক অসম্ভব বলে বিবেচিত হতো। মানুষ জন্মগতভাবে রাষ্ট্র ও রাজার অধীন এখানে তার স্বাধীন সত্তা
বলতে কিছু রাখা হয়নি। মানুষ তার প্রতিটা কর্মকাÐ তা ভালো কিংবা খারাপ যাই হোক এটা নিয়ে রাজার কাছে
জবাবদিহী করতে বাধ্য ছিলো। বিশেষ করে তখনকার রাষ্ট্র চাইলে বিনা বিচারে যে কোনো মানুষকে ধরে নিয়ে
গিয়ে কয়েদখানায় আটকে রাখতে পারতো। তখনকার দিনের ফ্রান্সে গুপ্ত আটক নামে একটি বিশেষ প্রথা চালু
হয়েছিলো। এভাবে আটক করে অনেক মানুষকে বিরোধিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে ছেড়ে
দিলেও বেশিরভাগ মানুষকে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। অপরাধী তথা বিদ্রোহীদের আটক করে রাখার মতো এমন
অনেক জেলখানা তখন গড়ে উঠেছিলো যার মধ্যে ইতিহাসবিখ্যাত বাস্তিল কারাদুর্গ অন্যতম।
৮. ধর্মীয় ও চিন্তাজাগতিক ক্ষেত্র: অগসবার্গের সন্ধির পর রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম এমন নীতি প্রতিষ্ঠা পায়। অনেক
ক্ষেত্রে প্রজাদের বাধ্যতামূলক ক্যাথলিক কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতে দীক্ষিত করা হয়। ধর্ম বিশ্বাস যার যার আর
দেশটা সবার এমন ধারণা তখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। মানুষ তার চিন্তাজাগতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
ছিলো। অন্যদিকে গ্রন্থ প্রকাশ ও সংবাদপত্র ছাপানোর ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হতো। এক্ষেত্রেও রাজার
বিরুদ্ধে কোনো কথা বলাটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রতিবাদী লেখনীর কারণে
ভলতেয়ারের কারাবরণের কথা। অন্যদিকে বার সংস্কার, পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টধর্ম ততোদিনে
একটি নতুন রূপ লাভ করেছে। কিংবা ক্যাথলিকদের অত্যাচারের অতিষ্ট অনেক প্রজা চাইছে প্রোটেস্ট্যান্ট
মতবাদে দীক্ষিত হবে। এক্ষেত্রে উভয় চিন্তার মানুষের উপরেই নেমে আসে বিভীষিকাময় নির্যাতনের ঘটনাগুলো।
অর্থনৈতিক কারণ
মুদ্রাস্ফীতি, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও ত্রæটিপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ফ্রান্সের মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহ্য করে তুলেছিলো।
অর্থনীতি সমাজের কতিপয় মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় বাকিরা প্রান্তিক হয়ে পড়ে। কিছু ক্ষমতাবান মানুষের জীবন
যেখানে আনন্দ উপভোগের এক অনন্য মাধ্যম বাকিদের কাছে সেই জীবন এক মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। এই
ধরনের একটি পরিস্থিতি ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচনা করে। বিভিন্ন শ্রেণির অর্থনৈতিক কর্মকাÐের মধ্যে এক ধরনের
উল্লেখযোগ্য বৈষম্য সুস্পষ্ট হয়েছিলো।
১. অর্থনৈতিক দায়িত্বঃ রাষ্ট্রকে কর প্রদান থেকে শুরু করে একজন নাগরিকের আরো কিছু অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন
করতে হয়। কিন্তু ফরাসি-বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের দিকে দৃষ্টি দিলে এক্ষেত্রে একটি চূড়ান্ত ধরনের অসঙ্গতি লক্ষ করা
যায়। বিশেষ করে তখনকার ফ্রান্সের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের দুই ধরনের জনগোষ্ঠীর ধারণা মেলে। প্রথমত
অধিকারভোগী এবং দ্বিতীয় অধিকারবিহীন এই দুটি শ্রেণি তখনকার ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের প্রথমোক্তটি
কোনো ধরনের কর প্রদান না করে রাষ্ট্রের প্রায় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণি
কর প্রদান করেও রাষ্ট্রের সকল সুযোগ, সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলো। দার্শনিক কিংবা সাহিত্যিক
তাদের লেখনী বা বর্ণনায় মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন ঠিকই কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটই যে কোনো বিপ্লবকে
উস্কে দিতে যথেষ্ঠ তা ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে আরেকবার প্রমাণিত হয়। তাই ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের
সময় থেকে থেকে অর্থনৈতিক সংকটের সূচনা হয়েছিলো তা ফরাসি বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে।
২. ত্রæটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা: ফ্রান্সের কর সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা ও ছিলো অযৌক্তিক, বিভ্রান্তিকর ও ত্রæটিপূর্ণ। অভিজাত
শ্রেণিই বলতে গেলে ফ্রান্সের বেশিরভাগ ভূমি তাদের দখলে রেখেছিলো কিন্তু তারা ছিলো করের আওতার বাইরে।
তারা করের বাইরে থাকায় রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত অর্থের যোগান নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে
পড়েছিলো। প্রতি বছরের অর্থনৈতিক ঘাটতি ক্রমশ বেড়ে গেলে তার অতিরিক্ত চাপ প্রদান করা হতো নিম্নশ্রেণির
উপর। কৃষকরা অভিজাতদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের অতিরিক্ত করের ভার বহন
করতে গিয়ে নুইয়ে পড়ে। টেইল, ক্যাপিটেশন কিংবা ভ্যাঁতিয়াম এই তিন ধরনের করের ক্ষেত্রেই একটি চূড়ান্ত
ধরনের অনিয়ম চোখে পড়ে। বিশেষ করে টেইল ছিলো ভূমিকর যা থেকে মুক্তছিলো যাজক (১
অভিজাত স¤প্রদায় (২ । তবে তৃতীয় শ্রেণি এই কর দিতে বাধ্য ছিলো। উৎপাদন ভিত্তিক আয়কর
ক্যাপিটেশন সমাজের সকল স্তরের মানুষের উপর জারি হওয়ার বিধান থাকলেও যাজক ও অভিজাত স¤প্রদায়
অনেক ছল-ছুঁতোয় এর থেকে অব্যাহতি পেতো। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর জারিকৃত কর বা ভ্যাঁতিয়াম
থেকেই নানাভাবে মুক্তি পেয়ে যেতো অভিজাত স¤প্রদায় কিংবা যাজকগণ। ফলে প্রত্যক্ষ করের প্রত্যেকটির
ভারই এসে পড়তো তৃতীয় শ্রেণির(৩
উপর। মন্ত্রী তুর্গো হিসেব করে বের করেন ফরাসি কৃষকগণ
তাদের মোট আয়ের পাঁচভাগের চারভাগই কর হিসেবে দিয়ে দিতো। চার্চ তাদের থেকে টাইদ (ঞরঃযব) বা
ধর্মকর আদায় করতো, জমিদার আদায় করতো টেইল। করভারে জর্জরিত ফ্রান্সের কৃষকরা বছরের বেশিরভাগ
সময় কেবলমাত্র আলু খেয়ে জীবন ধারণ করতো। ত্রæটিপূর্ণ কর পদ্ধতির কারণে রাজকর্মচারী ও জমিদার এমনকি
চার্চের রক্ষীদের হাতে পর্যন্ত নির্যাতিত হতো অসহায় কৃষক। আর এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীই পরবর্তীকালে ফরাসি
বিপ্লবের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো।
৩. অর্থনৈতিক ভ্রান্তির জাদুঘর: অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বিশেষ করে কর আদায়ে নানাবিধ অনিয়ম ও জটিলতা বিশ্লেষণ
করে অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সকে ‘অর্থনৈতিক ভ্রান্তির জাদুঘর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক সময়
এককালীন কর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিস্তৃীর্ণ এলাকা অভিজাতদের ইজারা দেয়া হতো। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকায় পুরো
জমির ইজারা লাভ করেও তাদের সন্তুষ্টি মেলেনি। অনিয়মতান্ত্রিক ও অনির্ধারিতভাবে ইচ্ছেখুশি কর আদায় করে
কৃষকদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিলো তারা। একদিকে করের নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্য অন্যদিকে আদায়ের
অযৌক্তিক কঠোরতা কৃষকদের জীবনকে মূর্তিমান অভিশাপে পরিণত করে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ শুল্কপ্রথা এক
স্থান হতে অন্যস্থানে পণ্য বিনিময়ে বিশেষ জটিলতার জন্ম দেয়। এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে রাষ্ট্রের শুল্ক
বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ নানা উপায়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করে। বণিকদের উপর তাদের
অকথ্য অত্যাচারে ব্যবসা বাণিজ্যে পর্যন্ত ধ্বস নামে। এভাবেই ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিলো।
৪. শূন্য রাজকোষ:চতুর্দশ লুই ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এই
যুদ্ধগুলোর ফলে ফরাসি রাজকোষ চাপের মুখে পড়ে। তিনি তাঁর পরবর্তী রাজা পঞ্চদশ লুইকে অর্থনৈতিক
সংস্কারে মনোযোগী হতে নির্দেশ দিলেও তিনি তার কথার পরোয়া করেননি। পঞ্চদশ লুই অনিয়ন্ত্রিত বিলাসব্যাসনের পাশাপাশি আরো কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ফরাসি রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। পোল্যান্ডের বিভাজন
সম্পর্কিত যুদ্ধ, অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা আরো
পরিষ্কার হয়েছিলো। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে ষোড়শ লুই যখন সিংহাসনে বসেন তখন প্রায়
ভেঙে পড়েছিলো ফরাসি অর্থনীতি। অহেতুক কর্মচারী ও কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি, রাজপ্রাসাদের অতিরিক্ত ব্যয় ও
রাণীদের বিলাস-ব্যসন ফ্রান্সকে ঋণের ভারে জর্জরিত করে। ১৭৮৮ সালের দিকে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যেখানে
রাষ্ট্রে মোট আয়ের শতকরা ৭৫ ভাগ ঋণশোধ ও প্রতিরক্ষা খাতেই ব্যয় হতো।
৫. নেকারের অপসারণ:ফরাসি অর্থনীতির দুর্দিনে ত্রানকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ নেকার।
অ্যাডাম স্মিথের পর তাঁকে অনেক যোগ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়। তিনি ক্ষমতা
লাভ করে সবার আগে করনীতির পুনর্বিন্যাসে মনযোগী হন। তিনি লক্ষ করেন ফ্রান্সের অধিকারভোগী শ্রেণি
ক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও কোনো কর প্রদাণ করেনা অন্যদিকে অধিকারবিহীন শ্রেণির উপর নানাবিধ কর চাপানো
থাকলেও তাদের সে কর প্রদাণের সক্ষমতা নেই। তাই ক্ষমতা পেয়েই তিনি বিভিন্ন দমনমূলক কর বাতিল করে
প্রতিটি শ্রেণির উপর করের সমবন্টন করেন। তিনি বিশেষ শ্রেণির আর্থিক সুবিধা বন্ধ করা, কঠোর হাতে শুল্ক
খাতের দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক অমিতব্যয়িতাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। কিন্তু রাণীর প্ররোচনায় তাকে
অপসারণ করে ষোড়শ লুই নিজে হাতে ফ্রান্সের দুর্দিন আরো ঘনীভূত করেন। বলতে গেলে নেকারের অপসারণের
মাধ্যমে ফরাসি অর্থনীতিতে নতুন করে যে সংকট তৈরি হয় তা বিপ্লবকে আরো অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
৬. মুদ্রাস্ফীতিঃ মন্ত্রী নেকারের অপসারণ উন্নয়নমূলক অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। রাণী ও
অভিজাতদের ভূমিকার সামনে রাজার অসহায় অবস্থান জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে দেখা যায় যা রাষ্ট্রকে চরম
দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন করে। অনিয়ন্ত্রিত ও অযৌক্তিক করপ্রথা মুদ্রাস্ফীতিকেও প্রবল করে তোলে। ডেভিড থমসন
দেখিয়েছেন প্রায় ৬৫ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও সেই অনুপাতে মানুষের আয় একদম বাড়েনি যা ফরাসি বিপ্লবের
আগমণ ত্বরান্বিত করে। ফ্রান্সের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য রুটির মূল্য শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়াতে
সাধারণ শ্রমিক ও চাকুরীজীবীদের পক্ষে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অর্ধাহার, অনাহার ও আর রুটিদাঙ্গা হয়ে
ওঠে তখনকার ফ্রান্সের নিত্য নৈমিত্যিক ব্যাপার।
৭. মঙ্গা ও খাদ্য সংকট: অনিয়মতান্ত্রিক কর আদায় ও নির্যাতনে কৃষকদের অবস্থা যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন
ফ্রান্সে ভয়াবহ মঙ্গা দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি ১৭৮৮ সালের ফ্রান্সে ভয়াবহ খাদ্য সংকট সৃষ্টি
করে। জীবন বাঁচানোর তাগিয়ে হাজার-হাজার বুভুক্ষু মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ি দেয় এবং প্যারিসে
এসে সমবেত হতে থাকে। ক্ষুধার্ত মানুষ শহরে এসে বাকিদের বিলাস ব্যসনের জীবন দেখে আক্রমণাত্মক হয়ে
ওঠে। তারা এখানে এসে একইসাথে দেখতে পায় নিজেদের দৈন্য আর তাদেরই হাতে উৎপাদিত ফসলে
শহুরেদের অযৌক্তিক বিলাসিতা। এক টুকরো রুটির সন্ধানে তারা প্যারিসের নানা স্থানে চোরাগোপ্তা আক্রমণ ও
লুটপাট করতে থাকে। এমনি প্রেক্ষাপটের উপর ১৭৮৯ সালে দিকে ফ্রান্সের অনেকগুলো গ্রামে কৃষক বিদ্রোহ দেখা
দেয় যা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশ জুড়ে।

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]