রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা আর অর্থনৈতিক অব্যবস্থার মতো সামাজিক অসমতা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজের শাসনতান্ত্রিক বৈষম্য মানুষকে হতাশ করে তোলে। বিশেষ করে কর না দিয়েও রাজ্যের সকল
সুবিধালাভকারী যাজক ও অভিজাতদের কর্মভূমিকা সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তোলে। পক্ষান্তরে কর দিয়েও
রাজ্যের সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই শ্রেণি তাদের সামাজিক জীবনের দুর্বলতা বেশ ভালোভাবে অনুভব করে। পাশাপাশি
অভিজাত শ্রেণির অনেক দুর্বৃত্তের হাতে অনেক নিম্নশ্রেণির নারী ক্রমাগত লাঞ্ছিত হয়। অনেক কৃষকের সামনে থেকে তার
স্ত্রী কিংবা মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করেও পার পেয়ে যায় অনেক অভিজাত। এই ধরনের বিষয়গুলো
সাধারণ মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সংখ্যায় মাত্র তিন লক্ষ হয়েও উপরের দুইটি শ্রেণি পুরো ফরাসি
জাতির উপর স্কন্ধের মতো চেপে বসেছিলো। তখনকার সমাজের ফার্স্ট-এস্টেট বা যাজক শ্রেণি, সেকেন্ড-এস্টেট বা
অভিজাত শ্রেণি আর থার্ড-এস্টেট তথা মধ্যবিত্ত ও উৎপাদনকারী শ্রেণির জীবন-যাপন প্রণালিতেও ছিলো ঘোর পার্থক্য।
তাই ১৭৮৯ সালে এসে এই সামাজিক অসমতাই হয়ে যায় বিপ্লবের মূলকথা।
১. যাজক শ্রেণির দৌরাত্বঃ ফরাসি সমাজের প্রথম শ্রেণিভুক্ত যাজকরা সব মিলিয়ে সংখ্যায় ততটা বেশি ছিলো না।
তবুও অবস্থানগত কারণে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা লাভ করে আসছিলো তারা। বিশেষ করে প্রায় এক লক্ষ বিশ
হাজার যাজকের দ্বারা পুরো ফ্রান্সের ধর্মকর্ম নিয়ন্ত্রিত হতো। অনেকগুলো রাজনৈতিক, বিচার প্রক্রিয়াগত ও
সামাজিক সুবিধা লাভ করে দিনের পর দিন যাজকদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ স্পষ্ট হতে থাকে। এরা স্থাবর সম্পত্তি
ও টাইদ (ঞরঃযব) নামে পরিচিত বিশেষ করের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিলো। গির্জার নামে
অর্থ উপার্জিত হলেও বিলাস-ব্যসনে তারা অভিজাতদের থেকে কম যেতো না। ভলতেয়ারের হিসেব অনুযায়ী
একাধারে শহর ও গ্রামে বিস্তৃত চার্চের স্থাবর সম্পত্তি থেকে আয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৯ কোটি লিভার। নেকার
যে সংশোধিত হিসেব পেশ করেন সেখানে চার্চের আয় দেখা যায় প্রায় ১৩ কোটি লিভারের মতো। স্বেচ্ছাদান ও
দেমিস এর মতো নামমাত্র কর তাদের আয়ের হিসেবে নিতান্তই তুচ্ছ ছিলো। নিজস্ব প্রাসাদ, দুর্গ ও গির্জা নিয়ে
আভিজাত্যের প্রশ্নে অন্যদের থেকে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিলো না যাজকবর্গ। অনেকটা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র
হিসেবে গড়ে উঠেছিলো ফ্রান্সের রোমান ক্যাথলিক গির্জাগুলো যাদের স্বেচ্ছাচারী আচরণে যার পর নাই বিরক্ত
হয়েও মুখ খুলতে পারেনি সাধারণ মানুষ। তবে উর্ধ্বতন যাজক আর অধস্তন যাজক সে যেই হোক তাদের
বেশিরভাগই অভিজাতশ্রেণি থেকে উদ্ভুত। তাই বিশপ, ক্যানন কিংবা মঠাধ্যক্ষ এদের কারো চিন্তা চেতনাতে
সাধারণ মানুষের অধিকারের ছিঁটেফোঁটা পর্যন্ত স্থান পেতো না। গবেষণায় জানা যায় ফরাসি-বিপ্লবের পটভূমিতে
ফ্রান্সের নানা স্থানের প্রায় ১৪০ জন বিশপের সবাই ছিলেন অভিজাত। তাদের হাতে থাকা গির্জার প্রায় সকল
সম্পত্তি আস্তে আস্তে তাদের বিলাস ব্যসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। রাজপ্রাসাদের দরবারি অভিজাতদের মতো
উর্ধতন যাজকগণও মদ্যমান, নারীসঙ্গ, জুয়া খেলা থেকে শুরু করে বিবিধ অপকর্ম করে ভার্সাই নগরীতে উচ্ছৃঙ্খল
জীবন-যাপন করতেন। অধস্তন যাজকদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তাদেরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে
নানারকম কর্মকাÐে ব্যস্ত রাখা হতো। তবে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত এই অধস্তন যাজকরা আস্তে আস্তে উর্ধ্বতন
যাজকদের অপকর্ম সম্পর্কে জেনে গিয়ে তাদের বিরুদ্দে সোচ্চার হয়েছিলেন। এদের কাউকে নাস্তিক কিংবা
ধর্মদ্রোহী বলে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চললেও মূল সত্য শেষ পর্যন্ত অজানা থাকেনি।
ধীরে ধীরে ফ্রান্সের মানুষ গির্জা ও বিশপদের এই ধর্মভিত্তিক ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলো। তবে
বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন অধস্তন ও উর্ধ্বতন যাজকদের এই বিবাদ ফরাসি বিপ্লবকে প্ররোচিত করেছিলো।
২. অভিজাত শ্রেণি: ফরাসি সমাজের স্তর বিন্যাসে যাজক শ্রেণির পরেই অবস্থান ছিলো অভিজাতদের। তারা কর না
দিয়েও বেশিরভাগ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করতো। চার্চ ও যাজকদের সাথে ভালো
সম্পর্ক রাখায় ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তারা অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে তাদের সংখ্যা
মাত্র তিন লক্ষাধিক হলেও এই নগন্য সংখ্যা নিয়ে তারা পুরো সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো। রাষ্ট্রের
সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও তারা ছিলো প্রতিটি নাগরিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত। পাশাপাশি রাজ দরবারের
অভিজাতগণ নানা ধরনের বৃত্তি, ভাতা ও অনুদান লাভ করতো যা ছিলো অবাস্তব ও অনৈতিক। এই সময় ফ্রান্সের
প্রশাসন ও বিচার বিভাগের স¤প্রসারণে আরেক শ্রেণির পোশাকী অভিজাত শ্রেণি উৎপত্তি লাভ করে। এদের
বেশিরভাগের শিকড়ই উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রোথিত ছিলো। ফ্রান্সের নানা স্থানে অনুৎপাদনমুখী অবস্থা আর
মঙ্গার প্রভাবে আর্থিক সংকটে পড়েন অভিজাতরাও। সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ শোষণ করেই তারা দিনাতিপাত
করতেন। তবে সেই নিম্নশ্রেণিই যেখানে খাদ্যাভাবে ধুঁকছে তাদের অবস্থা খারাপ হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক। এর
পরেও অনেক অভিজাত গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। সময়ের আবর্তে
তারা সামাজিক মানুষের শত্রæ এক প্রতিক্রিয়াশীল জাতিতে পরিণত হয়। তাদের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তশ্রেণি
ধীরে ধীরে সংঘটিত হতে থাকে। অভিজাতদের অযৌক্তিক সুবিধালাভ, অনর্থক অত্যাচার নিপীড়ন আর ভোগবিলাস দেখে সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শ্রেণি সংঘাত স্পষ্ট করে। এই সংঘাত শেষ পর্যন্ত
ফরাসি বিপ্লবের বিস্ফোরণে রূপ নেয়।
৩. মধ্যবিত্ত শ্রেণি: যাজক স¤প্রদায় আর অভিজাতদের পরে সমাজে অবস্থান ছিলো মধ্যবিত্তদের। তারা কোনো
কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সুযোগ সুবিধা লাভ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বও পালন করতো। বিশেষ করে
অনেক সরকারী চাকুরে, গ্রামীণ কৃষক, বণিক,পুঁজিপতি, শিল্পপতি, আইনজীবি, চিকিৎসক ও শিক্ষক শ্রেণির মানুষ
এর আওতায় পড়তেন। এদের বেশিরভাগ শহরবাসী হলেও গ্রামের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। বিশেষ করে
মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষ যারা শহরে বাস করতেন তাদের বেশিরভাগ আত্মীয় স্বজন বাস করতেন গ্রামে। ইংল্যান্ডের
শিল্প বিপ্লবের পর বুর্জোয়া শ্রেণি যে ধরনের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছিলৈা ফ্রান্সের অবস্থা তেমনটি
ছিলো না। তবুও গ্রামবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে তারা ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে মূল কার্যকর ভূমিকা
পালন করে। ফ্রান্সে সামন্ত প্রথার সুবাদে মধ্যবিত্তশ্রেণি সেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তবে সংখ্যায় কম
হলেও শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে এই শ্রেণি সব সময় অভিজাতদের থেকে একধাপ এগিয়ে
ছিলো। বিশেষ করে বিদ্যা-বুদ্ধি ও জাতীয়তাবাদী চেতনা এদের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিলো যা তাদের অভিজাতদের
থেকে পৃথক করেছিলো। নিম্নশ্রেণির মতো রাষ্ট্রের রাজস্ব ও ব্যয়ভার বহন করেও তারা অনেক ক্ষেত্রে বিশেষত
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবহেলিত ছিলো। এই ধরণের বৈষম্যের নীতি
মধ্যবিত্তশ্রেণিকে প্রথম দুইটি শ্রেণির ঘোর বিরোধী ও প্রতিবাদী করে তোলে। পাশাপাশি শিক্ষিত হওয়ায় অনেক
দার্শনিকের নীতিগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ হয়েছিলো তাদের। তারা জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়ে
কখনোই পূর্বতন কুসংস্কারে পাশাপাশি ধর্মের দোহাই দিয়ে চার্চের অপকর্মগুলো মেনে নিতে নারাজ ছিলো। তাই
সমাজ ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগী হয়ে তারাই ফরাসি বিপ্লবের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলো।
৪. কৃষক ও শ্রমিক: অভিজাত ও যাজকদের অত্যাচার ও নানামুখী শর্তের মধ্যে বাস করতে গিয়ে যেমন মধ্যবিত্ত
শ্রেণি অনেক যন্ত্রণার শিকার হয়েছে সেই তুলনায় কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থা ছিলো শোচনীয়। অভিজাতদের
শোষণ আর চার্চের নানামুখী বিধিনিষেধের মধ্যে বাস করা এই কৃষক-শ্রমিক অনেকটা ছিল জীবন্মৃত। রাষ্ট্রের
সকল ব্যয়ভার নানামুখী করের মাধ্যমে তারা বহন করলেও এর বিনিময়ে তাদের মিলতো নানামুখী অবহেলা,
অত্যাচার ও নির্যাতন। অত্যাচারী সামন্ত প্রভুর শোষন আর আর চার্চের বিশপের আজগুবি নানা নিয়মের জালে
নিষ্পেষিত ছিলো তাদের প্রতিটি দিন। অভুক্ত অবস্থায় বেশিরভাগ সময় খুব ভোরে ক্ষেত-খামার কিংবা কারখানায়
কাজ শুরু করে যারা প্রতিদিনের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সচল করতো সন্ধার পর তারা হারিয়ে যেতো ফ্রান্সের হিসেবের
খাতা থেকে। নৈশ ক্লাবের হৈ-হুল্লোড় কিংবা ফরাসি অভিজাতদের আলোচনার টেবিল কোথাও স্থান হতোনা এই
হতভাগ্যদের। তাদের জন্মই ছিলো একটি মূর্তিমান অভিশাপ যা খÐাতে আজীবন নিঃস্বার্থ শ্রম দিয়ে যেতে হতো।
এই দুঃখ দুর্দশা ও অত্যাচারের মুখেও ধীরে ধীরে কৃষক-শ্রমিকের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে আরো বেড়ে যায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল উৎপাদিত না হলেও কৃষকদের উপর থেকে করের ভার হালকা করা হয়নি বরং চলেছে
নানামুখী নিপীড়ন-নির্যাতন। ধীরে ধীরে সংখ্যায় বেড়ে যাওয়া কৃষকশ্রেণি তাদের আহারের সংস্থান করতে না
পেরে বিদ্রোহের পথ খুঁজে নিয়েছে। তারা দেখিয়ে দেয় অসহায় নিরীহ এই মানুষগুলো কোদাল-লাঙল দিয়ে মাঠে
ঘাম ঝরিয়ে কাজ করতেই শুধু জানে না, প্রয়োজনে অত্যাচারী শোষকদের রক্তও ঝরাতে পারে। তাদের প্রতিবাদে
ধ্বনিত হয় অনর্থক কর প্রদানের দিন শেষ, ধর্মের নামে গির্জার জমিতে বেগার শ্রম দেয়ার দিন শেষ। পুরো ফ্রান্স
জেগেছে অভিজাততান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সময় হয়েছে বিপ্লবের।
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র