মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের কারণ সম্পর্কে হিজরতের ঘটনাবলী ও ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারবে

মুখ্য শব্দ হিজরত, আকাবার শপথ, দারুন নাদওয়া, ‘সওর’ পাহাড়, সুরাকা ইবনে মালেক, সহল ও সুহাইল

মদীনাবাসীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন কুরাইশদের নিকট ইসলামপ্রচার করে নিরাশ হলেন তখন তিনি আরবের অন্যান্য
গোত্রের লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। হজ্জের সময় আরবের বিভিন্ন গোত্র হতে মক্কায় হজ্জের
উদ্দেশ্যে এবং বাণিজ্যের জন্যে যারা আসত তিনি তাদের কাছে গমন করে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। সে সময় মদিনায়
আরবের দুটি বিখ্যাত গোত্র আউস ও খাজরাজ বসবাস করতো। তাদের আদিবাস ছিল ইয়েমেনে। আউস ও খাযরাজ
গোত্রের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা শেষ নবীর আগমনের কথা জানত এবং তাদের
মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তারা একজন নেতাও সন্ধান করছিল। তারা মদিনার ইহুদিদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে, শেষ নবীর আবির্ভাবের সময় সমাগত।
বাইয়াতে আকাবা
আকাবার শপথ বা বাইয়াতে আকাবা ইসলামের ইতিহাসে তথা ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা। রাসূল (সা.)
এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা যখন বিরূপ, অধিকাংশ কুরাইশ যখন তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ, সহযোগিতার সকল পথ রুদ্ধ, ঠিক তখন
বাইয়াতে আকাবার সূত্র ধরে রাসূল (সা.) ইসলাম প্রচারের এক অনুকূল পরিবেশ খুঁজে পেলেন। মক্কার অদূরে আকাবা
নামক উপত্যকায় এ শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এজন্যে একে ‘আকাবার শপথ’ বলে।
১. নবুয়তের দশম বর্ষে হজ্জের দিনগুলোতে মক্কা থেকে একটু দূরে আকাবা নামক স্থানে (বর্তমানে যেখানে ‘মসজিদে
আকাবা’ অবস্থিত) ছয় জন লোক বসে কথাবার্তা বলছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে জানতে
পারলেন, তারা ইয়াসরিববাসী (মদিনা) খাযরাজ বংশীয় লোক। হজ্জের মৌসুমে তারা মক্কায় এসে শুনতে পেল, মুহাম্মদ
নামে এক কুরাইশ নবুয়তপ্রাপ্ত হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের ইসলামের শিক্ষা ও সত্যতার কথা বুঝিয়ে দিলেন।
অবশেষে কুরআনের কতকগুলো আয়াত পাঠ করে তাদের আল্লাহর দিকে আহবান করেন। তখন তারা একে অন্যের দিকে
তাকায় আর বলে, দেখ, ইহুদিরা যেন আমাদের আগেই ইসলাম গ্রহণের মর্যাদায় অভিষিক্ত না হয়। একথা বলে তারা
ইসলাম গ্রহণ করে। এটাই আকাবার প্রথম বায়াত বা শপথ।
২. নবুয়তের একাদশ বর্ষে হজ্জের সময় মদিনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের বারো জন লোক মহানবী (সা.) এর সাথে
সাক্ষাৎ করে ইসলামের বায়াত গ্রহণ করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার সময় তাঁদের আবেদন অনুযায়ী দ্বীনি আহকাম শিক্ষা
দেয়ার জন্য মহানবী (সা.) আমর ইবনে মাকতুম এবং মুসয়াব (রা:) কে তাদের সাথে প্রেরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে
একে দ্বিতীয় বায়াতে আকাবা বা আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়।
৩. প্রথম ও দ্বিতীয় বায়াতে আকাবায় যেসব মুমিন শপথ নিয়ে মদীনায় গিয়ে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন,
মুসয়াব (রা:) তাঁদের নেতা ছিলেন। সে বছর মুসয়াব (রা:) এর হাতে বহু লোক মুসলমান হন। তাঁদের মধ্যে ওসায়েদ
ইবনে হোযায়ের এবং সাদ ইবনে মুয়াযও ছিলেন। এ দু’ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের কারণে বনী আব্দুল আশহালের (আমর
ইবনে সাবিত ছাড়া) সকল নরনারী মুসলমান হয়ে গেলেন। এভাবে মদীনায় দ্রæতগতিতে ইসলাম বিস্তৃত হতে থাকে। সে
বছর মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুখ্যাতি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে। নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষে হজ্জ কাফেলা বর্ধিত হারে
মক্কাভিমুখে রওয়ানা করেছিল। এহজ্জ কাফিলায় আনসার মুসলিম এবং কাফিরদের বিরাট দল অংশগ্রহণ করে। এবার ৭৩
পাঠ-৩.৬
ওপেন স্কুল ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ১ম পত্র
ইউনিট তিন পৃষ্ঠা-৬৯
জন নারী পুরুষ মক্কায় এসে এক সাথে মহানবী (সা.) এর হাতে আকাবা নামক স্থানে তৃতীয়বারের মতো ওয়াদাবদ্ধ হয়ে
নিম্নোক্ত বিষয়ে শপথ গ্রহণ করে:
১. আমরা এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করব, তাঁকে ব্যতীত আর কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে আল্লাহ বলে স্বীকার করব
না, কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করব না।
২. আমরা চুরি, ডাকাতি করব না।
৩. আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হব না।
৪. কোনো অবস্থায়ই আমরা সন্তান হত্যা বা বলিদান করব না।
৫. আমরা কারো প্রতি মিথ্যারোপ করব না, কারে প্রতি অপবাদ আরোপ করব না।
৬. আমরা প্রত্যেক সৎকর্মে আল্লাহর রাসূলের অনুগত থাকব, কোনো ন্যায় কাজে তাঁর অবাধ্য হব না।
আকাবার শপথের গুরুত্ব
রাসূলের জীবনের একমাত্র মিশন ছিল ইসলামকে বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা
করার ভিত মূলত রচিত হয়েছিল আকাবার শপথের মধ্য দিয়ে। নিম্নে এর গুরুত্বের কিছু দিক তুলে ধরা হলোক. আকাবার শপথের প্রেক্ষিতে রাসূল (সা.) মদিনায় ইসলাম প্রচারক প্রেরণ করেন। রাসূল (সা.) এর পাঠানো প্রতিনিধির
ভূমিকায় মদিনায় ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে।
খ. মক্কার নির্যাতিত মুসলিম সমাজের জন্য নিরাপদ একটি আশ্রয় গড়ে ওঠে। আকাবার শপথের মাধ্যমে মদিনাবাসীরা
মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। ফলে নির্যাতনের সম্মুখীন মুসলমানরা নিরাপদ আশ্রয়স্থল রূপে
মদিনাকে গ্রহণ করে।
গ. নবুয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ (সা.) নিরাপদে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পাননি। আকাবার শপথের মাধ্যমে নিরাপদে
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। মদিনাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী সময়ে ইসলাম বিশ্বব্যাপী স¤প্রসারিত হওয়ার
সুযোগ লাভ করেছিল।
ঘ. আকাবা ছিল রাসূল (সা.) কর্তৃক মদিনায় হিজরতের ভূমিকা স্বরূপ। এ শপথে অংশগ্রহণকারী রাসূল (সা.) কে মদিনায়
আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁর সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এদিকে মক্কাবাসীদের নির্যাতন বৃদ্ধি পেলে রাসূল
(সা.) মদিনাবাসীদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে হিজরত করেন।
কুরাইশদের ষড়যন্ত্র সভা : মক্কার কাফিররা মুসলমানদের সার্বিক বিরোধিতা ও ক্ষতি সাধনের নিমিত্তে সুচিন্তিত ব্যবস্থা করে
রেখেছিল। কাফিররা যখন দেখল, মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীরা নিজ নিজ ধন সম্পদ, যুদ্ধসম্ভার, সন্তান সন্তুতি নিয়ে
মদীনায় চলে যাচ্ছে, তাদের সাথে মদিনার প্রভাবশালী আওস ও খাযরাজ গ্রোত্র রয়েছে, তখন তাদের মনে ভবিষ্যতের জন্য
ভীতির সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য কুরাইশ অকুরাইশ সকল গ্রোত্রের লোকদের এক সভায় আমন্ত্রণ করা
হয়েছিল। একমাত্র কুরাইশদের আবদে মানাফ [রাসূলুল্লাহ (সা.) এর] বংশকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। কুরাইশদের এ
ষড়যন্ত্রের কথা কুরআনে উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে- হে মুহাম্মদ (সা.), সে ঘোর বিপদের কথা স্মরণ কর, যখন কাফিররা
তোমাকে বন্দি করে রাখবে, হত্যা করবে কিংবা তোমাকে (দেশ থেকে) বের করে দেবে- এ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল
(আনফাল, রুকু ৪)
তখন আবু জাহল প্রস্তাব করল, আমার মতে তাকে অবিলম্বে হত্যা করে ফেলাই দরকার, তবে একা একজনকে হত্যা করলে
মুত্তালিব ও হাশিম (আবদে মানাফ) বংশের লোকেরা হত্যাকারী বা তার গোত্রের ওপর চড়াও হয়ে প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ
নাশ করার জেদ ধরবে। সেজন্য আমার মত হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন যুবক তরবারি নিয়ে
মুহাম্মদকে অনুসরণ করুক এবং সুযোগ পেলে একসঙ্গে আঘাত করে হত্যা করে ফেলুক। এ অবস্থায় আমাদের মধ্যে
কোনো গোত্রই দল ছাড়া হতে পারবে না। পক্ষান্তরে, মুহাম্মদের গোত্র আমাদের সকলের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না।
শোণিতপণ (দিয়াত) যদি দিতেই হয়, তবে আমরা ভাগ-বাটোয়ারা করে দেব। এ প্রস্তাবই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্র
রাসূল (সা.) তাদের এ ষড়যন্ত্র জানতে পেরে আল্লাহর নির্দেশে আবু বকর (রা:) কে সাথে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা
হলেন। যে রাতে কাফিররা রাসূলের বাসভবন ঘেরাও করেছিল, সে রাতেই তাদের অলক্ষে নিজের বিছানায় হযরত আলী
(রা:) কে শুইয়ে রেখে বের হয়ে পড়েন। মক্কা হতে মদিনার দূরত্ব ছিল প্রায় ২০০ মাইল। রাসূল (সা.) ঐ রাতেই বেশি
দূর যাওয়া নিরাপদ মনে করলেন না, তাই তারা তিন দিন তিন রাত মক্কার অদূরে ‘সওর’ নামক পাহাড়ের একটি নির্জন
গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। আবু জাহলের নেতৃত্বে আক্রমণকারীরা হযরতকে গৃহে না পেয়ে তাঁর পেছনে ছুটলেন।
কিন্তু তারা কোথাও তাঁকে পেলেন না। হযরত তিন দিন উক্ত গুহায় অবস্থানের পর চতুর্থ দিনে সেখান থেকে বের হয়ে
কাফিরদের গতিবিধি লক্ষ্য রেখে অতি সাবধানে ভিন্ন পথে মদিনার দিকে চলতে থাকেন।
যাত্রাপথে প্রিয় জন্মভূমির পানে তাকিয়ে অশ্রæসজল নয়নে গভীর মমতায় তিনি বললেন, ‘মক্কা! আমার প্রিয় জন্মভূমি মক্কা!
আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু তোমার সন্তানগণ আমাকে তোমার কোলে থাকতে দিল না। বাধ্য হয়ে তোমায় ছেড়ে
চললাম। বিদায়!” এদিকে কুরাইশরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে না পেয়ে ঘোষণা দিল, ‘মুহাম্মদ বা আবু বকরকে যে ব্যক্তি
বন্দি করে আনতে পারবে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে।” পুরস্কারের আশায় তাঁদেরকে ধরার জন্য অনেকেই
তাঁদের পেছনে ছুটল। হযরত পথের মধ্যে বেশ কয়েকজনের থেকে বড় ধরনের বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু
আল্লাহর অনুগ্রহে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাঁরা ৬২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (১২ রবিউল আউয়াল) সোমবার
মদিনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে এসে পৌঁছেন। এর তিন দিনের মধ্যেই হযরত আলী (রা:) ও কুবায় এসে তাঁদের সাথে
মিলিত হন। হযরত কুবায় ৪দিন অবস্থান করেন। তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নবুওয়াতের পর রাসূলের
হাতে নির্মিত এটাই প্রথম মসজিদ। তিন দিন পর শুক্রবার মদিনায় গিয়ে উপস্থিত হন। মদিনাবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা
তাঁকে বিপুল উৎসাহে সাদরে গ্রহণ করেন।
মদিনায় নানা গোত্র নানা দল। সবাই প্রিয়নবীকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করে সৌভাগ্যবান হতে চাইল। হযরত ঘোষণা
করলেন, আমার উট যেখানে গিয়ে থেমে যাবে, সেখানেই আমি অবস্থান করব। দেখা গেল রাসূলের বহনকারী কাসোয়া
নামক উটটি বনু নাজ্জার গোত্রের মহল্লায় এসে এতিম দু’সহোদর সহল ও সুহাইলের জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
হযরত জায়গাটি কিনে সেখানে মসজিদের নববী নির্মাণ করলেন। আর তৎসংলগ্ন আবু আইয়ুব আনসারীর বাসভবনে
আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। নবুওয়তের ১৩তম বছরে হিজরতের ঘটনা ঘটে। সে সময় মহানবী (সা.) এর বয়স হয়েছিল
৫৩ বছর। মক্কা থেকে মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর এ সুপরিকল্পিত প্রস্থানকে ইতিহাসে হিজরত বলা হয়। তাঁর এ
হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:) চান্দ্র বছরের প্রথম মাস
মহররমের প্রথম দিন (১৬ জুলাই) থেকে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন।
হিজরতের কারণ
আল কুরআনের বিবরণে দেখা যায় যে, বিশ্ব ইতিহাসের বেশির ভাগ নবী-রাসূলগণই নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত
হয়েছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের পথ কাঁটায় ভরা; ফুল বিছানো নয়। রজনী যতই গভীর হয়, সোনালী ঊষার আবির্ভাব
ততই নিকটবর্তী হয়। তাই আমরা দেখতে পাই, মক্কায় খোদাদ্রোহী শক্তির আঘাত যখন চরমে ওঠে তখন সত্যপন্থিরা
মাতৃভূমির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের মোড় ঘুরে
যায়। তাই ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেন- ঐরলৎধঃ রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ঃঁৎহরহম ঢ়ড়রহঃ রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ওংষধস. এ
হিজরতের মধ্য দিয়ে রাসূল (সা.) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি এ প্রসঙ্গে বলেন,
ক. মনস্তাত্তি¡ক কারণ
সর্বকালেই আম্বিয়ায়ে কিরাম, সংস্কারবাদী মনীষী ও মহামানবগণ জন্মভূমিতে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও বিরোধিতার
সম্মুখীন হয়েছেন। আল্লাহর নবী রাসূলদের ক্ষেত্রে যেমন এ রীতির ব্যতিক্রম ঘটেনি, তেমনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষেত্রেও এ রীতির ব্যতিক্রম হয়নি।
বদ্ধমূল ধারণায় আঘাত : চিরাচরিত আচার-অনুষ্ঠান, মূর্তিপুজা ও পূর্বপুরুষদের ধর্ম বর্জন করে আল্লাহর একত্ববাদের
আহবান মক্কার কাফিরদের সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আপসহীন তাওহীদের ঘোষণা জড়বাদী
কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুরাইশদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত হানে। এজন্য তাদের মন মানসিকতাই দায়ী। সর্বদা তারা
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লেগে থাকত। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর তীব্র প্রতিবাদের
কারণে কাফির কুরাইশরা তাঁর ওপর রুষ্ট ছিল।
আভিজাত্য ও অহংকার : ইসলামের সাম্য ও শান্তির বাণীতে যখন রক্ষণাশীল বিধর্মী কুরাইশদের মজ্জাগত আভিজাত্য ও
কৌলীন্য প্রথা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবার উপক্রম হয়, তখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা করেন,
‘বংশ, জন্মে বা পৌরোহিত্যের জন্য মানষ কোনো বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারে না।’ এ ঘোষণা কুরাইশদের কৌলীন্য
প্রথার ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে কুরাইশরা ইসলাম ও ইসলামের বাণীবাহক রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নির্মূল করার জন্য ষড়যন্ত্র
শুরু করে।
স্বার্থবাদী সংঘাত : কুরাইশদের ইসলাম ও ইসলামের নবীকে মেনে না নেয়ার আরো একটি প্রকট কারণ ছিলো, ইসলাম
নির্মল, নিষ্কলুষ, সরল ও জীবনযাপনের প্রেরণা যোগায়। আর ইসলামের সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনের আহবান মক্কার
রুক্ষ এবং মরুর দুরন্ত সন্তানদের পাশবিক লালসা, পাপাচার, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, কুসীদ প্রথা, মদ্যপান, জুয়াখেলা,
নরবলি প্রভৃতির মূলে কুঠারাঘাত করে। এতে তারা ইসলাম, ইসলামের নবী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম হিংস্র রূপ ধারণ
করে। হিজরতের পেছনে এটাও একটা শক্তিশালী কারণ।
আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের আমন্ত্রণ : মহানবীর আগমনের পূর্ব সময়ে মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় জঘন্য
অর্šÍদ্ব›েদ্ব লিপ্ত ছিল। এ স¤প্রদায়দ্বয়ের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী ‘বুয়াস যুদ্ধ’ কয়েক যুগ ধরে চলছিল তাতে কোনো স¤প্রদায়ই
লাভবান হয়নি। এ অবস্থায় কলহরত আওস ও খাযরাজ স¤প্রদায়ের মধ্যে মধ্যস্থতা এবং শান্তি স্থাপন করতে মদিনার
বাসিন্দারা একজন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকের অনুসন্ধান করছিল। তাই তারা রাসূল (সা.)-কে নিজেদের কাক্সিক্ষত
গুণাবলিসম্পন্ন বলে জানতে পেয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়।
রক্তের টান : মাতৃকুল ও পিতৃকুল উভয় দিক দিয়েই মদিনাবাসীগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সহৃদয় ও আন্তরিক ছিল।
তাই মেহমান হয়ে সেখানে গিয়ে দাওয়াতী কার্যক্রম চালানো সকল দিক দিয়ে সুবিধাজনক হবে ভেবে রাসূল (সা.) তথায় হিজরত করেন।
মুসয়াবের দাওয়াতী কার্যক্রম : ইসলামের দাওয়াত দানের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের এক বছর পূর্বে হযরত
মুসয়াবকে ইয়াসরিবে প্রেরণ করেছিলেন। মুসয়াবের প্রচারণায় নবী করীম (সা.) সম্পর্কে তথাকার অধিবাসীদের ভালো
ধারণা জন্মে। তিনি গেলে ইসলামের প্রচারকার্য আরো বেশি হবে ভেবে তিনি মদিনা যেতে আগ্রহী হন।
খ. বাহ্যিক কারণ : হিজরতের কিছু বাহ্যিক কারণও ছিল, তা নিম্নরূপকুরাইশদের অত্যচার : আবু তালিব ও খাদিজা (রা:)-এর মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলামের সুমহান আদর্শের
একান্ত অনুসারীদেরকে পূর্বেই কুরাইশদের অনেক অত্যাচার উৎপীড়ন ভোগ করতে হয়েছিল। এ অত্যাচারের ফলে তিনি
সাহাবায়ে কিরামসহ মদিনায় হিজরতে বাধ্য হয়েছিলেন।
হত্যার ষড়যন্ত্র : কুরাইশরা ইসলামের অপ্রতিহত গতি প্রতিরোধ করতে সর্বপ্রকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হযে শেষ পর্যন্ত
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র আঁটে। আল্লাহ তায়ালা পূর্বেই রাসূল (সা.)-কে ওয়াহীর মাধ্যমে তা জানিয়ে দিলে
তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইতিহাসসিদ্ধ কারণ: বিশ্ব ইতিহাসের একটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হলো- চৎড়ঢ়যবঃং ধৎব হড়ঃ যড়হড়ঁৎবফ রহ ঃযবরৎ ড়হি ষধহফং. এ
সত্যের শিকার হয়েছিলেন হযরত মুসা, ঈসা, ইউনুস, নূহ (আ)-সহ অনেক নবী রাসূল। সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ
(সা.)-ও একই পরিণতির শিকার হয়ে তাঁর দেশবাসী আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। এ কারণে
তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বাণিজ্যিক কারণ : মক্কার মুসলিম ব্যবসায়ীরা মদিনার নিরাপদ অবস্থান থেকে সিরিয়ার সাথে অবাধ বাণিজ্য করে জীবিকা
অর্জনে সক্ষম হবে, তাদের পরনির্ভর জীবন যাপন করতে হবে না, হিজরতের পেছনে এটাও অন্যতম কারণ।
আকাবার শপথ : ৬২০ এবং ৬২১ খ্রিস্টাব্দে আকাবার শপথের ফলে বহু মদিনাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। এতে মদিনায়
ইসলামের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সেখানে হিজরতের আমন্ত্রণ জানায়।
মক্কার প্রতিকূল জনমত : মহানবী (সা.) যে মিশন নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, তার জন্য প্রয়োজন ছিল একদল
যোগ্য লোকের, নিজের মিশন সফল করতে তিনি যাদের আনুকূল্য লাভ করবেন, কিন্তু মক্কায় আশানুরূপ এ ধরণের লোক
তৈরি না হওয়ায় জনমত প্রতিকূলে প্রবাহিত হতে থাকে। এ কারণে তিনি মদিনায় হিজরতের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
হিজরতের ঘটনা
নির্দেশপ্রাপ্তি : হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে হিজরতের আদেশ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করেন। হিজরতের
আদেশ পৌঁছানোর সময় জিবরাঈল (আ) বললেন, আজ রাতে আপনি শয্যায় যাবেন না। তিনি ঠিক দুপুরে সিদ্দীকে
আকবর (রা:)-কে হিজরতের সংবাদ দেন। রাতে আবু জাহল প্রমুখ কুরাইশ দুর্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁর গৃহ বেষ্ট করে
দাঁড়ায়। তিনি হযরত আলীকে নিজের বিছানায় চাদরে ঢেকে শুইয়ে দিয়ে কুরআনের একটি আয়াত- তেলাওয়াত করতে
করতে বের হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে কাফিরদের ওপর এক মুষ্টি মাটি ছিটিয়ে দিয়ে সকলের
অলক্ষ্যে আবু বকর (রা:)-এর গৃহে চলে যান এবং তাঁকে নিয়ে মক্কার তিন মাইল দূরবর্তী সওর পর্বত গুহায় সাময়িক
অবস্থান গ্রহণ করেন। যাওয়ার সময় হযরত আবু বকর (রা:)-এর পুত্র আবদুল্লাহ, কন্যা আসমা ও আয়িশাকে বলে গেলেন,
তারা যেন প্রতিদিন সন্ধ্যারাতে চুপি চুপি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেয়। মহানবী (সা.) তিন দিন সওর গুহায় অবস্থান
করেন। গুহার মুখে তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর নির্দেশে মাকড়সা জাল বুনে, পাখি বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। কাফিররা
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসন্ধানে গুহার মুখ পর্যন্ত এসে পুরনো গুহা মনে করে ফিরে যায়।
পুরস্কার ঘোষণা : কুরাইশ বীরেরা দিগি¦দিক ছুটোছুটি করে মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসন্ধানে হন্তদন্ত হয়ে ফিরতে লাগল।
কুরাইশ নেতারা ঘোষণা করল, মুহাম্মদ অথবা আবু বকরকে যে ব্যক্তি বন্দি করে আনতে পারবে তাকে একশত উট
পুরস্কার দেয়া হবে। মুদলেজ গোত্রের সুরাকা ইবনে মালেক নামক এক অশ্বারোহী যুবক রাসূলুল্লাহ (সা.) (সা.)-এর সন্ধান
পেয়ে সদলবলে আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়, কিন্তু কী আশ্চর্য! সুরাকা যখনই নিকটবর্তী হয়েছে, অমনি তার অশ্বের সম্মুখ
পদদ্বয় ধূলিগর্ভে প্রোথিত হয়ে যায়। সে ভীত হয়ে পড়ে। অবশেষে ক্ষমা প্রার্থনা করে ওয়াদা করে, সে আর রাসূলের পিছু
ধাওয়া করবে না। সে তিনবার চূড়ান্ত চেষ্টা চালিয়েও রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে স্পর্শ করতে পারেনি।
সাদর অভ্যর্থনা : রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় শুভাগমন করছেন, পূর্বাহ্নে এ সংবাদ পেয়ে মদিনাবাসী প্রতিদিন প্রত্যুষে ওঠে
নগর প্রান্তরে এসে সূর্যের কিরণ প্রখর না হওয়া পর্যন্ত আশা-আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত চিত্তে মহানবী (সা.)-এর আগমন
প্রতীক্ষায় বসে থাকতেন। অন্যদিনের ন্যায় রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখের প্রতীক্ষার পর ঘরে ফিরছিলেন। এমন
সময় জনৈক ইহুদি দুর্গের ওপর থেকে দেখতে পেল এক ছোট্ট কাফিলা মদিনা পানে অগ্রসর হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি রইল
না। তৎক্ষণাৎ সে উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে ওঠে, মদিনাবাসী মুসলিমরা প্রস্তুত হও, তোমাদের নবী আসছেন। ইতোমধ্যে
আমর ইবনে আওফ উচ্চঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি দেন। সাথে সাথে সবাই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে লাগল। সে
তাকবীরের আওয়াযে গোটা শহর মুখরিত হয়ে ওঠে এবং আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সবাই অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হয়ে
বিনয় সহকারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়।
মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন : মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে যে উঁচু বসতি রয়েছে তাকে ‘আলিয়া’ বা কুবা বলা হয়।
এখানে আনসারদের বহু পরিবার বসবাস করতো। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেখানকার আমর ইবনে আওফ গোত্রের কুলসুম ইবনে
হেদাম-এর ঘরে ১৪ দিন অবস্থান করেন এবং এখানে ইসলামের প্রথম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
মদিনাভিমুখে যাত্রা : ইবনে আওফ গোত্রের কুলসুম ইবনে হিদামের ঘরে ৪৪ দিন অবস্থানের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)
মদিনাভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় কাসওয়া নামক উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। সে দিন ছিল শুক্রবার। পশ্চাতে ছিলেন
আবু বকর (রা:)। উট সামনে এগিয়ে চলতে লাগল, ভক্তবৃন্দ তাঁর পশ্চাতে শ্রেণিবদ্ধভাবে নারায়ে তাকবীর ‘আল্লাহু
আকবার’ ধ্বনিতে মিছিল সহকারে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলেন। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত
হচ্ছিল। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে তিনি বনী সালিম গোত্রের মহল্লায় উপনীত হন। এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) একশ জন সাহাবী
নিয়ে জুমুআর সালাত আদায় করেন। এটাই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমুআর সালাত।
হিজরতের সন-তারিখ : নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে হিজরত সংঘটিত হয়। সে সময় মহনবী (সা.)-এর বয়স ৫৩ বছর।
সফল মাসের শেষে রবিউল আউয়ালের প্রথম দিকে সোমবার দিন তিনি মক্কা ত্যাগ করেন। সোমবার অথবা শুক্রবার ১২
রবিউল আউয়াল তিনি কুবায় পৌঁছান। সেখানে ৪ দিন অবস্থানের পর শুক্রবার মদিনা শহরের দিকে যাত্রা করেন। সে
দিনই বিকেলে আবু আইউব আনসারী (রা:)-এর গৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন।
হিজরতের গুরুত্ব ও ফলাফল
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরত বা মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমন একটি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হলেও ইসলামের ইতিহাসে
এর গুরুত্ব অতুলনীয়। পি কে হিট্টির ভাষ্যমতে, হিজরতের মাধ্যমে মক্কী জীবনের অবসান এবং মাদানী জীবনের সূচনা হয়।
ধর্মীয় গুরুত্ব : হিজরতের মাধ্যমে মদিনায় ইসলাম একটি সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে সংখ্যারিষ্ঠের জীবনব্যবস্থায় এবং
মদিনা মুসলমানাদের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। এ মদিনা নগরী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ও খুলাফায়ে
রাশিদার আমলে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় রাজধানী ছিল। এখানে এসে মহানবী (সা.) শুধু সম্মানিত মেহমানরুপেই
সম্বর্ধিত হননি; বরং কালক্রমে তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্রেরও প্রধান হলেন। মদিনায় ইসলাম দিন দিন শক্তিশালী হতে
লাগল। এতদিন পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাধনা স্বার্থকতায় রুপ নেয়।
রাজনৈতিক গুরুত্ব : মদিনায় হিজরতের পর ক্রমান্বয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন বাস্তববাদী বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে
পরিচিত হয়ে ওঠেন। হিজরতের মাধ্যমে মদিনায় রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি হয়। ফলে সেখানে যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় তা
ভবিষ্যত বৃহত্তর ইসলামী সমাজ গঠনে সহায়ক হয়। এ সম্বন্ধে পি কে হিট্টি বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দর্শন তাঁর
জীবনের পটভূমিকায় স্থিতি লাভ করল, আর জেগে উঠল রাজনীতির বাস্তব জীবন।” ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন,
হিজরতের মাধ্যমে মহানবী (সা.) আল্লাহর আদেশ পালন করেছেন।
সামাজিক গুরুত্ব : মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিপুল কৃতিত্ব অর্জন করেন। সর্বপ্রকার
সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করে তিনি দাস প্রথা লোপ, বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকার আইন প্রভৃতি সামাজিক আইনকানুন প্রবর্তন করেন। তিনি একটি নতুন সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং পারিাবারিক সংগঠন নির্মাণ করেন, যা পূর্বের
সকল বিধান ও সমাজ সংগঠন অপেক্ষা উন্নততর ছিল। হিজরতের মাধ্যমেই রাসূল (সা.) রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজ সংস্কারক
হিসেবে সুপরিচিত হন এবং সমাজের সকল স্তরে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলঙ্কৃত করেন।
যুগান্তকারী ঘটনা : মদিনায় হিজরত মহানবী (সা.)-এর জীবনের এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এর
ফলে তাঁর সাফল্য ও বিজয়ের নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন-
হিজরতের পর পরই মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় মুসলিমদের মিলনকেন্দ্র মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসলাম প্রচারে সুযোগ-সুবিধা লাভ : মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কাবাসীদের অবর্ণনীয় জোর-জুলুম সহ্য
করেছিলেন, কিন্তু হিজররেত ফলে তিনি তাদের নাগালের বাইরে এসে স্বাধীনভাবে ইসলাম প্রচার করার সুযোগ লাভ
করেন। এখানে তাঁর নিজের এমনকি অনুসারীদেরও নিরাপত্তার কোনোই চিন্তা ছিল না। তাই তিনি নিশ্চিন্তে ইসলামের প্রচার চালিয়ে যেতে লাগলেন।
রাষ্ট্র সংগঠন : মদিনায় মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম গোত্রীয় কলহ ও সর্বপ্রকার দ্ব›েদ্বর অবসান ঘটিয়ে সব গোত্রের মধ্যে একতা
স্থাপন করতে একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। কালক্রমে একে কেন্দ্র করেই বিশ্বজোড়া ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) নবপ্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান মনোনীত হন।
সনদ প্রবর্তন : মদিনায় হিজরত করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝলেন, মদিনার বিভিন্ন স¤প্রদায়ের লোকদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ
করতে না পারলে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। তাই তিনি একটি বিধিবদ্ধ সনদ প্রবর্তন করেন। এ সনদে প্রত্যেক স¤প্রদায়ের
সযোগ-সুবিধা ও স্বার্থ নিশ্চিত করা হয়। ইতিহাসে এটি মদিনা সনদ নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে সমাদৃত।
কলহের অবসান : মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনার বিবদমান সকল গোত্রের দ্ব›দ্বকলহের অবসান ঘটে। মহানবী
(সা.)-এর নেতৃত্বে আওস ও খাযরাজসহ সকল গোত্র কলহবিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলাম : মদিনায় হিজরতের ফলে ইসলাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। দূত মারফত বিশ্বের
বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত প্রচারের সুযোগ লাভ করেন।
হিজরী সন প্রবর্তন : হিজরতকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে হযরত ওমর (রা:) এর শাসনামলে হিজরী সনের প্রবর্তন করা
হয় যা হিজরতের ঘটনার স্মারক হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানব জাতিকে আল্লাহর নির্দেশ পালনে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত করবে।
হিজরত শব্দের অথ র্কী?
হিজরতের সময় মহানবী (সা.)এর সফরসঙ্গী কে ছিলেন?
হিজরতের সাথে কোন গুহার নাম সম্পর্কিত?
হিজরতকে কেন্দ্র করে কোন সালের উদ্ভব হয় ?
সারসংক্ষেপ :
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর তাঁর নতুন জীবন শুরু হয়। তাঁর জীবনের এ
অধ্যায় খুবই ঘটনা বহুল। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে তিনি শুধু ধর্মপ্রচারকের ভূমিকায় ছিলেন। আর মদিনায় এসে তিনি
রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা লাভ করেন। ফলে ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান। ইসলামের সামাজিক ন্যায়-নীতি
প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে তিনি একাধারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণ, শিক্ষাসংস্কৃতি ও নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন। সাথে সাথে ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হন।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। মক্কার কাফিররা কার নেতৃত্বে যুবকদেরকে দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যাকারী দল গঠন করে?
(ক) আবু জাহল (খ) ওতবা
(গ) শায়বা (ঘ) আবু সুফিয়ান
২। আরবের দুটি বিখ্যাত গোত্র আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে ছিল-
(ক) বন্ধুত্ব (খ) মৈত্রীভাব
(গ) চরম শত্রæতা (ঘ) তুমুল যুদ্ধ
৩। মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে দূর হয়র. মক্কা জীবনের লাঞ্ছনা রর. অবমাননা ররর. ভয় ভীতি
নিচের কোনটি সঠিক?
(ক) র (খ) রর (গ) ররর (ঘ) র, রর ও ররর
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন
রসূলপুরের চৌধূরী ও পাটওয়ারী বংশের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ বিবাদ চলে আসছিল। বিবাদমান সিলসিলা অনুসারীদের মধ্যে
কোন্দল, রেষারেষি, উগ্রভাবাবেগে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় সুলাইমান শমসেরী উক্ত এলাকায় আগমন করে
সকল বংশ ও অনুসারীদের মধ্যে বিভেদ-কোন্দল দূর করার লক্ষ্যে একটি শান্তি চুক্তি প্রণয়ন করেন। এতে রসূলপুরে স্থায়ী
শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ক) মহানবী (সা.) কত সালে হিজরত করেন? ১
(খ) রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারের গিরি সংকটের অবসান ঘটল কিভাবে? ২
(গ) সুলাইমান সাহেবের চুক্তিনামা ইসলামের ইতিহাসের কোন ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা কর। ৩
(ঘ) শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুলাইমান শমসেরীর ভূমিকা তোমার পাঠ্যপুস্তকের আলোকে মূল্যায়ন কর। ৪
উত্তরমালা
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.১ : ১. (ক) ২. (ক) ৩. (ক)
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.২ : ১. (ক) ২. (খ) ৩. (গ)
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.৩ : ১. (গ) ২. (ক) ৩. (ঘ)
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.৪ : ১. (ক) ২. (ঘ) ৩. (ক)
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.৫ : ১. (ঘ) ২. (গ) ৩. (ঘ)
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.৬ : ১. (ক) ২. (গ) ৩. (ঘ)

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]