মুখ্য শব্দ জসরের যুদ্ধ, বুয়ায়েবের যুদ্ধ, নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ামুল আরমাছ ও ইয়ামুল উম্মদ
খিলাফত লাভের পর হযরত উমর (রা.), হযরত আবু বকর (রা.) এর ন্যায় সীমান্ত সম্প্রসারণের দিকে দৃষ্টি
নিবন্ধন করলেন। তিনি ইসলামের পতাকা, দুটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সা¤্রাজ্যের মাটিতে স্থাপন করলেন।
পারস্য বিজয় ঃ
পারস্য সা¤্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল বর্তমান ইরাক, ইরান, মেসোপটোসিয়া থেকে অক্সাস নদী (আমুদরিয়া) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই
সময় বিভিন্ন ঘটনা ও কারণ মুসলিমদেরকে পারস্য বিজয় করতে উদ্বুদ্ধ করে।
পারস্য বিজয়ের কারণসমূহ ঃ
পারস্য সা¤্রাজ্য ছিল তৎকালীন বিশ্বে এক উন্নত ও আধুনিক সভ্যতা। তারা সর্বাত্মক ভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
হয়। এই সময় পারস্য ছিল ২য় খসরুর শাসন অধীনে।
ক) মুসলিম দূতকে হত্যা ঃ মহানবী (সা.) প্রেরিত দূত খুসরু পারভেজের দরবারে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলেন,
পারস্যরাজ তাকে হত্যা করেন। এই ঘটনা ছিল নীতিবিরুদ্ধ।
খ) ভৌগোলিক অবস্থান ঃ ইরাক ও ক্যালদীয় অঞ্চল ছিলো ভৌগোলিকভাবে আরবের সীমান্তবর্তী। এই অঞ্চলে
বসবাসকারী লোকজন তাদের আরবীয় গোত্রের আত্মীয় স্বজনকে সর্বদাই ইসলামের বিরুদ্ধে কুমন্ত্রণা প্রদান করতো। এটা
ছিলো মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাই সীমান্তে নিরাপত্তা বিধান আবশ্যক ছিলো।
গ) অর্থনৈতিক কারণ ঃ পারস্য ছিল ট্রাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস (দজলা-ফোরাত) নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। এর
মেসোপটেমিয়া অঞ্চল ছিল পৃথিবীর অন্যতম উর্বর উপত্যকা। যা ছিল কৃষি ও বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। কিন্তু পারস্যবাসী
আরবদের ঐ অঞ্চলে বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে।
পারস্য বিজয়ের ঘটনাবলি ঃ
ক) ব্যবিলনের যুদ্ধ ঃ ৬৩৪ খ্রিঃ এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে খালিদ (রা.) কর্তৃক উলিসের
যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে হীরা দখলকৃত হয়। এই সময় পারস্য রাজ খসরু হরমুজের নেতৃত্বে ১০,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী
মুসান্নার বিরুদ্ধে প্রেরণ করে। মুসান্না ফোরাত নদী পার হয়ে শত্রæর বিপক্ষে ঝাপিয়ে পড়ে। শত্রæরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়।
এই যুদ্ধ ‘ব্যবিলনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
খ) নামারিকের যুদ্ধ ঃ হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত কালে মুসান্না ও খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) হীরা দখল
করেন। এটি ছিল তৎকালীন সাসানীয় সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে হীরা ছিল পারস্যবাসীদের
জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই পারস্যবাসীরা হীরা মুসলিমদের হাত থেকে উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। পারস্য স¤্রাট এই
দায়িত্ব অর্পন করেন পারস্যের কিংবদন্তী সেনাপতি রুস্তমের হাতে। মুসান্না তখন পারস্যের সীমান্তে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে
অবস্থান করছিলেন। তিনি খলীফার নিকট সাহায্য কামনা করেন। ইতিমধ্যে খলীফা হযরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল
করেন এবং হযরত উমর (রা.) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সাকীফ গোত্রের প্রধান আবু উবায়দাকে
সেনাপতি করে অতিরিক্ত সৈন্য হীরা পুনঃদখলে প্রেরণ করলেন। ৬৩৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নামারিক নামক স্থানে উভয়
পক্ষের যুদ্ধ সংগঠিত হলো। যুদ্ধে পারস্যবাসী পরাজিত হলো এবং হীরা পুনরায় মুসলিমদের অধীনে চলে এলো।
গ) জসরের যুদ্ধ ঃ নামারকের যুদ্ধে পরাজয়ের গøানি পারস্যবাসী বেশিদিন ভেঅগ করতে পারছিলো না। অপর দিকে
পারসি সেনাপতি বাহমানের নেতৃত্বে ফোরাত নদীর অপর তীরে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হলো। সেনাপতি আবু উবায়দা
অভিজ্ঞ সেনাপতি মুসান্নার আদেশ অমান্য করে নৌকা দ্বারা সেতু নির্মাণ করে নদীর অপর তীরে শত্রæর মুখোমুখি হলেন।
তাই এই যুদ্ধ জসর বা সেতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু যুদ্ধে পারস্য সেনা বাহিনীর প্রচÐ আঘাতে মুসলিম বাহিনী
কোণঠাসা হয়ে পড়লো। সেতুকে ধ্বংস করা হলো যাতে মুসলিম বাহিনী পশ্চাদপদ হতে না পারে। আবু উবায়দা যুদ্ধ
ক্ষেত্রে শহীদ হলেন। এবার মুসান্না সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।একদল অশ্বারোহী সৈন্যের সাহায্যে সেতু মেরামত
করে মুসলিম বাহিনীর নিরাপদে নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৯০০০ সৈন্যের
মধ্যে ৬০০০ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। যুদ্ধটি (ত্রয়োদশ হিজরী রমযান মাস) ৬৩৪ খ্রিঃ এর অক্টোবর মাসে
সংঘটিত হয়।
ঘ) বুয়ায়েবের যুদ্ধ ঃ জসরের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় ও প্রাণহানি খলীফা হযরত উমর (রা.) কে দুঃখ ভারাক্রান্ত
করলো। তিনি এর প্রতিকারের জন্য একদল সৈন্য পাঠান। কুফার কিছু দূরে বুয়ায়েবের নামক স্থানে উভয়পক্ষের মধ্যে
প্রচÐ যুদ্ধ হল। এই যুদ্ধে পারস্য বাহিনী পরাজিত হল। তাদের সেনাপতি ‘মাহরা’ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলো।
ঙ) কাদিসিয়ার যুদ্ধ ঃ পারসিকগণ ছিলো আত্মাভিমানী জাতি । তারা পরাজয়কে মেনে নিলো না। তারা আবারো সমর
প্রস্তুতি শুরু করে দিল। মুসান্না ততোদিনে ইন্তেকাল করেছেন। হযরত উমর (রা.) আরেক বিখ্যাত সেনাপতি সাদ-বিনআবি ওয়াক্কাস (রা.) কে সেনাপতি মনোনীত করলেন। পারসিক রাজা ইয়াজদিজার্দ সেনাপতি রুস্তমকে প্রেরণ করলেন।
প্রথমে পারসিক সেনাপতির নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়, রুস্তম অস্বীকৃত হলে উভয় পক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৬৩৫
খ্রিঃ নভেম্বর মাসে কাদেসিয়ার প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধ ৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল। এই ৩ দিন আরবদের নিকট
“ইয়াওমুল আরমাছ” (বিশৃংখলার দিন), ইয়াওমুল আগওয়াছ (সাহায্যের দিন) এবং ইয়াওমুল উম্মদ (দুর্দশার দিন) নামে
পরিচিত। রুস্তম যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলো। এতে পারস্য বাহিনী বিশৃংখল হয়ে পলায়ন শুরু করে। কাদিসিয়ার যুদ্ধ ছিল
একটি তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধ। এতে পারস্যের অহংকার ও শক্তি বহুলাংশে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
চ) মাদায়েন অধিকার ঃ মাদায়েন অর্থ দুই-শহর। এর পশ্চিম ভাগের নাম অলুকিয়া ও পূর্বভাগের নাম টেসিফোন।
কাদিসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পর সেনাপতি সাদ (রা.) খলীফার অনুমতি নিয়ে পারস্যের রাজধানী মাদায়েন অভিমুখে যাত্রা
করলেন। মার্চ, ৬৩৭ খ্রি: সাদ (রা.) মাদায়েন অধিকার করলেন এবং এখানে রাজধানী স্থাপন করেন।
ছ) জালুলার যুদ্ধ ঃ পারস্যরাজ মাদায়েন হতে প্রায় ১০০ মাইল দূরবর্তী হলওয়ালে আত্মগোপন করেন। সেনাপতি সাদ
অপর সেনাপতি কাকার নেতৃত্বে এক সেনা বাহিনী প্রেরণ করলেন। আট দিন অবরুদ্ধ থাকার পর জালুলা দুর্গের পতন
ঘটলো। এখানে একটি শক্তিশালী মুসলিম সেনা নিবাস স্থাপন করা হল। যুদ্ধের সময় ছিল ৬৩৭ খ্রি:।
জ) নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ ঃ পারস্য চূড়ান্তভাবে বিজিত হয় নিহাওয়ান্দের যুদ্ধের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে পারস্য সেনাপতি
হরমুজান মুসলিমদের হাতে বন্দী হন এবং মদীনায় গিয়ে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। অপরদিকে পারস্যবাহিনীর ক্রমাগত
উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে খলীফা তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণে আহবান জানায়। দক্ষিণ পারস্যে মুসলিমরা অগ্রসর হলে
ইয়াজদিজার্দ ১,৫০,০০০ সৈন্য সমাবেশ ঘটালেন। এর নেতৃত্বে ছিল ফিরুযান। মুসলিম সেনাপতি ছিল নুমান বিন
মুকরান। উভয় পক্ষ হামাদানের নিকটবর্তী নিহাওয়ান্দে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হল। ৬৪২ খ্রি: সংগঠিত এই যুদ্ধ নিহাওয়ান্দের
যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে পারস্যবাসী চূড়ান্তভাবে মুসলিমদের নিকট পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী
র্ফাস, র্কিমান্, মাক্রান্, সিজিস্তান্, খোরাসান্ ও আর্জাবাইজান অধিকারে সক্ষম হয়। এটি ছিল একটি ভাগ্য
নির্ধারণকারী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাস্য সা¤্রাজ্যের উপর সর্বশেষ আঘাতটি আসে। তাই ইতিহাসে এই যুদ্ধের তাৎপর্য
অত্যাধিক।
পারস্য বিজয়ের ফলাফল ঃ
পারস্য বিজয় আরবের মুসলিমদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই বিজয়ের ফলাফল ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়
দিক থেকেই বিবেচ্য ছিল।
ক) ইতিবাচক ফলাফল ঃ
ইসলামের বিজয় ঃ পারস্য বিজয়ের মাধ্যমে পারস্যের প্রাচীন ‘জরস্থুস্ত্রবাদ’ ধর্মের অবসান ঘটে এবং পারস্যে ইসলামের
বাণী প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাসানীয় সা¤্রাজ্যের পতন ঃ মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের মাধ্যমে প্রাচীন শক্তিশালী সাসানীয় সা¤্রাজ্যের পতন ঘটে।
আরব খিলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থনৈতিক সুবিধা ঃ পারস্য বিজয়ের মধ্যে দিয়ে মুসলিমগণ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের উর্বর ভূমি লাভ করে। কৃষি ও
বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিনির্মাণ ঃ পারস্যবাসী ছিল তৎকালীন বিশ্বে প্রাচীন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। তথাকার জীবন প্রণালী ছিল
আধুনিক এবং রুচিশীল। তাদের নিকট থেকে আরবগণ শিক্ষা, সামরিক কৌশল, আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার। রাষ্ট্রীয়
প্রশাসন, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসে।
খ) নেতিবাচক প্রভাব ঃ
বিলাসিতার অনুপ্রবেশ ঃ পারস্যবাসীর ও পারস্য সভ্যতার সংস্পর্শে সরল ও অনাড়ম্বর আরবদের জীবনে বিলাসিতার
প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাদের কষ্ট-সহিষ্ণু ও অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনে ব্যাপক নেতিবাচক ছায়া পড়ে।
আরব-পারস্য রক্তের সংমিশ্রণ ঃ পারস্য বিজয় ও এই অঞ্চলে বসবাসের মাধ্যমে আরবগণ তাদের রক্তের বিশুদ্ধতা
হারায়। যা ছিল বহুলাংশে আরবীয় গুণাবলি বর্জিত। পরবর্তী ইতিহাসে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
শিয়া মতবাদের বিস্তার ঃ
পরবর্তীতে পারস্য হতে শিয়া মতবাদের বিস্তার ঘটে। যা মুসলিম জাতিকে দুই প্রধান ভাগে বিভক্ত করে দেয়।
গ) মুসলিমদের রোমান সা¤্রাজ্য বিজয় ঃ
রোমান সম্রাাজ্য ছিল আরবের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর নিয়ে রোমান বা বাইজান্টাইন সা¤্রাজ্য
গঠিত ছিল। প্রাথমিসভাবে মহানবী (সা.) এর সময়ে রোমান-মুসলিম সুসম্পর্ক বজায় ছিল, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে এই
সম্পর্ক নষ্ট হয়।
বাইজানটাইন বিজয়ের কারণসমূহ ঃ
ভৌগলিক কারণ ঃ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ছিল আরবের নিকটবর্তী। তাই সীমান্তে নিরাপত্তার
জন্য এই বিজয় আবশ্যক ছিল।
মুসলিম দূত হত্যা ঃ মুতার খ্রিস্টান শাসক শুরাহবিল মহানবী (সা.) প্রেরিত দূতকে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে হত্যা
করে। তাই মূতার যুদ্ধ সংগঠিত হয়।
সীমান্তে গোলযোগ ঃ উদীয়মান মুসলিম শক্তির বিকাশ বাইজানটাইন সা¤্রাজ্যের জন্য ছিল ভীতিকর। তাই প্রায়ই তারা
সীমান্তে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। সীমান্তে বসবাসকারী বেদুইনদেরকে মদীনা আক্রমণে প্ররোচিত করতো। তথাপি মুসলিম
বণিকদের নিরাপত্তা ছিল না। তাই বাইজানটাইন আক্রমণ মুসলিমদের জন্য আবশ্যক হয়ে দাড়ায়।
ঘটনা প্রবাহ ঃ ৬৩৪ খ্রি: আজনাদাইনের যুদ্ধে মুসলিমদের জয় লাভের সংবাদ আবু বকর (রা.)- এর মৃত্যু শয্যায় মদীনায়
এসে পৌছে। পরবর্তী খলীফা হযরত উমর (রা.) খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে সিরিয়া বিজয় সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।
দামেস্ক বিজয় (৬ অক্টোবর ৬৩৫)
রোমান স¤্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলিম বাহিনীর নিকট পরজিত হয়ে এন্টিয়কে আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি নতুন একটি
সেনাবাহিনী মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) দামেস্ক অবরোধ করেন। দীর্ঘ ছয় মাস
অবরুদ্ধ থাকার পর দামেস্ক মুসলিমদের অধিকার আসে।
ফিহল এর যুদ্ধ
দামেস্ক বিজয়ের পর মুসলিমগণ জর্ডানের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময় রোমান সেনাবাহিনী জর্ডানে অবস্থান করছিল।
উভয় পক্ষের মধ্যে মুয়ায বিন জাবালের নেতৃত্বে আপস মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত স্থির না
হওয়ায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধে আবু উবায়দা (রা.) মুসলিম বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদান করেন। রোমানরা যুদ্ধে
পরাজিত হলো। ইতিহাসে এটিই ‘ফিহলের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
হিম্স অধিকার (৬৩৫ খ্রি:)
হিম্স রোমান সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রাচীন শহর। ফিহল বিজয়ের পর, প্রায় বিনা বাধায় মুসলিমগণ হিম্স অধিকার
করেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ (৬৩৬ খ্রি:)
বাইজান্টাইন অধিকার হতে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি শহর দামেস্ক, হাম ও হিমস মুসলিমদের হস্তচ্যুত হয়। স¤্রাট হিরাক্লিয়াস
বাইজান্টাইন সা¤্রাজ্যের এই অফুরন্ত ক্ষতি মেনে নিতে পারেনি। তিনি তার ভ্রাতা থিওডোরাসের নেতৃত্বে ২,৪০,০০০
সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছিল মূলত আর্মেনিয়া, সিরিয়া ও রোমান
খ্রিস্টানগণ। খ্রিস্টান বাহিনী ইয়ারমুকের প্রান্তে এসে পৌঁছাল। আবু উবায়দা (রা.) ও আমর (রা.) মুসলিম বাহিনী নিয়ে
এসে পৌঁছলে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ২৫,০০০ বেশি ছিল না। কিছুদিন পর খালিদ (রা.) ও এসে সেখানে পৌঁছান। ৬৩৬
সালের ২০ আগস্ট এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। রোমানবাহিনী চরমভাবে পরাজিত হল। থিওডোরাস যুদ্ধক্ষেত্রে
প্রাণত্যাগ করলেন। যুদ্ধে রোমান বাহিনীর পরাজয়ের কথা শুনে হিরাক্লিয়াস কনস্টান্টিনোপল এ আশ্রয় গ্রহণ করলেন। যুদ্ধে
প্রায় ৭০ হাজার রোমান সৈন্য হতাহত হল এবং ৩০০০ মুসলিম সেনা শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।
গুরুত্ব
কাদেসিয়া যুদ্ধের মতো ইয়ারমুকের যুদ্ধ ছিল একটি ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বাইজানটাইন শক্তির উপর
মুসলিমরা চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়। সমগ্র সিরিয়া, তাদের পদানত হয়। পরবর্তীতে কিন্নীসিরিন, এন্টিওক,
আলেপ্পো, টায়ার, সিওন প্রভৃতি রোমান অঞ্চল মুসলিমদের অধিকারে আসে।
৫) জেরুজালেম অধিকার (৬৩৭ খ্রি:)
জেরুজালেম অধিকার অভিযানে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন আমর ইবনে আল-আস (রা.) । তিনি জেরুজালেম অবরোধ
করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলে, এর রোমান শাসক আরতাবুন শহর ত্যাগ করে পলায়ন করেন। কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর
জেরুজালেমের খ্রিস্টান পাদ্রী সাফ্রীউনিয়াস মুসলিমদের সাথে সন্ধি করার প্রতি ইচ্ছা পোষণ করেন। সেনাপতি আবু
উবায়দা (রা.) খলিফাকে এই সংবাদ প্রেরণ করলে খলীফা হযরত উমর (রা.) একজন মাত্র ভৃত্য সহকারে উটের পিঠে
চড়ে জেরুজালেমে পৌছেন। উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। খলীফা খ্রিস্টানদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ
করেন। জেরুজালেমের খ্রিস্টান অধিবাসী জিযিয়া প্রদানে সম্মত হয়। খলীফা উমরের হস্তে জেরুজালেম নগরীর চাবি
অর্পিত হয়।
৬) জাজিরা বিজয় (৬৩৮ খ্রি:)
রোমান সরকারের উস্কানিতে জাজিরাবাসী (যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০,০০০) মুসলিম শাসনের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা
করে। সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা.) তাদেরকে পরাজিত করে জাজিরা দখল করেন। এরপর মুসলিম বাহিনী আর্মেনিয়া ও
সাইলেসিয়া দখল করে। পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে মুসলিম সা¤্রাজ্য আরো বিস্তৃতি লাভ করে। এই সময় (৬৩৩-৬৪০)
সমগ্র সিরিয়া, প্যালেস্টাইন মুসলিমদের অধিকারে আসে। খলীফা হযরত উমর (রা.) মুয়াবিয়া (রা.) কে ৬৪০ খ্রি:
সিরিয়ার শাসক হিসেবে নিয়োজিত করেন।
মিসর বিজয় (৬৩৯-৬৪২ খ্রি:)
পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের পর মুসলিমগণ মিসর বিজয়ের দিকে অগ্রসর হয়।
মিসর বিজয়ের কারণ
সামরিক প্রয়োজন ঃ সামরিক দিক থেকে মিসরের অবস্থান ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মিসরে রোমান নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি ছিল।
মুসলিম সা¤্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ঃ
সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন হতে বিতাড়িত রোমান সৈন্য মিসরে আশ্রয় নেয়। আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর ছিল বাইজানটাইন
শাসকের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। তাই এটি ছিল মুসলিম সা¤্রাজ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ। তাই অতি সত্বর মিসর বিজয়ের
প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
অর্থনৈতিক চাহিদা ঃ
আরব জাতি সর্বদাই উর্বর ভূমির অন্বেষণে থাকে। নীল নদের তীরে অবস্থিত মিসর ছিল উর্বর, সুজলা, সুফলা অঞ্চল।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা ছিল এই নীলনদের দান। তাই অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করা ছিল এই অভিযানের অন্যতম
উদ্দেশ্য।
ঘটনাসমূহ ঃ
ক) হেলিওপলিসের যুদ্ধ (৬৪০ খ্রি:)
মুসলিমরা জেরুজালেম অধিকারের পর আমর ইবন আল-আস (রা.) পরবর্তী অভিযানের জন্য খলীফার অনুমতি কামনা
করেন। খলীফার অনুমতি বিলম্বিত হওয়ার কারণে, আমর ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিসরের দিকে অগ্রসর হলেন। ৬৩৯ খ্রি:
আমর ‘ওয়াদি আল-আবিশ’ নামক স্থান অধিকার করলেন। পথিমধ্যে আল-ফামার বিবলস দখল করেন। এ সময় খলীফা
কর্তৃক প্রেরিত যুবাইর-ইবন-আওয়াম ১০,০০০ সৈন্য
নিয়ে মিসরে এসে পৌঁছান। ৬৪০ খ্রি: মুসলিম
সেনাবাহিনী হেলিওপলিসের যুদ্ধে রোমান
সেনাবাহিনীকে পরাজিত করল। রোমান সেনাপতি
থিওডোরাস যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আলেকজেন্দ্রিয়ায়
আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাইজানটাইন শাসনকর্তা সাইরাস
ব্যবিলন দুর্গে আশ্রয় নিলেন। ৬৪১ খ্রি: মুসলিম
বাহিনী ব্যাবিলন দখল করেন।
খ) আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় (৬৪২ খ্রি:) ঃ
আমর ইবনে আস বাইজান্টাইনদের বিখ্যাত নৌ-ঘাঁটি
আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধ করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার
অধিপতি ছিল থিওডোরাস। তিনি তখন সুরক্ষিত দুর্গে
অবস্থান করছিলেন। রোমান স¤্রাট সিজার্স মুসলিমদের
বিরুদ্ধে ৫০,০০০ সৈন্য প্রেরণ করেন। উভয় পক্ষের
মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সময় মুসলিম বাহিনীতে ছিল ২০,০০০ জন সৈন্য । যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ৬৪১ সালের
৮ই নভেম্বর।
গুরুত্ব ঃ আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ছিল একটি বিখ্যাত নৌÑঘাঁটি।
পরবর্তীতে হযরত উসমানের সময়কালে মুসলিম নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ ঘটে। মুসলিমগণ ভূ-মধ্যসাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ
যেমনঃ সাইপ্রাস, ক্রীট, রোড্স, সিসিলি অধিকার করতে সক্ষম হয়।
মিসর বিজয়ের গুরুত্ব ঃ
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
রোমান ভূমি বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিমগণ উর্বর ভূমির দেশ সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর অধিকার করে। কৃষি ব্যবসায়বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও মুসলিমদের উন্নতি সাধিত হয়।
সুয়েজ খাল খনন
খলীফা হযরত উমর (রা.) এর নির্দেশে আমর সুয়েজ খাল খনন করেন। এটি নীলনদের সাথে লোহিত সাগরের সংযোগ
স্থাপন করে। এতে নৌ-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে।
মিসরে মুসলিম সম্প্রসারণ
ভূ-মধ্যসাগরে মুসলিম আধিপত্য
মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম নৌবাহিনীর উন্নতি সাধিত হয়। মুসলিমগণ ভূ-মধ্যসাগরে আধিপত্য
বিস্তারে সক্ষম হয়। এর বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ মুসলিম সা¤্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়।
ফুসতাত নগরীর পত্তন
আমর ইবন আল-আস (রা.) বর্তমান কায়রোর নিকটবর্তী আল-ফুসতাতে একটি নগরী প্রতিষ্ঠিত করেন। এটিই
পরবর্তীকালে বিখ্যাত ফুসতাত নগরী রুপে পরিচিত হয়।
বার্কা ও ত্রিপলী বিজয়
আমর ইবন আল-আস (রা.) আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায় (ইফ্রিকিয়া) অভিযান পরিচালনা করেন।
তিনি বার্কা ও ত্রিপলী ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জয় করেন। এই অঞ্চলের খ্রিস্টানরা কর দিতে সম্মত হয় এবং সেখানে
মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সারসংক্ষেপ:
হযরত উমর (রা.) এর শাসনকাল ছিল মুসলিম ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তাঁর সময়ে মুসলিম সা¤্রাজ্য
সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়। সাসানিয়ান ও বাইজানটাইন সভ্যতার পতন ঘটে। ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণ ঘটে,
আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রেষ্ঠ মুসলিম সেনাপতি খালিদ, মুসান্না, আবু ওবায়দা, সাদ এবং আমরের নৈপুণ্যে
ইসলামী পতাকা দুইটি মহাদেশে উত্তোলিত হয়। এই সকল বিজয়ের মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন খলীফা হযরত উমর (রা.)।
তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিরাট সাফল্য অর্জন করে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক দিক হতে মুসলিমগণ ভিনদেশী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শ লাভ করে।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১. পারস্য চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জিত হয় কোন যুদ্ধের মাধ্যমে?
ক) বুয়ায়েবের যুদ্ধ খ) কাদিসিয়ার যুদ্ধ গ) জালুলার যুদ্ধ ঘ) নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ
২. মিসর বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়ে কেন ?
ক) মুসলিম সা¤্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানের জন্য খ) মুসলিম সা¤্রজ্যের পরিধি বৃদ্ধির জন্য
গ) নবী (স.) এর অছিয়ত পূরনের জন্য ঘ) খ্রিস্টানদের দমনের জন্য
৩. মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের প্রধান কারণর) সীমান্তের নিরাপত্তা বিধান রর) মুসলিম দূতকে হত্যা
ররর) নৌবাহিনী গঠন
নিচের কোন্টি সঠিক
ক) র, রর, ররর খ) রর, ররর গ) র, রর ঘ) র, ররর
সৃজনশীল প্রশ্নঃ
ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক আব্দুল করিম শ্রেণিকক্ষে একজন খলীফার রাজত্বকাল আলোচনা করেন যিনি পারস্য,
সিরিয়া, জেরুজালেম মিসর প্রভৃতি অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করে বিজয় অর্জন করেন। তাঁর সময়ে মুসলিম সা¤্রাজ্য সবচেয়ে
বেশি বিস্তৃত হয়। তাঁর অনুপ্রেরণায় ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে।
ক) কোন খলীফার সময়ে মুসলিম সা¤্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয় ? ১
খ) হযরত উমর (রা.) এর পারস্য অভিযানের কারণ কী ছিল ? ২
গ) হযরত উমর (রা.) কীভাবে বাইজানটাইন সা¤্রাজ্য দখল করেন ? ৩
ঘ) হযরত উমর (রা.) এর সময়ে মুসলিম সা¤্রাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল-ব্যাখ্যা কর ? ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র