মুখ্য শব্দ উইতিজা, রডারিক, কাউন্ট জুলিয়ান, ফ্লোরিন্ডা, মুসা বিন নুসাইর, তারিফ বিন মালিক,
তারিক বিন-যিয়াদ, জাবালুত তারিক ও ওয়াদী লাক্কোর যুদ্ধ
মুসলিমদের স্পেন বিজয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের সময়ে
আফ্রিকার শাসনকর্তা মূসা বিন নুসাইর তাঁর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে ৭১১ সালে স্পেন জয়
করেন। প্রায় তিনশত বৎসর বর্বর ভিজিগথ্দের দুঃশাসনের (৪০৯-৭১১) পর স্পেন মুসলিম শাসনাধীনে আসে এবং
সেখানে উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কারণ :
সামাজিক কারণ : স্পেনে মুসলিমদের আগমনের আগে সেখানকার সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রাক-মুসলিম
স্পেনীয় সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শাসক ও প্রজা শ্রেণী। রাজা, ধর্মযাজক এবং অভিজাতদের নিয়ে শাসক
শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। স্পেনের শাসক শ্রেণী প্রজা-সাধারণের উপর নানারকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। তাদের উপর
সীমাহীন কর আরোপ করা হত। সাধারণ মানুষ এ অবস্থায় মুসলিমদের ত্রাণর্কতা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
রাজনৈতিক কারণ : সে সময়ে স্পেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ভিজিগথ্ শাসক রডারিক পূর্ববতী শাসক
উইতিজাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন এবং স্বৈরাচারী শাসন শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তুষ্টি ও কেন্দ্রিয়
শাসনের দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক শাসনকর্তা ও বিদ্রোহী নেতাগণ তাদের স্ব স্ব এলাকায় স্বাধীনতা লাভের
সুযোগ খুঁজতে থাকে। ফলে স্পেনে কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা। মুসলিমরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে।
অর্থনৈতিক কারণ : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। শাসক শ্রেণীর ইচ্ছামত
অর্থের অপচয়ের কারণে স্পেনের অর্থনৈতিক মেরুদÐ ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্রজা সাধারণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের
ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে আর্র্থিক বির্পযয়। এ সময় মুসলিমগণ স্পেন অভিযানে অগ্রসর হলে সাধারণ মানুষ তাদের
স্বাগত জানায়।
ধর্মীয় কারণ : স্পেনে সে সময় কোন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বা উদারতা ছিলনা। ক্ষমতাসীন ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা জ্ঞানদীপ্ত
ইহুদিদের জোরপূর্বক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাদের
ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি তাদেরকে তাদের পুত্র-কন্যাসহ
ক্রীতদাসরূপে বিক্রয় করা হয়। ফলে ইহুদীরা বাঁচার জন্য আশপাশের মুসলিম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। এ সময়
মুসলিমরা স্পেনে অভিযান চালালে জনগণ ধর্মীয় আশীর্বাদ হিসাবে তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে।
সামরিক কারণ : সে সময় স্পেনের সামরিক অবস্থা সুসংগঠিত ছিল না। প্রয়োজনের সময় সৈন্য সংগ্রহ করা হতো।
তাছাড়া ক্রীতদাসদেরকে জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হত। ফলে সেনাবাহিনীর সামরিক মান সন্তোষজনক ছিল
না। শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং ঐক্য তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। তাই সংখ্যায় বেশি হলেও রডারিকের লক্ষাধিক সৈন্য
মাত্র ১২ হাজার মুসলিম সৈন্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
মুসা ও তারিক ও বার্বারদের দক্ষতা : মুসা বিন নুসাইর ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মুসলিম বীর। তিনি উত্তর আফ্রিকার
সাহসী বার্বারদের নিয়ে তাঁর সেনাবাহিনী গঠন করেন। তিনি মুসলিম বীর তারিক বিন যিয়াদকে সেনাপতি করে স্পেনে
পাঠান। এই তারিক বিন যিয়াদ অসাধারণ নৈপূণ্যে স্পেন বিজয়ের দ্বার উম্মুক্ত করেন।
প্রত্যক্ষ কারণ :
কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণ : মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক উত্তর আফ্রিকার
মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসাইরকে আমন্ত্রণ। কাউন্ট জুলিয়ান ছিলেন উইতিজার জামাতা এবং উত্তর আফ্রিকার সিউটার
গভর্নর। তাঁর মেয়ে ফ্লোরিন্ডাকে প্রথা অনুসারে রাজকীয় চাল-চলন ও রীতি-নীতি শিক্ষা করার জন্য রাজা রডারিকের রাজ
দরবারে পাঠানো হয়। পরমা সুন্দরী ফ্লোরিন্ডা রাজা রডারিক কর্তৃক রাজ প্রাসাদে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত হন।
এ ঘটনায় কাউন্ট জুলিয়ান ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিশোধের পথ খুঁজতে থাকেন এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন
নুসাইরকে স্পেন বিজয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানান । কাউন্ট জুলিয়ান স্পেনের যাবতীয় তথ্য ও সহযোগিতা দিয়ে মুসলিমদের
স্পেন বিজয়ের পথ সুগম করে দেন ।
স্পেন বিজয়ের ঘটনা
শ্বশুর হত্যা ও কন্যার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কাউন্ট জুলিয়ান স্পেন আক্রমণের জন্য মুসা বিন নুসাইরকে
আমন্ত্রণ জানান। কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মুসা ৭১০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের বাস্তব অবস্থা অনুধাবনের জন্য তাঁর
একজন ক্রীতদাস তারিফ বিন মালিককে স্পেনে প্রেরণ করেন। তিনি স্পেনের দক্ষিণ উপকূল জরিপ এবং প্রাথমিক
পর্যবেক্ষণ করে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সেখানে বিজয়াভিযান প্রেরণের অনুকূল অবস্থা জানালে মুসা তার অপর একজন
সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদকে ৭১১ সালে ৭ হাজার সৈন্যসহ স্পেন বিজয়ে প্রেরণ করেন। তারিক বিন যিয়াদ জুলিয়ানের
সাহায্যে মোট ১২ হাজার সৈন্যসহ জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের দক্ষিণ-পূর্বের এক উচ্চ ভূমিতে অবতরণ
করেন। তারিকের নামানুসারে উক্ত স্থানের নাম হয় জাবালুত তারিক। ‘জাবাল’ আরবী শব্দ যার অর্থ পাহাড়। ‘জাবালুত
তারিক’ মানে তারিকের পাহাড় (ইংরেজিতে ঞযব ৎড়পশ ড়ভ ঞধৎরয়)। বর্তমানে এই স্থানটির পরিবর্তিত নাম জিব্রাল্টার।
তারিকের আগমনের সংবাদে রডারিক ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। গুয়াডেল্ট নদীর
তীরে মেডিনা সিডোনিয়া শহরের নিকটবর্তী ওয়াদী লাক্কো নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। রডারিকের
সৈন্যবাহিনী পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। রডারিক পলায়নকালে নদী গর্ভে নিমজ্জত হয়ে প্রাণ হারান। তারিক রাজধানী
টলেডোসহ কর্ডোভা, মুর্সিয়া, ভ্যালেন্সিয়া, আলমেরিয়া, মালাগা ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেন। মুসা এ সংবাদ শুনে আরও
১৮ হাজার সৈন্য নিয়ে স্পেনে আসেন এবং বাকী বিজয় কার্য সম্পাদন করেন।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধনী-দরিদ্র সমমর্যাদা লাভ করে। উচ্চ শ্রেণী ও
ধর্মযাজকদের বিশেষ সুবিধা লোপ পায়। মধ্যবিত্তের করের বোঝা লাঘব করা হয়। দাসদের মুক্ত করা হয়। কৃষক, শ্রমিক,
মজুর ও ইহুদী স¤প্রদায় পূর্ববর্তী শাসনের অত্যাচার হতে মুক্ত হয় এবং তারা স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন শুরু করে। ফলে
সমাজে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম শাসনামলে বিজয়ী এবং বিজীতদের মধ্যে আন্ত:বৈবাহিক সর্ম্পক স্থাপিত
হয়। এর ফলে সেখানে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠে। মুসলিমদের উদার ও প্রগতিশীল শাসনের কারণে সুষ্ঠু পরিবেশের সৃষ্টি হয়
এবং এই সুষ্ঠু পরিবেশ কৃষ্টি ও সভ্যতা বিকাশের পক্ষে সহজ হয়। অল্প দিনের মধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্পেন বিশ্ব সভ্যতা ও
সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। মুসলিম স্পেনের আলোকোজ্জ্বল সভ্যতার ছোঁয়ায় ইউরোপ আলোকিত হয়। আধুনিক
সভ্যতার পেছনেও স্পেনের অবদান অনস্বীকার্য। মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলে সেখানে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক নব অধ্যায়ের
সূচনা হয়। জনগণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের অধিকার লাভ করে। মুসলিমগণ অন্য ধর্মমতের প্রতি ছিল
অত্যন্ত উদার ও সহনশীল। তাদের ধর্মীয় উদারতা ও সহনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে স্পেনবাসী দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করে। আর যারা মুসলিম হয়নি তারাও মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে।
সারসংক্ষেপ:
মুসলিমদের স্পেন বিজয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের সময়ে সিউটার গভর্নর
কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণে আফ্রিকার শাসনকর্তা মুসা বিন নুসাইর তাঁর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে ৭১১
সালে স্পেন জয় করেন। মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলে প্রায় তিন শত বছরের বর্বর ভিজিগথ্দের দুঃশাসনের (৪০৯-
৭১১) পর স্পেন মুসলিম শাসনাধীনে আসে এবং সেখানে উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করা হয়। অল্প দিনের মধ্যে
অন্ধকারাচ্ছন্ন স্পেন বিশ্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৯.৩
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১. কোন্ মুসলিম সেনাপতি স্পেন বিজয় করেন?
(ক) তারিক বিন যিয়াদ (খ) মুসা বিন নুসাইর
(গ) আল-ওয়ালিদ (ঘ) তারিফ বিন মালিক
২. কোন্ খলিফার সময় মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে?
(ক) খলিফা হযরত মুয়াবিয়া (রা.)- এর সময় (খ) খলিফা আব্দুল মালিক-এর সময়
(গ) খলিফা আল-ওয়ালিদ- এর সময় (ঘ) খলিফা হারুন-অর-রশিদ-এর সময়
৩. কোন্ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে?
(ক) টুরসের যুদ্ধ (খ) মাসারার যুদ্ধ
(গ) টলেডোর যুদ্ধ (ঘ) ওয়াদী লাক্কোর যুদ্ধ
সৃজনশীল প্রশ্ন:
সোনিয়া তার বান্ধবির সাথে সিন্ধু বিজয় নিয়ে আলোচনা করার সময় উল্লেখ করে যে, মুহম্মদ বিন কাশিম রাজা দাহিরকে
পরাজিত করে সিন্ধু বিজয় করেন। মুসলিমরা নানা কারণে সিন্ধু অভিযান করে। এই বিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
ক. মুসলিমরা কাকে পরাজিত করে স্পেন বিজয় করে? ১
খ. স্পেন বিজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত সিন্ধু বিজয়ের সাথে পাঠ্য পুস্তকে বর্ণিত বিজয়ের ঘটনাপ্রবাহ লিখুন। ৩
ঘ. মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করুন। ৪
মুখ্য শব্দ আব্দুর রহমান আল-গাফিকি, চার্লস মার্টেল, একুইটেন, ডিউক ইউডেস,
মেরোভিনজিয়ান রাজবংশ, পইটিয়ার্স ও শহীদদের স্মৃতিক্ষেত্র
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে। এরপর থেকে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনে
একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ৭১১ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনের উমাইয়া শাসনকে বলা হয় পরাধীন উমাইয়া
আমীরাত। এ সময়কালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল র্টুসের যুদ্ধ। ইসলাম ও ইউরোপের ইতিহাসে এই যুদ্ধের
ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
র্টুসের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট :
আব্দুর রহমান আল গাফিকির শাসনভার লাভ: আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ৭৩২ সালে স্পেনের শাসনভার লাভ করেন।
৭২৫ সাল থেকে ৭৩০ সাল পর্যন্ত স্পেনের শাসনব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হয়। এ সময় ৬ জন শাসনকর্তা সেনাবাহিনী
কর্তৃক নিযুক্ত হন। এ অবস্থায় দামেস্কের উমাইয়া খলিফা হিশাম তাঁকে স্পেনের আমীর হিসেবে নিয়োগ দেন।
অভ্যন্তরীণ বিবাদ দূরীকরণ : আব্দুর রহমান আল-গাফিকি একজন যোগ্য শাসনকর্তা ও সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন।
শাসনক্ষমতা লাভ করে তিনি অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ দূরীকরণ এবং শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের উপর নযর দেন। সে সময়
স্পেনের মুসলিমদের মধ্যে গোত্র-কলহে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় ও উত্তর আরবের মুদারীয়দের এবং
আরবদের সাথে বার্বারদের দ্ব›েদ্ব স্পেন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেন। হিমারীয় ও
মুদারীয় উভয় গোত্রের মধ্যে তিনি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন এবং তারা তাঁকে তাদের নেতারূপে মেনে নেয়।
শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন : দেশের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য তিনি সমগ্র দেশ সফর করেন। ফলে অতি অল্প
সময়ের মধ্যেই তিনি একজন জনপ্রিয় শাসকে পরিণত হন এবং সমগ্র জাতি তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
ইউরোপ জয়ের চেষ্টা : আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মূল লক্ষ্য ছিল তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইরের অসমাপ্ত
কাজ সমাপ্ত করা। তারিক ও মুসার স্বপ্ন ছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও বাইজানটাইন সা¤্রাজ্যসহ ইউরোপের বিস্তীর্ণ
অঞ্চলকে মুসলিম স্পেনের সাথে একত্রিত করে বিশাল ইসলামী সা¤্রাজ্য গড়ে তোলা। ৭২১ সালে স্পেনের গভর্নর আলসামাহ (৭১৯-২১) পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে অভিযান চালান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুলুস-এর যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও
নিহত হন। মুসলিমরা এ পরাজয় ভুলে যায়নি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থা স্থিতিশীল না থাকার কারণে তারা এর প্রতিশোধ
গ্রহণ করতে পারেনি। ১১ বছর পর আব্দুর রহমান আল-গাফিকির নেতৃত্বে তারা এর সুযোগ পায়।
উসমানকে পরাজিত ও হত্যা : দক্ষিণ ফ্রান্সের শাসনকর্তা ও বার্বার নেতা উসমান বিন আবু নিসা এ সময় একুইটেনের
স্বাধীন শাসক ডিউক ইউডেসের কন্যাকে বিবাহ করে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
ডিউক ইউডেসের বিরুদ্ধে অভিযান : ৭৩২ সালে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পিরেনীজ অতিক্রম
করে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তিনি আর্লেস নগর দখল করেন। এরপর তিনি একুইটেনের শাসক ডিউক ইউডেসকে পরাজিত
করে একে একে বার্তিমাস্ক, বুরন্ডি, লিওন, বেসাসকোন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আরও কয়েকটি শহর দখল করেন।
র্টুসের যুদ্ধের ঘটনা
সে সময় ফ্রান্সে মেরোভিনজিয়ান রাজবংশের (৪৯৬-৭৫১) শাসন চলছিল। এ বংশের শেষ দিকে শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়ে
এবং প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় প্রাসাদের মেয়র বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখন রাজা ছিলেন লোথায়ের। তিনি শাসক হিসেবে
দুর্বল ছিলেন এবং তার মেয়র ছিলেন চার্লস যিনি প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করতেন। পরে অবশ্য চার্লস রাজা হয়েছিলেন।
এদিকে ডিউক ইউডেস তার শত্রæ চার্লসের সাথে বিবাদ দূর করে তার সাহায্য কামনা করেন। ৭৩২ সালের অক্টোবর মাসে
উত্তর ফ্রান্সের র্টুস ও পইটিয়ার্সের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বাহিনী এবং চার্লস ও ডিউক
ইউডেসের সম্মিলিত বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ যখন প্রায় নিশ্চিত
হয়ে যায় তখন মুসলিম সেনাদের মধ্যে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তাঁর বাহিনীতে শৃংখলা
ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এরপর
মুসলিমরা একজন নতুন সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।
র্টুসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ :
র্টুসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছেমুসলিম গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা : চার্লস ও ইউডেসের মধ্যে সন্ধি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দারা কোন তথ্য সংগ্রহ করতে
পারেনি। ফলে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি খ্রিস্টান সৈন্যদের প্রকৃত শক্তি পরিমাপ করতে পরেননি। তাই এই সন্ধি এবং
খ্রিস্টানদের শক্তি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দাদের অজ্ঞতা যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
গোত্রীয় কলহ : যুদ্ধ চলাকালে মুদারীয়, হিমারীয় ও বার্বারদের মধ্যে পুরাতন গোত্রীয় কোন্দল আবার নতুনভাবে শুরু হয়।
আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সাময়িকভাবে বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করলেও তা স্থায়ী হয়নি।
সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থতা : যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মৃত্যু অবস্থা পাল্টে দেয়। তাঁর মৃত্যুতে
মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিনিধি বা সেনাপতি নির্বাচন নিয়ে মুসলিম সেনাদের মধ্যে
মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে রাতের অন্ধকারে তারা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।
গনিমতের মাল সংগ্রহে প্রতিযোগিতা : যুদ্ধে জয়লাভ যখন অত্যাসন্ন তখন মুসলিম সৈন্যরা শৃংখলা ভঙ্গ করে গনীমতের
মাল সংগ্রহ করে এবং এই মালের হিফাজতের দিকে দৃষ্টি দেয়। ফলে তারা খ্রিস্টানদের পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কে ভাবা ও
এর জন্য নিজেদেরকে সামরিক ও মানসিক দিক দিয়ে যথেষ্ঠ প্রস্তুত করতে পারেনি।
গুজব : যুদ্ধ চলাকালে গুজব ওঠে যে খ্রিস্টানরা মুসলিম সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করেছে। মুসলিম সেনারা গুজবের
যথার্থতা পরীক্ষা না করেই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান ও সম্পদ রক্ষায় তাঁবুতে ফিরে আসে। ফলে মুসলিম
বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং খ্রিস্টানদের আক্রমণ ও জয়লাভ সহজ হয়।
র্টুসের যুদ্ধের ফলাফল :
র্টুসের যুদ্ধ ইতিহাসের চূড়ান্ত যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম। র্টুসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর চার্লস আহত মুসলিমদের
হত্যা করে মার্টেল (গধৎঃবষ) উপাধি লাভ করেন।‘মার্টেল’ অর্থ হাতুড়ি (যধসসবৎ)। হাতুড়ি দিয়ে যেভাবে লোহা বা কঠিন
পদার্থকে অবদমিত করা হয় তেমনি ভাবে চার্লস মুসলিমদের পরাজিত করে তাদের বিজয়ের ধারা থামিয়ে দিয়েছেন এবং
তাদের মর্যাদাকেও অবনমন করেছেন। আরবের বাইরে এই প্রথম কোন যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যায় বেশি থাকা সত্তে¡ও
পরাজিত হল। মুসলিমদের নিকট র্টুসের যুদ্ধক্ষেত্র শহীদদের স্মৃতিক্ষেত্র রূপে পরিগণিত। এ যুদ্ধের ফলে খ্রিস্টান
ইউরোপে মুসলিমদের প্রবেশ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এই যুদ্ধে চার্লস পরাজয় বরণ করলে সমগ্র ইউরোপের বিপর্যয়
ঘটতে পারত। অন্যদিকে চ. ক. ঐরঃঃর (গ্রন্থ: ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব অৎধনং) এর মতে, এ যুদ্ধে আরবরা জয়লাভ করলে গীবন
এবং তাঁর পরবর্তী ঐতিহাসিকরা প্যারিসে এবং লন্ডনের যেখানে এখন গির্জা রয়েছে এর পরিবর্তে সেখানে মসজিদ দেখতে
পেতেন এবং অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে বাইবেলের পরিবর্তে কুরআন পাঠ শুনতে পেতেন। এর মতে, এ যুদ্ধ মুসলিমদের অব্যাহত বিজয়ের ধারা রুদ্ধ করে দেয়। তাঁর মতে, এই
যুদ্ধের ফলাফলের উপরই নির্ভর করছিল ইউরোপ খ্রিস্টানদের অধিকারে থাকবে না মুসলিম অধিকারে যাবে।
সারসংক্ষেপ:
স্পেনের পরাধীন উমাইয়া আমীরাত আমলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা র্টুসের যুদ্ধ। ৭৩২ সালে আব্দুর রহমান আলগাফিকি ও ফ্রান্সের চার্লসের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। টুরসের যুদ্ধ ছিল একটি চূড়ান্তকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পরাজয়ের
ফলে খ্রিস্টান ইউরোপে মুসলিমদের প্রবেশ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৯.৪
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১. র্টুসের যুদ্ধের সময় স্পেনের মুসলিম আমীর কে ছিলেন?
(ক) আব্দুর রহমান আদ্-দাখিল (খ) আব্দুর রহমান আল-ফিহরি
(গ) আব্দুর রহমান আল-নাসির (ঘ) আব্দুর রহমান আল-গাফিকি
২. কত সালে র্টুসের যুদ্ধ সংঘটিত হয়?
(ক) ৭১১ সালে (খ) ৭২১ সালে
(গ) ৭৩২ সালে (ঘ) ৭৫৬ সালে
৩. কার সাথে মুসলিমদের র্টুসের যুদ্ধ সংঘটিত হয়?
(ক) চার্লস-এর সাথে (খ) পিপিন-এর সাথে
(গ) ইউডেস-এর সাথে (ঘ) উসমান-এর সাথে
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন:
মুসা তার পাঠ্য পুস্তকে ‘ক’ ‘খ’-এর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার নানা প্রস্তুতির কথা জানতে পারে। ‘ক’-এর বাহিনীতে সৈন্য
বেশি হলেও শেষ পর্যন্ত নানা কারণে পরাজিত হয়। এটি ছিল একটি চূড়ান্তকারী যুদ্ধ।
ক. কত সালে র্টুসের যুদ্ধ সংঘটিত হয়? ১
খ. টুরসের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. উদ্দীপকে ‘ক’-এর বাহিনীর পরাজয়ের সাথে টুরসের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পরাজয় আলোচনা করুন। ৩
ঘ. র্টুসের যুদ্ধের ফলাফল উল্লেখ করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র