মূখ্য শব্দ মালিকা-ই-জাহান, আরিজ-ই-মামালিক, ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’
[
শাসন সংস্কার
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬খ্রি:) ভারতের মধ্য যুগের ইতিহাসে শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ
বিজেতাই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ প্রশাসক। বিজিত অঞ্চলে তিনি যুগোপযোগী সুষ্ঠু
প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ন্যায় সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়
বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রভাবশালী ও ক্রিয়াশীল উলেমা ও অভিজাত স¤প্রদায়ের প্রভাব ক্ষুণœ করে একটি
ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে সম্রাট আকবর ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে সুলতান
আলাউদ্দিন খলজিকে অনুসরণ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বিজিত অঞ্চলে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রর্বতন
করে সাম্রাজ্যে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। তিনি নিজেকে ‘ইয়ামিন-উল-খিলাফত’ ও ‘ নাসিরী আমির- উল-মুমেনিন’
হিসেবে অভিহিত করেন। সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি জালাল উদ্দিন খলজির বিধবা
পত্মী মালিকা-ই-জাহান, পুত্র রুকনউদ্দিন ইব্রাহিম, হাজী মওলা, ভ্রাতুষ্পুত্র আকত খান, নও মুসলিম উমর খান ও মঙ্গু খান
এবং অভিজাত শ্রেণির ব্যাপক বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর বিদ্রোহের চারটি কারণ উদঘাটিত হয়। এগুলো হলো-
(১) রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা এবং শাসনকার্য সম্পাদনে সুলতানের অমনোযোগিতা ও ঔদাসীন্য,
(২) মাদক দ্রব্যের অপরিমিত প্রচলন,
(৩) আমির, মালিক ও অভিজাত স¤প্রদায়ের সুসম্পর্ক, পারস্পরিক স¤প্রীতি এবং অবাধ মেলামেশা ও
(৪) অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য।
বিদ্রোহের কারণ চিহ্নিত করার পর তার মূলোৎপাটন করতে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ
করেন।
প্রথমত, শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক কার্যাবলীর দায়িত্ব আমির ও উমারাহদের উপর ন্যস্ত না করে
সুলতান নিজেই এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়ত, সুলতান মাদক জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং অবাধ সরবরাহ নিষিদ্ধ করেন। জনসাধারণকে
উদ্বুদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে সুলতান নিজেই মদ্যপান ত্যাগ করেন এবং সমস্ত পান-পাত্র ভেঙে ফেলেন।
তৃতীয়ত, সুলতানের বিনা অনুমতিতে আমির, মালিক ও অভিজাত স¤প্রদায়ের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, সামাজিক
উৎসব, আমোদ-প্রমোদ, ভোজসভা এবং অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিজাত স¤প্রদায়ের কার্যকলাপের
প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যের সর্বত্র সুলতান অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করেন।
চতুর্থত, সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বিশ্বাস করতেন যে, সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেই জনসাধারণের মনে বিদ্রোহের মনোবৃত্তি
উদ্রেক করে। তিনি আমির, মালিক, অভিজাত স¤প্রদায় ও বিত্তবান হিন্দুদের জায়গীর ও নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন
এবং বখশিস, পেনশন, ভাতা প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন। ফলশ্রæতিতে হিন্দু-মুসলিম অভিজাত স¤প্রদায়ের
প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পায়। শাসন ব্যবস্থায় এ ধরনের কঠোর নীতি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সময় প্রচলিত ছিল
আলাউদ্দিন খলজি সেই নীতিরই পুন:প্রচলন করেন।
রাজস্ব সংস্কার
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থার উন্নতি
বিধান এবং প্রজাসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে
রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন। মধ্যযুগীয়
সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস ছিল
ভূমিকর (খধহফ জবাবহঁব)। উৎপাদনের পরিমাণ সম্পর্কে
সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন এবং রাজস্ব পুন: নির্ধারণের জন্য
সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের প্রবর্তন করেন সুলতান আলাউদ্দিন
খলজি। রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করে চৌধুরী, খুত,
মুকাদ্দাম প্রভৃতি রাজস্ব কর্মচারীগণ ইতোপূর্বে খাজনাবিহীন
যেসব ভূমি ভোগ দখল করে আসছিল তা বাতিল করা হয়।
রায়তদের নিকট থেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব আদায় করার জন্য
নতুন নতুন রাজস্ব কর্মচারী নিয়োগ করে তাদেরকে নগদ
বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি
রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধিকল্পে ভূমি রাজস্ব ছাড়াও গোচারণ ভূমি কর,
গৃহকর এবং আমদানি-রপ্তানি শুল্ক আরোপ করেন এবং
জায়গীর প্রথা বিলুপ্ত করেন। হিন্দু স¤প্রদায়ের উপর নিরাপত্তা
কর হিসেবে বিবেচিত জিজিয়া আরোপ করেন। দোয়াব ও
অন্যান্য উপদ্রæত অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত কর ধার্য
করেন। শুধুমাত্র দোয়াব অঞ্চল ছাড়া সর্বত্র নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় করা হতো। ঐতিহাসিক বারানীর মতে, এভাবে
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সমগ্র দেশকে একটিমাত্র কেন্দ্রিয় রাজস্ব প্রশাসনের আওতাভুক্ত করেন। সুলতান আলাউদ্দিন
খলজি রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধন এবং নতুন নতুন করারোপ এবং আদায়ের ফলে সাম্রাজ্যব্যাপী আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে
আসে এবং জনসাধারণের জীবন-মানের সমৃদ্ধি ঘটে। বলা হয়ে থাকে যে, সুলতান আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক প্রবর্তিত ভূমি
জরিপ পদ্ধতি পরবর্তীকালে শের শাহ এবং মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে নতুনরূপে বিকাশ লাভ করে।
সামরিক সংস্কার
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমন, সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করণ এবং রাজ্য বিস্তারের
লক্ষ্যে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি এক বিশাল সুদক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন। তিনি একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করে
আরিজ-ই-মামালিক (সমরমন্ত্রী) এর নিকট তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। জায়গীরের পরিবর্তে সেনাবাহিনীকে
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করেন। দাক্ষিণাত্য বিজয়ের মাধ্যমে অজস্র ধন-সম্পদ উত্তর
ভারতে নিয়ে আসার ফলে সাম্রাজ্যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী যাতে সেনাবাহিনীর ক্রয় ক্ষমতার
মধ্যে থাকে এজন্য সুলতান মূল্যনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাজমান দুর্নীতি দূর করার লক্ষ্যে
সুলতান আলাউদ্দিন মুসলিম ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম অশ্বচিহ্নিত করার প্রথা ‘দাগ’ এবং সেনাবাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা
সম্বলিত তালিকা করার রীতি প্রবর্তন করেন, যা ‘হুলিয়া’ নামে সর্বজন পরিচিত। তিনি ছিলেন খলজি সামরিক পদ্ধতির
গোড়াপত্তনকারী। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে সেনা বাহিনীকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। যথাঅশ্বারোহী বাহিনী, পদাতিক বাহিনী এবং হস্তী বাহিনী। ঐতিহাসিক ফিরিস্তার বর্ণনা হতে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন
খলজির অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪,৭৫,০০০। সুলতানের পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা ছিল অশ্বারোহী বাহিনীর
প্রায় দ্বিগুণ।
শিক্ষার্থীর কাজ আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে আলোকপাত করুন।
আলাউদ্দিন খলজীর সা¤্রাজ্য সীমা
সারসংক্ষেপ:
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি আমির, মালিক, অভিজাত স¤প্রদায় এবং উলামাদের প্রভাব ক্ষুণœ করে মধ্যযুগীয় দিল্লি
সালতানাতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র
কায়েম করে তিনি সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি এবং নিয়মিত রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি
রাজস্ব ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। অভ্যন্তরীণ ও বহি:স্থ বিদ্রোহ দমন এবং সাম্রাজ্যের স¤প্রসারণের জন্য
তিনি এক বিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন একাধারে রাজ্য বিজেতা, সুদক্ষ
যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক এবং সমসাময়িককালের একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-২.৭
১। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন কোন সুলতান?
ক. কুতুব উদ্দিন আইবেক খ. শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ গ. গিয়াস উদ্দিন বলবন ঘ. আলাউদ্দিন খলজি
২। ‘ইয়ামিন-উল-খিলাফত’ ও ‘নাসিরী আমির-উল-মুমেনিন’ হিসেবে অভিহিত হতেন কে?
ক. কুতুব উদ্দিন আইবেক খ. শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ গ. গিয়াউদ্দিন বলবন ঘ. আলাউদ্দিন খলজি
৩। ‘মালিকা-ই-জাহান’ ছিলেন-
ক. খলজির পতœী খ. খলজির পতœী। গ. ওমর খলজির পতœী ঘ. মুবারক খলজির পতœী
৪। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ভূমি জরিপ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন-
ক. কুতুব উদ্দিন আইবেক খ. শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ গ. জালাল উদ্দিন ফিরোজ খলজি ঘ. আলাউদ্দিন
খলজি
১. ‘নাসিরী আমির-উল মুমেনিন’ হিসেবে অভিহিত হতেন কে? ১
২. আলাউদ্দিন খলজির সময়ে উদঘাটিত অভিজাত শ্রেণির বিদ্রোহের কারনগুলো লিখুন। ২
৩. উদ্দীপকে বর্ণিত শাসকের শাসন সংস্কার সম্পর্কে বর্ণনা দিন। ৩
৪. সমসাময়িক একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আলাউদ্দিন খলজিকে মূল্যায়ন করুন। ৪
?
নাসিরী আমির-উল-মুমেনিন
মূল্য নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা
দাগ ও হুলিয়া প্রথা
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র