ভারতবর্ষ একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। এ উপমহাদেশের মুসলিম বিজয়ের সূচনা হয় অষ্টম শতাব্দির প্রারম্ভে। যদিও
পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকের শেষদিকে ঘুরি এবং ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভে তথাকথিত মামলুক শাসকদের মাধ্যমে ভারতে
মুসলিম শাসনের সূচনা হয়েছিল। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটেছিল ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার
খলজি ছিলেন বাংলার মুসলিম শাসনের সূচনাকারী। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলায় খলজি, তুর্কি এবং বলবনী
শাসনের সূচনা ঘটে এবং এ রাজবংশগুলো বাংলার জনগণের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
মূখ্য শব্দ জনপদ, মাৎস্যন্যায়, কৌলিন্য প্রথা ও সনাতন ধর্ম
ভ‚মিকা
‘রাষ্ট্র’ হিসেবে বাংলার রয়েছে এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে। প্রাচীনকাল থেকে এর নানা অঞ্চলে প্রয়োজনানুসারে
গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো জনপদ। মৌর্য ও গুপ্ত যুগ পেরিয়ে বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা শাসনের
সূত্রপাত ঘটলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরই ধারায় বাংলায় মাৎসন্যায়ের যুগ শুরু হলে অষ্টম শতাব্দির মাঝামাঝি
সময়ে চার শতাব্দি ব্যাপী স্থায়ী পাল শাসনের সূত্রপাত হয়। একাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে পাল শাসকদের দুর্বলতার
সুযোগে রাঢ় অঞ্চলে সেন শাসনের সূচনা হয়। এয়োদশ শতাব্দির প্রারম্ভে সেনরাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে মুসলিম বিজয়ী বীর
মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলায় সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন বাংলায়
সেন রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অন্তর্দ্ব›েদ্বর কারণে এর নানা স্থানে স্থানীয় সামন্ত শাসকের উদ্ভব ঘটেছিল। সে যুগে মিথ্যা
কৌলিন্য ও আভিজাত্যের যাতাকলে নিস্পেষিত হয়েছিল বাংলার সামাজিক জীবন। বাংলার বর্ণবাদী সমাজের অর্থনীতি ছিল
গ্রামভিত্তিক ও কৃষি নির্ভর। বিত্তশালী ও নি¤œবিত্তের মধ্যে বৈষম্য ছিল প্রচুর। এ সময় বাংলায় বৌদ্ধদের সহনশীল ধর্ম
চিন্তার সাথে হিন্দু ধর্মের বাড়াবাড়ি ও প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। তবে সে যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত
হয়েছিল।
রাজনৈতিক অবস্থা
সমকালীন উৎসের অভাবে প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট করে জানা যায় না। প্রাপ্ত বিভিন্ন
লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে ‘বাংলা’ নামে কোন একক রাষ্ট্র বা রাজ্য ছিল না। এদেশ
তখন অনেকগুলি ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি অঞ্চলের শাসকরা যার যার মত করে শাসন করত। এভাবে
বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠা এলাকাগুলিকে বলা হত জনপদ। প্রাচীন বাংলার এসব জনপদের মধ্যে বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, পুন্ড্র,
বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। সমকালীন প্রাপ্ত নানা সূত্র থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার
অব্দে বর্তমান পশ্বিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মহাস্থানে
প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপি থেকে জানা যায় যে, এরই ধারায় মৌর্য সম্রাট মহামতি অশোকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রি.পূ.)
বর্তমান বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত পুন্ড্র জনপদ মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে মৌর্য সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠলে রাঢ়
ও বঙ্গ জনপদ মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মৌর্য শাসনের অবসান ঘটলে বাংলায় শুঙ্গ শাসনের সূচনা হয়। ধারণা করা হয় যে,
শুঙ্গ শাসনকালেও পুন্ড্র নগর সমৃদ্ধিশালী ছিল। এরপর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় কুষাণগণ কিছুদিন এবং পরবর্তীতে
দীর্ঘদিন ধরে বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল বলে জানা যায়। গুপ্ত রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময়েই উত্তরবঙ্গেও কিছু অংশ
সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল বলে প্রমাণ মেলে।
বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক ও মাৎস্যন্যায়
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনোত্তর যুগে পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের দুর্বলতা ও বিরোধী মৌখরিদের উৎপাতের সুযোগ নিয়ে গুপ্ত রাজা
মহাসেন গুপ্তের একজন সামন্ত শশাঙ্ক গৌড় অঞ্চলে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙালি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্ক (আনু.
৬০৬-৬৩৭খ্রি.) বাংলার খÐ খÐ রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে বাংলাকে একটি একক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন।
তার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ গ্রামে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় ও বাংলায় মহা দুর্দিন নেমে আসে। হর্ষবর্ধন ও
ভাস্কর বর্মনের হাতে একদিকে যেমন বিশাল গৌড় রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অন্যদিকে ক্ষমতাশালী ভূ-স্বামীরা একে অন্যের
সাথে সংঘাতে মেতে উঠে। কোন কেন্দ্রিয় শাসন না থাকায় সামন্ত শাসকরা যে যার মত চারদিক জবর দখল করে
ফেলেছিল। পাল তাম্রশাসনে এই অবস্থাকে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলার এরূপ নৈরাজ্যময় যুগ প্রায়
একশ বছর স্থায়ী ছিল।
পাল যুগ
শশাঙ্ক পরবর্তী প্রায় একশ বছরের বিক্ষিপ্ত শাসনামলের অরাজকতায় বাংলার মানুষের মন বিষিয়ে গিয়েছিল। এই
অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য অষ্টম শতাব্দির মধ্যভাগে দেশের জনগণ মিলিত হয়ে গোপাল (৭৫৬-৭৮১খ্রি.) নামক
এক ব্যক্তিকে রাজা নির্বাচিত করেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলায় নবযুগের সৃষ্টি হয়। গোপালের পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল (৭৮১-
৮২১খ্রি.) বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন পালবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। দশম শতাব্দিতে পাল বংশের গৌরব স্তিমিত
হতে থাকে। পশ্চিম বাংলার বরেন্দ্রে কৈবর্ত নেতা ভীম ও দিব্যোক কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করেন। কৈবর্ত শাসন
বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। পাল বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য শাসক রামপাল পালরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। কিন্ত তিনি পাল
বংশের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সফল হননি। ফলে তার মৃত্যুর পর পাল শাসন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। পালদের
এই দুর্বলতার সুযোগ সেনরা বাংলায় সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
সেন যুগ
অযোগ্য পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে বাংলার ব্যাপক অংশ নিয়ে একাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় সেন
শাসনের সূচনা হয়। সেনদের আদি বাসভূমি ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট জেলায়। দাক্ষিণাত্যে থাকাকালীন তারা প্রথমে ব্রাহ্মণ
ছিলেন। কালক্রমে তারা ব্রাহ্মণ্য বৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয় বৃত্তি গ্রহণ করেন এবং ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত হন। সেন বংশের
প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসে সামন্ত সেনের নাম পাওয়া যায়। তবে বিজয় সেন (১০৯৮-১১৬০খ্রি.) ছিলেন এ বংশের প্রথম
রাজা। অতঃপর সেনবংশের রাজা হন বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮খ্রি.)। বল্লাল সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন
(১১৭৮-১২০৪খ্রি.) পিতৃ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা। বর্তমান ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার গৌড় ছিল তার প্রধান রাজধানী। এর অপর নাম ছিল লক্ষণাবতী। পরবর্তীতে তিনি তার
রাজধানী নদীয়ায় স্থাপন করেন। তিনি গৌড়, কলিঙ্গ, কামরূপ, কাশী, প্রয়াগ প্রভৃতি স্থান জয় করেন বলে জানা যায়। তাঁর
রাজত্বের শেষ দিকে সেন রাজ্যে অতীব দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে চারপাশের সামন্ত শাসকরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
সুন্দরবন অঞ্চলের ডোম্মানপাল ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পট্টিকেরা নামে এক রাজ্য
যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে। রণবঙ্কমল্ল হরিকেল দেব নামে এক রাজা সেখানে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
সেনদের এ দুর্বল পরিস্থিতিতে এয়োদশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানগণ উত্তর ভারত হয়ে আক্রমণের
সূচনা শুরু করলে ভারতীয় রাজন্যবর্গ ভীত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতে দিল্লি বিজয়ী বীর মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি ইখতিয়ার
উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বিহার বিজয় সমাপ্ত করে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে অতর্কিতে লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়ার
দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। এ অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব মনে করে রাজা লক্ষণ সেন পলায়ন করে পূর্ববঙ্গের
বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলা খলজিদের অধিকারে চলে যায়। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণসেনের মৃত্যু
হয়। এর স্বল্প দিন পরেই সেন রাজত্বের অবসান ঘটে। এভাবে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলার
নৈরাজ্যময় পরিস্থিতির অবসান ঘটে।
সামাজিক অবস্থা
প্রাক মুসলিম যুগে বাংলার জনগণের জীবনমান অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত ছিল। জনগণ নানা পেশায় নিয়োজিত ছিল। কৃষিকাজ
ছিল তাদের প্রধান পেশা। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর, শ্রমিক, যোদ্ধা, তাঁতি, সুতার, স্বর্ণকার সহ নানা
সামাজিক পেশার লোক ছিল। এসময় যোদ্ধা, ধর্মযাজক, পন্ডিত, চিকিৎসক ও অভিজাতগণ উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ভোগ
করতেন। এর ফলে সমাজে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির জীবনমানে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষণীয় ছিল। অভিজাতগণ সমাজের নিয়ন্ত্রক
হিসেবে সর্বদা সকল সামাজিক সুবিধা ভোগ করতেন। এ কারণে এ যুগে বাংলায় আর্য প্রভাবেই বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথার
ওপেন স্কুল ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র
ইউনিট ৪ পৃষ্ঠা ১১০
সূত্রপাত ঘটে। আর্য সমাজ প্রধানত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এ চার শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। এ চারটি শ্রেণি ছাড়াও
অনেক শঙ্কর জাতির জনগণও বংলায় বসবাস করত। সেনযুগে ব্যাপক বর্ণবিন্যাস লক্ষণীয়। এ সময় জাতিভেদ প্রথা
এতটাই প্রকট ছিল যে সমাজে ৩৬ টি জাতিগোষ্টীর মানুষ বসবাস করত। কিন্তু একটির সাথে অন্যটির কোন সামাজিক
যোগাযোগ ছিল না। ফলে তাদের সমাজে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি অনুপস্থিত ছিল। সে যুগে বাংলার জনসাধারণের
জীবনযাত্রা ছিল সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর। বাঙালি চরিত্র ছিল কোমল। বাঙালি জাতির সারল্য, সাধুতা, বিদ্যানুরাগ, মধুর ও
অমায়িক ব্যবহারে চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে তাদের চরিত্রে দৃঢ়তা, সাহসিকতা, চঞ্চলতা ও
ব্যস্তবাগীশতাও বিরাজমান ছিল। সমাজে নারীর কোন স্বাতন্ত্র বা স্বাধীনতা ছিল না। পিতা-মাতা ও স্বামীর পরিবারের
অধীনেই তাদেরকে থাকতে হত। সমাজে বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ প্রচলিত ছিল। নিষ্ঠুর সহমরণ প্রথাও প্রচলিত ছিল।
প্রাচীন বাংলায় নর-নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র ছিল ধুতি ও শাড়ি। পুরুষেরা মালকোচা দিয়ে ধুতি পরিধান করত এবং তা
হাঁটুর নিচে নামত না। মেয়েদের শাড়ি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাত। ধুতি বা শাড়ি ছাড়াও পুরুষেরা চাদর ও মেয়েরা
ওড়না পরত। উৎসব বা বিশেষ উপলক্ষে নারী-পুরুষ উভয়েই বিশেষ ধরণের পোষাক পরত। নারী-পুরুষ উভয়েই আঙ্গুলে
আংটি, কানে কুÐল, গলায় হার, হাতে বালা, কটিতে মেখলা, পায়ে মল ইত্যাদি গহনা পরত। আহার্য দ্রব্য হিসেবে ডাল,
ভাত, মাছ, গোশত, শাকসবজী, ফলমূল, দুধ, দই, ঘি, ক্ষীর ইত্যাদি প্রধান খাদ্য ছিল। ইলিশ মাছের খুব বেশি কদর
ছিল। শুটকি মাছও প্রিয় খাদ্য রূপে গণ্য হত। ভোজ উৎসবে নানা প্রকার মসলাযুক্ত মাংসের ব্যঞ্জন, পিঠা ইত্যাদি এবং
কর্পুর মেশানো সুগন্ধি পানি পরিবেশন করা হত। এ সময় নানা রকম মাদক পানীয়েরও ব্যবহার হত। ভোজের পর পান
শুপারিও পরিবেশন করা হত। প্রাচীন বাংলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আদৌও উন্নত ছিল না। স্থলপথে গরুর গাড়ি ও জলপথে
নৌকা প্রধান বাহন ছিল। ধনী লোকেরা হাতি, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি প্রভৃতি ব্যবহার করত। বর্ষাকালে সাধারণ
মানুষ ভেলা ও ডোঙ্গা ব্যবহার করত। মালামাল পরিবহনের জন্য বড় বড় বজরা নৌকা ব্যবহৃত হত।
অর্থনৈতিক অবস্থা
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক জীবন ছিল কৃষি নির্ভর। বর্তমানকালের মত তখনও বেশির ভাগ লোক
গ্রামেই বাস করত। গ্রামগুলি ছিল কৃষিভিত্তিক এবং শহরগুলি ছিল শিল্প কারখানা এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল।
বাংলার উর্বর মাটিতে প্রচুর ধান, পাট, ইক্ষু, তুলা, সরিষা, নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি উৎপন্ন হত। আখের চাষ প্রচুর
পরিমাণে হত। আখের রস থেকে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও গুড় তৈরি হত এবং তা বিদেশেও রপ্তানি করা হত। সে যুগে
কলা, আম, কাঁঠাল, লেবু, ডালিম ইত্যাদি নানা প্রকার ফলমূল ও সবজির চাষ হত। গরু, ছাগল, হাতি, মহিষ, ঘোড়া
ইত্যাদি পশু পালিত হত। ভূমির মালিক শাসকগণ হলেও কৃষকেরা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। তবে মজুর, দরিদ্র দূর্দশাগ্রস্থ ও
ভূমিহীন কৃষক লোকের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল। প্রাচীন বাংলা কৃষি প্রধান হলেও শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। সে যুগে
বাংলার বস্ত্র শিল্প যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দিতে প্রচুর উৎকৃষ্ট সূ² মসলিন বস্ত্র বাংলা থেকে
বিদেশে রপ্তানি হত। এ সময় ধাতু শিল্প এবং মৃৎ শিল্পেরও উন্নতি হয়েছিল। কর্মকার, স্বর্ণকার, মণিকার প্রভৃতি কারিগরদের
দ্বারা এ শিল্প উন্নত হয়েছিল। বাংলার কাঠ শিল্প তখন বেশ উন্নত ছিল। শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে বাংলার ব্যবসা
বাণিজ্যেরও উন্নতি হয়েছিল। নৌ ও স্থল পথে বাংলায় উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষি পণ্য ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি বিভিন্ন হাট, বাজার
ও বন্দরে নিয়ে যাওয়া হত। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন পণ্য বাইরেও রপ্তানি করা হত। শিল্পজাত দ্রব্যাদি বিনিময়ের
জন্য দিনার এবং রূপক নামের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত ছিল। পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে সে যুগে কড়ি
ব্যবহৃত হত।
সাংস্কৃতিক অবস্থা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করাই তার স্বজাত প্রবৃত্তি। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়েই বাংলায়
সভ্যতার বিকাশ ঘটে। সভ্যতার বিকাশের ধারায় আর্য ও অনার্যের সংমিশ্রণে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি নতুনভাবে গড়ে
উঠে। সভ্যতার যুগে গুপ্ত ও মৌয যুগের অবসান ঘটলে শশাঙ্ক ও পাল শাসনামলে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভূত
উন্নয়ন ঘটেছিল। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মীয় গীতিকবিতা ও গান হিসেবে চর্যাপদ রচিত হয়। চর্যাপদকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের
আদিরূপ বলা হয়ে থাকে। সেন যুগে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি আরো বিকশিত হয়। সেন রাজা বল্লাল সেন ও লহ্মণ
সেন নিজেরাই বড় পন্ডিত ছিলেন। রামাই পন্ডিত, হুলায়ূধ মিশ্র, সর্বানন্দ, উমাপতিধর, গোবর্ধন, শরণ, সভাকবি জয়দেব
প্রমুখ ছিলেন এ যুগের প্রখ্যাত পন্ডিত ও গ্রন্থাকার। বাংলায় মুসলমানদের আগমনের পূর্বে এখানকার সমাজে আমোদ-
প্রমোদ ও বিনোদনের নানা ব্যবস্থা ছিল। হোলি উৎসব, নবান্ন, পৌষ পার্বনেও আনন্দ উৎসবের প্রচলন ছিল। নৃত্য, গীত,
যাত্রাভিনয়, কুস্তি, শরীরচর্চা, যাদুমন্ত্র, পাশা, দাবা, নাচগান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল। গোলকধাম ও কড়ি ছিল নারীদের
প্রিয় খেলা। সে যুগে বাঙালিরা বার মাসে তের পার্বণ উদ্যাপন করত। নাচ গানে তারা বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢাক-ঢোল,
করতাল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত।
ধর্মীয় অবস্থা
ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের পাদপীঠ হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে ইসলাম পূর্ব যুগে
বাংলায় নানা ধর্ম ও স¤প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ সময় বাংলায় সনাতন হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং বেদান্ত
ভিত্তিক সহজিয়া ধর্মেরও সন্ধান পাওয়া যায়। সে যুগের অনেক ধর্মানুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণ অবশেষে ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুষ্ঠানাদির
সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাবান্ন উৎসব, চন্ডীপূজা, ষষ্ঠীপূজা, কালীপূজা,
মনসাপূজা, শিবপূজা, দূর্গাপূজা, রথযাত্রা, ¤øানযাত্রা, দোলযাত্রা, ঝুলন যাত্রা, হোলি, চড়কপূজা, অনার্য দেবদেবীর পূজা,
ধর্মঠাকুর পূজা বিভিন্ন ও মঙ্গলানুষ্ঠান।
সারসংক্ষেপ :
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা বিভেদ ও গোলযোগপূর্ণ ছিল। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক
জীবনও স্বাচ্ছন্দ পূর্ণ ছিল না। ভারতে এ সময় বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ মানুষ সচ্ছল
জীবন যাপন করত। কৃষির উন্নতি হলেও শিল্প ও বাণিজ্যের স্তিমিত অগ্রগতি হয়েছিল। ফলে তৎকালীন বাংলার সার্বিক
অবস্থা মুসলিম বিজয় অভিযানের অনুক‚লে ছিল। প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলার শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন রাজা
এবং তিনিই ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৪.১
১. প্রাচীন বাংলার ছোট ছোট স্বাধীন অঞ্চল কি নামে পরিচিত ছিল?
ক) রাজ্য খ) জনপদ গ) রাষ্ট্র ঘ) সাম্রাজ্য
২. প্রাচীন বাংলার প্রধান বাহন ছিল-
ক) গরুর গাড়ি খ) ঘোড়ার গাড়ি গ) নৌকা ঘ) ভেলা
৩. বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল-
ক) পালি ভাষা থেকে খ) সৌরসেনী ভাষা থেকে গ) আরবি ভাষা থেকে ঘ) সংস্কৃত ভাষা থেকে
সৃজনশীল প্রশ্ন:
সম্প্রতি বিশে^র শক্তিশালী একটি দেশের প্রেসিডেন্ট একটি দেশের জনগণকে নিয়ে বর্ণবাদী বক্তব্য দিলে সে দেশের জনগণ
বিক্ষুব্ধ হলেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তেমনি বাংলার ইতিহাসে একটি রাজবংশের শাসনকালে বর্ণবাদী
চরিত্র লক্ষ্য করা যায়, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ জনগণকে শোষণ করা। তবে এ সময় জনগণ বিক্ষোভ করতে সমর্থ
হয়নি।
ক. পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? ১
খ. তখনকার হিন্দু সমাজ কয়টি ভাগে বিভক্ত ছিল? ২
গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত জাতিবর্ণ ব্যবস্থার সাথে আপনার পঠিত প্রাচীন বাংলার বর্ণবাদী চরিত্র সম্পর্কে লিখুন। ৩
ঘ. উদ্দীপকের আলোকে প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি তুলে ধরুন? ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র