মূখ্য শব্দ জায়গীর, ইকতা ও মুকতা
ভ‚মিকা
প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলা ছিল প্রধানত: হিন্দু-বৌদ্ধ ও কিছু সংখ্যক জৈনদের দ্বারা অধ্যুষিত জনপদ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এয়োদশ শতাব্দির সূচনা লগ্নে (১২০৪-১২০৫ খ্রি.) এ দেশের উত্তর ও
উত্তর পশ্চিমে সেন শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত করেন। কিন্তু সমকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ,
প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন, ভ‚গোলবিদদের বিবরণী, পর্যটকদের বর্ণনা, কিংবদন্তী ও লোকগাঁথা থেকে জানা যায় যে, মুসলিম
অভিযানের অনেক পূর্ব থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগযোগ ছিল। এ যোগাযোগের ভিত্তি ছিল বাণিজ্যিক
ও ধর্মীয়। বণিকগণ সমুদ্র যাত্রায় জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপাঞ্চলে যাওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশের দক্ষিণ
পূর্বাঞ্চল হয়ে যেতেন। এতে বাংলার দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। মৌসুমি বায়ু
প্রবাহের উপর ভিত্তি করে বাণিজ্য সম্পাদন করতে হত বিধায় আরব বণিকগণ চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্রতীরের
অঞ্চলগুলিতে তারা বসতি গড়ে তোলেন এবং স্থানীয় বাঙালিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবে বিবাহের
মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রসারিত হতে থাকে এবং বাংলায় ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী মুসলিম সমাজের ভিত রচিত
হয়।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম¥দ বিন বখতিয়ার খলজির প্রাথমিক পরিচয়
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম¥দ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন। তুর্কী জাতির খলজি গোষ্ঠীভুক্ত
বখতিয়ার আফগানিস্তানের গরমশীর বা আধুনিক দশতÐইÐমার্গÐএর অধিবাসী ছিলেন। তাঁর বাল্যজীবন স¤পর্কে তেমন
কিছু জানা যায় না। প্রথম জীবনে কর্মহীন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম¥দ বিন বখতিয়ার খলজি ভাগ্যনে¦ষণে ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে
গজনীতে গমন করেন। সেখানে তিনি মুহাম¥দ ঘুরীর সেনাবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অত:পর তিনি
দিল্লিতে গমন করে কুতুবউদ্দিন আইবকের দরবারে উপস্থিত হয়ে সেনাবাহিনীর চাকুরি প্রার্থনা করেন। খর্বাকৃতি এবং দীর্ঘ
বাহুবিশিষ্ট বখতিয়ার খলজি দেখতে কুৎসিৎ ছিলেন বলে এখানেও তিনি ব্যর্থ হন। তিনি এরূপ ব্যর্থতায় নিরুৎসাহিত না
হয়ে বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর উদ্দিনের নিকট গমন করে চাকুরির আবেদন করেন। মালিক তাঁকে অতি সামান্য
বেতনে, একজন সৈনিক হিসেবে নিয়োগদান করেন। দুঃসাহসী ও উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার চাকুরি ছেড়ে বদাউন থেকে
অযোধ্যায় আসেন। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসামুদ্দিনের অধীনে মির্জাপুরের ‘ভগবত’ ও ‘ভিউলা’ নামক দু‘টি পরগণার
জায়গীর প্রাপ্ত হন। এখানে তিনি তুর্কী ও খলজি বংশজাত লোকদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করে পূর্ব দিকের
অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালিয়ে ধনরতœ সংগ্রহ করেন এবং বিহার ও বাংলা জয়ে আগ্রহী হন।
বিহার অভিযান
হুসামুদ্দিনের জায়গীরদার হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করলে চারদিকে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় বখতিয়ার খলজি দিল্লির প্রশাসক কুতুবউদ্দিনের অধীনতা স্বীকার করে সর্বপ্রথম পূর্ব ভারতের বিহারে অভিযান
চালিয়ে তা দখল করেন। বিহারের উদন্তপুরী বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জ্ঞানচর্চা করতো, ফলে অনেকটা বিনা বাঁধায় তিনি
তা অধিকার করেন। এ সময় থেকে মুসলমানদের নিকট স্থানটি বিহার বা বিহার শরীফ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি এ
অঞ্চলের শাসনভার পেয়ে একটি বিশাল খলজি বাহিনী গঠন করেন।
নদীয়া অভিযান
বিহারকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি পূর্ব দিকে সেনারাজ্য আক্রমণের
প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। বাংলার সেনবংশীয় বয়োঃবৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন তখন নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেনদের আদি
রাজধানী ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। নদীয়া ছিল তাদের দ্বিতীয় রাজধানী। তিনি ১২০৪ খ্রি. নদীয়া আক্রমণ করেন। নদীয়া
আক্রমণের সময় বখতিয়ার বাংলার সাধারণ প্রবেশ পথ তেলিয়াগর্হির গিরিপথ দিয়ে না ঢুকে উড়িষ্যার ঝড়খন্ডের জঙ্গলের
দূর্গম পথে বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনি ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে মাত্র ১৭ বা ১৮ জন অগ্রগামী অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে
দ্রæতগতিতে নদীয়ার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হন। মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের হত্যা করে প্রাসাদে ঢুকে
অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করেন। ইতিমধ্যে তাঁর মূল বাহিনী এসে পড়ে। এ সময় রাজা লক্ষণ সেন মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত
ছিলেন। তিনি এ আকষ্মিক আক্রমণে ভীত হয়ে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই পেছনের দরজা দিয়ে নৌকা যোগে পূর্ববঙ্গের
বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। ফলে অনেকটা বিনা বাঁধায় নদীয়া মুসলমানদের হস্তগত হয়।
লক্ষণাবতী দখল
বখতিয়ার খলজির আক্রমণে ভীত হয়ে লক্ষণ সেন পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গেলে বখতিয়ার খলজি লক্ষণ সেনের রাজধানী
লক্ষণাবতী দখল করেন (১২০৫খ্রি.) এবং সেখানে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি অগাধ ধনস¤পদ, অগণিত
পরিচারক, পরিচারিকা ও বহুসংখ্যক হাতি হস্তগত করেন। নদীয়া অধিকারের পর তিনি বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী
গৌড়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নগরটি দখল করেন। এখানে তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন
মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এরপর ধীরে ধীরে সমস্ত উত্তরবঙ্গ দখল করে নেন।
তিব্বত অভিযান
সাহসী বখতিয়ার খলজির জীবনের শেষ লক্ষ্য ছিল তিব্বত অভিযান (১২০৬খ্রি.)। সম্ভবতঃ দুঃসাহসিক নব বিজয়ের ধারা
অক্ষুণœ রাখতেই তিনি এ অভিযান করেছিলেন। তিব্বত অভিমুখে যাত্রার পূর্বে তিনি বিজিত অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
সুসংহত করেন। তিনি দশ হাজার সৈন্যসহ এ অভিযান করে ব্যর্থ হন। এতে তাঁর সেনা দলের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়।
তিনি ব্যর্থতার গøানি নিয়ে শোকাহত ও হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় দেবকোটে ফিরে আসেন এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু
ভিন্ন মতে, তিনি আলী মর্দান খলজি কর্তৃক নিহত হন।
বাংলায় শাসন ব্যবস্থা চালু
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সুশাসনের
ব্যবস্থা করেন। তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস করেন এবং এক ধরনের গোত্রীয় সামন্ত প্রথার প্রবর্তন করেন।
তিনি রাজ্যকে কয়েকটি ‘ইকতায়’ বিভক্ত করে এর প্রতিটিতে একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ইকতার শাসনকর্তাকে
‘মুকতা’ বলা হত। বখতিয়ার কর্তৃক নিয়োজিত শাসনকর্তাদের মধ্যে আলী মর্দান খলজি, হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজি এবং
মুহাম¥দ শীরান খলজি বিখ্যাত ছিলেন।
তাঁর কৃতিত্ব
বাংলায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া
নদী, দক্ষিণে পদ্মানদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। বখতিয়ার খলজি
বাংলায় মুসলিম সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। তিনি রাজ্যময় মুসলমানদের নামাজের জন্য মসজিদ, শিক্ষাদানের জন্য
মাদ্রাসা এবং ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে সুফীদের জন্য খানক্হা প্রতিষ্ঠা করেন। মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি যেমন ছিলেন
একজন প্রতিভাবান ও দুঃসাহসিক সৈনিক তেমনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ ও প্রজারঞ্জক শাসক। তিনি
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করায় এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের পথ সুগম হয়।
মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের কারণেই এ দেশে ব্যাপক ধর্মান্তকরণ হয়। বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মের
মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অতএব বলা যায় যে, বঙ্গ দেশে বখতিয়ার খলজির রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ছিল এ দেশে ইসলাম
প্রচারের ক্ষেত্রে আর্শীবাদ স¦রূপ।
শিক্ষার্থীর কাজ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বিজীত অঞ্চলগুলো একটি তালিকা তৈরি করুন।
সারসংক্ষেপ :
উচ্চাভিলাষী ও সমর কুশলী যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম¥দ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলায় অভিযান করে ক্ষমতাসীন
সেনবংশীয় রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা দখল করে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত করেন। সুশাসনের
জন্য তিনি বাংলাদেশকে অনেকগুলি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রদেশগুলিকে ‘ইকতা’ বলা হত। ইকতার শাসনকর্তাকে
বলা হত মুকতা। তিনি বাংলায় মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিরও প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে বখতিয়ারের পর বাংলায় খলজি
মালিকদের শাসনের সূচনা হয়েছিল।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৪.২।
১। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আফগানিস্তানের কোন অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন?
ক) বামিয়ানের খ) গরমশীরের গ) কাবুলের ঘ) কান্দাহারের
২। বাংলা জয়ের পর বখতিয়ার খলজি কোথায় রাজধানী স্থানান্তর করেন?
ক) নদীয়ায় খ) বিক্রমপুরে গ) সোনারগাঁওয়ে ঘ) গৌড়ে
৩। ইকতার প্রধান কে বলা হত-
ক) নোকতা খ) মুকতা গ) জমিদার ঘ) কৃষক
বিশ্বের সর্বোচ্চ পরাক্রমশালী দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্ম আফ্রিকার কেনিয়াতে। তার পূর্বপুরুষ
ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকায় এসেছিলেন। এই আফ্রিকান সন্তানটিই নিজ কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিসত্তা ও যোগ্যতা গুণে আমেরিকার
মতো রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তেমনি বাংলায় ইতিহাসেও একজন ব্যক্তি ভাগ্যান্বেষণে এদেশে এসে নিজ মেধা ও
কৌশলের দ্বারা বাংলা জয় করেন ও প্রথম মুসলিম শাসনের সূত্রপাত করে অমর হয়ে আছেন।
ক. মুকতা কে? ১
খ. ইকতা বলতে কী বুঝায় ব্যাখ্যা করুন। ২
গ. উদ্দীপকে উল্লেখিত ও ইঙ্গিতকৃত শাসকদের মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধরুন। ৩
ঘ. উদ্দীপকে ইঙ্গিতকৃত বাংলার শাসকের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান মূল্যায়ন করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র