মূখ্য শব্দ শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, শাহ-ই-বাঙ্গালাহ ও একডালা দুর্গ
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের প্রাথমিক জীবন
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পরিচয় ও প্রথম জীবন স¤¦ন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ঐতিহাসিক ইবন হজর
ও আল সাখাভির মতে, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পূর্বে তাঁর নাম ছিল হাজী ইলিয়াস। তিনি পূর্ব ইরানের সিজিস্তানের
অধিবাসী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ইলিয়াস শাহ কখন, কিভাবে ভারতবর্ষে আসেন তাঁর সমকালীন কোন বিবরণ
পাওয়া যায় না। তবে গোলাম হোসেন সলিম এর রিয়াজউস-সালাতীন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, হাজী ইলিয়াস ও তাঁর এক
দুধভাই আলী মুবারক এক সময় দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলকের ভৃত্য ছিলেন। কিন্তু এসময় কোন অপকর্ম করে
হাজী ইলিয়াস জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। এর ফলে ফিরোজ শাহ হাজী ইলিয়াসকে ধরে আনার জন্য আলী মুবারককে
আদেশ করেন। আলী মুবারক হাজী ইলিয়াসকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলে ফিরোজ শাহ আলী মুবারককে বিতাড়িত
করেন। অতঃপর আলী মুবারক বাংলায় চলে আসেন এবং লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খানের অধীনে চাকরি লাভ করেন।
অল্পকালের মধ্যেই আলী মোবারক কদর খানের আস্থাভাজন হন এবং কালক্রমে প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সাথে এক যুদ্ধে কদর খান নিহত হলে তাঁর সেনাধ্যক্ষ আলী মুবারক ‘সুলতান আলাউদ্দিন আলী
শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের ক্ষমতালাভ
ভাই আলী মোবারক লখনৌতির শাসক হলে হাজী ইলিয়াস কিছুকাল পরে দিল্লি হতে বাংলায় আসেন কিন্তু আলী মুবারক
তাঁকে বন্দি করেন। পরে তাঁর মাতার অনুরোধে আলী মুবারক তাঁকে ছেড়ে দেন এবং উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন। কিন্তু
হাজী ইলিয়াস এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে নিজে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন
‘ইলিয়াস শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন।
শাসন সুদৃঢ়করণ
একজন সুযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইলিয়াস শাহ শাসন ক্ষমতায় বসেই সেনাবাহিনীকে সুসংহত করেন। তিনি রাজ্যের
কেন্দ্রিয় প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে বিন্যস্ত করে সার্বভৌম রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দেন এবং একে একে
সাতগাঁও, ত্রিহুত, নেপাল ও পূর্ব বাংলা সহ অনেক স্থানে অভিযান চালনা করে ইলিয়াস শাহী শাসনকে সুদৃঢ় করেন।
রাজ্য বিস্তার:
সাতগাঁও বিজয়
ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলার অধিপতি হয়ে ফিরোজাবাদে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে
রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রথমে সাতগাঁও-এর দিকে রাজ্য স¤প্রসারণের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ১৩৪৬
সালের মধ্যে সাতগাঁও সহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন।
ত্রিহুত বিজয় ও নেপাল অভিযান
ইলিয়াস শাহ তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ত্রিহুত অধিকার করেন। তিনি ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালে অভিযান করে
দুর্গম পর্বতময় নেপাল থেকে প্রচুর ধনস¤পদ হস্তগত করে বাংলায় ফিরে আসেন।
সোনারগাঁ অধিকার
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মুদ্রা
ইলিয়াস শাহী বংশ
ইলিয়াস শাহ অতঃপর পূর্ব বাংলায় একটি সাফল্যজনক বিজয়াভিযান প্রেরণ করেন। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক
শাহের পুত্র ও সোনারগাঁও-এর শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে পূর্ব বঙ্গে রাজ্য স¤প্রসারণ করেন।
লখনৌতি, সাতগাঁও এবং এর সাথে সোনারগাঁও অধিকার করে ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলার একচ্ছত্র অধিপতির মর্যাদা লাভ
করেন। ইতিপূর্বে এই বিরল গৌরব আর কোন মুসলমান শাসক অর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে ঐতিহাসিক শামস-ইসিরাজ আফীফ তাঁকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’’ এবং ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অন্যান্য বিজয়
পুরো বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ইলিয়াস শাহ রাজ্য বিস্তারের জন্য বাংলার বাইরে অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি
উড়িষ্যা আক্রমণ করে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হন। দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের বিদ্রোহ দসনের ব্যস্ততায় তিনি
বিহারেও সাফল্যজনক অভিযান প্রেরণ করেন। বিহারের সাফল্যে ইলিয়াস শাহের উচ্চাকাঙ্খা আরো বেড়ে যায়। তারিখ-ইফিরোজশাহী গ্রন্থের বর্ণনামতে, অতঃপর তিনি আরো পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে চ¤পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী পর্যন্ত জয় করে
এক বিশাল ভূখÐ রাজ্যভুক্ত করেন।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাথে সংঘর্ষ
ইলিয়াস শাহের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে দিল্লির সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক
১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিশাল সেন্যবাহিনী নিয়ে ইলিয়াস শাহকে দমন করতে বঙ্গ
অভিযানে আসেন। ইলিয়াস শাহ তাঁর সুরক্ষিত একডালা দূর্গে আশ্রয় নেন।
ফিরোজশাহ পাÐুয়া দখল করে একডালা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। বহু চেষ্টা
করেও ফিরোজ শাহ দূর্গটি দখল করতে ব্যর্থ হয়ে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে সন্ধি স্থাপন
করে দিল্লিতে ফিরে যান। সন্ধির শর্তানুযায়ী ইলিয়াস শাহ পরে নানাবিধ
উপঢৌকন পাঠিয়ে ফিরোজের বন্ধুত্ব লাভে সক্ষম হন।
ত্রিপুরা অভিযান
ফিরোজশাহ দিল্লিতে ফিরে গেলে ইলিয়াস শাহ রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের দিকে নজর দেন। গৌড় রাজমালা গ্রন্থের বর্ণনানুযায়ী
এ সময় রতœ-ফা নামক একজন রাজকুমার ত্রিপুরার শাসক হন। কিন্তু তাঁর অন্যান্য ভাইরা তাকে সিংহাসনচ্যুত করে
তাড়িয়ে দিলে রতœ-ফা ইলিয়াস শাহের
নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর ইলিয়াস
শাহ ত্রিপুরায় সামরিক অভিযান চালিয়ে
রতœ-ফাকে পুনরায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত
করেন। রতœ-ফা ইলিয়াস শাহের এ
বন্ধুত্বকে স্মরণে রাখায় ত্রিপুরার উপর
বাংলার কর্তৃত্ব অনেকদিন বজায় ছিল।
ইলিয়াস শাহের অন্যান্য কৃতিত্ব
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স¦ীয় বুদ্ধি, শৌর্য,
ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার দ্বারা সামান্য অবস্থা
থেকে উন্নতির চারম শিখরে আরোহণ
করেন। সামান্য আঞ্চলিক শাসক থেকে
সমগ্র বাংলা দেশকে একত্র করে শাসনকর্তা
হওয়া এক বিস্ময়কর ব্যাপার। শাসক
হিসেবে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয়।
তাঁর শাসনামলে বাংলায় শান্তি ও শৃঙ্খলা
বিরাজমান ছিল। তাঁর নিরপেক্ষ সুশাসনে
বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রীতির স¤পর্ক গড়ে উঠেছিল। দূর দৃষ্টি সম্পন্ন শাসক ইলিয়াস শাহ ফিরোজ শাহের
আক্রমণের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা এবং পরবর্তীকালে তাঁর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক স্থাপন করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার
পরিচয় দিয়েছেন। ইলিয়াস শাহ একজন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ফকির ও দরবেশগণকে তিনি খুব শ্রদ্ধা
করতেন। পীর আঁখি সিরাজউদ্দিন ও তাঁর শিষ্য শায়খ আলাউল হক এবং শায়খ রাজা বিয়াবানী এদেশে আগমন করে তাঁর
দরবার অলংকৃত করেন। তিনি তাঁদের সম¥ানে রাজ্যময় খানকাহ, মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
কৃতিত্ব মূল্যায়ন
ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। একজন সামান্য শাসক থেকে একত্রিত
বৃহৎ বাংলা প্রতিষ্ঠিত করে এখানে সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জনকল্যাণমূলক শাসন প্রতিষ্ঠিত করায় ইলিয়াস শাহ
বাংলার ইতিহাসে উচ্চ স্থান অধিকার করে আছেন। দুইবাংলার সমগ্র সীমানাকে একত্রিত করে বাঙ্গালাহ নামটি তাঁর
সময়েই প্রচলিত হয় এবং সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ বলা হয়। তাঁর রাজত্বকালে বাঙালিরা সর্বপ্রথম
একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় বাংলার লোকেরা বাঙালি হিসেবে পরিচিত হয়। এ কারণে ঐতিহাসিকগণ
তাঁকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলার ইতিহাসের এ মহানায়ক সুদীর্ঘ ১৬ বছর রাজত্ব
করার পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সারসংক্ষেপ :
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স¦াধীন সুলতানি যুগের সূচনা করলেও সুলতানি যুগের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে লখনৌতির শাসক হয়ে লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁ ও বিহার
অধিকার করে সমগ্র বাংলাকে একটি কেন্দ্রিয় শাসনের অধীনে এনে ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে অমর স্থান অধিকার
করে আছেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৫.২
১। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের আদি নিবাস ছিল
ক) কাবুলে খ) সিজিস্তানে গ) খুরাসনে ঘ) সমরখন্দে
২। হাজী ইলিয়াস শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি গ্রহণ করেন
ক) ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে খ) ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে গ) ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে ঘ) ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে
৩। ফিরোজ শাহ তুঘলক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে দমন করতে এলে তিনি কোন দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন ?
ক) পাÐুয়ায় খ) লখনৌতিতে গ) একডালায় ঘ) সোনারগাঁওয়ে
৪। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম জনক ছিলেন?
ক) ফখরুদ্দিন ইলিয়াস শাহ খ) আলাউদ্দিন আলী শাহ গ) সিকান্দর শাহ ঘ) শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
সৃজনশীল প্রশ্ন:
সুমন ও জাভেদ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের ফুটবল লেখা দেখছিল। আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যকার এ খেলায় দু’দলে বেশ
কয়েকজন বিদেশী খেলোয়াড় দেখে সুমন বললো, আমাদের দেশে এখন অনেক বিদেশী খেলোড়ার রয়েছে। জাভেদ
বললো, হ্যাঁ, এদের অনেকে আবার এখানে বিয়ে-শাদি করে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। মধ্যযুগে
বাংলায়-ও বিদেশীরা এসে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ক. ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’’ কার উপাধি ছিল? ১
খ. ইলিয়াস শাহ বাংলার সীমানা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন কেন? বর্ণনা দিন। ২
গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত বিদেশীদের মতো ইলিয়াস শাহী শাসকেরা বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন-তা ব্যাখ্যা করুন। ৩
ঘ. উদ্দীপকের আলোকে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসন কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র