মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরির উত্তর ভারত অভিযান: তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ

মূখ্য শব্দ মুলতান, পৃথ্বীরাজ, কনৌজ, বারাণসী ও আজমির
ভূমিকা: গজনীর শাসনকর্তা হিসেবে মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরি ভারতে অনেকগুলো অভিযান প্রেরণ করেন।
১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ ঘোরি কারমাতি শিয়াদের পরাজিত করে মুলতান দখল করেন। তিনি অন্য শিয়া
সম্প্রদায় সুমরাদের কাছ থেকে সিন্ধু নিজ হস্তগত করেন। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুজরাটের রাজধানী আনহিলওয়ার
আক্রমণ করেন। কিন্তু গুজরাট রাজের হাতে তিনি পরাজিত হন। ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পেশোয়ার অধিকার করেন।
এরপর কয়েক বছর তিনি পাঞ্জাবের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। অবশেষে গজনী বংশের শেষ সুলতান খসরু মালিককে
পরাজিত করে তিনি পাঞ্জাব ঘোর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই অভিযানের নায়ক ছিলেন শিহাবউদ্দিন মুহম্মদ। ঘোর
নামক স্থানে জন্মে ছিলেন বলে ভারতের ইতিহাসে তিনি মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘোরি নামে পরিচিত। তিনি দিল্লি ও এর
আশেপাশের এলাকা দখল করেন। ফলে ভারতে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (১১৯১ খ্রি.)
মুহম্মদ ঘোরি পাঞ্জাব দখল করলে ভারতের হিন্দু রাজাগণ শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ১১৮৯ খ্রি. ভাতিন্দা দখল করে মুহম্মদ
ঘোরি চৌহান রাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে দিল্লি ও আজমীরের
রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান একটি শক্তি-সংঘ গঠন করেন।
পৃথ্বীরাজের আহŸানে অনেক রাজা সাড়া দেন। তবে কনৌজের
রাজা জয়চাঁদের সাথে পৃথ্বীরাজের সুসম্পর্ক ছিল না। পৃথ্বীরাজ
জয়চাঁদের কন্যা সংযুক্তার স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রণ পাননি। তিনি
ছদ্মবেশে এসে সংযুক্তাকে হরণ করে নিয়ে বিয়ে করেন। মুহম্মদ
ঘোরী পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করেন। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে
তরাইন প্রান্তরে মিলিত পৃথ্বীরাজের বাহিনীর সাথে মুহম্মদ
ঘোরির প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুহম্মদ ঘোরির বাহিনী পরাজিত
হলে তিনি নিজে আহত হন ও পলায়ন করেন। এটি তরাইনের
প্রথম যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল।
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১১৯২ খ্রি.)
মুহম্মদ ঘোরি দমবার পাত্র ছিলেন না। তিনি প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ
হলেও পর বৎসর অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে ১,২০,০০০ সৈন্য
নিয়ে আবার ভারত আক্রমণ করেন। এবারও পৃথ্বীরাজের
বাহিনীর সাথে তরাইনের প্রান্তরে তাঁর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। দু’পক্ষেই
বহু সৈন্য নিহত হয়। এবার পৃথ্বীরাজের বাহিনী পরাজিত হলে
পৃথ্বীরাজ পলায়ন করেন। কিন্তু সরস্বতী নদীর তীরবর্তী সিরসুতী
নামক স্থানে তিনি ধরা পড়লে তাঁকে হত্যা করা হয়। আজমীর
পর্যন্ত মুসলমানদের দখলে আসে। উন্নত রণকৌশল এবং সৈন্য পরিচালনার দক্ষতায় ঘোরির সৈন্যবাহিনী রাজপুতদের
নির্মমভাবে পরাজিত করে। অত:পর বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দিন আইবককে বিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে মুহম্মদ
ঘোরি গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন। কুতুবউদ্দিন আইবক মুসলিম বিজয়কে আরও সম্প্রসারিত করে হান্সী, মীরাট, দিল্লি ও
কুইলী দখল করেন। জয়চাঁদের সাথে মোকাবেলার জন্য মুহম্মদ ঘোরি ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ভারতে আসেন।
কুতুবউদ্দিন তাঁর সাথে যোগ দেন। কনৌজ মুহম্মদ ঘোরির দখলে আসে। তিনি আরও অগ্রসর হয়ে বারাণসী অধিকার করে
গজনী ফিরে যান। তাঁর প্রতিনিধি কুতবউদ্দিন গোয়ালিয়র জয় করেন। এরপর কুতুবউদ্দিন ভীমকে পরাজিত করে ১১৯৮
খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের রাজধানী আনহিলওয়ার দখল করেন। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জরও কুতুবউদ্দিনের অধিকারে আসে।
মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০২ খ্রিস্টাব্দে বিহার জয় করেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ঝাড়খÐ এর মধ্য দিয়ে বখতিয়ার
খলজী সেন বংশের রাজা ল²ণ সেনকে পরাজিত করে নদীয়া ও বঙ্গ পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। ১২০৩
খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু হয়। তখন মুহম্মদ ঘোরি ঘোরের সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি
মুইজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম উপাধি গ্রহণ করেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে জনৈক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ফলাফল
মুহম্মদ ঘোরির ভারত অভিযান পূর্ববর্তী মুসলিম অভিযানগুলোর
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ফলাফলের তুলনায় বেশী ছিল। মুহম্মদ
বিন-কাসিমের বিজয় শুধু সিন্ধু ও মুলতানে সীমাবদ্ধ ছিল। সুলতান
মাহমুদ ১৭ বার ভারত অভিযান করলেও এর তাৎক্ষনিক কোন
রাজনৈতিক ফলাফল ছিল না। তাঁর অভিযানগুলো ভারতীয়
রাজন্যবর্গের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। পক্ষান্তরে মুহম্মদ
ঘোরির ভারত অভিযান এদেশে মুসলমান শাসন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত
করে। তিনি মুলতান, সিন্ধু ও পাঞ্জাব দখল করার পর ভারতের
অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তরাইনের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে তিনি আজমীর পর্যন্ত এলাকা জয় করেন। তরাইনের দ্বিতীয়
যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ভি.এ. স্মিথ বলেন, “এই যুদ্ধ হিন্দুস্থানের উপর মুসলিম আক্রমণের চরম
সাফল্যের নিশ্চয়তা দান করেছিল।” বিজিত এলাকা শাসন করার জন্য তিনি তাঁর সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেককে
প্রতিনিধি হিসেবে রেখে যান। কুতুবউদ্দিনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিম
শাসনাধীনে আনেন। বস্তুত কুতুবউদ্দিনের বিজয় ছিল তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘোরির বিজয়েরই যৌক্তিক পরিণতি।
কনৌজ ও বারাণসী জয় করে মুহম্মদ ঘোরি ভারতে মুসলিম বিজয়কে সুসংহত করেন। এরপর বখতিয়ার খলজির বিহার ও
বাংলা জয়ের মধ্য দিয়ে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও প্রতিষ্ঠিত
সাম্রাজ্য শাসনের জন্য প্রয়োজন পড়লো নতুন প্রশাসনের। মুহম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি হিসেবে কুতুবউদ্দিন ভারতীয়
প্রশাসনিক রীতির সাথে ইসলামি রীতির মিলন ঘটান। ফলে উদ্ভব ঘটে এক নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার। তিনি প্রশাসন
স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের হাতে ন্যস্ত করেন। বিচার কাজ সম্পন্ন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুসলমান কাজী ও ফৌজদার নিযুক্ত হন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ফলাফল
মুহম্মদ ঘোরির অভিযানের ফলে ভারতের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। নতুন অঞ্চল বিজিত
হওয়ায় মুসলমান শিক্ষাবিদ, ধর্মপ্রচারক ও শিল্পীগণ নতুন ও বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রের সন্ধান পান। অনেক ধর্মীয় নেতা ও সুফি
দরবেশ এদেশে আসেন এবং ধর্মপ্রচারে ব্রতী হন। বিজিত অঞ্চলে মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকাহ্ গড়ে উঠতে থাকে। মুসলিম
শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে নতুন সভ্যতার সূচনা করে। হিন্দু সমাজের বর্ণভেদ প্রথা মুসলিম শাসনে কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে।
ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতেও সাধিত হয় ব্যাপক পরিবর্তন। মুসলিম বিজেতাগণ প্রয়োজনের তাগিদে এবং ইসলামের গৌরব
প্রকাশের জন্য সুদৃশ্য ইমারত, মসজিদ ও মিনার নির্মাণ করেন। এ সকল স্থাপত্য নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত ও
শ্রমিক নিয়োজিত হয়। ফলে ভারতীয় ও মুসলিম স্থাপত্য কৌশলের সংযোজন ঘটে। এক নতুন ইন্দো-মুসলিম
স্থাপত্যরীতির উদ্ভব হয়। এভাবেই মুহম্মদ ঘোরির বিজয় অভিযান ভারতে এক নতুন যুগের সূচনা করে।
সারসংক্ষেপ:
ঘোর রাজ্যের সুলতান গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদ মুলতান, সিন্ধু ও পাঞ্জাব জয়ের জন্য যুদ্ধ করেন ভারতের হিন্দু
রাজশক্তিগুলোর সাথে। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে তিনি পৃথ্বীরাজের নিকট পরাজিত হলেও তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি
জয়লাভ করেন। পলায়নকালে পৃথ্বীরাজ নিহত হলে আজমীর তাঁর দখলে আসে। তিনি কুতুবউদ্দিনকে ভারতে তাঁর
প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। কুতুবউদ্দিন দিল্লিসহ ভারতের অনেক অঞ্চল জয় করেন। কনৌজের জয়চাঁদকে পরাজিত করে
মুহম্মদ ঘোরি কনৌজ ও বারাণসী দখল করেন। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে ভাইয়ের মৃত্যুর পর মুহম্মদ ঘোরি ঘোরের সুলতান
হন। এই অভিযানের ফলে এদেশে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে মুসলিম প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-১.৪।
১। তরাইনে দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘোরির নিকট পরাজিত হয়।
ক. মুহম্মদ বিন-কাসিম খ. সুলতান মাহমুদ গ. পৃথ্বীরাজের বাহিনী ঘ. কুতুবউদ্দীন আইবেক
২। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় −
ক. ১০৯২ খ্রি. খ. ১১৯০ খ্রি. গ. ১০৯০ খ্রি. ঘ. ১১৯২ খ্রি.
৩। মুইজ উদ্দিন মুহাম্মদ ঘোরি কত খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন?
ক. ১১০৪ খ্রি. খ. ১১০৬ খ্রি. গ. ১১০৫ খ্রি. ঘ. ১১০৭ খ্রি.
সৃজনশীল প্রশ্ন:
রায়হান বিশ্বাস মাগুরা জেলার একজন বিখ্যাত কুস্তিগির ছিলেন। প্রথম বছর কুস্তি খেলতে শ্রীপুর উপজেলা থেকে মাগুরা
জেলায় আসেন। এ বছর তিনি কুস্তি খেলার প্রথম ধাপেই বাদ পড়ে যান। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না। এরপরের
বছর তিনি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এলেন এবং জেলার সেরা কুস্তি খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেলেন।
ক. ঘোর রাজ্য কোথায় অবস্থিত ছিল? ১
খ. মুহম্মদ ঘোরি কোন কোন গুণের অধিকারী ছিলেন লিখুন। ২
গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত রায়হান বিশ্বাসের ন্যায় মুহম্মদ ঘোরির ভারত অভিযানে সফলতার ব্যাখ্যা দিন। ৩
ঘ পূর্ববর্তী মুসলিম অভিযান অপেক্ষা মুহম্মদ ঘোরির ভারত অভিযানের ফলাফল ব্যাপক ছিল-বর্ণনা করুন। ৪

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]